বিজ্ঞানে বিশ্বজয়ের স্বপ্ন নিয়ে দিনাজপুর ফিজিক্স অলিম্পিয়াড অনুষ্ঠিত

অলিম্পিয়াড শেষে অতিথিদের সঙ্গে বিজয়ীরা
ডাচ্-বাংলা ব্যাংক-প্রথম আলো ফিজিক্স অলিম্পিয়াডের দিনাজপুর আঞ্চলিক পর্বে চার ক্যাটাগরিতে মোট ৮৯ জনকে পুরস্কৃত করা হয়।

ডাচ্-বাংলা ব্যাংক-প্রথম আলো ফিজিক্স অলিম্পিয়াডের দিনাজপুর আঞ্চলিক পর্বে চার ক্যাটাগরিতে মোট ৮৯ জনকে পুরস্কৃত করা হয়। এ ক্যাটাগরিতে ১০ জন, বি ক্যাটাগরিতে ২৭ জন, সি ক্যাটাগরিতে ৪১ জন এবং ডি ক্যাটাগরিতে পুরস্কার দেওয়া হয় ১১ জনকে। আনন্দ-উচ্ছ্বাসে পুরস্কার বিতরণী পর্বের মধ্য দিয়ে পর্দা নামে দিনাজপুর ফিজিক্স অলিম্পিয়াডের।

শিক্ষার্থীদের এ উচ্ছ্বাস ছিল সকাল থেকেই। পুরস্কার বিতরণীর আগ পর্যন্ত এ উৎসবে ছিল নানা আয়োজন।

সকাল ৮.৩০টায় দিনাজপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট প্রাঙ্গনে সার বেঁধে দাঁড়ায় শিক্ষার্থীরা। চারদিকে সবুজের সমারোহ। উপস্থাপক মুনিরা শাহনাজ চৌধুরী মাইক্রোফোনে বললেন, 'আমরা সবাই মিলে একসঙ্গে জাতীয় সঙ্গীত গাইব। তোমরা যারা মাইকে গাইতে চাও, চলে এসো সামনে।' ছুটে এল একদল শিক্ষার্থী। উচ্ছল।

সকাল ৯টায় দিনাজপুর বন্ধুসভার বন্ধুদের সঙ্গে সেই শিক্ষার্থীরা গেয়ে ওঠেন, 'আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।' সামনে দাঁড়ানো সবাই গলা মেলায়। দেশের প্রতি ভালোবাসা প্রত্যেকের বুকে। এভাবেই সূচনা হয় ডাচ্-বাংলা ব্যাংক-প্রথম আলো ফিজিক্স অলিম্পিয়াডের দিনাজপুর আঞ্চলিক পর্বের। এ সময় জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন দিনাজপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ ওয়াদুদ মন্ডল। বাংলাদেশ ফিজিক্স অলিম্পিয়াডের পতাকা উত্তোলন করেন দিনাজপুর সঙ্গীত কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মারুফা বেগম। আর ইভেন্টের পতাকা উত্তোলন করেন ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ব্যবস্থাপক অপূর্ব রায়।

সকালে লাইনে দাঁড়িয়ে সমাবেত কন্ঠে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার মধ্যে দিয়ে শুরু ফিজিক্স অলিম্পিয়াডের দিনাজপুর আঞ্চলিক পর্ব
বেলুন উড়িয়ে অলিম্পিয়াডের শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করেন অতিথিরা

উৎসবের উদ্বোধনী পর্বে তাঁদের পাশাপাশি অতিথি হিসেবে ছিলেন প্রথম আলোর দিনাজপুর প্রতিনিধি রাজিউল ইসলাম, রংপুর বিভাগের আঞ্চলিক কর্মকর্তা ইমরান আলী এবং বিজ্ঞানচিন্তার সহসম্পাদক উচ্ছ্বাস তৌসিফ।

উদ্বোধনী পর্বে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ব্যবস্থাপক অপূর্ব রায় শিক্ষার্থীদের শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, ফিজিক্স আমাদের জাতি হিসেবে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সহায়ক। তোমরা পদার্থবিজ্ঞান চর্চা করে ভবিষ্যতে বড় কিছু করবে আমাদের দেশের জন্য, এটাই আমাদের আশা। আজকে সবাই পুরস্কার পাবে না। তবে মনে রাখবে, এখানে উপস্থিত তোমরা প্রত্যেকেই বিজয়ী।'

দিনাজপুর সঙ্গীত কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মারুফা বেগম বলেন, 'পদার্থবিজ্ঞানের নানা প্রয়োগ আমরা প্রতিনিয়ত দেখছি। এটা আমাকে মুগ্ধ করে। তোমাদের মতো আমিও পদার্থবিজ্ঞান ভালোবাসি। একটা পরমতসহিষ্ণু জাতি গঠনে তোমরাই আমাদের ভবিষ্যৎ।'

অনলাইনে বাছাইপর্বে নির্বাচিত ৫৯৪ শিক্ষার্থীর মধ্যে এতে অংশ নেয় ৪৭৬ জন।

দিনাজপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ ওয়াদুদ মন্ডল বলেন, 'আমাদের প্রতিদিনের জীবনের প্রতি মুহূর্তে রয়েছে পদার্থবিজ্ঞান। আমরা এক পা এগোতে চাইলেও এর মধ্যে পদার্থবিজ্ঞানের প্রয়োগ দেখতে পাব৷ কত ডিগ্রি কোণে পা রাখলে দাঁড়াতে সুবিধা, বৃষ্টি হলে ছাতা কীভাবে ধরতে হয়, সব কিছুতেই আছে পদার্থবিজ্ঞান। পদার্থবিজ্ঞান ছাড়া এগোনো সম্ভব নয়। তোমরা পদার্থবিজ্ঞান শিখবে, আমাদের একটা সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।'

বক্তব্য শেষে অতিথিদের সঙ্গে শিক্ষার্থীরা মিলে বেলুন উড়িয়ে শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করা হয় দিনাজপুর আঞ্চলিক ফিজিক্স অলিম্পিয়াডের।

তারপর শুরু হয় পরীক্ষা। চলে সকাল ৯.৪৫টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত। অনলাইনে বাছাইপর্বে নির্বাচিত ৫৯৪ শিক্ষার্থীর মধ্যে এতে অংশ নেয় ৪৭৬ জন। এরপর দিনাজপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের জাহাঙ্গীর মিলনায়তনে শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। দিনাজপুর বন্ধুসভার বন্ধু জান্নাতুল মাওয়া জারা কবিতা আবৃত্তি করেন। তারপর বন্ধু সাদমান হক সিফাত গেয়ে ওঠেন, 'তীরহারা ওই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেব রে।' এরপর শুরু হয় প্রশ্নোত্তর পর্ব।

প্রশ্নোত্তর পর্বে কৌতুহলী দারুণ সব প্রশ্ন করে শিক্ষার্থীরা
ফিজিক্স অলিম্পিয়াডে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের একাংশ

'কম্পাসের কাঁটা শুধু উত্তর দিকেই ফিরে থাকে কেন?' 'রিখটার স্কেলে কীভাবে মাপে ভূমিকম্প?' 'জেমস ওয়েব কী দিয়ে তৈরি? কেন এটা এত দূর অতীতের ছবি দেখতে পায়?' কৌতুহলী এমন দারুণ সব প্রশ্ন করে শিক্ষার্থীরা। সহজ ভাষায় এসব প্রশ্নের জবাব দেন দিনাজপুর সরকারি কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক আব্দুস সালাম, একই কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক বিশ্বজিৎ দাস এবং দিনাজপুর স্কুল অব লিবারেটস-এর অধ্যক্ষ জিয়াউল হক সিজার।

প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষে জাদু দেখিয়ে শিক্ষার্থীদের মুগ্ধতার ঘেরে আটকে রাখেন জাদুকর রাজীব বসাক। এরপর নাচের তালে তালে মঞ্চ মাতান বন্ধুসভার বন্ধু দিয়া বসাক।

সবশেষে পুরস্কার বিতরণী পর্ব। এ সময় প্রশ্নোত্তর পর্বের অতিথিদের সঙ্গে যোগ দেন রংপুর সরকারি কলেজের শিক্ষক ধীরাজ সরকার, এনটিভির সাবেক সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট এস প্রমথেশ শীল, প্রথম আলোর দিনাজপুর জেলা প্রতিনিধি রাজিউল ইসলাম এবং বিজ্ঞানচিন্তার সহসম্পাদক উচ্ছ্বাস তৌসিফ। পুরো অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন দিনাজপুর বন্ধুসভার সভাপতি মুনিরা শাহনাজ চৌধুরী। সার্বিক সহযোগিতা করে বন্ধুসভার বন্ধুরা। একাডেমিক দলের নেতৃত্ব দেন ফিজিক্স অলিম্পিয়াডের একাডেমিক দলের সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী নিসার আলী তিতুমীর।

১৩তম ফিজিক্স অলিম্পিয়াড অনুষ্ঠিত হচ্ছে চারটি ক্যাটাগরিতে। ৫ম-৬ষ্ঠ শ্রেণি বা সমমানের শিক্ষার্থীরা এ ক্যাটাগরি, ৭ম-৮ম শ্রেণি বা সমমানের শিক্ষার্থীরা বি ক্যাটাগরি, ৯ম-১০ম শ্রেণি বা সমমানের শিক্ষার্থীরা সি ক্যাটাগরি এবং একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি বা সমমানের শিক্ষার্থীরা ডি ক্যাটাগরি।

অতিথিরা পুরস্কার তুলে দেন বিজয়ীদের হাতে

২০২৩ সালে জাপানের টোকিওতে অনুষ্ঠিত হবে ৫৩তম ফিজিক্স অলিম্পিয়াড। এ লক্ষ্যে প্রতিবারের মতো এবারও দেশব্যাপী ১৩তম ডাচ্-বাংলা ব্যাংক-প্রথম আলো ফিজিক্স অলিম্পিয়াড ২০২৩ আয়োজন করা হচ্ছে। বাছাইপর্বের নির্বাচিতদের নিয়ে আয়োজিত হচ্ছে আঞ্চলিক ফিজিক্স অলিম্পিয়াড। ইতিমধ্যেই অনুষ্ঠিত হয়েছে ফিজিক্স অলিম্পিয়াডের ঢাকা, যশোর ও বরিশাল আঞ্চলিক পর্ব। এ পর্ব অনুষ্ঠিত হচ্ছে অফলাইনে, বিভিন্ন আঞ্চলিক ভেন্যুতে। এরপর আঞ্চলিক পর্বের বিজয়ীদের নিয়ে আয়োজিত হবে জাতীয় উৎসব। পরে জাতীয় উৎসবের বিজয়ীদের নিয়ে ক্যাম্প আয়োজন করা হবে। ক্যাম্প শেষে বাছাইকৃতদের নিয়ে গঠিত হবে বাংলাদেশ ফিজিক্স অলিম্পিয়াড দল। ওই দলটিই জাপানের টোকিওতে অনুষ্ঠেয় ৫৩তম ফিজিক্স অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবে।

এ অলিম্পিয়াডের আয়োজন করছে বাংলাদেশ ফিজিক্স অলিম্পিয়াড কমিটি। আয়োজনের পৃষ্ঠপোষকতা করছে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক। ব্যবস্থাপনায় রয়েছে প্রথম আলো। এ ছাড়া ম্যাগাজিন পার্টনার হিসাবে থাকছে কিশোর আলো ও বিজ্ঞানবিষয়ক মাসিক ম্যাগাজিন বিজ্ঞানচিন্তা। টেকনিক্যাল পার্টনার হিসাবে আছে বিডিকম।

দেশের শিক্ষার্থীদের পদার্থবিজ্ঞানে দক্ষ করে তুলতে ২০১১ সাল থেকেই আয়োজিত হচ্ছে ফিজিক্স অলিম্পিয়াড। এবারেও একই উদ্দেশ্য নিয়ে শুরু হচ্ছে ফিজিক্স অলিম্পিয়াড ২০২৩।

ফিজিক্স অলিম্পিয়াড ও আঞ্চলিক পর্ব সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যাবে bdpho.org ওয়েবসাইটে।