সবচেয়ে শক্তিশালী অ্যাসিড

অ্যাসিড শব্দটা শুনলেই মারাত্মক রাসায়নিক তরলের কথা মনে আসে। মনে আসে অ্যাসিডসন্ত্রাসের কথা। কিন্তু সব অ্যাসিডই কি মারাত্মক? আবার যেসব অ্যাসিডকে আমরা সবচেয়ে মারাত্মক বলে মনে করি, তারাই কি সবচেয়ে শক্তিশালী অ্যাসিড?

স্কুল, কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন ল্যাবে অ্যাসিড ব্যবহার করা হয়, তার ঘনমাত্রা অনেক কম। বেশি ঘনমাত্রার অ্যাসিড ব্যবহারে ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা অনেক বেশি থাকে। রসায়ন ল্যাবে সালফিউরিক অ্যাসিডের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। আমাদের পাকস্থলীও কিন্তু অ্যাসিডের ডিপো। তবে সেখানে থাকে হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড (HCl)। এমনিতে হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড যথেষ্ট শক্তিশালী। তবে সেখানে এই অ্যাসিডটি লঘুমাত্রায় থাকায় এবং পাকস্থলীর দেয়ালে বিশেষ একটি স্তর থাকার কারণে তা পাকস্থলীর ক্ষতি করতে পারে না। পাকস্থলীর অ্যাসিডের তুলনায় রসায়ন ল্যাবে ব্যবহূত সালফিউরিক অ্যাসিড অনেক গুণ শক্তিশালী। যানবাহন কিংবা বৈদুত্যিক যন্ত্রের ব্যাটারিতে এই সালফিউরিক অ্যাসিড ব্যবহার করা হয় কম ঘনমাত্রায়। স্বর্ণকারের দোকানে সোনার খাদ গলাতে ব্যবহার করে বেশি ঘনমাত্রার বা শক্তিশালী নাইট্রিক অ্যাসিড। সালফিউরিক কিংবা নাইট্রিক অ্যাসিড ঝলসে দিতে পারে মানুষের শরীর। গলিয়ে দিতে পারে মাংস।

সালফিউরিক অ্যাসিড বা হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিডের চেয়েও মারাত্মক অ্যাসিড আছে। সেগুলো অনেক কম পরিচিত। ফ্লোরো-অ্যান্টিমনিক অ্যাসিড (H2F[SbF6])। হ্যামেট ফাংশন অনুসারে এই অ্যাসিডের শক্তিমাত্রা হচ্ছে মাইনাস ৩১.৩। ১০০% সালফিউরিক অ্যাসিডের তুলনায় এই অ্যাসিড ১ লাখ কোটি (১০১৬) গুণ শক্তিশালী!

চাইলেই যে কেউ ফ্লোরো-অ্যান্টিমনিক অ্যাসিড নিয়ে কাজ করতে পারবে না। টেস্টটিউব বা বিকারকে মুহূর্তেই গলিয়ে ফেলে এই ভয়ংকর অ্যাসিড। কাচ, প্লাস্টিক, সিরামিক বা ধাতু কোনো কিছুই নিরাপদ নয় ফ্লোরো-অ্যান্টিমনিকের কাছে। তাহলে এই অ্যাসিড সংরক্ষণ করা হয় কীভাবে? রান্নার সময় যে ননস্টিক ফ্রায়েড প্যান ব্যবহার হয়, তার ওপরে একটা মসৃণ আবরণ থাকে। আবরণটা টেফলন পলিমারের। এই টেফলনের কাছেই হার মানে ফ্লোরো-অ্যান্টিমনিক অ্যাসিড।

টেফলন আসলে বাণিজ্যিক নাম। রাসায়নিক নাম পলিটেট্রাফ্লোরোইথিন। টেট্রাফ্লোরোইথিন নামের একটি ২-কার্বনবিশিষ্ট জৈব যৌগের পলিমার হলো পলিটেট্রাফ্লোরোইথিন বা টেফনল। অর্থাত্ অনেক টেট্রাফ্লোরোইথিন অণু পাশাপাশি যোগ হয়ে যে পলিমার যৌগ গঠন করে, তাই টেফলন। টেফলনের কার্বন-ফ্লোরিন (C-F) রাসায়নিক বন্ধন রয়েছে। এই বন্ধন অত্যন্ত শক্তিশালী। শক্তিশালী অ্যাসিডও টেফলনের এই বন্ধন ভাঙতে পারে না। টেফলনের সঙ্গে বিক্রিয়া ঘটে না কোনো অ্যাসিডের। তাই টেফলনের পাত্রে রাখা হয় ফ্লোরো-অ্যান্টিমনিক নামের মারাত্মক এই অ্যাসিডকে। তারপরও ফ্লোরো-অ্যান্টিমনিক সবচেয়ে শক্তিশালী অ্যাসিড নয়। সবচেয়ে শক্তিশালী হলো কার্বোরেন গ্রুপের অ্যাসিড।

অ্যাসিড কতটা শক্তিশালী, সেটা বোঝা যায় এদের pH ও হ্যামেট ফাংশন (H_0) মান থেকে। কোনো রাসায়নিক পদার্থের pH মান যত কম, সে তত বেশি শক্তিশালী। pH-এর সঙ্গে হ্যামেট ফাংশনের কিছুটা মিল আছে। তাই বলে দুটো আবার গুলিয়ে ফেললে ভুল হবে। হ্যামেট ফাংশন ব্যবহার করা হয় অতি গাঢ় ঘনমাত্রার অ্যাসিড ও শক্তিশালী অ্যাসিডের ক্ষেত্রে, যাদের বলা হয় সুপার অ্যাসিড। তবে pH-এর মতো এই যে অ্যাসিডের হ্যামেট ফাংশন যত কম, তার অ্যাসিডিটিও তত বেশি। হ্যামেট ফাংশনের মান শূন্যের চেয়েও অনেক কম হতে পারে। ফ্লোরো-অ্যান্টিমনিক অ্যাসিডের ক্ষেত্রে যেটা মাইনাস ৩১.৩।

কার্বরেন অ্যাসিডের হ্যামেট ফাংশন মাইনাস ১৮। ফ্লোরো-অ্যান্টিমনিক অ্যাসিডের চেয়ে বেশি। তবু কার্বোরেনকে সবচেয়ে শক্তিশালী অ্যাসিড বলা হয়। কারণ, আসলে ফ্লোরো-অ্যান্টিমনিক অ্যাসিড কোনো রাসায়নিক যৌগ নয়, বরং একটি রাসায়নিক মিশ্রণ মাত্র। হাইড্রোজেন ফ্লোরাইড (HF) ও অ্যান্টিমনিক পেন্টাফ্লোরাইড (SbF5) ২:১ অনুপাতের মিশ্রণই ফ্লোরো-অ্যান্টিমনিক অ্যাসিড। অন্যদিকে কার্বোরেন অ্যাসিড কোনো মিশ্রণ নয়, এটা প্রকৃত একটা যৌগ। এর রাসায়নিক সংকেত হচ্ছে H(CHB11 X11)। এখানে X নির্দিষ্ট কোনো মৌলের সংকেত নয়। সত্যি বলতে কি, কার্বোরেন হলো অনেক অ্যাসিডের একটা গ্রুপ। যেখানে X-এর বদলে বেশ কয়েকটি মৌল বসানো যেতে পারে। ক্লোরিনের কার্বোরেন অ্যাসিডের কথাই ধরা যাক। কার্বোরেন গ্রুপের সংকেতে X বদলে Cl (ক্লোরিন) বসালে ক্লোরিনের কার্বোরেন অ্যাসিডের সংকেতটি পাওয়া যাবে H(CHB11Cl11)।

কার্বোরেন অ্যাসিডের অ্যাসিডিটি কিন্তু বিকার, টেস্টটিউব কিংবা ধাতুকে গলাতে পারে না। আসলে অ্যাসিডিটি কতটা বেশি, তার ওপর অ্যাসিডের ক্ষয়কারী ধর্ম নির্ভর করে না। সালফিউরিক অ্যাসিডের হ্যামেট ফাংশন মাইনাস ১২। কার্বোরেনের চেয়ে অনেক কম অ্যাসিডিক। তবু এর ক্ষয়কারক ধর্ম অনেক শক্তিশালী। সুতরাং যৌগ হিসেবে কার্বোরেনই সবচেয়ে শক্তিশালী অ্যাসিড। কিন্তু মিশ্রণ আর ধ্বংসক্ষমতাকে গোনায় ধরলে ফ্লোরো-অ্যান্টিমনিক সবচেয়ে শক্তিশালী।

লেখক: বিজ্ঞানকর্মী, সূত্র: রিয়েলক্লিয়ার সায়েন্স ডটকম

*লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার জুলাই সংখ্যায় প্রকাশিত।