বিজ্ঞানচিন্তা: সহজভাবে হিগস-বোসন কণার বিষয়টি বুিঝেয় বলুন।

ড. অমিতাভ রায়: পরমাণুর যে মৌলিক গঠন, সেখানে ছয়-সাতটি মৌলিক কণিকা থাকে। জন্মের সময় সেগুলোর কোনো চার্জ কিংবা ভর থাকে না। তবে এগুলোকে ভর প্রদানের জন্য বেশ কিছু পন্থা আছে। যেমন এমন এক ধরনের কণিকা আছে, যেগুলো মহাবিশ্বের প্রায় সব স্থানেই আছে কমবেশি। এই কণিকার সঙ্গে পরমাণুর এই মৌলিক কণিকাগুলো সংঘর্ষে লিপ্ত হলেই সেগুলো ভর লাভ করে। হিগস-বোসন হচ্ছে এমনই একটি কণা। গোটা কণাজগৎই এই বোসন কণার সমুদ্রে ভাসছে। তবে মাঝেমধ্যেই কিছু বিশেষ মাত্রার সংঘর্ষ সৃষ্টির ফলে কণাজগতের মৌলিক কণাগুলোতে ভর সৃষ্টি করে, আমরা সেগুলো নিয়ে আরও বিস্তারিত গবেষণা করতে পারি। এই ধারণা থেকেই সৃষ্টি হয়েছে হিগস ফিল্ড তত্ত্বের। এখন এ ধরনের কণাগুলো বিভিন্ন ফিল্ডে বিভিন্ন রকম। ধরুন, আলোর ক্ষেত্রে একটা আদর্শ কণা হলো ফোটন। দুর্বল শক্তির ক্ষেত্রে থাকে জেড বোসন, ডব্লিউ বোসন কণাগুলো। আবার উচ্চশক্তির ক্ষেত্রে থাকে গ্লুয়ন আর মহাকর্ষের ক্ষেত্রে গ্র্যাভিটন। এখন এই কণাগুলো শনাক্ত করার জন্য কিন্তু আলাদা ফিল্ডের প্রয়োজন হয়। তবে হিগস-বোসন কিন্তু প্রায় সব ফিল্ডেই ছড়িয়ে রয়েছে। তবে জেড বোসন আর ডব্লিউ বোসন কণাগুলোর ক্ষেত্রেই হিগস ফিল্ড বেশি কার্যকরভাবে দেখা যায়।

বিজ্ঞানচিন্তা: হিগস-বোসন কণা কীভাবে শনাক্ত করা হলো?

ড. অমিতাভ রায়: আমি যখন কাজ করছিলাম, তখন কিন্তু এই কণা শনাক্ত করা যায়নি। শনাক্ত হয়েছে আরও পরে। তবে ভেতরের মূল যন্ত্রে যেহেতু আমার কাজ ছিল, সেই হিসেবেই আমি এই আবিষ্কারের একজন অংশীদার। লার্জ হ্যাড্রন কলাইডার মূলত প্রোটনভিত্তিক সংঘর্ষ নিয়েই কাজ করে। আমরা যেহেতু আগেই নানা রকম প্রোটনের সংঘর্ষের ফল জানি, তাই ইতিমধ্যে একটা ধারণা করা যাচ্ছিল যে কোনো কোনো প্রোটনের সংঘর্ষ ঘটালে এমন ভরের কণা পাওয়া সম্ভব। সে ক্ষেত্রে যখন দুটি সাধারণ কণা সংঘর্ষ ঘটায়, তখন তারা তাদের থেকেও কম ভরের কণা সৃষ্টি করে। ওগুলো থেকে সাধারণত ফোটন, জেড বোসন, বটম কোয়ার্ক ধরনের কম ভরের কণা পাওয়া যায়। এখন এই কণা সৃষ্টির তথ্যগুলো পর্যালোচনা করলে আমরা সাধারণ কণা মানে ফোটন বা অন্যান্য পরিচিত কণার জন্য একটা চিরচেনা গ্রাফ পাই। তবে কখনো গ্রাফে কোনো উচ্চমাত্রার রেখা দেখা গেলেই বোঝায় যে এই সংঘর্ষে সাধারণ কণাগুলো ছাড়াও ভিন্ন কোনো কণার সৃষ্টি হয়েছে। সেটার শক্তি পরিমাপ করেই ওই কণার ভর বের করা যাবে। এখন আমাদের বুঝতে হবে, এই সংঘর্ষের ফল বিশ্লেষণে ব্যবহৃত ডিটেক্টরগুলো কীভাবে কাজ করে। ডিটেক্টরগুলোর একদম ভেতরের অংশে এই কণাগুলোর সংঘর্ষ ঘটে। তারপর তিনটি সিলিকনের ডিটেক্টর আস্তরণ কণাগুলোর গতিবিধি পর্যালোচনা করে। তারপর আরও কিছু সিলিকনের আস্তরণের পর বসানো হয় ইলেকট্রন ক্যালরি মিটার। এই মিটারগুলো আলোককণা মানে ফোটন কণাগুলোর শক্তি পরিমাপ করে। এরপর থাকে হ্যাড্রন মিটার, যেগুলো আরও উচ্চস্তরের কণার শক্তির মান নির্ণয় করে। আর তারপর থাকে ফোর টেসলা চুম্বক। আর সব থেকে বাইরের অংশে থাকে মিয়ন ক্যালরি মিটার। মিয়ন যেহেতু সবচেয়ে কম পরিমাণে সংঘর্ষে যুক্ত হয়, তাই শেষ ধাপে এটা দেখা হয়। এখন প্রতিটি সংঘর্ষের পরই আপনি প্রথম ধাপের সেমিকন্ডাক্টরের ডিটেক্টরগুলোতে কণাগুলোর গতিপথ বেঁকে যাওয়ার বিষয়টি দেখতে পারবেন। কেননা, সেটা বেশ শক্তিশালী চৌম্বকীয় একটা ক্ষেত্র সৃষ্টি করে। যেকোনো চৌম্বকক্ষেত্রেই এ রকম ইলেকট্রনীয় চার্জিত কণার গতিপথ বেঁকে যাবেই। এই বাঁকানো পথের হিসাব থেকেই কণাগুলোর ভর ও চার্জের অনুপাত নির্ণয় করা সম্ভব। আর যদি পথ বাঁকা না হয়, তার মানে কণাটি চার্জহীন। ফলে শুরুর ধাপেই কণাটির সামগ্রিক তথ্য বোঝা সম্ভব। এই কণা থেকে কণার বিশ্লেষণগুলো কিন্তু এই সিলিকনের চিপের ভেতরের ধাপ থেকে ধাপে হতে থাকে। এ ক্ষেত্রে মিটারে প্রবেশের পর প্রতি ধাপে কণাগুলোর শক্তি ও ভরের তারতম্য হিসাব করা সম্ভব। তবে কিছু শক্তি নিউট্রিনো কণার মাধ্যমে কোনো রকম সংকেত না দিয়েই টানেল থেকে বেরিয়ে যায়। সেটাও আমাদের হিসাবে করতে হয়। এই সবকিছু বিশ্লেষণ শেষে কোনো কণার চার্জ আর তার ভরের সামগ্রিক তথ্য মিলিয়েই বোঝা যায় যে কণাটি হিগস-বোসন কণা কি না।

বিজ্ঞানচিন্তা: আপনার ছেলেবেলা, পড়াশোনা, বেড়ে ওঠার সেই পুরোনো দিন থেকে আজকের মানুষ হয়ে ওঠার গল্পগুলো জানতে চাই।

ড. রায়: ১৯৮৪ সালের দিকে আমার বয়স প্রায় ১০ বছর। আমার বাবা চিন্তা করছিলেন আমাকে বোর্ডিং স্কুলে পাঠিয়ে দেওয়ার। মূলত মায়ের এ ব্যাপারে বেশি আগ্রহ ছিল। আমি তখন কলকাতায় নরেন্দ্র মিশন রেসিডেনসিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভর্তি হই। সেখানেই আমি উচ্চমাধ্যমিক শেষ করি। এরপর শান্তিনিকেতন বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করি। সেখানে আমার দেখা হয় দীপঙ্কর চ্যাটার্জির সঙ্গে। তিনি অ্যাটোমিক ফিজিকসের অধ্যাপক ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আসল পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে কাজ করতে হলে অবশ্যই পরীক্ষা-নিরীক্ষামূলক পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে কাজ করতে হবে। এ কথাই আমাকে পদার্থবিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহী করে তোলে। ছেলেবেলায় বাবা আমাকে বলতেন, ‘যেটা তোমার ভালো লাগে, সেটাই তুমি করবে।’ তাই নিজের পছন্দের বাছাই করা এবং সেই কাজে অংশগ্রহণ করতে পারিবারিকভাবে আমাকে তেমন কোনো বেগ পেতেই হয়নি। ইঞ্জিনিয়ারিং বা ডাক্তারি ছেড়ে ফিজিকস পড়াতে আমার তেমন কোনো বাধা আসেনি। এ জন্যই বর্তমানে আমি ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথে কাজ করছি।

ফিজিকসের পাট তখনো চুকে যায়নি। একদিন দীপঙ্কর চ্যাটার্জির সঙ্গে দেখা করতে আসি। তিনি আমাকে আবার বলেন, পরীক্ষা-নিরীক্ষামূলক পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে কাজ করলে আর দেশে ফেরা অসম্ভব। তাই পিএইচডি শেষ হলে আমি কম্পিউটেশনাল জীববিজ্ঞান নিয়ে কাজ করার চিন্তা করি। ২০০৫ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত আমি কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্ট ডক্টরাল সম্পন্ন করি। এই মুহূর্তে আমি ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথে কম্পিউটেশনাল জীববিজ্ঞানী হিসেবে কাজ করছি। এটি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের নিজস্ব আর্থিক সহায়তায় পরিচালিত গবেষণাকেন্দ্র। এর তত্ত্বাবধানে ১২টি ইনস্টিটিউট পরিচালিত হয়। আমি ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ইনফেকশন অ্যান্ড অ্যালার্মিং ডিজিজেসের সঙ্গে বর্তমানে যুক্ত আছি। এখানে মূলত মহামারি ধরনের যে রোগগুলো আছে, সেগুলো নিয়ে গবেষণা করা হয়। ইবোলা, নিপা, কালাজ্বর, এইডসসহ নানা রোগের জীবাণু এবং সেগুলোর প্রতিষেধক নিয়ে আমরা সেখানে কাজ করি।

বিজ্ঞানচিন্তা: কালাজ্বরের মতো মহামারি রোগগুলো আবার ফিরে আসার কারণ কী?

ড. রায়: এই রোগগুলো সাধারণত ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে ছড়ায়। আমরা একদিকে ওদের থামাতে প্রতিষেধক বানিয়ে চলেছি, অন্যদিকে জীবাণুগুলোও প্রতিষেধকগুলোর বিপরীতে নিজেদের প্রস্তুত করতে শুরু করে। এই অমীমাংসিত যুদ্ধ আজীবনের। যখন আমাদের তৈরি প্রতিষেধক কাজ করে, তখন রোগগুলোর প্রকোপ কমে যায়। আবার যখন ওদের হাতিয়ার বেশি শক্তিশালী হয়, তখন এসব রোগ মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে। আমরা এক ধাপ এগোলে ওরাও বসে থাকবে না। ইতিমধ্যে যক্ষ্মারোগ আবার ফিরে এসেছে। এই প্রতিষেধককে আরও কর্মক্ষম করে তোলার জন্যই আমরা কাজ করছি।

বিজ্ঞানচিন্তা: বাংলাদেশের তরুণ গবেষকদের সম্পর্কে আপনার ধারণা কেমন? তাঁদের আপনি কী পরামর্শ দেবেন?

ড. রায়: বাংলাদেশের বেশ কিছু তরুণ গবেষকের সঙ্গে আমার কাজ করার সুযোগ হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। তারা বেশির ভাগই প্রকৌশলী। এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে আমার এ দেশের জীববিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলাপ হলো। এরা অকল্পনীয় মাত্রায় পরিশ্রম করতে পারে। দেশের গবেষণা খাতে এত কম সুযোগ-সুবিধা, তারপর বাংলাদেশের তরুণেরা কিন্তু চমত্কার সব গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে নিজেদের উদ্যোগেই।

গবেষণা হলো খুব ধৈর্য নিয়ে কাজ করার একটা বিষয়। আসলে গবেষক হওয়ার আগে নিশ্চিত হতে হবে, নিজের ব্যর্থতাকে পাশ কাটিয়ে বিজ্ঞান নিয়ে সে কাজ চালিয়ে যেতে পারবে কি না। আবার বিজ্ঞান কিন্তু খুব বেশি টাকা উপার্জন করার সুযোগ দেয় না। তাই সেদিক দিয়েও মানসিক প্রস্তুতির বিষয় রয়েছে। এই বিষয়গুলো মাথায় রেখে কেউ যদি তার গবেষণায় লেগে থাকে, সে একসময় না একসময় ভালো করবেই।

*সাক্ষাৎকারটি ২০১৯ সালে বিজ্ঞানচিন্তার জুন সংখ্যায় প্রকাশিত।