৭ পেরিয়ে বিজ্ঞানচিন্তা
বিজ্ঞানচিন্তা আমাদের আশার আলো দেখায়
আজ ১৫ অক্টোবর, বিজ্ঞানচিন্তার জন্মদিন। ২০১৬ সালের ১৫ অক্টোবর যাত্রা শুরু করে বিজ্ঞানচিন্তা। সময়ের আবর্তে ৭ পেরিয়ে আজ আটে পা রাখল। এ উপলক্ষে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন বিজ্ঞানচিন্তার নিয়মিত লেখক ও বিজ্ঞানবক্তা আসিফ।
বিজ্ঞানচিন্তা—বিজ্ঞানবিষয়ক মাসিক ম্যাগাজিন। ৭ পেরিয়ে আটে পা রাখছে আজ। সে জন্য আমি আন্তরিক শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ জানাচ্ছি। কামনা করছি, তার পথচলা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হোক। আমি কৃতজ্ঞ, পত্রিকার সম্পাদক ও সম্পাদকমণ্ডলী শুধু বিজ্ঞানবিষয়ক নয়, আমার সাংস্কৃতিক সংঘাতবিষয়ক লেখাগুলোও গুরুত্ব সহকারে ছেপেছেন। সেগুলো শুধু বাংলাদেশই নয়, সারা পৃথিবীর বাস্তবতা নিয়ে লেখা—বিজ্ঞানের আত্মীকরণ ছাড়া প্রযুক্তি ব্যবহারে কী বিপদ হতে পারে, তা-ই ছিল এর উপজীব্য।
আমাদের বর্তমান সভ্যতা আসলে বিজ্ঞানভিত্তিক সভ্যতা। যে সভ্যতায় উদ্ভাবিত সব প্রযুক্তি এই বৈজ্ঞানিক নিয়ম-কানুনের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। যেখানে বিজ্ঞানের ওপেন ফোরাম নেই, সেই সমাজে বিজ্ঞানবিষয়ক নিয়মগুলোর চর্চা কেমন করে হবে, তার আত্মীকরণই-বা মানুষের মধ্যে কেমন করে ঘটবে? প্রাযুক্তিক সুবিধাগুলো যে বিজ্ঞানের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে, তা আমরা কীভাবে অনুধাবন করব? অনুধাবন না করলে, বিজ্ঞান সংস্কৃতিই-বা গড়ে উঠবে কীভাবে? বিজ্ঞানকে শুধু আন্তর্জাতিক পাতার বিষয় করে বা একটি কর্ণারের আইটেম করে এগুলো হয় না। মাসিক বিজ্ঞানচিন্তা এমন এক সময় প্রকাশিত হয়েছে, যখন সব দৈনিক পত্রিকা বিজ্ঞানায়োজন বন্ধ করে দিয়েছে। বিজ্ঞানবিষয়ক ম্যাগাজিন যাও ছিল, তাও বন্ধ হয়ে গেছে! অথচ বিজ্ঞানের পাতা বা ম্যাগাজিনই হতে পারে ভালো মাপের ওপেন ফোরাম।
বিজ্ঞানচিন্তার এ সময় প্রকাশ নিঃসন্দেহে আশার আলো হিসেবে এসেছে। পর্যাপ্ত না হলেও স্বীকার করতেই হবে, এই মাসিক সাময়িকীটি বাংলাদেশে বিজ্ঞান কমিউনিটি বা সমাজের সম্প্রসারণে যোগাযোগমাধ্যম হিসেবে কাজ করছে। বিজ্ঞানচিন্তার ওয়েব পোর্টাল একে আরও শক্তিশালী করে তুলেছে। এর সুবাদে শুধু বিশেষজ্ঞ-বিজ্ঞান লেখকই লিখছেন না, অসংখ্য কিশোর তরুণ তাঁদের প্রবন্ধ, নিবন্ধ, মতামত প্রকাশ করতে পারছেন। জানতে পারছেন, শুধু বাংলাদেশের নয়, বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞানের অগ্রগতি ও কর্মকাণ্ড। এ জন্য আমি আবারও শুভেচ্ছা জানাচ্ছি—বিজ্ঞান পত্রিকা হিসেবে বিজ্ঞানচিন্তা কিশোর-তরণদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছে।
বিজ্ঞানবিষয়ক জ্ঞান আত্মীকরণ ছাড়া আইটি বা তথ্য-প্রযুক্তি দিয়ে একটা সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া কতটা আত্মঘাতী, তা শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বব্যাপী শিশু-কিশোরদের প্রযুক্তি আসক্তি আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। কারণ, বিজ্ঞানই বলে গাছ কেন দরকার, বিজ্ঞানই তো বলে নদী কেন দরকার, বিজ্ঞানই বলে এক জায়গায় কত মানুষ থাকতে পারে, তার চেয়ে বেশি হলে মানুষের বসতি পোকামাকড়েরর মতো প্রাদুর্ভাব বলেই বিবেচিত হবে, পোকামাকরের মতো বিলীন হওয়ার আশংকা দেখা দেবে। এ ব্যাপারে পরিবেশ ও আবহাওয়াবিশেষজ্ঞরা বহু আগেই সর্তক করে দিয়েছেন।
আমি ফিরে যাই ৯০ দশকের শুরুর দিকে। আমি বিজ্ঞান বক্তৃতা দিতে শুরু করি, যে বক্তৃতাগুলো মানুষ শুনতে আসত দর্শনীর বিনিময়ে বা টিকিট কেটে। বক্তৃতা দিতে গিয়ে শুধু বিজ্ঞানবিষয়ক নয়, সমাজ-সংস্কৃতি নিয়েও লিখতে শুরু করি। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখার সুবাদে কয়েকটি দৈনিকের সাপ্তাহিক বিজ্ঞান আয়োজনের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে। স্বাভাবিকভাবে পাতাসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কর্মাকাণ্ডের সঙ্গেও একধরনের বিনিময় হয়। আমারও অভিজ্ঞতার পরিসর বাড়তে থাকে। আমি সবসময় পাতাসংশ্লিষ্ট মানুষগুলোর সহযোগিতা পেয়ে এসেছি। সম্ভবত একই কমিউনিটির মানুষ হওয়ায় এই সুবিধা এসেছিল। একরকম সহযোগিতার সংস্কৃতি নির্মাণের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম। অতএব এটা বেগবান হবে এই ধরনের প্রকাশনা আরও বৃদ্ধি পেলে।
২০০৩-এর দিকে আমিও বিজ্ঞান পাতা সম্পাদনার সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ি। ২০০৫ সাল পর্যন্ত যে দৈনিক পত্রিকাই নতুন প্রকাশিত হোক না কেন, একটা সায়েন্স বা বিজ্ঞান পাতা রাখত। পাতা ঘিরে ছোট ছোট দল কাজ করত। তাদের মধ্যে কাজের সুবাদে শুধু বিজ্ঞান বলব না, বিজ্ঞান-দর্শন ও বিজ্ঞান-সংস্কৃতির চর্চাও গড়ে উঠত। আমাদের লক্ষ্য ছিল, প্রতিটা জেলা-উপজেলা শহরের বিজ্ঞান ক্লাবগুলোকে ঘিরে একটা যোগাযোগের জাল তৈরি করা। এভাবে আমরা পরস্পরকে সমৃদ্ধ করতে পারতে পারি। ২০০৬ সালের প্রথম দিকে একটি বিজ্ঞান ম্যাগাজিনের সম্পাদনার দায়িত্ব আমার হাতে আসে। ইন্টারনেটের যুগ তখনও সেভাবে শুরু হয়নি। আমার টিম বা আমরা শুধু অবাক না, আপ্লুত হয়ে যেতাম পাঠকদের মতামত ও চিঠির স্রোতে। আমরা অনুভব করেছিলাম, একটা দৈনিকের বিজ্ঞান পাতার চেয়ে মোটামুটি পরিচিত একটা বিজ্ঞান ম্যাগাজিন কিশোর-তরুণদের মাঝে সাড়া ফেলতে পারে কত জোরালোভাবে! উল্লেখ্য, দেশের সেরা দৈনিকগুলোতে এখনও যারা বিজ্ঞান-পরিবেশবিষয়ক রচনা লেখেন, তাঁদের অনেকের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় কেটেছে এই পত্রিকাটিকে ঘিরে।
যাহোক, আগের প্রসঙ্গে ফিরি। হঠাৎ করেই লক্ষ করলাম, বিজ্ঞান পাতাগুলো সংবাদ, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, ক্লাব-কার্যক্রমের চেয়ে নিজেদের ইভেন্টের প্রতি বেশি মনযোগী হয়ে পড়ল। অন্য বেশিরভাগ বিষয়ের প্রতি মনযোগ হারাল। শেষ নাগাদ দৈনিক পত্রিকার সাপ্তাহিক আয়োজনগুলো বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু তাদের ইভেন্টগুলো রয়ে গেল। বিষয়টি খুব অদ্ভুত ও হাস্যকর। সব পাতা বন্ধ হওয়ার পরও আমি আরও ১০ বছর বিজ্ঞান পাতা সম্পাদনা করেছি। এরকম একসময় বিজ্ঞানচিন্তার জন্ম।
এর মধ্যে অনেক বিজ্ঞান সাময়িকী হয়তো বের হচ্ছে মাঝেমধ্যে, কিন্তু বিজ্ঞানচিন্তার বিশেষত্ব হলো, দীর্ঘ ৭ বছর একটানা কোনো বিরতি না দিয়ে প্রকাশ করে যাওয়া এক দারুণ দৃষ্টান্ত বটে। এ ধরনের কার্যক্রম অন্যদেরও বিজ্ঞানবিষয়ক বিভিন্ন ধরনের প্রকাশনায় উত্সাহ যোগাচ্ছে।
তার জন্য বিজ্ঞানচিন্তা ম্যাগাজিনটি নিয়মিত প্রকাশের জন্য প্রথম আলোকে কৃতজ্ঞতা জানাই। শুভেচ্ছা জানাই সম্পাদকসহ নিরলস কর্মী বাহিনীর প্রতি। শুভকামনা রইল নিরন্তর।
লেখক: বিজ্ঞান বক্তা; সম্পাদক, মহাবৃত্ত