অভিজ্ঞতা
যেভাবে রোবট অলিম্পিয়াডে অংশ নিলাম
আন্তর্জাতিক রোবট অলিম্পিয়াডে অংশ নিয়ে পেয়েছেন রৌপ্য ও ব্রোঞ্জপদক। এই অভিযাত্রায় নানা বাধাবিপত্তি ও সেগুলো পেরোনোর গল্প...
২০১৯ সালে আমি যখন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী, তখন একদিন শুনলাম, আমাদের স্কুলে রোবটিকসের একটি ওয়ার্কশপ হবে। রোবটিকস আসলে কী? জানার আগ্রহ থেকে রোবটিকস ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণ করলাম। ওয়ার্কশপে আমরা লাইন ফলোয়ার রোবট তৈরি করা শিখলাম। রোবটটির কাজ ছিল সাদা মেঝের ওপর কোড অনুযায়ী কালো লাইন অনুসরণ করে চলা। শুরুর দিকে দ্বিধায় থাকতাম। আসলেই কি চলবে ঠিকঠাক? অনেক দ্বিধা নিয়ে আমরা যখন রোবট বানানো শেষ করে নির্দিষ্ট লাইন ফলো করার কোড আপলোড করলাম, দেখলাম, রোবটটি সত্যি সত্যিই সেই কোড অনুসরণ করে চলছে! একটা যন্ত্র আমরা যা বলছি, তা-ই মেনে চলছে, কী চমৎকার একটি ব্যাপার! সেই থেকে রোবটিকসের প্রতি ভালোবাসার শুরু।
এর পাঁচ দিনের মাথায় আমাদের স্কুল থেকে নয়জন ঢাকায় আসি দ্বিতীয় বাংলাদেশ রোবট অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ করতে। কিন্তু সেবার কোনো পদক অর্জন করতে পারিনি। মন খারাপ হলেও মেনে নিয়ে ফিরে গেলাম ভাঙ্গুড়ায়।
এর কিছুদিন পর অক্টোবর মাসে ‘ভাঙ্গুড়া শিক্ষা ও প্রযুক্তি উৎসব ২০১৯’ অনুষ্ঠিত হয়। এ আয়োজনে আমরা অবস্ট্যাকল অ্যাভয়েডার রোবট (প্রতিবন্ধকতা এড়িয়ে যেতে পারে, এমন রোবট) বানিয়ে প্রদর্শন করি। এ ছাড়া ‘কুদরাত-এ-খুদা সায়েন্স ক্যাম্প’ থেকে শেখা পোস্টার বানানোর নিয়ম কাজে লাগিয়ে বানিয়ে ফেলি একটি বৈজ্ঞানিক পোস্টার। এরপর আমাদের স্কুলের নয়জন ঢাকায় অ্যাডা লাভলেস সেলিব্রেশন ২০২০-এ প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা ও পোস্টার প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করি।
এরপর শুরু হলো মহামারি। স্কুল-কলেজ সব বন্ধ। রোবটিকস–চর্চার ব্যাপারটাও কেমন যেন থমকে গেল।
২০২১–এ হঠাৎ রোবট অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণের সুপ্ত ইচ্ছাটা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। এর পেছনে ছিল আমাদের স্কুলের তৎকালীন সভাপতি মাসুদ মোহাম্মদ জাহিদ হাসান স্যারের অনুপ্রেরণা। মাকে বলার সঙ্গে সঙ্গে রোবটিকসের প্রয়োজনীয় উপকরণগুলো কিনে দিলেন। আমাদের রোবট অলিম্পিয়াডের মেন্টর মাহেরুল আজম কোরেশীর সঙ্গে কথা বললেন তিনি। আরেকজন মেন্টর ফজলে এলাহী তন্ময়ের একটি রোবটিকস ওয়ার্কশপে মেইজ সলভার রোবট (গোলকধাঁধার হেঁয়ালি সমাধান করে বেরিয়ে যেতে পারে, এমন রোবট) বানানো শিখলাম। নতুন উদ্যমে অনলাইনে চতুর্থ বাংলাদেশ রোবট অলিম্পিয়াডে রোবট গ্যাদারিংয়ে (চ্যালেঞ্জ গ্রুপ) অংশগ্রহণ করে পেলাম অনারেবল মেনশন (সম্মানজনক স্বীকৃতি)। এরপর আন্তর্জাতিক রোবট অলিম্পিয়াড ২০২১-এ ‘মেকা রো’ টিমে জাইবা মাহজাবীন ও যাহরা মাহযারীনের সঙ্গে ক্রিয়েটিভ ক্যাটাগরিতে (চ্যালেঞ্জ গ্রুপ) অংশগ্রহণ করলাম। সেবার অর্জন করলাম টেকনিক্যাল অ্যাওয়ার্ড।
২০২২-এর শুরুতে আরেকটি রোবটিকস ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণ করি। যেখানে প্রথমবার ড্রোন ও জেআরসি বোর্ড নিয়ে কাজ করি। প্রোগ্রামিংয়ে ভালো করতে এক মাস ক্লাস করে প্রোগ্রামিং ও সমস্যার সমাধান সম্পর্কে মোটামুটি ভালো ধারণা পাই, যার ফলে বিডি গার্লস কোডিং কনটেস্টের চূড়ান্ত প্রতিযোগিতায় শীর্ষ ১০-এর তালিকায় জায়গা করে নিই। সুযোগ পাই ঢাকায় তিন দিনের আবাসিক প্রোগ্রামিং ক্যাম্পে অংশগ্রহণের। এ ক্যাম্পেই আমাদের দলের আরেক সদস্য নুসাইবা তাজরিন তানিশার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে যায়!
এরপর আমি স্কুল পেরিয়ে রাজশাহী কলেজে ভর্তি হই। বাসা থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা, নতুন পরিবেশ, নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচয়। ভেবেছিলাম, এবার হয়তো রোবট অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ করাই হবে না। কলেজে পড়াশোনা চলছিল যথারীতি। এর মধ্যে হঠাৎ মা আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময় যখন পার করছি, ভাবিইনি কলেজের শিক্ষকদের কাছে এত সহায়তা পাব। বিশেষ করে আমাদের রাজশাহী কলেজের শিক্ষক আলাউদ্দিন স্যার সব সময় অনুপ্রাণিত করেছেন। মা ও স্যারের কথা ভেবে সিদ্ধান্ত নিলাম অংশগ্রহণ করব। আমাদের কলেজের প্রিন্সিপাল আবদুল খালেক স্যার ও আলাউদ্দিন স্যারের সহযোগিতায় রোবটিকসের প্রয়োজনীয় উপকরণগুলো কিনে কলেজেরই পদার্থবিজ্ঞান গবেষণাগারে বসে প্রস্তুতি নিতে শুরু করলাম।
এরপর পঞ্চম বাংলাদেশ রোবট অলিম্পিয়াডের সময়সূচি প্রকাশিত হলো। দেখলাম, এক দিন মাত্র অংশগ্রহণ করতে পারব। অন্য দিন আমার ও আমার ভাই বি এম হামীম দুজনেরই পরীক্ষা। আগের দিন বিকেলে একটি পরীক্ষা দিয়ে রাতের ট্রেনে সাত ঘণ্টা জার্নি করে সকালে পৌঁছালাম ঢাকায়। সারা দিন পঞ্চম বাংলাদেশ রোবট অলিম্পিয়াডের রোবট ইন মুভি (চ্যালেঞ্জ গ্রুপ) প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করলাম দুজন। রাতে আবার রাজশাহী ফিরে পরদিন দুটো পরীক্ষা দিলাম একসঙ্গে। ওই দিনই আমরা প্রথম রোবট নিয়ে কোনো মুভি বানালাম। আর আশ্চর্যজনকভাবে ব্রোঞ্জপদকও পেয়ে গেলাম! তার ওপর থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক রোবট অলিম্পিয়াড ২০২২-এর বাংলাদেশ দলেও নির্বাচিত হয়ে গেলাম। তানিশা যুক্ত হলো আমাদের সঙ্গে। সিদ্ধান্ত হলো তানিশা, হামীম আর আমি ‘জিরোথ টিম’-এ একসঙ্গে কাজ করব। আমাদের প্রস্তুতি চলছিল। নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে জানতে পারলাম, আমাদের স্পনসর নিয়ে ঝামেলা হয়েছে। বুঝতে পারলাম, যাওয়া হবে না। তারপর প্রস্তুতি বন্ধ। ফিরে গেলাম রাজশাহীতে।
ডিসেম্বরে আমাদের মেন্টর মাহেরুল আজম জানালেন, অংশগ্রহণ করার সম্ভাবনা ও সুযোগ দেখা যাচ্ছে। তখন হাতে এক মাসের কম সময়, অথচ প্রস্তুতি পুরোপুরি বন্ধ। ২৫ ডিসেম্বর চলে গেলাম ঢাকায়। শুরু হলো আমার ও হামীমের আবাসিক প্রশিক্ষণ।
আমরা মূল কাজগুলো মেন্টরদের অফিসে করতাম। সকালবেলায় চলে যেতাম অফিসে। সারা দিন কাজ করে রাত ১০টা-১১টার দিকে ফিরতাম। রাতের খাবার খেয়ে আরও কিছু কাজ করে তারপর ঘুমাতাম। পরদিন সকালে আবার অফিসে। রোবটিকস ছাড়াও যেকোনো প্রয়োজনে মেন্টররা পাশে থেকেছেন। আমাদের মনোবল ঠিক রাখতে তাঁরা সময়–সময় অনুপ্রাণিত করেছেন, রোবট ইন মুভির জন্য ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির মিডিয়া ল্যাবে ভিডিও শুটিং ও এডিটিংয়ের ওপর প্রশিক্ষণের জন্য নিয়ে গেছেন আমাদের। ঢাকার মার্কেটগুলো ঘুরে ঘুরে তাঁরা মুভির প্রপস, ব্যাকগ্রাউন্ড কিনতে সাহায্য করেছেন। এ ছাড়া রোবট অলিম্পিয়াডের অনাবাসিক ক্যাম্পগুলোতে মেন্টর মিশাল ইসলাম আমাদের আন্তর্জাতিক রোবট অলিম্পিয়াডের ধারণা দিয়েছেন। আমাদের দলীয় কাজের জন্য তানিশার সঙ্গে বসেও কাজ করেছি—কখনো অফিসে, কখনো তাদের বাসায়; কখনো ম্যাসল্যাবে, আবার কখনো অনলাইনে। এভাবে প্রায় তিন সপ্তাহ পর এল আমাদের ফ্লাইটের সময়। দুরু দুরু বুকে যাত্রা শুরু করলাম আন্তর্জাতিক রোবট অলিম্পিয়াডের উদ্দেশ্যে।
থাইল্যান্ডের ফুকেটে যথাসম্ভব প্রস্তুতি নিয়ে অংশগ্রহণ করলাম। তারপর পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে আমরা ক্রিয়েটিভ ক্যাটাগরিতে (চ্যালেঞ্জ গ্রুপ) রৌপ্যপদক পেয়ে গেলাম। পাশাপাশি রোবট ইন মুভিতে (চ্যালেঞ্জ গ্রুপ) পেয়ে গেলাম ব্রোঞ্জপদক। দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণ হলো।
লেখক: শিক্ষার্থী, রাজশাহী কলেজ