কিছু মানুষ নীরবে কাজ করেন, লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকতে ভালোবাসেন। সময়ের আবর্তে তাঁরা নীরবেই চলে যান। শুধু থেকে যায় তাঁদের কাজগুলো। কাজের স্বীকৃতি হয়তো পরে মেলে, প্রজন্মের পর প্রজন্মের কাজে আসে। তবে নীরবে থাকা সেই মানুষটি আড়ালেই রয়ে যান। তেমনি একজন মানুষ হচ্ছেন বাংলাদেশের ভূ-বিজ্ঞানী এম এ জাহের। দেশের খনিজসম্পদ অনুসন্ধানে বিজ্ঞানী এম এ জাহেরের রয়েছে বিশেষ অবদান। প্রায় ৩০ বছরের বেশি সময় নিয়ে তিনি বাংলাদেশের ভূবৈজ্ঞানিক লগ তৈরি এবং বিশ্লেষণ করে ভূ-অভ্যন্তরের কাঠামো, শিলার গঠন এবং খনিজ সম্পদের বিবরণ তৈরিতে কাজ করেছেন।
তিনি খুলনার কোলামৌজায় প্রথম পিট কয়লা ও জয়পুরহাটের জামালগঞ্জে মাটির গভীরে চুনাপাথর আবিষ্কার করেন। তিনিই দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র বিজ্ঞানী, যাঁর নামে একটি খনিজ আকরিকের নামকরণ করা হয়েছে। আকরিকটির নাম জাহেরাইট।
জাহেরাইটের সাংকেতিক নাম হাইড্রাইট অ্যালুমিনিয়াম সালফেট। এর রাসায়নিক সংকেত Al12 (SO4)5(OH)26+20H2O আরও নির্দিষ্ট করে বললে জাহেরাইট আসলে খনিজ পদার্থের একটি আকরিক। দেখতে সাদা কিংবা হলুদ-নীলাভ-সবুজ রঙের এই আকরিক পাওয়া যায় পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের লবণ-অধ্যুষিত (সল্ট রেঞ্জ) পাহাড়ি এলাকায়। আর পাওয়া যায় দক্ষিণ আফ্রিকার উত্তরে কেপ প্রদেশের পুফাডের শহর থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে।
মোটামুটি বিশুদ্ধ জাহেরাইট পাওয়া যায় অত্যন্ত ঘন ও শস্যের দানার মতো আকারে। এক পাশ থেকে দেখলে এর ফাটল বা চিড় (ক্লিভেজ) স্পষ্ট দেখা যায় ইলেকট্রন মাইক্রোগ্রাফসের চিত্রে। জাহেরাইট আকরিকটির সাদা ও মুক্তার মতো দীপ্তি আছে। গ্যাস পাইক্যারোমিটারে এর ঘনত্ব ২.০০৭।
আকরিকটি তীব্র সক্রিয়। এটা আলফা থেকে গামা অ্যালুমিনাতে রূপান্তরিত হয় ৯০০ থেকে ১০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়।
জাহেরাইটের রাসায়নিক বিশ্লেষণ করে দেখা যায় এতে ৩৭.৭৯ ভাগ অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইড, ৩৬.৫৫ ভাগ পানি, ২৪.৮৭ ভাগ সালফার ডাই-অক্সাইড ও অন্যান্য পদার্থ আছে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক খনিজ পদার্থ কেনাবেচার কয়েকটি অনলাইন প্ল্যাটফর্মে জাহেরাইট আকরিক কিনতেও পাওয়া যায়।
জাহেরাইট খনিজ পদার্থ হলেও এটি আসলে একটি আকরিক। সহজ ভাষায় ব্যাপারটা হচ্ছে সব আকরিকই খনিজ, তবে সব খনিজই আকরিক নয়। তাই জেনে নেওয়া যাক, খনিজ পদার্থ ও আকরিকের পার্থক্যটা কোথায়। ভূ-গর্ভে বা ভূ-পৃষ্ঠে কোনো শিলাস্তূপে প্রচুর পরিমাণে যৌগ অথবা মুক্ত মৌল হিসেবে মূল্যবান ধাতু বা অধাতুর খনিজ পাওয়া যায়। ধাতু নিষ্কাশনের সাহায্যে এর মধ্যে যেসব খনিজ পদার্থ থেকে লাভজনকভাবে ধাতু আহরণ করা যায়, সেগুলোকে আকরিক বলে। আকরিকের সুবিধাটা হচ্ছে এটা থেকে মূল্যবান ধাতু বের করে ব্যবহারিক কাজে লাগানো যায়।
জাহেরাইটের আবিষ্কারক বিজ্ঞানী এম এ জাহেরের জন্ম ১ ডিসেম্বর ১৯৩৫ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। বাঞ্ছারামপুর উজানচর কে এন হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক ও চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক শেষে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
এম এ জাহেরের কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৫৯ সালে জিওলজিক্যাল সার্ভে অব পাকিস্তানে (বর্তমানে বাংলাদেশ ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর) সহকারী পরিচালক হিসেবে। এই প্রতিষ্ঠানে থেকেই দেশ ও দেশের বাইরে ৩৩ বছর কাজ করেছেন। লিখেছেন ২১টি ভূ-বিজ্ঞানবিষয়ক গবেষণা নিবন্ধ।
১৯৬৮ সালে বিজ্ঞানী জাহের যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার জন্য গিয়েছিলেন। গবেষণার অংশ হিসেবে চলে আসেন পাকিস্তানে। পাঞ্জাবের কাদামাটি নিয়ে গবেষণা করতে গিয়েই এক নতুন আকরিক আবিষ্কার করেন।
আন্তর্জাতিক কয়েকটি গবেষণাগারের মতামতের ভিত্তিতে আট বছর পরে তাঁর এই আবিষ্কার স্বীকৃতি দেয় আন্তর্জাতিক মিনারেলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (আইএমআই)। এম এ জাহেরের নামের সঙ্গে মিল রেখে আইএমআই ওই খনিজটির নাম রাখে জাহেরাইট।
আইএমআই কর্তৃপক্ষ বিজ্ঞানচিন্তাকে জানিয়েছে, বিজ্ঞানী জাহের হচ্ছেন প্রথম বাংলাদেশি, যাঁর নামে কোনো আকরিকের নামকরণ হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র ব্যক্তি, যিনি একটি খনিজ পদার্থ আবিষ্কার করেছেন। ই-মেইলে যোগাযোগ করা হলে আইএমআই প্রেসিডেন্ট ও যুক্তরাষ্ট্রের নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পিটার সি বার্ন্স বলেন, ‘পাকিস্তানের পাঞ্জাবের লবণ-অধ্যুষিত এলাকায় কাদামাটি নিয়ে অনুসন্ধানের সময় এম এ জাহের এক্স-রে পাউডার ডিফ্র্যাকশন ডেটা পরীক্ষা করে নতুন একটি হাইড্রাইড অ্যালুমিনিয়াম সিলিকেট বা অক্সাইড আবিষ্কার করেন।’
এম এ জাহের ১৯৬২ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত ইউএন-পাক মিনারেল সার্ভেতে গন্ডোয়ানা কয়লা অনুসন্ধানের সার্বিক দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। এই বিজ্ঞানী ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের কারিগরি ও কৌশলগতভাবে সহায়তা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন দলকে দূরবীক্ষণ যন্ত্র, ঢাকা ও আশপাশের এলাকার মানচিত্র (লার্জ স্কেল ম্যাপ) সরবরাহ করেছিলেন এবং ম্যাপ রিডিং শিখিয়েছিলেন।
দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৯ সালে পোল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ইউনাইটেড নেশন সিম্পোজিয়াম অন ওয়ার্ল্ড কোল প্রসপেক্টে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জাহের প্রতিনিধিত্ব করেন। এ ছাড়া ১৯৯২ সালে জাপানের কিয়োটো নগরীতে আন্তর্জাতিক ভূ-তাত্ত্বিক কংগ্রেসে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে অংশ নেন।
চাকরিজীবনে তাঁর অভিজ্ঞতা আরও ভারী হতে থাকে। জাহের পরে বাংলাদেশ ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তরে কাজ করে মহাপরিচালক হন। সেখান থেকে তিনি ১৯৯২ সালে অবসর নেন। বিজ্ঞানের মৌলিক অবদানের জন্য বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় ১৯৯৩ ও ১৯৯৪ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়ার জন্য এম এ জাহেরের নাম সুপারিশ করেছিল। কিন্তু তিনি এই পদক পাননি। তবে ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠান স্বাধীনতা পদক পেয়েছিল।
নিভৃতে থাকা এই মানুষটি অবসরের পর একেবারেই গুটিয়ে নেন নিজেকে। পরিবারকে সময় দিতেন আর মাঝেমধ্যে নিজ কর্মস্থলে ঘুরে আসতেন। বয়সের ভারে মানুষটি ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যেতে থাকেন।
প্রথমে ছানি পড়ে দুটো চোখ হারান, তারপর দেখা দেয় নানা শারীরিক জটিলতা। একেবারেই অসুস্থ হয়ে পড়েন ২০১৭ সালের মে মাসে। চার মাস কোমায় থাকার পর ওই বছর ২৮ আগস্ট মালিবাগের গুলবাগের বাসায় মারা যান এম এ জাহের।
নীরবেই চলে গেলেন এই ভূ-বিজ্ঞানী। আশা এটুকুই, যত দিন এই পৃথিবীতে জাহেরাইট আকরিক পাওয়া যাবে, এ নিয়ে কোনো গবেষণা বা কাজ হবে, তত দিন কেউ না কেউ হয়তো আগ্রহী হবে কেন এই আকরিকটির নামকরণ করা হলো জাহেরাইট। সাদা-হলুদ-নীলাভ-সবুজ রঙের আকরিকের সঙ্গে সঙ্গে কৌতূহলী কোনো মন জানবে বাংলাদেশি এক বিজ্ঞানীর নাম।
লেখক: সাংবাদিক
সূত্র: আন্তর্জাতিক মিনারেলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন