মধুর রসায়ন

খাবার হিসেবে মধুর একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে, সময়ের সঙ্গে এই বস্তু নষ্ট হয় না বা পচে না। এখন পর্যন্ত পাওয়া সবচেয়ে পুরোনো মধুর নমুনা পাওয়া গেছে মিসরীয় পিরামিডের এক কবরের ভেতর। সেই মধুর বয়স ছিল ৩ হাজার বছর! তারপরও সেই মধু খাওয়ার উপযোগী ছিল। মানুষ মধু সংগ্রহ করছে, এমন একটা গুহাচিত্র পাওয়া গেছে স্পেনের পূর্বাঞ্চলের ভ্যালেন্সিয়ার ‘কুয়েস দে লা আরানা এন বাইকর্প’ গুহার ভেতরে। সেই গুহাচিত্রের বয়স ৮ হাজার বছর!

প্রশ্ন হচ্ছে, মধুর এই অবিশ্বাস্য ধর্মের কারণ কী? প্রশ্নটার উত্তর জানতে হলে আমাদের আগে জানতে হবে আসলে মৌমাছি মধু বানায় কী করে। মধুর আসল উৎস হচ্ছে ফুলের মধ্যে। ফুলের ভেতরে যে মিষ্টি পদার্থ থাকে, তাতে নানা রকম চিনি, প্রোটিন ও অন্যান্য যৌগিক পদার্থ পানিতে দ্রবীভূত অবস্থায় থাকে। এই মিষ্টি পদার্থই হলো মধু। রাসায়নিক মিশ্রণ ও গঠনভেদে বিভিন্ন ফুলের মধুতে পার্থক্য থাকে। বিভিন্ন ফুলের মধুতে পার্থক্য থাকলে কিছু রাসায়নিক পদার্থ মোটামুটি একই থাকে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে সুক্রোজ। সুক্রোজ (SUCROSE) কিন্তু আমাদের টেবিলে যে চিনিটা আছে, সেটাই। একটা মৌমাছি বিভিন্ন ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে। তাই মৌচাকে জমা হওয়া মধুর স্বাদ যেকোনো একটা ফুলের মধুর মতো হবে না। তবে মৌমাছি সবচেয়ে বেশি মধু যে ফুল থেকে সংগ্রহ করে, মধুতে সেই স্বাদই পাওয়া যায়।

ফুলের ভেতরের মধু আর আমরা যে মধু খাচ্ছি, তার মাঝখানের ধাপটায় মৌমাছির ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কর্মী মৌমাছি ফুল থেকে ফুলে মধু সংগ্রহ করে জমা করে নিজের শরীরের ভেতরে মধু রাখার জন্যে বিশেষ পাকস্থলীতে। এই পাকস্থলীর সঙ্গে মৌমাছির সাধারণ পাকস্থলীর কোনো মিল নেই। মধুর পাকস্থলীতে মধু ঢোকামাত্র নানা রকম এনজাইমের ক্ষরণ শুরু হয়। এসব এনজাইম মধুর সুক্রোজকে ভাঙা শুরু করে সাধারণ চিনিতে রূপান্তর করে। সুক্রোজ হচ্ছে একধরনের ডাই–স্যাকারাইড, এটি তৈরি হয় খুব সাধারণ গ্লুকোজ এবং ফ্রুক্টোজের মিশ্রণে। কর্মী মৌমাছির পাকস্থলীর অভ্যন্তরের এনজাইম সুক্রোজ মলিকিউলসকে ধীরে ধীরে গ্লুকোজ আর সুক্রোজে আলাদা করে ফেলে।

গ্লুকোজ (GLUCOSE) ও ফ্রুক্টোজকে (FRUCTOSE) আবার ডেক্সট্রোজ ও লেভুলোজ হিসেবেও ডাকা হয়। কারণ হচ্ছে, এরা গঠনগতভাবে আইসোমার, মানে একই রাসায়নিক ফর্মুলায় তৈরি। ডেক্সট্রোজ ও লেভুলোজ নাম দেওয়া হয়েছে প্লেন-পোলারাইজড আলোয় আণবিক গঠনের বিন্যাসের কারণে ডেক্সট্রোজ ডানে ঘুরে যায় আর লেভুলোজ ঘোরে বাঁয়ে। এই ডেক্সট্রো ও লেভু এসেছে মূলত ল্যাটিন ভাষার ডান ও বাঁ থেকে।

কর্মী মৌমাছি মধু নিয়ে এসে চাকের ভেতর ক্ষুদ্র ছয় কোনা প্রকোষ্ঠে উগরে দেয়, ওখানে থাকা গৃহী মৌমাছির কাছে। এই গৃহী মৌমাছি মৌচাকের ভেতরেই থাকে। গৃহী মৌমাছিরা কর্মী মৌমাছির উগরে দেওয়া মধু আবার মিনিট বিশেকের মধ্যে খেয়ে ফেলে। গৃহী মৌমাছির পাকস্থলীতে গিয়ে সেই মধু আবার এনজাইম দিয়ে নতুন করে ভাঙা শুরু করে। এই ভাঙনপ্রক্রিয়ায় শেষমেশ খুব সামান্যই সুক্রোজ থাকে, বেশির ভাগই হয়ে যায় গ্লুকোজ আর ফ্রুক্টোজ।

ভাঙনের এই প্রক্রিয়া ঠিকঠাক হয়ে গেলে গৃহী মৌমাছি খুব যত্ন করে মৌচাকের ছয় কোণবিশিষ্ট খোপের মধ্যে মধু উগরে জমা করে। এরপরের কাজটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, যে মধু জমা হয়েছে তার ৭০ শতাংশ হচ্ছে পানি। এই পানিকে বাষ্পীভূত করতেই হবে, না হলে মধুর মূল ঘনত্বটা আসবে না। কাজটা মৌমাছিরা করে ক্রমাগত তাদের পাখা ঝাপটিয়ে। এটা করতে হয় দ্রুতগতিতে, যাতে জলের বাষ্পীভবন প্রক্রিয়া খুব দ্রুত ঘটে। ৭০ শতাংশ পানি নেমে আসে ১৭ শতাংশে! কাজটা করতে হয় টানা ১ থেকে ৩ দিন!

মধুতে পানির পরিমাণেই লুকিয়ে আছে মধুর দীর্ঘ সময় ঠিকঠাক থাকার ক্ষমতা। ১৭ শতাংশ পানি ব্যাকটেরিয়া বা ফাঙ্গাসের বংশবৃদ্ধির জন্য খুবই কম। পানির যদি একটা স্কেল করা হয়—ধরা যাক, ১ থেকে ৫ সেই স্কেলের সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ মান, সেই স্কেলে ০.৭৫–এর নিচে ফাঙ্গাস বা ব্যাকটেরিয়া জন্মাতে বা বংশবৃদ্ধি করতে পারে না। সেই একই স্কেলে মধুতে পানির পরিমাণ হচ্ছে ০.৬। তাই ব্যাকটেরিয়া জলশূন্য হয়ে টিকতে পারে না, যদি মধু বায়ুরোধী বোতল বা বয়ামে রাখা হয়।

আরেকটা কারণে মধু নষ্ট হয় না। তা হচ্ছে এর অম্লত্ব বা অ্যাসিডিটি। মধুর গড় pH (নেগেটিভ লগারিদম অব হাইড্রোজেন আয়ন কনসেন্ট্রেশন) ৪–এর কাছাকাছি। মধুর এই অম্লত্ব বা অ্যাসিডিটি বেশ কয়েকটা অ্যাসিডের কারণে হয়। এর মধ্যে আছে সাইট্রিক অ্যাসিড, ফরমিক অ্যাসিড। তবে বেশি থাকে গ্লুকোনিক অ্যাসিড। এই গ্লুকোনিক অ্যাসিড তৈরি হয় মৌমাছির পাকস্থলীর কিছু এনজাইমের মধুর গ্লুকোজের ওপর সরাসরি সক্রিয় বিক্রিয়ার কারণে। এসব অ্যাসিড অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল হিসেবে কাজ করে। গ্লুকোনিক অ্যাসিড থেকে আবার হাইড্রোজেন পার–অক্সাইডও তৈরি হয়। এই জিনিসও ব্যাকটেরিয়ার বংশবৃদ্ধি দমন করে। মধুর এই অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল ধর্মের কারণে একে খুব সহজেই শরীরের ক্ষতস্থান ড্রেসিং বা পরিষ্কার করার কাজে ব্যবহার করা যায়।

কখনো মধুতে চিনির দানার মতো স্ফটিক তৈরি হয় কিংবা শক্ত হয়ে যায়। এর কারণ এতে পানির মাত্রা এত কম যে একে আলাদাভাবে নানা রকম চিনির অতিসম্পৃক্ত দ্রবণ বলা যায়। সময়ে গ্লুকোজ থিতু হয়ে আলাদা স্ফটিক তৈরি করে। তখনো কিন্তু এই মধু খাওয়ার উপযুক্ত থাকে। মধু যে বয়ামে আছে, শুধু সে বয়ামটিকে গরম পানির ওপর কিছুক্ষণ বসিয়ে রাখলেই সব ঠিক!