পাঁচবার ফলন দেওয়া ধান পঞ্চব্রীহি সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে চান আবেদ চৌধুরী

পঞ্চব্রীহি ধান নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত হলো সেমিনার। ২৪ এপ্রিল, বুধবার সকাল ১১.৩০টায় সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড রিসার্চ ইন সায়েন্সেসের কনফারেন্স রুমে (২য় তলা) এ সেমিনার আয়োজিত হয়।

এ সময় উপস্থিত ছিলেন পঞ্চব্রীহি ধানের উদ্ভাবক জিনবিজ্ঞানী ও ধান গবেষক আবেদ চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর সীতেশ চন্দ্র বাছার, কুলাউড়া উপজেলার মৌলভীবাজার-২ আসনের সংসদ সদস্য শফিউল আলম চৌধুরী এবং  সাবেক শিক্ষা সচিব মো. নজরুল ইসলাম খান।

শুরুতেই পঞ্চব্রীহি ধান নিয়ে কথা বলেন আবেদ চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘আমরা কৃষির ওপর খুব নির্ভরশীল। তবে ধান চাষ করে উন্নত জীবনযাপন করা কঠিন। এটা আমার জন্য খুব পীড়াদায়ক ছিল। কারণ কৃষিনির্ভর পরিবারের মানুষ দেশে খুব অবহেলিত। কৃষকেরা ধানের মূল্য পাচ্ছে না। তাই আমি চেষ্টা করলাম, কৃষিতে কীভাবে ব্যয় কমিয়ে আয় বাড়ানো যায়। এ জন্য এমন ধান উৎপাদনের চেষ্টা করি, যা একবার রোপণ করে একাধিকবার ফসল পাওয়া যাবে। এতে কৃষকের উৎপাদন খরচ কমবে, বাড়বে আয়। আমি এই জিনিসটাই করতে চেয়েছি। অত্যন্ত আনন্দের বিষয়, সেটা করতে পেরেছি।’

পঞ্চব্রীহি ধানের উদ্ভাবক আবেদ চৌধুরী

পঞ্চবীহি ধান আবিষ্কারের পেছনের কাহিনি শোনান তিনি এ সময়। ‘যে জাতগুলোর ধান পাকার পর কেটে নিয়ে গেলে আবার ধানের শীষ বের হয়, সেগুলো আলাদা করলাম প্রথমে। এভাবে ১২টি জাত বের করতে সক্ষম হই। তিন বছর ধরে জাতগুলো চাষ করে দেখলাম, এগুলো দ্বিতীয়বার ফলন দিচ্ছে। তারপর একই গাছ থেকে কীভাবে তৃতীয় ফলন পাওয়া যায়, সেই গবেষণা শুরু করি। দেখলাম, চারটি জাত একই গাছ থেকে পাঁচবার ফলন দিচ্ছে। এই চারটি জাতের ওপর ১০ বছর ধরে চলে গবেষণা।

গত বছরের জানুয়ারিতে বোরো ধানের এই জাত একশ বিঘা জমিতে রোপণ করা হয়। পরিমাণ মতো সার প্রয়োগ করা হয়। সঠিকভাবে সেচ ও পরিচর্যা করার পর ১১০ দিনের মধ্যে ৮৫ সেন্টিমিটার থেকে এক মিটার উচ্চতার গাছে ফসল আসে। পরে মাটি থেকে নির্দিষ্ট উচ্চতায় পরিকল্পিতভাবে ওই ধান কেটে ফেলি। মে মাসের প্রথম দিকে প্রথমবার কাটা ধানে প্রতি হেক্টরে উৎপাদন হয়েছে চার টন। তারপর থেকে ৪৫ দিন অন্তর প্রতি মৌসুমে প্রতি হেক্টরে কখনো দুই টন, কখনো তিন টন ফলন এসেছে। সব জাত হেক্টরপ্রতি প্রায় ১৬ টন ফলন দিয়েছে। যেহেতু পাঁচবার চাষ হয়, তাই ‘পঞ্চব্রীহি’ নামটাই চূড়ান্ত করা হয়।

বছরের যে কোনো সময়ে এ ধান রোপণ করা যায়। এখন পরের ধাপগুলোতে কিছুটা কম উৎপাদন হচ্ছে। আমার চেষ্টা থাকবে আরও বেশি ফলন বের করার। এ ধানের বীজ সংগ্রহ সহজ। কৃষকরা নিজেরাই তা করতে পারবেন। অন্য ধানের মতো বীজতলায় রোপণের পর চারা তুলে চাষ করতে হয়। এর আগে আমি অন্য ধানের জাত উদ্ভাবন করেছি। দুবার ফসল হয়, এমন ধানও উদ্ভাবন করেছিলাম; যাকে আন্তর্জাতিক মিডিয়া ‘রাইস টোয়াইস’ বলেছে। আবার অনেকে জীবন বর্ধিত ধান বলেছে। এই প্রথম সারা বছর আমার অন্য আরেকটি ধানের জাত মাঠে থাকল। এ ধানের চারা ২৫ সেন্টিমিটার দূরত্বে রোপণ করতে হয়। ফলে গাছটি মাটি থেকে ভালোভাবে শক্তি নিয়ে বেড়ে উঠতে পারে এবং একটি ধান গাছ থেকে আরও বেশ কয়েকটি ধান গাছ গজাতে থাকে।’

মাঝে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর সীতেশ চন্দ্র বাছার

এরপর সেমিনারের প্রধান অতিথি অধ্যাপক সীতেশ চন্দ্র বাছার তাঁর বক্তব্যে এই ধানকে অনেক বড় উদ্ভাবন বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘একটি ধান গাছ বার বার ফলন দেয়, এটা অনেক বড় একটা উদ্ভাবন। এখন অনেক অঞ্চলে চিংড়ি চাষ হয়। ফলে ধানের জমি কেটে তৈরি করা হয় পুকুর। তা ছাড়া জনসংখ্যা যেভাবে বাড়ছে, তাতে ধানের জমি প্রতিনিয়ত কমছে। তাই আমাদের এমন ধান প্রয়োজন, যা কম জমিতে বেশি ধান উৎপাদন করতে পারে। তাই আমি মনে করি, পঞ্চব্রীহি ধানের উদ্ভাবন কোনো সাধারণ বিষয় নয়।’

বিশেষ অতিথি শফিউল আলম চৌধুরী বলেন, ‘এই ধান শুধু পাঁচবার ফলন দেবে, বিষয়টা এমন নয়। পঞ্চব্রীহি ধানের শেকড় বড়, তাই এটি মটিতে বেশি কার্বন ধরে রাখতে পারে। অর্থাৎ জলবায়ু পরিবর্তন রোধ ও বায়ুমণ্ডলে গ্রিন হাউস গ্যাসের পরিমাণ কমাতেও এটি ভূমিকা রাখবে।’

শফিউল আলম চৌধুরী

মো. নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘দেশে এমন অনেক জায়গা আছে, যেখানে পর্যাপ্ত পানি পাওয়া যায় না। আবার সবখানে ট্র্যাক্টর যেতে পারে না। ফলে বার বার ধান রোপন করা মুশকিল। এ সব জায়গায় এই পঞ্চব্রীহি ধান বেশি কার্যকর হবে বলে আমি মনে করি। তা ছাড়া আবেদ চৌধুরীর কথা অনুযায়ী, বাজারের অন্যান্য ধানের চেয়ে এর উৎপাদন বেশি। ফলে আমরা অল্প জমিতে বেশি ধান পাব।’

মো. নজরুল ইসলাম খান

এ ধান নিয়ে এক বছর মেয়াদি একটি প্রকল্প চালানো হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ান হাই কমিশনের অর্থায়নে বাংলাদেশ ফ্রিডম ফাউন্ডেশন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে। সহযোগিতা করেছে বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্ক। এ প্রকল্পের নাম ইনক্রিসিং ভলিউম অব আর্লি-হারভেস্ট অ্যান্ড মাল্টি-হারভেস্ট রাইস ভ্যারাইটিস ইন মৌলভিবাজার’। প্রকল্প শেষে এ ধানের বীজ বিভিন্ন এলাকার কৃষকদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

আবেদ চৌধুরী জিনগবেষক। একদল অস্ট্রেলীয় বিজ্ঞানীর সঙ্গে তিনি ফিস (ইন্ডিপেনডেন্ট সিড) জিন আবিষ্কার করেন। লাল রঙের চাল ও রঙিন ভুট্টাও উদ্ভাবন করেছেন। তাঁর ডায়াবেটিস ও ক্যান্সার প্রতিরোধক রঙিন ভুট্টা বিশ্বব্যাপী আলোচিত। বর্তমানে তিনি অস্ট্রেলিয়ায় উচ্চ ফলনশীল ধান উৎপাদন ও ভবিষ্যতের খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে গবেষণা করছেন। কুলাউড়ার কানিহাটি গ্রামের সন্তান আবেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে কৃষি বিষয়ে উচ্চশিক্ষা শেষে চাকরি নিয়ে চলে যান অস্ট্রেলিয়ায়। সেখানকার জাতীয় গবেষণা সংস্থার প্রধান ধানবিজ্ঞানী হিসেবে ধানের জিন নিয়ে গবেষণা করে কাটিয়েছেন ২০ বছর। এ পর্যন্ত তিনি প্রায় ৩০০ রকম নতুন ধান উদ্ভাবন করেছেন। গ্রামের বাড়ি কানিহাটিতে তুলেছেন কৃষি খামার। তাঁর নামে আবেদ ধানও এলাকায় চাষ করে সফলতা পেয়েছেন কৃষকরা।

আজকের এ সেমিনার আয়োজন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড রিসার্চ ইন সায়েন্সেস। সহযোগিতা করে বাংলাদেশ ফ্রিডম ফাউন্ডেশন।