বাংলাদেশ বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ সমিতির ২২ বছর

বাংলাদেশ বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ সমিতির ২২ বছর পূর্ণ হলো। বাংলাদেশে জুনিয়র সায়েন্স অলিম্পিয়াড আয়োজন, আন্তর্জাতিক জুনিয়র সায়েন্স অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশ দল নির্বাচন ও প্রেরণ, শিশু-কিশোর বিজ্ঞান কংগ্রেসসহ উল্লেখযোগ্য সব কাজের নেপথ্যে রয়েছে এই সংগঠন। ২৩ তম জন্মদিনে এর শুরুর কালের স্মৃতিচারণ করেছেন সংগঠনটির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মুনির হাসান।

বাংলাদেশ জুনিয়র সায়েন্স অলিম্পিয়াড ২০২৩-এর জাতীয় পর্বে চলছে প্রশ্নোত্তর সেশন

ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটনের যখন জন্ম হয়, তখন ছিল জুলিয়ান ক্যালেন্ডার। সেই ক্যালেন্ডার অনুসারে তাঁর জন্মদিন ছিল ২৫ ডিসেম্বর। পরে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে এটা ৪ জানুয়ারি হয়ে যায়। এই দিনই বাংলাদেশ বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ সমিতির (বাবিজস) জন্মদিন।

২০০১ সালের ২৫ ডিসেম্বর আমরা বাংলাদেশ বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ সমিতি প্রতিষ্ঠা করি। উদ্দেশ্য, দেশে বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করা। কারণ তখন দেশে বিজ্ঞান শিক্ষার প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ মারাত্মকভাবে কমে যায়। ১৯৮৮ সালে এসএসসিতে বিজ্ঞান শিক্ষার্থী ছিল ৪৮%, ১৯৯৮-তে সেটা হয়ে যায় ২১%!

আমাদের অবশ্য একটি সংগঠনেরও দরকার ছিল। বিশেষ করে যখন ঠিক করলাম, ঢাকার বাইরে আমরা বিজ্ঞান ও গণিত নিয়ে কাজ করব। (তখনও গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির জন্ম হয়নি।) নামকরণের সময় আমরা অখণ্ড ভারতের ‘সোসাইটি ফর দ্য কালটিভেশন অব সায়েন্স’কে অনুসরণ করি। কেবল ‘কালটিভেশন’-এর জায়গায় ‘পপুলারাইজেশন’ ব্যবহার করা হয়। ইংরেজিতে নাম দেওয়া হয়—সোসাইটি ফর দ্য পপুলারাইজেশন অব সায়েন্স, বাংলাদেশ (Society for the popularization of Science, Bangladesh—SPSB)। নামটার বাংলা করা হয়, বাংলাদেশ বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ সমিতি (বাবিজস)। যথারীতি, জাফর স্যার (মুহম্মদ জাফর ইকবাল) সভাপতি, আর আমি সাধারণ সম্পাদক। সে সময় আমাদের উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে ছিল সারা দেশে মঙ্গলগ্রহ দেখানো, একটি ভ্রাম্যমাণ জাদুঘর নিয়ে নানা জায়গায় যাওয়া ইত্যাদি।

২০০৩ সালে গণিত অলিম্পিয়াড শুরু হয় পূর্ণোদ্যমে। আমরা বুঝতে পারি, একই লোকদের পক্ষে একাধিক কর্মকাণ্ড চালানো সম্ভব নয়। কাজেই আমরা এসপিএসবির কার্যক্রম মুলতবি রাখি। তবে কিছু কাজ তো করতেই হবে। এই দায়িত্ব নেয় আরাফাত সিদ্দিকী সোহাগ। মানে, কেবল চালু রাখা। বছরে একটি কর্মশালা, জহুরুল হক-আবদুল্লাহ আল-মুতী স্মারক বক্তৃতা চালিয়ে যাওয়া ইত্যাদি। এর মধ্যে ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী পিএইচডি সম্পন্ন করে দেশে ফেরে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) শিক্ষকতা করতে শুরু করে সে। দেশে একটু থিতু হওয়ার পর ওর কাঁধে বাবিজসের (সাধারণ সম্পাদকের) দায়িত্ব দেওয়া হয়। তখন থেকে শুরু হয় আবদুল জব্বার জ্যোতির্বিজ্ঞান কর্মশালা। এই কর্মশালায় আগ্রহীদের জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রাথমিক বিষয়গুলো নিয়ে একটা ধারণা দেওয়া হয়। প্রয়োজনীয় বইপত্রের সঙ্গে পরিচয়, আরও পড়াশোনা ও নবিশ জ্যোতির্বিদ হিসেবে এগোনোর পথটা দেখিয়ে দেওয়া।

এ সময় মঞ্চে এলেন সাজ্জাদুর রহমান চৌধুরী, বাংলাদেশ ফ্রিডম ফাউন্ডেশনের (বিএফএফ) নির্বাহী পরিচালক। বললেন, ‘খালি ম্যাথ করলে হবে? চলেন, বিজ্ঞান নিয়েও কিছু কাজ করি।’

কাজেই ২০১১ সাল থেকে আমরা আবার বিজ্ঞানের কাজকর্মে ফিরে গেলাম। শুরুতে বিজ্ঞান শিক্ষকদের জন্য একটা আবাসিক ক্যাম্প করা হলো—সত্যেন বসু ক্যাম্প। সেই ক্যাম্পে বসে পরিকল্পনা করা হলো শিশু-কিশোর বিজ্ঞান কংগ্রেসের (Children Science Congress)। চিন্তা-ভাবনাটা সরল—শিশু-কিশোররা হাতে-কলমে গবেষণা করবে, প্রকল্প বানাবে, পোস্টার তৈরি করবে। পুরো কাজটা করবে বৈজ্ঞানি পদ্ধতিতে, এবং সেটাই তারা সবার সামনে উপস্থাপন করবে। একদম সত্যিকার কনফারেন্সের মতো। আসলে সত্যিকার কনফারেন্স-ই, খুদে বিজ্ঞানীদের কনফারেন্স।

বিশ্ব মহাকাশ সপ্তাহ ২০১৮ উদ্‌যাপন করছে এসপিএসবি, কথা বলছেন অধ্যাপক ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী (বাঁয়ে), সঙ্গে রয়েছেন অধ্যাপক আরশাদ মোমেন

কংগ্রেসের দাওয়াত দিতে গেলাম আজম খানকে। তখন তিনি ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামিক ব্যাংকে ছিলেন। বললেন, আমরাও থাকতে চাই আপনাদের সঙ্গে। এভাবে মাঠে গড়াল শিশু-কিশোর বিজ্ঞান কংগ্রেস ও জগদীশচন্দ্র বসু ক্যাম্প।

এরপর একদিন বায়োজিদ ভূঁইয়া জানাল, আন্তর্জাতিক জুনিয়র সায়েন্স অলিম্পিয়াড (আইজেএসও) হয়। আমাদের কিশোর শিক্ষার্থীদের ওখানে পাঠানো যায় কি না। সেই সূত্রে ২০১৩ সালে ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী ও ফারহানা মান্নান পর্যবেক্ষক হিসেবে ভারতের পুনেতে গেলেন বাংলাদেশের সদস্যপদ নিতে। সেবার শিক্ষার্থী পাঠানো যায়নি। তবে বাংলাদেশ সে বছর সদস্যপদ লাভ করে। সদস্যপদ হলো বটে, তবে ২০১৪ সালে বাংলাদেশে জুনিয়র সায়েন্স অলিম্পিয়াড আয়োজনের সামর্থ্য আমাদের ছিল না।

২০১৫ সালের কথা। একদিন দেখা করতে গেলাম তৎকালীন আল-আরাফাহ্‌ ইসলামী ব্যাংকের এএমডি তৌহিদুল আলমের সঙ্গে। কথা প্রসঙ্গে জানতে পারলেন, কেউ পৃষ্ঠপোষকতা করলে আমরা এই অলিম্পিয়াডটাও করতে পারব। তিনি আমাদের পাশে দাঁড়ালেন। সেই থেকে আল-আরাফাহ্‌ ইসলামী ব্যাংকের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশ জুনিয়র সায়েন্স অলিম্পিয়াড আয়োজিত হচ্ছে।

২০১৫ সাল থেকে আমাদের কিশোররা স্কুল পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মেধার এই বিশ্ব লড়াই-এ অংশ নিচ্ছে। প্রথমবার অংশ নিয়েই দলের সদস্য ফারহান রওনক ব্রোঞ্জপদক অর্জন করেন। বর্তমানে তিনি স্ট্যানফোর্ডে পিএইচডি করছেন। এরপর ধারাবাহিকভাবে প্রতিবারই ব্রোঞ্জপদক, রৌপ্যপদক অর্জন করেছে আমাদের শিক্ষার্থীরা।

যাহোক, প্রথমবার দল ফেরার পর বোঝা গেল, স্কুলের ব্যবহারিক ক্লাস আইজেএসওতে ভালো করার জন্য যথেষ্ট না। কাজেই আমরা তৈরি করলাম মাকসুদুল আলম বিজ্ঞানাগার (ম্যাসল্যাব)। নানা জনের সহযোগিতায় ল্যাবে কিছু যন্ত্রপাতি ও প্রয়োজনীয় উপকরণ যোগাড় করে ফারসীম মান্নানের বাসার নিচতলায় এই ল্যাব শুরু হলো। পরে এটি স্থানান্তরিত হয়েছে ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডে। এই বছরে এটি আমাদের ইনস্টিটিউট ফ্লোরের এক কোণায় জায়গা নিয়েছে। আইজেএসওর প্রশিক্ষণের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে বিজ্ঞান শেখানোর বিভিন্ন কর্মশালা ও অনলাইন ওয়ার্কশপ আয়োজিত হচ্ছে নিয়মিতই। শুরুর সেই সময় ল্যাবের জন্য ডেল কম্পিউটার্সের পক্ষ থেকে ১০টি ল্যাপটপ দেন আতিকুর রহমান। পরে আবারও দিয়েছেন। এভাবেই আমাদের দুই দশক দুই বছর হয়ে গেল।

আজ ২২ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে স্মরণ করছি আমাদের সব কর্মী, শুভানুধ্যায়ী, নিন্দুক ও সমালোচকদের। সেই সঙ্গে আমাদের নানা কার্যক্রমের অংশগ্রহণকারী ও তাঁদের অভিভাবকদের। অনেক গোপনদাতা আমাদের এসপিএসবিকে সচল রেখেছেন। তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা। আমাদের স্পন্সর আল-আরাফাহ্‌ ইসলামী ব্যাংক, বাংলাদেশ ফ্রিডম ফাউন্ডেশনসহ সবাইকে ধন্যবাদ।

বিশেষ ধন্যবাদ এসপিএসবির স্বেচ্ছাসেবকদের, যাঁরা খেয়ে-না খেয়ে, নন-এসি বাসে করে সারা দেশে বিজ্ঞানের বার্তা বয়ে নিয়ে যায়। এদের অনেকে এখন বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে। সেখান থেকে খোঁজ রাখে, দেশে আসলে ঢুঁ দিয়ে যায়।

২ / ৫
বিজ্ঞান কংগ্রেসে এক শিক্ষার্থী

স্মরণ করছি আমাদের প্রয়াত অভিভাবক জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যারকে। বিজ্ঞান কংগ্রেসে এসে প্রতিবার কিছু নতুন তথ্য বা চ্যালেঞ্জ দিয়ে যেতেন, যা ধরে আমরা এগোতে পারতাম। স্মরণ করি এ আর খান স্যার, প্রথম জিরো গ্র্যাভিটির বাঙালি এফ আর সরকার স্যার, আমাদের স্যারদের স্যার—এ এম হারুন অর রশিদ, যাঁদের ভালবাসায় আমরা ধন্য হয়েছি।

ধন্যবাদ দিতে চাই ড্যাফোডিল পরিবারের স্থপতি সবুর খানকে। তাঁর সহযোগিতা না পেলে আমাদের নানা পরিকল্পনা কল্পনাই থেকে যেত। জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরের মহাপরিচালক মুনীর চৌধুরী স্যারের প্রতিও বিশেষ কৃতজ্ঞতা। তাঁর স্নেহ ও ভালবাসায় এসপিএসবি বেড়ে উঠছে ক্রমাগত।

সবাইকে  বাংলাদেশ বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ সমিতির ২২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর শুভেচ্ছা।

বিজ্ঞানের জয় হোক!

লেখক: জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি, বাংলাদেশ বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ সমিতি