আবিষ্কারের নেশায়

কয়েকজন আবিষ্কারক

এবার কয়েকজন আবিষ্কারকের গল্প বলা যাক। এসব গল্প ড. আল-মুতীর বই আবিষ্কারের নেশায় (অনুপম প্রকাশনী, ২০১০) থেকে নেওয়া।

প্রথমেই শুরু করি আর্কিমিডিসের কথা দিয়ে। ভূমধ্যসাগরের বুকে সিসিলি একটি দ্বীপ। সেকালে এই দ্বীপের সবচেয়ে নামকরা শহর সিরাকিউসে ছিল গ্রিকদের বসতি। এখানেই আর্কিমিডিসের জন্ম। তিনি প্রায় ৭৫ বছর বেঁচে ছিলেন। পড়াশোনা করেন মিসরের আলেকজান্দ্রিয়ায়। গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানে বেশ কয়েকটি গভীর ও গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের জন্য তিনি বিখ্যাত হয়ে আছেন।

আর্কিমিডিসের কয়েকটি বিখ্যাত উক্তি আছে। একটি আমরা আগেই জানি, ‘ইউরেকা’। তিনি প্লবতার ব্যাপার এবং বস্তুর ঘনত্ব-সংক্রান্ত ব্যাপার আবিষ্কার করতে পেরে এই বিখ্যাত উক্তিটি করেছিলেন। আরেকবার তিনি সদম্ভে ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘আমাকে একটি দাঁড়ানোর জায়গা দাও, আর একটা লম্বা লাঠি দাও, আমি পুরো পৃথিবীকে নড়িয়ে দেব।’ লিভারের মূলনীতি আবিষ্কারের পর তিনি এই কথা বলেছিলেন। আর তাঁর শেষ বিখ্যাত উক্তি ‘খবরদার, আমার বৃত্তকে নষ্ট কোরো না।’

সিরাকিউসের রাজা ছিলেন আর্কিমিডিসের বন্ধু ও পৃষ্ঠপোষক। রাজার জন্য তিনি অনেক দারুণ দারুণ আবিষ্কার করে চমকে দিয়েছেন। এর বেশির ভাগই ছিল ব্যবহারিক প্রয়োগ এবং অনেকগুলোই ছিল যুদ্ধের জন্য উপযোগী আবিষ্কার।

মগ্ন আর্কিমিডিস
ছবি : সংগৃহীত

আফ্রিকার উত্তরে আরেকটি শহর ছিল কার্থেজ। কার্থেজের সঙ্গে সিরাকিউসের ভাব ছিল। যেহেতু কার্থেজের সঙ্গে রোমের খটরমটর চলছিল, তাই সিরাকিউসও রোমের বিরুদ্ধে যুদ্ধংদেহী ছিল। যেহেতু সিরাকিউস ছোট শহর, সেনাবলও রোমের তুলনায় নগণ্য, তাই রোম সেনাপতি মার্সেলাস ঠিক করলেন, সিরাকিউসকে উচিত শিক্ষা দেবেন। কিন্তু আর্কিমিডিস এমন সব মজার কৌশল বের করলেন যে রোমের ওই পরাক্রান্ত বাহিনি সিরাকিউসের কাছেই ভিড়তে পারল না।

আর্কিমিডিস শক্তিশালী লিভার আর স্প্রিংয়ের সাহায্যে রোম বাহিনীর ওপর বড় বড় পাথর ছুড়ে মারার ব্যবস্থা করলেন। তখন রোমের বাহিনী দুদিক থেকে—সাগর আর স্থল, সিরকউসকে অবরোধ করে রাখল তিন বছর। কিন্তু আর্কিমিডিস শহরের উঁচু দেয়ালে বড় বড় আয়না ফিট করে রাখলেন। রোমের জাহাজ দেখলেই আয়না তাক করে সূর্য রশ্মি ফেলার ব্যবস্থা হলো। তাতে জাহাজের মাস্তুলে-পালে আগুন ধরে যেত।

ভেতরের কিছু লোকের বিশ্বাসঘাতকতায় শহর শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করে। সেনাপতি মার্সেলাস কিছু সৈনিককে পাঠালেন আর্কিমিডিসকে নিয়ে আসতে। এই বিখ্যাত বিজ্ঞানী সম্পর্কে তিনি অনেক কিছু শুনেছেন। তিনি বিজ্ঞানীকে সামনাসামনি দেখতে চান। সৈন্যরা যখন আর্কিমিডিসের কাছে গেল, তখন তিনি বালিতে জটিল জ্যামিতিক নকশা এঁকে গভীর চিন্তায় মগ্ন। সৈন্যরা যখন বললেন, তাঁদের সঙ্গে বিজ্ঞানীকে যেতে হবে, আর তাঁরা তাঁর জ্যামিতিক নকশায় বাধা দিচ্ছিলেন, আর্কিমিডিস তখন বললেন, ‘আমার বৃত্তের ছবিকে নষ্ট কোরো না।’ এই কথায় উদ্ধত সৈন্যরা রেগে গিয়ে বিজ্ঞানীকে সেখানেই হত্যা করেন। আর্কিমিডিস নিহত হয়েছেন শুনে সেনাপতি খুব দুঃখ পেয়েছিলেন। তাঁর জন্য তিনি একটি সমাধি বানিয়ে দিয়েছিলেন। আর্কিমিডিসের খুব চমত্কার একটা বই আছে দ্য স্যান্ড রেকোনার। একটু জটিল কিন্তু পড়ে দেখতে পারেন। উইকিপিডিয়ায় এর একটি সারাংশ আছে। তিনি পৃথিবীতে বালির দানা কত, সেটা অসীম না গোনা যায়—এই প্রশ্ন সামনে রেখে বইটি লিখেছিলেন।

আবিষ্কারের নেশায়, নতুন প্রচ্ছদ
ছবি: সংগৃহীত

দুই

‘গবেষণায় মগ্ন বিজ্ঞানী শুধু যন্ত্রপাতির কারিগর নন, প্রকৃতির রহস্যমালায় বিমুগ্ধ তিনি এক শিশু।’ এ কথা বলেছিলেন মাদাম মেরি কুরি (১৮৬৭-১৯৩৪)। তিনিই একমাত্র নারী বিজ্ঞানী, যিনি দুবার নোবেল পুরস্কার জিতেছিলেন। মেরি কুরির জন্ম পোল্যান্ডে ওয়ারশ শহরে। মা-বাবা দুজনেই শিক্ষক। অতএব অসচ্ছল পরিবারে তীক্ষ মেধা নিয়ে দুর্বার সাধনার জীবন মেরির। ক্লাসের সেরা ছাত্রী তিনি। স্কুলের সমাপনী পরীক্ষায় প্রথম হয়েছেন, ইচ্ছে আরও পড়ার। কিন্তু পরাধীন দেশে তখন ছেলেরাই ভালো কোথাও সুযোগ পায় না, আর তো মেয়েরা। টিউশন করে টাকা জমিয়ে কয়েক বছরের দুর্দান্ত কষ্টের শেষে প্যারিসে গিয়ে ভর্তি হলেন বিখ্যাত সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে, পদার্থবিদ্যায়। কম ভাড়ার পুরোনো বাড়িতে স্যাঁতসেঁতে ছাদের ঘরে থেকে থেকে অসুখই বাধিয়ে ফেলেছিলেন। ওই বিশ্ববিদ্যালয়েরই তরুণ অধ্যাপক পিয়ের কুরির সঙ্গে বিবাহবন্ধনে বাঁধা পড়েন মেরি। পিয়েরের গবেষণাগারে তাঁরই তত্ত্বাবধানে শুরু হলো মারির ডক্টরেট গবেষণা। মেরি ঠিক করলেন তিনি ইউরেনিয়ামের অদৃশ্য রশ্মি নিয়ে কাজ করবেন। তত দিনে হেনরি বেকেরেল ও উইলিয়াম রন্টগেনের আবিষ্কার থেকে এক্স-রশ্মি বিচ্ছুরণ এবং তেজস্ক্রিয় পদার্থের বিকিরণ বিষয়ে অনেক কিছু জানা গেছে।

আবিষ্কারের নেশায়, পুরোনো প্রচ্ছদ
ছবি: সংগৃহীত

মেরি কুরির গবেষণা থেকে তেজস্ক্রিয়া সম্পর্কে অনেক কিছু জানা গেল। তিনি বিভিন্ন লবণের নমুনা থেকে পাওয়া অদৃশ্য রশ্মির তেজ মেপে দেখতে পেলেন, যেসব লবণে ইউরেনিয়াম থাকে, তাদের থেকে এসব তেজ বিকিরণ বেশি হয়। একই কথা থোরিয়ামের ক্ষেত্রেও দেখা যায়। এভাবে ইউরেনিয়ামের আকরিক পিচব্লেন্ড নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে মেরি দেখলেন, এর তেজস্ক্রিয়া ইউরেনিয়ামের থেকে প্রায় ৪০০ গুণ বেশি। এখান থেকে তিনি এক নতুন মৌলিক পদার্থের অস্তিত্ব খুঁজে পেলেন, যার নাম তিনি দিলেন পোলোনিয়াম। ১৮৯৮-এর ডিসেম্বরে তিনি রেডিয়াম বলে আরেকটি মৌলিক পদার্থ খুঁজে পেলেন, যার তেজস্ক্রিয়া পোলোনিয়ামের থেকেও বেশি। এই রেডিয়াম নিয়ে কাজ করতে গিয়ে এর তেজরশ্মির প্রভাবে মেরি কুরি ক্যানসারে আক্রান্ত হন। মারা যান ১৯৩৪ সালে। তার আগেই পিয়েরে কুরি মারা যান দুর্ঘটনায়। তখন সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার প্রধান অধ্যাপক হন মেরি কুরি। সোরবোনের ইতিহাসে সেই প্রথম প্রধান অধ্যাপক হলেন একজন নারী।

মেরি কুরি
ছবি: সংগৃহীত

তাঁদের গবেষণার আবহটা কেমন ছিল সেটা ড. আল-মুতী লিখেছেন খুব চমত্কারভাবে, ‘আজকে যে দেশটাকে চেকোস্লাভাকিয়া বলা হয়, সে জায়গায় বোহেমিয়া বলে এক অঞ্চলে তখন প্রচুর পিচব্লেন্ড পাওয়া যেত। কারখানার মালিকেরা আকরিক থেকে রুপা পৃথক করে বাকি পিচব্লেন্ডটা ফেলে দিত। তারা [পিয়েরে ও মেরি কুরি দম্পতি বিজ্ঞানীর] প্রস্তাব শুনে বলল: আবর্জনাগুলো স্বচ্ছন্দে দিয়ে দেব যদি কেউ গাড়িভাড়া দিয়ে এগুলো নিয়ে যায়। [পিয়রে ও মেরির] টানাটানির সংসারে বহু কষ্টে জমানো টাকা খরচ করে তাঁরা এই পিচব্লেন্ড আকরিক নিয়ে এলেন। তারপর সেই স্যাঁতসেঁতে ঘরে দিনের পর দিন ধরে চলল তাকে শোধন করা। বিরাট বিরাট কড়াইতে অ্যাসিডে জ্বাল করা হচ্ছে আকরিক। মেরি লম্বা কাঠি দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে নেড়ে যাচ্ছেন। সংগ্রহ হচ্ছে খানিকটা তেজস্ক্রিয় উপাদান। আবার তাকে নিখাদ করা হচ্ছে আরও জ্বাল করে। চার বছর চলল এই পিচব্লেন্ড শোধন করা। ক্রমে ক্রমে আরও তেজি, আরও জোরালো তেজস্ক্রিয় উপাদান পৃথক করা। একনাগাড়ে চার বছরের পরিশ্রমের পর প্রায় ৩০ মণ পিচব্লেন্ড থেকে পাওয়া গেল এক রতিরও কম একরকম বিশুদ্ধ সাদা গুঁড়া। এই সেই দুর্লভ বস্তু—রেডিয়াম। এর জোরালো বিকিরণে যে কাচের পাত্রে একে রাখা হয়েছিল, সেটা অন্ধকারে জ্বলজ্বল করে জ্বলতে লাগল।’

১৯০৩ সালে পিয়েরে ও বেকেরেলের সঙ্গে যৌথভাবে ইউরেনিয়াম নিয়ে গবেষণার জন্য এবং ১৯১১ সালে পোলোনিয়াম ও রেডিয়াম আবিষ্কারের জন্য এককভাবে নোবেল পুরস্কার পেলেন মেরি কুরি।

লেখক : অধ্যাপক তড়িকৌশল ও ইলেকট্রনিকস বিভাগ, বুয়েট।