সকাল থেকেই ভীড়। জমে উঠেছে রাজধানীর সেন্ট যোসেফ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলপ্রাঙ্গন। সারা ঢাকার বিভিন্ন স্কুলের ক্ষুদে বিজ্ঞানীরা এসেছে নিজেদের বানানো প্রজেক্ট নিয়ে। কৃষিকাজে ইন্টারনেট অব থিংসের প্রয়োগ, পরিমার্জিত প্লাস্টিক ব্যবস্থাপনা, সাইবর্গ থেকে শুরু করে মাছের আঁশ দিয়ে পঁচনশীল প্লাস্টিক তৈরির মতো জৈবপ্রযুক্তি—নানারকম গবেষণায় নিজেদের মেধার প্রয়োগ করেছে ক্ষুদে বিজ্ঞানীরা। সেই সঙ্গে রয়েছে বিজ্ঞান কুইজে অংশগ্রহণকারী পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থী।
জমজমাট এ আয়োজনে উপস্থিত হয়েছেন দেশসেরা অধ্যাপক, বিজ্ঞানী-গবেষক ও কথাসাহিত্যিকরা। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে আজ ২৯ অক্টোবর, শনিবার অনুষ্ঠিত হল বিকাশ-বিজ্ঞানচিন্তা বিজ্ঞান উৎসবের ঢাকা আঞ্চলিক পর্ব। রাজধানীর সেন্ট যোসেফ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে সকাল ৮ টায় শুরু হয় এ আয়োজন। চলে দুপুর ১টা পর্যন্ত।
এ উৎসবের প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শিক্ষাবিদ ও লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল। বিশেষ অতিথি হিসেবে ছিলেন বিকাশের চিফ এক্সটার্নাল অ্যান্ড করপোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার মেজর জেনারেল শেখ মো. মনিরুল ইসলাম (অব.), বিজ্ঞানচিন্তার সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম, কিশোর আলোর সম্পাদক ও কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শহীদুর রশীদ ভূঁইয়া, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আরশাদ মোমেন, কার্টুনিস্ট ও উন্মাদ-এর সম্পাদক আহসান হাবীব, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক খলিলুর রহমান, বিকাশের ইভিপি ও হেড অব রেগুলেটরি অ্যান্ড করপোরেট অ্যাফেয়ার্স কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির, জেনারেল ম্যানেজার সায়মা আহসান সেন্ট যোসেফ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের অধ্যক্ষ ও ভেন্যু প্রধান ব্রাদার লিও পেরেরা, বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সাধারণ সম্পাদক মুনির হাসান, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ও ছাড়াকার রোমেন রায়হান, বিজ্ঞানবক্তা আসিফ, গীতিকার কবির বকুল, অন্যরকম গ্রুপের চেয়ারম্যান মাহমুদুল হাসান সোহাগ, লেখক ও চিকিৎসক তানজিনা হোসেন এবং শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ও অধ্যাপক মির্জা হাসানুজ্জামান, বিকাশের জেনারেল ম্যানেজার সায়মা আহসান, অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার শাকিল মাহবুব, প্রথম আলোর ইভেন্ট এন্ড অ্যাক্টিভেশনের মহাব্যবস্থাপক অরূপ কুমার ঘোষ, সহকারী ব্যবস্থাপক শাহপরান তুষার, জ্যেষ্ঠ্য নির্বাহী আল মামুন, শুভাশীষ প্রামানিক বিজ্ঞানচিন্তার নির্বাহী সম্পাদক আবুল বাসার, সহসম্পাদক উচ্ছ্বাস তৌসিফ।
সকাল ৮টায় জাতীয় পতাকা ও উৎসবের পতাকা উত্তোলন করা হয়। শান্তির প্রতীক পায়রা উড়িয়ে মুহম্মদ জাফর ইকবাল এ অনুষ্ঠানের উদ্বোধন ঘোষণা করেন। শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘বাচ্চাদের অনুষ্ঠান আমাদের খুব ভালো লাগে। আমি সবসময় বলি, আমার ভেতরে একটা ব্যাটারি আছে। সেই ব্যাটারির বাচ্চারা চার্জ করে দেয়। আমি ওদের দেখতে থাকি আর আমার ব্যাটারি চার্জ হতে থাকে। করোনার জন্য মাঝে দুই বছর আমার ব্যাটারি চার্জ হয় নাই। তাই ব্যাটারি চার্জের জন্য এখন আমি বাচ্চাদের অনুষ্ঠানে গিয়ে বসে থাকি।’
বিজ্ঞানচিন্তার সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম বলেন, ‘স্কুলের আজকের শিক্ষার্থীরাই হবে আমাদের ভবিষ্যৎ বিজ্ঞানী। এই শিক্ষার্থীরাই আমাদের পথ দেখিয়ে এগিয়ে নেবে। এদের থেকে কেউ হয়তো বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পাবে, স্বপ্ন দেখাবে সুন্দর ভবিষ্যতের। তাই এই স্কুল শিক্ষার্থীদের আমরা বিজ্ঞানী হতে উৎসাহ দিতে চাই, বিজ্ঞানচর্চায় আগ্রহী করে তুলতে চাই। সেজন্যই আমাদের এই আয়োজন।’
বিকাশের চিফ এক্সটার্নাল অ্যান্ড করপোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার মেজর জেনারেল শেখ মো. মনিরুল ইসলাম (অব.) বলেন, ‘আমাদের শিক্ষার্থীরা চমৎকার সব প্রজেক্ট বানিয়ে এনেছে। ভবিষ্যতে ওরা যে অনেক বড় কিছু করবে, এ স্বপ্ন আমরা দেখতে পারি। এই শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানে আগ্রহী করে তুলতে বিজ্ঞানচিন্তার সঙ্গে এই আয়োজন করতে পেরে আমরা আনন্দিত। করোনা মহামারীর জন্য দুবছর আমরা এ আয়োজন করতে পারিনি। তবে এখন আমরা আবার এ আয়োজন শুরু করেছি। ভবিষ্যতেও আমরা এই ক্ষুদে বিজ্ঞানীদের নিয়ে কাজ করে যেতে চাই।’
উৎসবে স্কুলের ৬ষ্ঠ-১০ম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা প্রজেক্ট প্রদর্শনী ও কুইজ প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। প্রায় পাঁচ শতাধিক প্রতিযোগীর মধ্যে থেকে প্রজেক্ট প্রদর্শনীতে সেরা দশ বিজয়ী দলকে বাছাই করা হয়। এছাড়া কুইজ প্রতিযোগিতায় নিম্নমাধ্যমিক ও মাধ্যমিক, এ দুটি ক্যাটাগরিতে ১০ জন করে মোট ২০ জনকে বাছাই করা হয়। আঞ্চলিক উৎসবে এই বিজয়ীরা ঢাকায় অনুষ্ঠিত জাতীয় উৎসবে অংশ নেওয়ার সুযোগ পাবে। বিজয়ীদের জন্য ছিল সার্টিফিকেট, মেডাল, বই ও টি-শার্ট এবং প্রতিটি বিভাগের প্রথম তিনজনের জন্য বিজ্ঞানবাক্স। এছাড়া প্রজেক্ট ও দুই বিভাগের কুইজের সেরাদের সেরার জন্য ছিল ট্রফি।
কুইজ শেষে মঞ্চের সামনে দর্শকসারিতে ক্ষুদে বিজ্ঞানী ও তাদের অভিভাবকরা। মঞ্চে গান তুলেছেন অবন্তি সিঁথি ও অটামনাল মুন। বিজ্ঞানচিন্তার থিম সং-এ গলা মেলায় ক্ষুদে বিজ্ঞানীরা। গান শেষেই আবার হৈ চৈ। মঞ্চে নাচ তুলেছে এক রোবট! বিজ্ঞানের উৎসবে এমনটাই হবে, তা বলা বাহুল্য। রোবটের এ নাচ পরিচালনা করেন বিডিওএসএনের কোঅর্ডিনেটর মাহেরুল আজম কোরেশী। নাচ শেষ হতেই জাদু! বিজ্ঞানের জাদু। রাজীব বসাক হাতের কারিকুরিতে মুগ্ধ করেন দর্শকদের।
তারপর বহু প্রত্যাশিত প্রশ্নোত্তর পর্ব। এ পর্বে অতিথিদের মজার সব প্রশ্ন করে চমকে দেয় ক্ষুদে বিজ্ঞানীরা। ‘১৩০০ কোটি বছর আগের ছবি কেমন করে দেখল টেলিস্কোপ? দুই চোখে একসঙ্গে কেন দুদিকে দেখা যায় না? কৃত্রিমভাবে কি ব্ল্যাকহোল তৈরি করা যায়? আলোর তরঙ্গরূপ শোষিত হয়ে বা দুর্বল হয়ে শেষ হয়ে যায় না কেন?’ ক্ষুদে বিজ্ঞানীদের অনেক প্রশ্ন। প্রশ্নোত্তর পর্বে শিক্ষার্থীদের কৌতুহলী সব প্রশ্নের জবাব দেন কার্টুনিস্ট আহসান হাবীব, অধ্যাপক আরশাদ মোমেন, অধ্যাপক ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী, অধ্যাপক খলিলুর রহমান, চিকিৎসক তানজিনা হোসেন, বিজ্ঞানবক্তা আসিফ, বিকাশের কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির এবং ছাড়াকার রোমেন রায়হান। কিন্তু সময় পেরিয়ে গেলেও ভবিষ্যৎ বিজ্ঞানীদের প্রশ্ন শেষ হতে চায় না। কত কী আছে জানার!
প্রশ্নোত্তর পর্বশেষে পুরস্কার বিতরণীর মাধ্যমে শেষ হয় এ আয়োজন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন মৌসুমী মৌ। প্রশ্নোত্তর পর্ব ও পুরস্কার বিতরণী পর্ব সঞ্চালনা করেন শিবলী বিন সারওয়ার ও উচ্ছ্বাস তৌসিফ।
সারা দেশের স্কুল শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানে উৎসাহী করে তুলতে আয়োজিত হচ্ছে বিকাশ-বিজ্ঞানচিন্তা বিজ্ঞান উৎসব। দেশের সর্বাধিক পঠিত বিজ্ঞানবিষয়ক ম্যাগাজিন বিজ্ঞানচিন্তা এবং দেশের সর্ববৃহৎ মোবাইল ফিনান্সিয়াল সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান বিকাশ যৌথভাবে এ আয়োজন করে। এ আয়োজনের সহযোগিতায় ছিল প্রথম আলো বন্ধুসভা। ঢাকা আঞ্চলিক পর্বের পর চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, রংপুর ও সিলেট বিভাগে অনুষ্ঠিত হবে এ উৎসব। সবশেষে আঞ্চলিক পর্বের সেরাদের নিয়ে জাতীয় পর্বের মাধ্যমে শেষ হবে ক্ষুদে বিজ্ঞানীদের এই মিলনমেলা।
বিজ্ঞান উৎসবের যেকোনো খবর জানতে চোখ রাখো bigganchinta.com-এ, বিকাশ-বিজ্ঞানচিন্তা বিজ্ঞান উৎসব ও বিজ্ঞানচিন্তার ফেসবুক পেজ ও গ্রুপে, প্রথম আলোয় এবং বিজ্ঞানচিন্তার প্রিন্ট সংস্করণে।
লেখক: সম্পাদনা দলের সদস্য, বিজ্ঞানচিন্তা