চট্টগ্রামে দিনব্যাপী ফিজিক্স অলিম্পিয়াড অনুষ্ঠিত

ফিজিক্স অলিম্পিয়াডের চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পর্ব

দুপাশের বুথগুলোতে চলছে তথ্য যাচাই। এর মাঝেই দেওয়া হচ্ছে টি-শার্ট, কুপন ও ভেন্যুতে ঢোকার টিকেট। সার বেঁধে হলুদ টি-শার্ট পড়ে শিক্ষার্থীরা প্রবেশ করছে ভেন্যুতে। সকাল ৮টার দিকে সাধারণত এমন দৃশ্য দেখা যায় না চট্টগ্রাম ফয়’স লেক কনকর্ড অ্যামিউজমেন্ট পার্কের প্রবেশদ্বারে। কিন্তু আজকের দিনটা সাধারণ আর সব দিনের মতো নয়। আজ ফিজিক্স অলিম্পিয়াডের চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পর্ব। বাছাইপর্বের মাধ্যমে প্রায় সহস্রাধিক শিক্ষার্থী আঞ্চলিক এ অলিম্পিয়াডে অংশ নেওয়ার জন্য নির্বাচিত হয়েছে। অভিভাবকসহ এসব শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে ফয়’স লেক প্রাঙ্গন হয়ে উঠেছিল উৎসবমুখর। দিনব্যাপি চলা এ আয়োজনে শিক্ষার্থী-অভিভাবক ছাড়াও অংশ নেন দেশের খ্যাতনামা অধ্যপক, বিজ্ঞানী শিক্ষাবিদসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তিরা। ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংক-প্রথম আলো ফিজিক্স অলিম্পিয়াডের চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পর্ব আয়োজনে সার্বিক সহযোগিতা করেছে প্রেসিডেন্সি ইন্টারন্যাশলান স্কুল।

সকালে অলিম্পিয়াড সূচনা হয় কোরআন তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে। তারপর সমবেত কন্ঠে জাতীয় সঙ্গীত গান উপস্থিত সবাই। এ সময় উদ্বোধনী মঞ্চে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী ও বাংলাদেশ ফিজিক্স অলিম্পিয়াড দলের কোচ অধ্যাপক আরশাদ মোমেন। এ ছাড়াও বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ফিজিক্স অলিম্পিয়াড কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ফয়েজ আহমেদ জাহাঙ্গীর মাসুদ, চট্টগ্রাম প্রেসিডেন্সি ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের চেয়ারম্যান মো. আশরাফুল হক খান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. গোলজার খান আলমগীর, প্রেসিডেন্সি এডুকেশনের রেক্টর ইমাম হাসান রেজা এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আ ক ম মাইনুল হক মিয়াজি।

উদ্বোধনী পর্বে অতিথিরা

অনুষ্ঠানে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন অধ্যাপক আরশাদ মোমেন, প্রেসিডেন্সি স্কুলের পতাকা উত্তোলন করেন প্রেসিডেন্সি এডুকেশনের রেক্টর ইমাম হাসান রেজা, বাংলাদেশ ফিজিক্স অলিম্পিয়াডের পতাকা ও ১৩তম ফিজিক্স অলিম্পিয়াডের পতাকা উত্তোলন করেন যথাক্রমে বাংলাদেশ ফিজিক্স অলিম্পিয়াড কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ফয়েজ আহমেদ জাহাঙ্গীর মাসুদ ও প্রেসিডেন্সি স্কুলের কনভেনর অব দ্য প্রোগ্রাম অ্যান্ড ডিরেক্টর নুরুল কবির।

উদ্বোধনী বক্তব্য অধ্যাপক আরশাদ মোমেন বলেন, ‘তোমরা কষ্ট করে ফিজিক্স অলিম্পিয়াডে অংশ নিতে এসেছ, এজন্য তোমাদের অসংখ্য ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা। সাধারণত ফিজিক্স অলিম্পিয়াডে এসে শিক্ষার্থীরা ভড়কে যায়। কিন্তু ভয় পেলে চলবে না। ভয়কে জয় করতে হবে। পদার্থবিজ্ঞানকে ভালোবাসতে হবে। তোমরাই এগিয়ে নেবে দেশকে।’

এরপর শিক্ষার্থী ও অতিথিরা একসঙ্গে বেলুন উদ্বোধন করে অলিম্পিয়াডের। অনুষ্ঠানের উদ্বোধন ঘোষণা করেন অধ্যাপক আরশাদ মোমেন।

উদ্বোধনী পর্ব সঞ্চালনা করেন প্রেসিডেন্সি স্কুলের আর্ট অ্যান্ড ডিজাইন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান উদ্দীপন তালুকদার ও একই স্কুলের বাংলা বিভাগের শিক্ষক রাশেদুল ইসলাম।

বেলুন উড়িয়ে দিয়ে শিক্ষার্থীরা ছুটে যায় পরীক্ষার স্থানে। আগে থেকেই সারি সারি টেবিল-বেঞ্চ পাতা ছিল। ক্যাটাগরি অনুযায়ী শিক্ষার্থীরা বসে যায় নিজ নিজ আসনে। 

এ সময় শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে দেওয়া স্বাগত বক্তব্যে প্রেসিডেন্সি এডুকেশনের রেক্টর ইমাম হাসান রেজা বলেন, ‘ফিজিক্স অলিম্পিয়াড তোমাদের জন্য অসাধারণ সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। বিজ্ঞানের মৌলিক চিন্তাগুলো তোমরা পদার্থবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবতে পারবে।'

পরীক্ষার্থীদের একাংশ

ঠিক ৯.৫০টায় শুরু হয় অলিম্পিয়াডের পরীক্ষা। ১ঘন্টা ৪৫ মিনিটের পরীক্ষা শেষে শিক্ষার্থীদের জন্য ছিল মধ্যাহ্নভোজের বিরতি। এরপর শুরু হয় বিজ্ঞান বক্তৃতা ও প্রশ্নোত্তর পর্ব। মঞ্চে ওঠেন বাংলাদেশ ফিজিক্স অলিম্পিয়াড দলের কোচ অধ্যাপক আরশাদ মোমেন।

রিলেটিভিটি বা আপেক্ষিক তত্ত্ব বিষয়টা আসলে কী, তা-ই ছিল তাঁর বক্তৃতার প্রতিপাদ্য। প্রাঞ্জল ভাষা ও হাসি গল্পের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের পুরো বিষয়টি বুঝিয়ে দেন তিনি। 

লেকচার পর্ব শেষ হতেই প্রশ্নের ঝাঁপি খুলে বসে শিক্ষার্থীরা। “মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি কাকে কেন্দ্র করে ঘুরছে? আলোর ভর না থাকলে ভরবেগ কীভাবে হয়? মাল্টিভার্স কী? প্রতিটি ইউনিভার্সের জন্য কি সময় ভিন্ন? ভর কীভাবে শক্তিতে পরিণত হয়? বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের ভর কোথায় হারাচ্ছে? কীভাবে আলোর বেগ একই থাকে সবসময়?- এমন হাজারও জিজ্ঞাসা শিক্ষার্থীদের। বুদ্ধিদীপ্ত এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক আরশাদ মোমেন, ফয়েজ আহমেদ জাহাঙ্গীর মাসুদ এবং অধ্যাপক আ ক ম মাইনুল হক মিয়াজি।

ফিজিক্স অলিম্পিয়াডে শিক্ষার্থীদের জন্য ফয়’স লেকের দুটি ছাড়া (বাম্পিং কার ও ওয়াটার বোট) যেকোনো পাঁচটি রাইড উপভোগ করার সুযোগ করে দিয়োছিল আয়োজক কর্তৃপক্ষ। প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষ হতে কিছু সময়ের জন্য শিক্ষার্থীরা ছুটে যায় এসব রাইডে চড়ার জন্য।

চলছে প্রশ্নোত্তর পর্ব

বিকেলে অনুষ্ঠানের তৃতীয় পর্ব সাজানো হয়েছিল সাংস্কৃতিক নানা আয়োজন দিয়ে। এর ফাঁকে ফাঁকে ছিল ফলাফল ঘোষণা ও পুরষ্কার বিতরণী। অলিম্পিয়াডের এ ক্যাটগরিতে ২১ জন, বি ক্যাটাগরিতে ৪০ জন, সি ক্যাটাগরিতে ৬৮ জন এবং ডি ক্যাটাগরিতে ৪১ জনকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। এ ছাড়াও বি ক্যাটাগরিতে ১০জন, সি ক্যাটাগরিতে ১৩জন এবং ডি ক্যাটাগরিতে ১০জনকে অনারেবল মেনশন পুরষ্কার দেওয়া হয়।

পড়ন্ত বসন্তের বিকেলে হৃদের তীরে বসে শিক্ষার্থীরা জাদু, নাচ, গানসহ মনোমুগ্ধকর নানা আয়োজন উপভোগ করে। 

চট্টগ্রামের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও প্রথম আলো চট্টগ্রাম বন্ধুসভার সাংস্কৃতিক দলের পরিবেশনায় মুগ্ধ হন সবাই।

ফলাফল ও পুরস্কার বিতরণীর মাঝেই প্রেসিডেন্সি স্কুলের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ফিজিক্স অলিম্পিয়াড কমিটির সাধারণ সম্পাদক ফয়েজ আহমেদ জাহাঙ্গীর মাসুদকে সম্মাননা স্মারক তুলে দেন কনভেনর অফ দ্য প্রোগ্রাম ও ডিরেক্টর নুরুল কবির। চূড়ান্ত পর্বের পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ ফিজিক্স অলিম্পিয়াড কমিটির সাধারণ সম্পাদক ফয়েজ আহমেদ জাহাঙ্গীর মাসুদ, প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক বিশ্বজিত চৌধুরী প্রমুখ।

বিশ্বজিৎ চৌধুরী তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘প্রথম আলো শুধু একটি পত্রিকা নয়। পত্রিকার চেয়েও একটু বেশি কিছু। আমরা বলি, ভালো সাথে আলোর পথে। প্রতিটা ভালো কাজের সঙ্গে প্রথম আলো ছিল, আছে এবং থাকবে। এজন্যই আমরা বছরজুড়ে পত্রিকা প্রকাশের পাশাপাশি ম্যাথ অলিম্পিয়াড, ফিজিক্স অলিম্পিয়াড, বিজ্ঞান উৎসব, বর্ণমেলার মতো আয়োজনগুলো করে থাকি। আমরা সব ক্ষেত্রে পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশের জয় দেখতে চায়। আজকের অনুষ্ঠানে যারা এসেছ, তাদের সবাইকে শুভেচ্ছা। অনুষ্ঠান আয়োজনে যারা সহযোগী হিসেবে ছিলেন, তাদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা।’

শিক্ষার্থীদের জন্য ছিল নানা ধরনের রাইডে চড়ার সুযোগ

অনুষ্ঠানের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন প্রেসিডেন্সি এডুকেশনের রেক্টর ইমাম হাসান রেজা। পুরস্কার বিতরণী শেষে সমাপনী বক্তব্যে তিনি উপস্থিত সবাইকে ধন্যবাদ জানান। শিক্ষার্থীদের আরও বেশি করে জ্ঞান চর্চায় আগ্রহী হওয়ার ব্যাপারে উৎসাহ দেন। অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নাসিম হাসান, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিমেষ চক্রবর্তী, প্রেসিডেন্সি ইন্টারন্যাশনাল স্কুল পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান আশরাফুল হক খান ও সদস্য সচিব মো. গোলজার খান আলমগীরসহ অন্যান্য পরিচালক বৃন্দ, স্কুলের উপাধ্যক্ষ, অভিভাবক ও শিক্ষকমণ্ডলী।

২০২৩ সালে জাপানের টোকিওতে অনুষ্ঠিত হবে ৫৩তম ফিজিক্স অলিম্পিয়াড। এ লক্ষ্যে প্রতিবারের মতো এবারও দেশব্যাপী ১৩তম ডাচ্-বাংলা ব্যাংক-প্রথম আলো ফিজিক্স অলিম্পিয়াড ২০২৩ আয়োজন করা হচ্ছে। বাছাইপর্বের নির্বাচিতদের নিয়ে আয়োজিত হচ্ছে আঞ্চলিক ফিজিক্স অলিম্পিয়াড। ইতিমধ্যেই অনুষ্ঠিত হয়েছে ফিজিক্স অলিম্পিয়াডের ঢাকা, যশোর, বরিশাল, দিনাজপুর, রাজশাহী ও সিলেট আঞ্চলিক পর্ব। ফিজিক্স অলিম্পিয়াডের চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পর্বের মধ্য দিয়ে শেষ হলো আঞ্চলিক উৎসব। এরপর আঞ্চলিক পর্বের বিজয়ীদের নিয়ে আয়োজিত হবে জাতীয় উৎসব। পরে জাতীয় উৎসবের বিজয়ীদের নিয়ে ক্যাম্প আয়োজন করা হবে। ক্যাম্প শেষে বাছাইকৃতদের নিয়ে গঠিত হবে বাংলাদেশ ফিজিক্স অলিম্পিয়াড দল। ওই দলটিই জাপানের টোকিওতে অনুষ্ঠেয় ৫৩তম ফিজিক্স অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবে।

এ অলিম্পিয়াডের আয়োজন করছে বাংলাদেশ ফিজিক্স অলিম্পিয়াড কমিটি। আয়োজনের পৃষ্ঠপোষকতা করছে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক। ব্যবস্থাপনায় রয়েছে প্রথম আলো। এ ছাড়া ম্যাগাজিন পার্টনার হিসাবে রয়েছে কিশোর আলো নবিষয়ক মাসিক ম্যাগাজিন বিজ্ঞানচিন্তা। টেকনিক্যাল পার্টনার হিসাবে আছে বিডিকম।

দেশের শিক্ষার্থীদের পদার্থবিজ্ঞানে দক্ষ করে তুলতে ২০১১ সাল থেকেই আয়োজিত হচ্ছে ফিজিক্স অলিম্পিয়াড। এবারেও একই উদ্দেশ্য নিয়ে শুরু হচ্ছে ফিজিক্স অলিম্পিয়াড ২০২৩।

ফিজিক্স অলিম্পিয়াড ও আঞ্চলিক পর্ব সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যাবে bdpho.org ওয়েবসাইটে।


লেখক: শিক্ষার্থী, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা