জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় উড়ি ধানের ব্যবহারিক প্রয়োগ বিষয়ক সেমিনার আয়োজিত হল। ১৮ অক্টোবর, বুধবার সকাল ১০টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস স্টাডিজ অনুষদের ড. মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ কনফারেন্স কক্ষে আয়োজিত হয় এ সেমিনার।
এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান। বিশেষ অতিথি ছিলেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. আব্দুল মতিন, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সঞ্জয় কুমার ভৌমিক। আরও উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান মো. এনামুল হক, প্রকল্প পরিচালক জেবা ইসলাম সেরাজ এবং উপ-প্রকল্প পরিচালক মো. রাকিবুল ইসলাম।
শুরতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন মো. রাকিবুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আমাদের এই ধানের তিনটি লক্ষ্য। লবণাক্ত পানিতে কীভাবে ধান রোপন করা যায়, তা নিয়ে আমাদের এই গবেষণা।’
‘অর্থনৈতিকভাবে দেশে এই ধান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। দক্ষিণাঞ্চলে লবণক্ততার পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। এ সময়ে এসে এ ধরনের গবেষণা খুবই সময়োপযোগী। গবেষণার জন্য সরকারের যথেষ্ট ফান্ড আছে। কিন্তু পর্যাপ্ত ভালো ফান্ডের অভাবে আমরা তা দিতে পারি না। সুতরাং কেউ যদি ভালো গবেষণা করে, তবে তাঁর জন্য ফান্ডের অভাব হবে না।’
উড়ি ধানের ব্যাপারে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেন অধ্যাপক জেবা ইসলাম সেরাজ। তিনি বলেন, ‘এই ধান সমুদ্রের লবণাক্ত পানিতেও জন্মাতে পারে। যেসব অঞ্চলে সারা বছরব্যাপী লবণাক্ত পানি থাকে, সেখানকার কৃষকেরা এ ধান রোপন করে লাভবান হতে পারবেন।’
জেবা ইসলাম সেরাজ এবং তাঁর দলের কর্মরত সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে সঞ্জয় কুমার ভৌমিক বলেন, ‘বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশেই প্রথম নিজেদের টাকায় ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করে। প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা আমরা এ ফান্ডের মাধ্যমে ব্যয় করেছি। এই প্রকল্পের মতো মৌলিক গবেষণা আমরা চাই। জেবা ইসলাম সেরাজের এ পদক্ষেপ আসলে সাহসের কাজ।’
‘আজ এখানে কাজের ফলাফল ঘোষণা করা হচ্ছে। তবে এটাই শেষ কথা নয়। এই গবেষণা কীভাবে সাধারণ মানুষের জন্য কাজে লাগানো যায়, সেটাই নিয়ে ভাবতে হবে। এ ফলাফলের প্রভাব নিয়ে আপনারা পর্যালোচনা করুন। মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিন এই গবেষণার বিষয়বস্তু।’
এরপর শুরু হয় মুক্ত আলোচনা। জেবা ইসলাম সেরাজের বক্তব্যের ওপরে অনেকে তাঁদের মতামত দেন। এ ধানের ভালো মন্দ সব দিক নিয়ে আলোচনা করেন আগত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও শিক্ষকরা। অনেকে প্রশ্ন করেছেন উড়ি ধান সম্পর্কে। জেবা ইসলাম সেরাজ সে সব প্রশ্নের উত্তর দেন।
সবশেষে ধন্যবাদ বক্তব্য দেন মো. এনামুল হক। তিনি বলেন, ‘আজকের সেমিনারে যারা উন্মুক্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে নানা বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন, সেগুলো মাথায় রেখে এরপর আমরা আরও কাজ করব। দেশের আবাদি জমির পরিমাণ দিন দিন কমছে। ফলে বেশি ফলন দেয় এমন ধান রোপণ করতে হবে।’
উড়ি ধান উপকূল এলাকায় ‘ধানি ঘাস’ নামে পরিচিত। এ ধানের তেমন ফলন হয় না। দানা পাওয়া যায় খুব কম। কিন্তু এ ধান অন্যান্য ধানের চেয়ে প্রায় পাঁচ গুণ বেশি লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে। তাই এ ধান নিয়ে কাজ করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের একদল গবেষক। তাঁদের লক্ষ্য তিনটি। প্রথমত, উড়ি ধানের জিনগত বৈশিষ্ট্য সাধারণ ধানের মধ্যে এনে লবণ সহনশীল ধানের উদ্ভাবন করা। দ্বিতীয়ত, উড়ি ধানের মধ্যে বাস করে এমন অণুজীব প্রয়োগের মাধ্যমে ধানের ফলন বাড়ানো। এই অণুজীব রাসায়নিক সারের বিকল্প হিসেবে কাজ করে। সবশেষে শুষ্ক মৌসুমে লবণাক্ততা বেড়ে গেলে উড়ি ধানের মাধ্যমে শোধনকৃত পানি ব্যবহার করে সাধারণ ধানের ফলন বাড়ানো।
উড়ি ধানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, এটি তার আশেপাশের পরিবেশ থেকে লবণ শোষণ করে পানি ও মাটির লবণের মাত্রা কমায়। এই গুণ ব্যবহার করে উপকূলীয় অঞ্চলে শুকনো মৌসুমে পানি ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা সম্ভব। এতে কৃষকদের সব ধরনের শস্য উৎপাদনে সুবিধা হবে।
এই গবেষণার কাজ মাঠ পর্যায়ে করা হয়েছে সাতক্ষীরা, খুলনা ও নোয়াখালীতে। উড়ি ধানের মাধ্যমে পরিশোধনকৃত পানি দিয়ে চাষ করে লবণ সংবেদনশীল ধানের জাতের প্রায় পাঁচ গুণ ফলন পাওয়া গেছে। উড়ি ধানের বিশেষায়িত মূল থেকে গবেষক দল এমন কিছু ব্যাকটেরিয়া ও ফাঙ্গাস চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছে, যা সাধারণ অণুজীবের চেয়ে দ্বিগুণ লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে। এ সম্পর্কিত তিনটি বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। এসব ব্যাকটেরিয়া ও ফাঙ্গাস থেকে বায়োফার্টিলাইজার তৈরি করে একইসঙ্গে ধান গাছের লবণ সহিঞ্চুতা এবং ফলন বাড়ানো সম্ভব বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট গবেষকরা।