চলছে গণিত উৎসবের জাতীয় পর্ব

বেলুন উড়িয়ে জাতীয় গণিত উৎসবের উদ্বোধনদীপু মালাকার

চারদিকে উৎসবের আমেজ। সারা দেশ থেকে খুদে গণিতবিদেরা জড়ো হয়েছে রাজধানীর সেন্ট যোসেফ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল প্রাঙ্গণে। পর্দা উঠছে ‘ডাচ্-বাংলা ব্যাংক-প্রথম আলো গণিত উৎসব ২০২৩’-এর জাতীয় পর্বের। দুই দিনের এ উৎসবে অংশ নিচ্ছে আঞ্চলিক পর্বে বিজয়ী ১ হাজার ২৪৫ শিক্ষার্থী।

সকাল ৯টার মধ্যে শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ অঞ্চলের বুথে নাম নিবন্ধন করে। সংগ্রহ করে উৎসবের পরিচয়পত্র ও লাল-সবুজ ব্যান্ডানা। ১০ ফেব্রুয়ারি, শুক্রবার সকাল ৯টায় একযোগে জাতীয় সংগীত গেয়ে ওঠে সেন্ট যোসেফ হায়ার সেকেন্ডারি ও সেন্ট যোসেফ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের শিক্ষার্থীরা। উত্তোলিত হয় জাতীয় পতাকা। এর মাধ্যমে সূচনা হয় জাতীয় গণিত উৎসবের।

সারবেঁধে দাঁড়িয়ে শিক্ষার্থীরা
দীপু মালাকার

জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন সেন্ট যোসেফ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের অধ্যক্ষ ব্রাদার লিও প্যারেরা। বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডের পতাকা উত্তোলন করেন বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ। আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির পতাকা উত্তোলন করেন ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কাশেম মো. শিরিন। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের সাবেক অধ্যাপক অমল কৃষ্ণ হালদার, সিলেটের নর্থ ইস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের উপাচার্য ইলিয়াস উদ্দীন বিশ্বাস, প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান, ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আনিসুল হক, বুয়েটের অধ্যাপক আবদুল হাকিম খান, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ আলমগীর হোসেন, মনোরোগ চিকিৎসক অধ্যাপক মোহিত কামাল ও বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সাধারণ সম্পাদক মুনির হাসান। এরপর বেলুন উড়িয়ে উৎসবের শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করেন সেন্ট যোসেফ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের অধ্যক্ষ ব্রাদার লিও প্যারেরা।

সেন্ট যোসেফ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের অধ্যক্ষ ব্রাদার লিও প্যারেরা কথা বলছেন শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে
দীপু মালাকার

শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছরের মতো গণিত উৎসবের এবারের আয়োজনে অংশ নিতে পেরে আমরা আনন্দিত।’

অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ শিক্ষার্থীদের শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, ‘এই অলিম্পিয়াডের মধ্য দিয়ে দেশে গণিতের সংস্কৃতি শুরু হয়। এই গণিত উৎসবের ফলে সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশের একটা দারুণ ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে। আমরা একটি থিঙ্কিং ন্যাশন (চিন্তাশীল জাতি) তৈরি করতে চাই৷ এর জন্য গণিত আবশ্যক।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের সাবেক অধ্যাপক অমল কৃষ্ণ হালদার বলেন, ‘তোমাদের মাঝেই আমাদের আগামীর উন্নত, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। আগামী বিশ্ব হবে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের। সেখানে জয়ী হতে গেলে গণিত হবে শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার। তোমরা সেই হাতিয়ার ধরে এগিয়ে নেবে দেশকে।’

সিলেটের নর্থ ইস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের উপাচার্য ইলিয়াস উদ্দীন বিশ্বাস বলেন, ‘ফেব্রুয়ারিতে রাষ্ট্রভাষা পেয়েছি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পেয়েছি। এই মাসে এই অনুষ্ঠানে প্রত্যাশা দেশের আশা-আকাঙ্ক্ষা তোমাদের দিয়ে পূরণ হবে।’

প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আনিসুল হক বলেন, ‘গণিতে ভালো না হলে বড় হওয়া যাবে না। পাশাপাশি, অনেক পড়তে হবে তোমাদের। অনেক না পড়লে বিজ্ঞানী হওয়া যায় না। পাঠ্যবই পড়তে হবে, পত্রিকা-ম্যাগাজিন পড়তে হবে। খেলতে হবে, কল্পনা করতে হবে। তোমাদের হাত ধরে আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশ আরও স্বর্ণ জিতবে।’

ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কাশেম মো. শিরিন বলেন, ‘তোমাদের দিকে সারা বিশ্ব তাকিয়ে। গণিত না শিখলে এগিয়ে যাওয়া যাবে না। তোমরাই একদিন গণিতবিদ, প্রকৌশলী ও বিজ্ঞানী হবে। বিশ্বের নামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা।’

অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখছেন
দীপু মালাকার
শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য দিচ্ছেন প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান
দীপু মালাকার
শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য দিচ্ছেন প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আনিসুল হক
দীপু মালাকার

প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, ‘গণিত উৎসবে দেশের নানা প্রান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা আসে। তাদের হাসিমুখ, সরব উপস্থিতি মন ভালো করে দেয়। প্রথম আলো ২৫ বছরে পা রাখছে। বাংলাদেশের যা কিছু ভালো, তার সঙ্গে থাকতে চায় প্রথম আলো। আমাদের একটাই লক্ষ্য, সব বিষয়ে বাংলাদেশের জয় দেখতে চাই।’

উদ্বোধনী পর্ব শেষে সকাল ৯টা ৫৫ মিনিটে শুরু হয় পরীক্ষা পর্ব। প্রাইমারি দুই ঘণ্টা, জুনিয়র তিন ঘণ্টা, সেকেন্ডারি ও হায়ার সেকেন্ডারি ক্যাটাগরির পরীক্ষা চলে সাড়ে তিন ঘণ্টা।

পরীক্ষা শেষে শিক্ষার্থীদের জন্য ছিল নানা আয়োজন। এ সময় সবাই আবারও জড়ো হয় মাঠে। দুপুরের বিরতির পর মঞ্চে যক্ষ্মা সচেতনতা নিয়ে গম্ভীরা গান পরিবেশন করেন জলপুতুলের শিল্পীরা৷ জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির অধীনে আইসিডিডিআরবি পরিচালিত ইউএসএআইডিস অ্যালায়েন্স ফর কমব্যাটিং টিবি ইন বাংলাদেশ কার্যক্রম এ আয়োজন করে। উৎসবে প্রাথমিক চিকিৎসাসহায়তা দিয়েছে ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল লিমিটেড।

এরপর শুরু হয় রুবিকস কিউব প্রতিযোগিতার বাছাইপর্ব। আজ শনিবার এ প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্ব অনুষ্ঠিত হবে। এরপর মুখ দিয়ে নানা বাদ্যযন্ত্রের শব্দ করে বিটবক্সিং করে শোনান ‘বিটমসফিয়ার’-এর সদস্যরা।

সারবেঁধে দাঁড়ানো শিক্ষার্থীদের একাংশ
দীপু মালাকার

বিশেষ আকর্ষণ হিসেবে এরপর অনুষ্ঠিত হয় দাবা পর্ব। বাংলাদেশের তিন আন্তর্জাতিক দাবাড়ু এ দাবা পর্বে অংশ নেন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। তাঁরা হলেন, গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমান ও এনামুল হোসেন রাজীব এবং ফিদে মাস্টার তাহসিন তাজওয়ার। ‘সিমুলট্যানিয়াস চেজ’ নামের এই প্রতিযোগিতায় একই সময়ে মোট ৪৫ শিক্ষার্থীর সঙ্গে খেলেন এই তিন দাবাড়ু। এ আয়োজনে সহযোগিতা করে বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশন।

নানা আয়োজনের ফাঁকে অভিভাবকদের জন্যও ছিল কিছুটা সময়। মঞ্চে এসে তাঁরা গণিত উৎসব নিয়ে নিজেদের অনুভূতি জানান। সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক আলম শিকদার বলেন, ‘ছেলের গণিতের প্রতি আগ্রহ তৈরি করেছে এ উৎসব, দূর করেছে গণিতের ভয়।’

এ পর্বে মনোরোগ চিকিৎসক অধ্যাপক মোহিত কামাল বলেন, ‘ছেলেমেয়েরা পুরস্কার না পেলে অভিভাবকদের মন খারাপ হয়। কিন্তু ছেলেমেয়েদের মন বেশি খারাপ হয়। বাবা-মা বকা দিলে তা আরও বেড়ে যায়। তাই পুরস্কার না পেলেও সন্তানদের বাহবা দিতে হবে, উৎসাহিত করতে হবে।’

এ অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন গণিত অলিম্পিয়াডের একাডেমিক কাউন্সিলর জাহিদ হোসাইন খান ও স্বেচ্ছাসেবক ফাতেমা ফারজানা। আজ শনিবার উৎসবের সমাপনী দিনের অনুষ্ঠান শুরু হয় সকাল সাড়ে আটটায় সুডোকু প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে। গণিতের পট, সেরা গণিত ক্লাবের সম্মাননাসহ সমাপনী ও পুরস্কার বিতরণের মাধ্যমে শেষ হবে এ বছরের গণিত উৎসব।

এবার উৎসবের মধ্য দিয়ে চলতি বছরের জুলাই মাসে জাপানের চিবা শহরে অনুষ্ঠেয় ৬৪তম আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে অংশ নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ দল নির্বাচন করা হচ্ছে। এবারের গণিত উৎসবে সারা দেশ থেকে অনলাইনে প্রায় ৪৫ হাজার শিক্ষার্থী নিবন্ধন করে। নিবন্ধিত শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্রথমে ‘অনলাইন বাছাই অলিম্পিয়াড’ অনুষ্ঠিত হয়। বাছাইপর্বের বিজয়ীদের নিয়ে ২০টি শহরে অনুষ্ঠিত হয় আঞ্চলিক গণিত উৎসব। এ পর্বের বিজয়ীরা অংশ নিচ্ছে এই জাতীয় গণিত অলিম্পিয়াডে। এ পর্বের বিজয়ীরা জাতীয় গণিত ক্যাম্পে অংশ নেওয়ার সুযোগ পাবে। ক্যাম্প শেষে বাছাইকৃতদের নিয়ে গঠিত হবে বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড দল। এই দলটিই ২০২৩ সালে জাপানের চিবায় অনুষ্ঠেয় ৬৪তম আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে (আইএমও) বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবে।

গণিত অলিম্পিয়াডের পৃষ্ঠপোষকতা করছে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক। এ ছাড়া প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনায় গণিত উৎসব আয়োজন করছে বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি। এবার ছিল এ উৎসবের ২১তম আয়োজন।

গণিত উৎসবের সব খবর পাওয়া যাবে গণিত অলিম্পিয়াডের ওয়েবসাইট—matholympiad.org.bd এবং অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ— facebook.com/BdMOC-এ।