কল্পগল্প থেকে বিজ্ঞান

আজকের কল্পবিজ্ঞানই আগামী দিনের বাস্তবতা। তেমনি আজকে যেসব প্রযুক্তি পণ্যের সুফল মানুষ ঘরে তুলছে, তারই অনেকগুলোই উঠে এসেছে কল্পবিজ্ঞানের পাতা থেকে। কল্পবিজ্ঞান থেকে বাস্তবে রূপ নেওয়া প্রযুক্তিপণ্যগুলির কথা হয়তো অনেকেই জানি না।

সায়েন্স ফিকশনের সবচেয়ে চমকপ্রদ দিক হলো, এর মাধ্যমে আমরা সেসব ঘটনাও জানতে পারি, যেগুলো ভবিষ্যতে ঘটা সম্ভব, কিন্তু বর্তমানে ঘটছে না! বাক্যটি যে কত বড় সত্য, তা একটু পেছনে তাকালেই বোঝা যায়। বর্তমানের ক্রেডিট কার্ড, ট্যাব, সাবমেরিন, চালকবিহীন গাড়ি, মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বা বাড়িঘর নির্মাণে থ্রি-ডি প্রিন্টারের ব্যবহার, টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থায় জিওসিনক্রোনাস স্যাটেলাইটের ব্যবহার ইত্যাদি অসংখ্য আইডিয়া অনেক আগেই বর্ণিত হয়েছে সায়েন্স ফিকশনের বইগুলোতে বা চলচ্চিত্রে। সুতরাং অল্পস্বল্প বিজ্ঞান কল্পগল্পও দিতে পারে অতিকায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দেখা। সায়েন্স ফিকশনে বিজ্ঞানের বিভিন্ন সূত্রের ওপর ভর করে সাই-ফাই লেখকের কল্পনার জগৎ নির্মিত হয় বলে কল্পনাসমগ্র পরে বাস্তবে রূপ নিয়েছে, নিচ্ছে বা নেবে।

মহাবিশ্বের যেকোনো বস্তুকে ভাঙলে শেষমেশ একই প্রজাতির মৌলিক কণা অর্থাৎ ইলেকট্রন, কোয়ার্ক ইত্যাদি পাওয়া যায়। এসব মৌলিক কণার বিভিন্ন বিন্যাসের মাধ্যমে তৈরি হয় ভিন্ন ভিন্ন বস্তু। খাদ্যদ্রব্য থেকে শুরু করে পোশাক-আশাক, ঘরবাড়ির ইট-বালু-সিমেন্ট, চেয়ার-টেবিল সবকিছুই একই মৌলিক কণার সম্মিলনে তৈরি! এ ধারণাকে প্রথম টেলিভিশন পর্দায় তুলে আনে বিখ্যাত চলচ্চিত্র স্টার ট্রেক। সিনেমাটিতে দেখানো হয় রেপ্লিকেটর নামের একটি যন্ত্র। সেটা কমান্ড শুনে তৈরি করে দিতে পারে যেকোনো খাদ্যবস্তু। শুধু খাদ্যবস্তু কেন, যেকোনো বস্তুই তৈরি সম্ভব এই উপায়ে। সিনেমাটি মুক্তির পর মৌলিক কণা দিয়ে বস্তু তৈরি বাস্তবজগতে এখনো সম্ভব না হলেও ইতিমধ্যে সম্ভব হয়েছে নির্দিষ্ট উপকরণ দিয়ে বিভিন্ন বস্তু তৈরি। আর যে যন্ত্র এ কাজ করছে, তার নাম থ্রি-ডি প্রিন্টার। থ্রি-ডি প্রিন্টার দিয়ে শুধু খাদ্যদ্রব্য বা নানা কলকব্জা তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে, তা-ই নয়, এর মাধ্যমে প্রিন্ট করে তৈরি করা হচ্ছে কৃত্রিম অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। সেগুলো মানুষের দেহে প্রতিস্থাপনও করা হচ্ছে। বিস্মিত হওয়ার মতো আরও খবর হচ্ছে, এই থ্রি-ডি প্রিন্টারের মাধ্যমে ইতিমধ্যে প্রিন্ট করে নির্মাণ করা হয়েছে বাসস্থানের বাড়ি। মাত্র চার হাজার ডলার ব্যয়ে প্রিন্ট কমান্ড দিয়ে আপনিও পেয়ে যেতে পারেন আপনার স্বপ্নের বাড়ি! বানানো যেতে পারে গাড়ির কাঠামোও।

১৮৮৮ সালে একটি সায়েন্স ফিকশন বই লিখে বিশ্বজুড়ে হইচই ফেলে দেন এডওয়ার্ড বেলামি। প্রকাশের পরপরই বেস্টসেলার তালিকায় তিন নম্বরে চলে আসে সেই গ্রন্থ। বইটির নাম লুকিং ব্যাকওয়ার্ড। বইয়ের কাহিনিতে বর্ণিত কল্পলোকের নাগরিকরা ব্যবহার করেন ইউনিভার্সাল ক্রেডিট কার্ড। তারা কাগুজে নোটের বদলে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে সাধ-আহ্লাদ মেটান। সেই ক্রেডিট কার্ডের সাহায্যে মূলত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্রেডিট খরচের মাধ্যমে কেনাকাটা সম্ভব হয়। বুঝতেই পারছেন, একালের ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড, এটিএম কার্ড—সবই সেই কল্পনার বাস্তবায়ন। বর্তমানে ডায়মন্ডের দুল থেকে শুরু করে দাঁত মাজার গুল, যা-ই কিনি না কেন, বিল পরিশোধে এসব কার্ড আমাদের নিত্যসঙ্গী।

ফরাসি ঔপন্যাসিক, কবি, নাট্যকার জুল ভার্ন একজন। তাঁর অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাসগুলো শুধু আনন্দের খোরাক নয়, তথ্য ও প্রযুক্তির উত্স। তাঁর অন্তত দুই হালি কল্পনা এখন আমরা বাস্তবে বড় আবিষ্কার হিসেবে দেখতে পাই। সেসবের মধ্যে অন্যতম সাবমেরিন বা ডুবোজাহাজ। ১৮৭০ সালে প্রকাশিত হয় জুল ভার্নের বিখ্যাত গ্রন্থ টোয়েন্টি থাউজেন্ড লিগস আন্ডার দ্য সি। বইটিতে তিনি বিদ্যুচ্চালিত সাবমেরিনের বর্ণনা দিয়েছেন। বইতে দেখা যায়, রহস্যময় চরিত্র ক্যাপ্টেন নিমো তার অসাধারণ বুদ্ধিমত্তায় তৈরি করেন নটিলাস নামের সাবমেরিন। সেই সময় অনেক বিজ্ঞানীই সাবমেরিন তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছিলেন, কিন্তু জুল ভার্নের বইতে সেটির কারিগরি ও কাঠামোগত যে বর্ণনা দেওয়া হয়, তা সবার কল্পনাকে ছাড়িয়ে যায়। বইটি সাবমেরিন তৈরির গবেষণায় মত্ত বিজ্ঞানীদের তাড়নায় স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দেয়। বইয়ের সেই সাবমেরিন অনুপ্ররণা জোগায় আমেরিকান যন্ত্রপ্রকৌশলী ও নৌবাহিনীর স্থপতি সাইমন লেককে। পরবর্তীকালে নিরলস গবেষণার ফলে ১৮৯৮ সালে সর্বপ্রথম উন্মুক্ত সাগরবুকে চলাচল শুরু করে তাঁর গবেষণালব্ধ সাবমেরিন, যার নাম আর্গোনট।

পৃথিবীখ্যাত কল্পবিজ্ঞান লেখক হিসেবে আর্থার সি ক্লার্কের নাম আমরা জানি। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইংল্যান্ডের রয়েল এয়ার ফোর্সে রাডার বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ শুরু করেন। সে সময়ই তার মাথায় অবিস্মরণীয় একটি আইডিয়া খেলে যায়। তিনি কল্পনা করেন, চাঁদের মতো কোনো উপগ্রহ যদি প্রতিফলক হিসেবে ব্যবহার করা যায়, তাহলে বেতার তরঙ্গের মাধ্যমে সহজেই পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তের মানুষ একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবে। প্রাকৃতিক উপগ্রহ চাঁদ পৃথিবী থেকে বেশি দূরে বলে তিনি কৃত্রিম যোগাযোগ উপগ্রহ বা আর্টিফিশিয়াল কমিউনিকেশন স্যাটেলাইটের কথা চিন্তা করেন। সেই সঙ্গে স্যাটেলাইট বসানোর জন্য ভূ-ত্বক থেকে প্রায় ২২ হাজার ২৩৬ মাইল বা ৩৫ হাজার ৭৮৬ কিলোমিটার উচ্চতায় অবস্থিত জিওস্টেশনারি বা জিওসিনক্রোনাস অরবিটের কথা ভাবেন। প্রতিটি স্যাটেলাইট ১২০ ডিগ্রি করে কভার করলে ৩৬০ ডিগ্রির পুরো পৃথিবী কভার করতে দরকার তিনটি স্যাটেলাইট—এ ভাবনাও তাঁর। বর্তমানের টেলিযোগাযোগব্যবস্থা দাঁড়িয়ে রয়েছে এই কল্পবিজ্ঞান লেখকের অসাধারণ কল্পনাশক্তির ওপর। রেডিও বা টেলিভিশনের স্যাটেলাইট ব্রডকাস্টিং সম্ভব হচ্ছে এই ব্যবস্থায়। এই সাই-ফাই লেখকের ভবিষ্যদ্বাণীর অনেকগুলোই ইতিমধ্যে বাস্তবে রূপ নিয়েছে। তাঁর প্রাপ্য সম্মান পৃথিবীবাসী দিতে পেরেছে কি না বলা মুশকিল; তবে জিওসিনক্রোনাস অরবিটের নামকরণ করা হয়েছে ‘ক্লার্ক অরবিট’। ভবিষ্যতে যখন অন্য গ্রহে ভ্রমণ করা মানুষের অন্যতম শখ হবে, তখন ক্লার্ক অরবিট আরও পরিচিত হয়ে উঠবে আশা করি।

দ্য গ্র্যান্ড মাস্টার অব সায়েন্স ফিকশন রাশিয়ান বংশোদ্ভূত আমেরিকান সাই-ফাই লেখক আইজ্যাক আসিমভের কথা আমরা সবাই জানি। তাঁরও অনেক কল্পনা পরবর্তী সময়ে সত্যি হয়েছে। তিনি গত শতকের ষাটের দশকেই ধারণা দেন সামনের ৫০ বছরের সম্ভাব্য আবিষ্কার সম্পর্কে। সেগুলোর মধ্যে ছিল চালকবিহীন গাড়ি। আসিমভের ভাষ্যমতে, রোবট ব্রেইন অর্থাৎ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের সাহায্যে মানুষ ছাড়াই চলবে গাড়িগুলো। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে গুগল, অ্যাপল, টেসলা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে এ ধরনের চালকবিহীন গাড়ি নির্মাণ করেছে। সেদিন বেশি দূরে নেই, যখন রাস্তায় মানুষচালিত গাড়ি পাওয়াই মুশকিল হবে! আসিমভের অনন্যসাধারণ অবদানের জন্য তাঁর জন্মদিন ২ জানুয়ারিতে পালিত হয় ‘সায়েন্স ফিকশন দিবস’। যাঁরা ভবিষ্যতে মহাশূন্য ভ্রমণে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছেন, তাঁরা হয়তো পথিমধ্যে ‌৫০২০ আসিমভ গ্রহাণুর দেখা পাবেন। সেই মহাশূন্য ভ্রমণের জন্য আগাম শুভকামনা রইল।

লেখক: কল্পবিজ্ঞান লেখক