লিথিয়াম সোনার চেয়ে দামি

মানুষ লিথিয়ামের কথা জানে দুই শ বছর ধরে। তবে এর গুরুত্ব বুঝতে শুরু করছে মাত্র কিছুদিন আগে থেকে—যখন থেকে লিথিয়াম ব্যবহৃত হচ্ছে ব্যাটারি বানাতে। অনেকেই ইতিমধ্যে একে ডাকতে শুরু করেছেন এ যুগের স্বর্ণ বলে।

প্রাচীনকালে কোনো পদার্থের দাম নির্ধারিত হতো তার স্থায়িত্ব দিয়ে। তাই ধাতব পদার্থের দাম ছিল সবচেয়ে বেশি। যে ধাতুগুলো সহজে বাতাস, পানি বা পরিবেশের সঙ্গে বিক্রিয়া করে না, সেগুলোর মূল্যই ছিল সবচেয়ে বেশি। যেমন স্বর্ণ সহজে কারও সঙ্গেই বিক্রিয়া করে না, তাই তা অনেক দামি। অপরদিকে লোহা খুব সহজেই পানি আর অক্সিজেনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে হয়ে যায় মরিচা।

তবে পদার্থের দামের এই ধারণায় পরিবর্তন আসতে শুরু করে শিল্পায়নের সঙ্গে সঙ্গে। বিশ্বজুড়ে যত শিল্পায়ন হয়, ততই বাড়তে থাকে শক্তির চাহিদা। যে পদার্থ শক্তি উত্পাদনে যত বেশি ব্যবহার্য, তার দাম নির্ধারিত হয় তত বেশি। হঠাৎ করেই তাই ধনী হয়ে যায় মধ্যপ্রাচ্য, বিশাল তেলের খনি আবিষ্কার হওয়ায়। শক্তির উত্স হিসেবে চমত্কার হওয়ায় কয়লাকে অনেক আগে থেকেই ডাকা হয় কালো সোনা বলে। অপরদিকে পারমাণবিক শক্তির উত্স ইউরেনিয়াম বা প্লুটোনিয়াম হয়ে ওঠে সবচেয়ে দামি মৌল।

ইতিহাসে নতুন নতুন আবিষ্কার সবকিছু বদলে দেয়। লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির যুগ শুরু হওয়ায় মনে হচ্ছে আরেকটা বড় পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে। এখন অধিকাংশ ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি শক্তি পাচ্ছে এই লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি থেকেই। লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির সাফল্য এত বেশি যে সবাই বুঝতে পারছেন, কিছুদিনের মধ্যে সব ইলেকট্রিক যন্ত্র চালিত হবে লিথিয়াম দিয়ে। এর প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। পৃথিবীপৃষ্ঠে সব জায়গায় লিথিয়ামের ঘনত্ব সমান নয়। ধারণা করা হচ্ছে, আন্দিয়ান/ আমেরিকান দেশগুলোতে আছে লিথিয়ামের বড় ধরনের মজুত। তার মানে হলো এ দেশগুলো হয়ে উঠতে পারে ভবিষ্যৎ মধ্যপ্রাচ্য।

আলোচনার টেবিলে নবীন হলেও লিথিয়ামের গল্প আসলে খুব প্রাচীন। বিগ ব্যাংয়ের পরপরই হাইড্রোজেন আর হিলিয়ামের সঙ্গে অন্য যে মৌলটি তৈরি হয়েছিল তা ছিল লিথিয়াম। পরিমাণে অল্প হলেও প্রাচীনত্বের গৌরবের অংশীদার। এরপর নক্ষত্রে চলা নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়ায় হাইড্রোজেন বা হিলিয়াম থেকেও তৈরি হয়েছে লিথিয়াম। তৈরি হয়েছে বেরিলিয়াম বা অন্য কোনো মৌলের তেজস্ক্রিয় বিকিরণ থেকেও। প্রাণী দেহ সৃষ্টিতে কার্বন, অক্সিজেন বা হাইড্রোজেনের মতো গুরুত্ববাহী না হওয়ায় লিথিয়ামের পরের গল্প মানুষের চোখে পড়ে মাত্র ২০০ বছর আগে।

১৮০০ সালে একটা খনিজ আবিষ্কৃত হয়, যার নাম পেটালাইট (LiAlSi4O10)। রসায়নের ইতিহাসে বিখ্যাত ব্যক্তি জন জ্যাকব বার্জেলিয়াসের ছাত্র জোহান অগাস্ট আরফেডসন পেটালাইট বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ঠিক ২০৪ বছর আগে ১৮১৭ সালে লিথিয়াম (Li) আবিষ্কার করেন। বার্জেলিয়াস এর নাম দেন লিথোস। গ্রিক শব্দ লিথোসের অর্থ পাথর।

পর্যায় সারণিতে তাকালে চোখে পড়ে লিথিয়ামের নানান বৈশিষ্ট্য। তিনটি প্রোটন নিয়ে সবচেয়ে হালকা ধাতু লিথিয়াম। সবচেয়ে কম ঘনত্বের ধাতুও লিথিয়াম, সাধারণ তাপমাত্রায় কঠিন, ঘনত্ব মাত্র শূন্য দশমিক ৫৩ গ্রাম প্রতি ঘনসেন্টিমিটার। অর্থাৎ ধাতু হওয়ার পরও দিব্যি ভেসে থাকবে পানিতে। অবশ্য একে পানির মধ্যে ছেড়ে দিলে বিক্রিয়া শুরু করে দেবে। এমনকি বিক্রিয়া করবে বাতাসের সঙ্গেও। রুপালি রঙের এই ধাতু বাতাসে রেখে দিলে অল্প সময়েই জারিত হয়ে রং বদলে যায়। অন্যভাবে বললে লিথিয়ামের ওপর খুব সহজেই মরিচা পড়ে যায়। এর কারণ মহাবিশ্বের সবচেয়ে তড়িৎ ধনাত্মক (-৩ দশমিক ০৪ ভোল্ট) মৌলও লিথিয়াম। এত সক্রিয় ধাতু হওয়ার দরুন প্রকৃতিতে লিথিয়াম পাওয়া যায় শুধু অন্য নানান পদার্থের সঙ্গে যৌগ অবস্থায়। মূলত লবণাক্ত পানি (ব্রাইন) বা শক্ত খনিজই লিথিয়ামের উত্স। সক্রিয়তার কারণে একে রাখতে হয় খনিজ তেল, যেমন কেরোসিনের নিচে বা বাতাসহীন কোনো পাত্রে।

লিথিয়ামের চমত্কার ভৌত, রাসায়নিক ও তড়িৎ রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যের জন্য ব্যাটারির বাইরেও নানান ব্যবহার আছে। যেমন লিথিয়াম নায়োবেইট ব্যবহূত হয় অরৈখিক আলোকবিজ্ঞানে। প্রকৌশলে লিথিয়াম ব্যবহূত হয় উচ্চ তাপমাত্রার লুব্রিক্যান্ট হিসেবে, সংকর ধাতু মজবুত করতে বা তাপ পরিবহনে। রাসায়নিক শিল্পেও রয়েছে লিথিয়ামের বহুল ব্যবহার। জৈব-লিথিয়াম একটি শক্তিশালী ক্ষার ও নিউক্লিওফাইল, নানা বস্তু বানাতে এর গুরুত্ব অনেক। আধুনিক বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান পলিমার। পলিমার তৈরিতে জৈব-লিথিয়ামের ভূমিকা অন্যতম। লিথিয়াম প্রভাব ফেলে মানুষের নার্ভাস সিস্টেমেও, তাই মুড স্টাবিলাইজিং ওষুধ বানাতেও আছে লিথিয়ামের ব্যবহার। লিথিয়ামের তেজস্ক্রিয় বিকিরণে উত্পন্ন হয় হাইড্রোজেনের আইসোটোপ ট্রিটিয়াম, তাই নিউক্লিয়ার গবেষণাতেও গুরুত্বপূর্ণ এই ধাতু।

লিথিয়ামের এত এত ব্যবহারের দরুন প্রতিবছর ৭-১০ শতাংশ বাড়ছে এর বৈশ্বিক চাহিদা। বর্তমানে লিথিয়াম কার্বোনেটের বার্ষিক চাহিদা প্রায় পৌনে দুই লাখ টন, যার ২০ থেকে ২৫ শতাংশ যায় ব্যাটারি তৈরিতে। জলবায়ুর পরিবর্তন নিয়ে সবাই উদ্বিগ্ন হওয়ায় জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সবাই দিন দিন ঝুঁকছে বিকল্প উেসর দিকে। এক হিসাবে ২০৫০ সালের মধ্যে সব গাড়ি জীবাশ্ম জ্বালানির বদলে চলবে ব্যাটারিতে। বলা বাহুল্য, এ ক্ষেত্রে লিথিয়ামের গুরুত্ব ও চাহিদাও বাড়বে বহুগুণ। অপরদিকে নিউক্লিয়ার ফিউশনে ডিউটেরিয়ামের পাশাপাশি ব্যবহার করা যেতে পারে ট্রিটিয়ামও। সে ক্ষেত্রে লিথিয়ামের চাহিদা বাড়বে আরও, যেহেতু ট্রিটিয়ামের একটি কার্যকরী উত্স তেজস্ক্রিয় লিথিয়াম।

খনিজ পাথর থেকে লিথিয়াম আহরণ খুবই ব্যয়বহুল। সাগরের পানিতেও যথেষ্ট পরিমাণ লিথিয়াম লবণ আছে, কিন্তু সেখান থেকেও পরিশোধন কষ্টসাধ্য ও ব্যয়বহুল। তাই লিথিয়াম প্রধানত (প্রায় ৮৩%) লবণাক্ত লেক বা সল্ট প্যান থেকেই আহরিত হয়। প্রথমে লবণাক্ত পানিকে সূর্যতাপে বাষ্পীভূত করে লিথিয়াম লবণের ঘনত্ব বাড়ানো হয়। এরপর একে সোডার (সোডিয়াম কার্বোনেট) সঙ্গে বিক্রিয়া করালে নিচে জমা হয় লিথিয়াম কার্বনেট। লিথিয়াম কার্বোনেট পাঠিয়ে দেওয়া হয় নির্দিষ্ট শিল্পকারখানায়।

পৃথিবীতে মোট কতটুকু লিথিয়াম মজুত আছে তার সঠিক হিসাব কারও কাছে নেই। এমনকি এ হিসাব করাও অত্যন্ত কঠিন। তবে প্রতিবছর যে পরিমাণ লিথিয়াম পরিশোধিত হয়, তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। বর্তমানে বছরে উত্পাদিত গাড়ির সংখ্যা প্রায় পাঁচ কোটি। সব গাড়ি যদি হাইব্রিড কারে রূপান্তর করা হয়, তাতেও লিথিয়াম কার্বনেটের উত্পাদন করতে হবে দ্বিগুণ। হাইব্রিড গাড়ি হলো জীবাশ্ম জ্বালানি ও লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির সমন্বয়ে চলা গাড়ি। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির শক্তি সাত কিলোওয়াট ঘণ্টা। গাড়ি যদি পূর্ণাঙ্গ লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারিনির্ভর করতে হয়, তবে ব্যাটারির শক্তি প্রয়োজন হবে ৪০ কিলোওয়াট ঘণ্টা। প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টা শক্তির জন্য প্রয়োজন প্রায় ৮০০ গ্রাম লিথিয়াম কার্বোনেট। এসব সংখ্যা ভয় ধরানো। কারণ, খুব সহজেই ধারণা করা যায়, লিথিয়ামের মজুত যতই থাকুক, চাহিদার সমান লিথিয়াম উত্পাদন খুবই কঠিন হবে। সম্ভবত কয়েক যুগেই ফুরিয়েও যাবে।

এ থেকে উত্তরণের উপায় হতে পারে নতুন ব্যাটারি প্রযুক্তির আবিষ্কার। তাতে লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির ওপর নির্ভরতা কমবে। আরেকটি উপায় হতে পারে লিথিয়াম রিসাইক্লিং বা পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ। আশার কথা হলো, লিথিয়ামের গলনাঙ্ক মাত্র ১৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস হওয়ায় এর রিসাইক্লিংও বেশ সহজ। একই সঙ্গে লিথিয়ামের ফ্লোরাইড, কার্বোনেট বা ফসফেট যৌগের পানিতে দ্রাব্যতা কম হওয়ায় এর রিসাইক্লিং আরও সহজসাধ্য। তাই একটি কার্যকর রিসাইক্লিং পদ্ধতি আবিষ্কার করতে পারলে এবং সহজ পরিশোধন পদ্ধতি বের করতে পারলে লিথিয়াম আয়ন নিঃসন্দেহে বিপ্লব এনে দেবে।

শতবর্ষ আগে মধ্যপ্রাচ্যে জীবাশ্ম জ্বালানির বিশাল আধার আবিষ্কারের পরে ভূরাজনীতি বা বিশ্বব্যবস্থায় যে বড় পরিবর্তন এনেছিল, লিথিয়াম সম্ভবত তেমন কিছুই করতে যাচ্ছে। একই সঙ্গে জলবায়ুর পরিবর্তন নিয়ে দুশ্চিন্তাতেও হয়তো কিছু আশার বাণী শোনা যাবে। তাই লিথিয়ামকে এ শতাব্দীর স্বর্ণ বললে মোটেও বাড়াবাড়ি হবে না। আসলে লিথিয়াম সোনার চেয়েও দামি।

লেখক: পিএইচডি গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব ওহাইওমিং, যুক্তরাষ্ট্র

নেচার কেমিস্ট্রি, জুন ২০১০ সংখ্যায় প্রকাশিত জিন মারি টারাসকনের লেখা অবলম্বনে।

*লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার জুলাই সংখ্যায় প্রকাশিত