মহাজাগতিক রশ্মি ও ভি কণা
১৯৪৬ সাল। দুই ব্রিটিশ পদার্থবিদ জর্জ রচেস্টার ও ক্লিফোর্ড বাটলার মহাজাগতিক রশ্মি নিয়ে কাজ করছিলেন। ক্লাউড চেম্বার থেকে তোলা ফটোগ্রাফিক প্লেটে অনেকগুলো কণার পথরেখা দেখতে পান তাঁরা। এগুলোর মধ্যে একটা রেখা একদম আলাদা। কণাদের পথরেখা সর্পিল আকার হয়, নইলে বৃত্তচাপের মতো। গতিশক্তি বেশি হলে, পথরেখা সোজা হয়। কিন্তু রচেস্টার আর বাটলারের অদ্ভুত সেই রেখাটা ছিল ইংরেজি বর্ণ V-এর মতো। এমন তো হওয়ার কথা নয়! এটা আবার কী ধরনের কণা? দুই বিজ্ঞানী অদ্ভুত কণাটির ভর ও বৈশিষ্ট্য কেমন হওয়া উচিত, সেটা অনুমানের চেষ্টা করলেন। হিসাব করে দেখলেন, কণাটির ভর ৪৯৪ মেগা ইলেকট্রন ভোল্ট। কিন্তু কণাটির গতিপথ এমন কেন?
দুই বিজ্ঞানী তারও একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করালেন, কণাটি ক্লাউড চেম্বারের ভেতর আসার পর ভেঙে দুটো কণায় পরিণত হয়। ভাঙন বিন্দু থেকে দুদিকে দুটো কণার ছুটে যাওয়া এবং সে দুটোর মধ্যবর্তী কোণ এমন, যে V আকৃতির গতিপথ তৈরি হয়। কিন্তু রচেস্টার-বাটলারদের অনুমান যে ঠিক, সেটা প্রমাণ করতে হলে আরও কিছু নমুনা পাওয়া দরকার। কিন্তু সেটাই হচ্ছিল না। অনেকদিন পর্যন্ত আর কোনো ছবি পাওয়া যায়নি। অবশেষে এক বছর পর আবার দৃশ্যপটে হাজির সেই সেসিল পাওয়েল, যিঁনি পায়ন আবিষ্কার করে খ্যাতি পেয়েছিলেন। পাওয়েল এ ধরনের ছবি অনেকগুলো পেলেন। তিনি এই কণার নাম দিলেন কে-মেসন বা কেয়ন। পাওয়েল দেখালেন, কেয়ন ভেঙে দুটি পায়নে পরিণত হয়। এই কেয়ন ছিল চার্জ নিরপেক্ষ। কিছুদিন পর ধনাত্মক ও ঋণাত্মক চার্জের কেয়ন পাওয়া গেল। ধনাত্মক কেয়ন ভেঙে তিনটি পায়ন তৈরি করে। ধনাত্মক কেয়ন ভেঙে দুটি ধনাত্মক পায়ন আর একটি ঋণাত্মক পায়ন তৈরি করে। তেমনি একটি ঋণাত্মক কেয়ন ভেঙে দুটি ঋণাত্মক পায়ন আর একটি ধনাত্মক পায়ন তৈরি হয়। আসলে এভাবেই কেয়নদের ভাঙতে হতো, নইলে চার্জের সংরক্ষণশীলতা বজায় থাকে না। ধনাত্মক আর ঋণাত্মক কেয়নের ভর পর পাওয়া গেল ৪৯৩.৬৬৭ ইলেকট্রন।
এ পর্যন্ত ঠিক ছিল। সব কণাগুলোই ছিল প্রোটন আর নিউট্রনের চেয়ে হালকা। তাই বিজ্ঞানীদের মনে অন্য ভাবনা আসেনি। কিন্তু ১৯৪৭ সালে নতুন এক ধরনের কণা আবিষ্কার হলো, যেগুলো প্রোটনের চেয়ে ভারী। এগুলো নিয়ে ঝামেলায় পড়ে গেলেন বিজ্ঞানীরা। কারণ এগুলো পাওয়া গিয়েছিল মহাজাগতিক রশ্মিতে। কিন্তু মহাজাগতিক রশ্মিতে তো আর কণারা এমনি এমনি আসে না। সেগুলো পরমাণুর ভেতরে জন্ম হয়, তারপর নানা ভাঙন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মহাজাগতিক রশ্মিতে হাজির হয়।
প্রোটন আর নিউট্রনের চেয়ে ভারি কণার জন্ম কীভাবে হয়, সেটা বড় ধাঁধায় পরিণত হয়। তখন পর্যন্ত নিউট্রন-প্রোটনকে মৌলিক কণাই মনে করতেন বিজ্ঞানীরা। তাই এর চেয়ে হালকা কণাদের নিয়ে ঝামেলা ছিল না। ভারি কণা ভেঙে আরও ছোট কণা তৈরি হতেই পারে। কিন্তু তুলনামূলক হালকা কণা ভেঙে কখনো আরও ভারী কণা পাওয়া অসম্ভব। তাই নতুন ভারী কণাগুলো ভাবিয়ে তুলল বিজ্ঞানীদের। ১৯৪৭-এর পর অনেকগুলো ভারী কণা আবিষ্কার হলো। বিজ্ঞানীরা সেগুলোর নামকরণ করলেন হাইপেরন। কিন্তু এর একটা ব্যাখ্যা দরকার, এরা কোথায় থাকে? তখন বিজ্ঞানীরা আবার দারস্থ হন আইসোস্পিনের, যেটার প্রবক্তা ইউজিন উইগনার। অবশ্য এর গোড়াপত্তন করেন হাইজেনবার্গ। হাইজেনবার্গ বলেছিলেন, বৈদ্যুতিক চার্জকে যদি বাদ দেওয়া হয়, তাহলে নিউট্রন আর প্রোটনের মধ্যে কোনো পাথর্ক্যই নেই। দুটি ভিন্ন দশায় থাকা একই কণা এরা। অন্যদিকে উইগনার বলেছিলেন, এগুলো আসলে একই স্পিন দশায় থাকা ভিন্ন চার্জের দুটি কণা। তাই এদের একই গোত্রে ফেলার জন্য নাম দেওয়া হলো আইসোস্পিন কণা। অর্থাৎ, এমনিতে এসব কণাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই, এদের যদি আলাদা করতে হয়, তাহলে সেটা হবে স্পিনের কারণে। ১৯৩৮ সালে হাঙ্গেরিয়ান-মার্কিন বিজ্ঞানী জন কেমার বলেছিলেন, পায়নদের মধ্যেও ঘটে একই ঘটনা। তিন ধরনের পায়ন আসলে একই। কিন্তু স্পিন দশা আলাদা বলে এদের মধ্যে পার্থক্য দেখা যায়।
আইসোস্পিনের মাধ্যমে কণাদের মধ্যে একটা সংরক্ষণশীলতা আরোপ করার চেষ্টা করেছিলেন বিজ্ঞানীরা। এর কারণ, কাতারে-কাতারে ভারী কণা আবিষ্কার হচ্ছিল। প্রতিটার ধর্ম-বৈশিষ্ট্যকে আলাদা করে লিখতে হলে, মহাভারত লিখতে বসতে হবে। তারচেয়ে এদেরকে একটা গোষ্ঠীতে ফেলে, এদের সাধারণ ধর্ম মনে রেখে সহজেই লিখে ফেলা যায় এদের চরিত্রের ব্যাখা। এই ধারাতেই অনেকগুলো কণা হ্যাড্রন কণা পরপর আবিষ্কৃত হলো। এদের মধ্যে রয়েছে ওমেগা মাইনাস, ওমেগা প্লাস, ইটা মেসন ইত্যাদি কণা।
দুই
কণাপদার্থবিজ্ঞানে কণাদের যে গোষ্ঠী, তাতে একটা ভূমিকা রয়েছে লেপটনদের। লেপটন হলো মূল কণাদের পরিবার। ইলেকট্রন, মিউয়ন, নিউট্রিনো আর এর এদের প্রতি-কণারা এই পরিবারের সদস্য। লেপটনের যে নীতি, তাতে এই কণাদের ভর খুব সামান্য হওয়া উচিৎ, তেমনি এরা নিজেরা মূল কণা। অর্থাৎ একাধিক মূল কণিকা দিয়ে এরা তৈরি নয়। কিন্তু ১৯৭৫ সালে মার্কিন পদার্থবিদ মার্টিন পার্ল এক ধরনের কণা পেলেন সাইক্লোট্রনে, কণাদের সংঘর্ষ ঘটিয়ে। নাম দিলেন টাউ লেপটন। তিনি মূল সংঘর্ষের জায়গায় এই কণাটিকে পাননি। পেয়েছিলেন জঞ্জাল জমা হয় যে অঞ্চলে, সেখানে। কণাটা তাঁকে অবাক করে। কারণ এর ভর সাড়ে তিন হাজারের ইলেকট্রনের সমান। যা নিউট্রন আর প্রোটনের ভরের প্রায় দ্বিগুন। তবুও এ কণাটাকে লেপটন বললেন? কারণ নিশ্চয়ই আছে!
এর চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য অনেকটাই ইলেকট্রনের কাছাকাছি। সত্যি বলতে কি, ভর ছাড়া আর কিছুতেই ইলেকট্রন আর নিউট্রনের সঙ্গে এই কণার পার্থক্য করা মুশকিল। অর্থাৎ এর চার্জ -১ এবং স্পিন ১/২ এবং এরা মূল কণিকা। অন্যসব হ্যাড্রন কিংবা ব্যারিয়ন ভেঙে যেমন কোয়ার্কের সন্ধান পাওয়া যায়, টাউ লেপটনে তা পাওয়া যায় না। অনেক পরে কোয়ার্ক শনাক্তের পরও দেখা গেল, এই কণা অন্য কণা দিয়ে তৈরি নয়। পরে সেই কণাটার নাম হয় টাউয়ন। পার্ল আরও লক্ষ করলেন, এই কণটা খুবই ক্ষণস্থায়ী। জন্মের পরপরই এটা ভেঙে মিউয়নে পরিণত হয়।
প্রকৃতি সরলতা পছন্দ করে। তাই ভারী কণাগুলো সাধারণত ভেঙে একই চার্জের সবচেয়ে ছোট কণায় পরিণত হয়। সেই ধারায় টাউয়নও ভেঙে যায়। জন্মের পরে এক সেকেন্ডের ৫ ট্রিলিয়ন ভাগের এক ভাগ সময়ের মধ্যেই টাউয়ন ভেঙে মিউয়নে পরিণত হয়। মিউয়নও কিন্তু খুব বেশি স্থায়ী নয়। যদিও অন্যসব অস্থায়ী কণাদের চেয়ে বেশি স্থিতিশীল। তবু এক সেকেন্ডের পাঁচ লাখ ভাগের এক ভাগ সময়ের মধ্যেই ভেঙে যায়। মিউয়ন ভেঙে ইলেকট্রনে পরিণত হয়। কিন্তু শুধু ইলেকট্রনে পরিণত হলে ভরেবেগ, স্পিনের সংরক্ষণশীলতা বজায় থাকে না। খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, মিউয়ন ভেঙে একই সঙ্গে একটি ইলেকট্রন আর আর একটি নিউট্রিনো উৎপন্ন হয়।
কিন্তু শুধু একটা নিউট্রিনো উৎপন্ন হলেও স্পিনের সংরক্ষণশীলতায় ঝামেলা দেখা যায়। মিউয়নের স্পিন +১/২ বা -১/২। ইলেকট্রনেরও একই স্পিন। একই নিউট্রিনোরও। সুতরাং মিউয়ন ভেঙে ইলেকট্রন আর প্রতি ইলেকট্রন তৈরি হলে এদের সম্মিলিত স্পিন হবে +১ অথবা ০ অথবা -১। তখন স্পিনের সংরক্ষণশীলতার সন্ধান করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা দেখলেন, শুধু একটা নিউট্রিনো নয়, মিউয়নের ভাঙনে একই সঙ্গে একটি নিউট্রিনো আর একটি প্রতি-নিউট্রিনো তৈরি হয়। সেকালে নিউট্রিনো শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। এটা ছিল খাতা-কলমের হিসাবে। তাই হিসাবটা মিলানো সহজ ছিল না। কারণ একই সঙ্গে নিউট্রিনো প্রতি-নিউনিট্রিনো তৈরি হলে ভাঙন প্রক্রিয়ার হিসাবেই গড়মিল লেগে যাবে। তাই হিসাবটা একটু অন্যভাবে কষলেন বিজ্ঞানীরা। নিশ্চয়ই নিউট্রিনোরা একরকম নয়, এদের মধ্যে পার্থক্য আছে। মিউয়ন ভাঙনের ফলে যে নিউট্রিনো ও প্রতি-নিউট্রিনো তৈরি হচ্ছে, এরা পরস্পরের প্রতি-কণা নয়। অর্থাৎ উৎপন্ন প্রতি-নিউট্রিনোটি অন্য ধরনের নিউট্রিনোর প্রতি-কণা। ১৯৬১ সালে মার্কিন কণাপদার্থবিদ লিও লেডারম্যান একটা পরীক্ষার আয়োজন করে তিন ধরনের নিউট্রিনোর হদিস দেন—ইলেকট্রন নিউট্রিনো, মিউয়ন নিউট্রিনো আর টাউ নিউট্রিনো। এজন্য ১৯৮১ সালে পদার্থবিজ্ঞানে তিনি নোবেল পুরস্কার পান।
সূত্র: ইনসাইড দা অ্যাটম/আইজ্যাক আসিমভ
আধুনিক নিউক্লীয় পদার্থবিজ্ঞান/এ এম হারুন-অর-রশীদ