আফ্রিকা মহাদেশ কি দুভাগ হয়ে যাচ্ছে?

আমরা জানি, এক কালে পৃথিবীর সবটা ভূমি একসঙ্গে ছিল। বিজ্ঞানীরা এটিকে বলেন অতি অতিমহাদেশ প্যানজিয়া। সেই প্যানজিয়া কোটি কোটি বছর ধরে ভেঙে ভেঙে তৈরি হয়েছে বর্তমান সাতটি মহাদেশ। মহাদেশের এরকম ভাঙন ও স্থানান্তর হতে অনেক সময় লাগে। আক্ষরিক অর্থেই সেটা কোটি কোটি বছর। এজন্য শুনে হয়তো অবিশ্বাস্য লাগে কারো কারো কাছে। তবে বর্তমানে এরকম একটি ঘটনা ঘটছে আমাদের চোখের সামনেই। এ নিয়েই আজকের আলোচনা।

বিশাল এক ফাটল দেখা দিয়েছে আফ্রিকা মহাদেশের বুকে। এটি বর্তমানে দ্বিতীয় বৃহত্তম মহাদেশ। এই বিশাল ফাটলকে বলা হচ্ছে পূর্ব আফ্রিকান চিড়। বিশাল এই উপত্যকা সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ। এর বিস্তৃতি সেই লাল সাগর থেকে শুরু করে মোজাম্বিক পর্যন্ত।

তবে এ চিড় কি আসলেই আফ্রিকাকে দুভাগ করে ফেলবে? প্রশ্নটির জবাব একবাক্যে দেওয়া যে কঠিন, তা বলা বাহুল্য। বরং এ প্রশ্নের জবাব বুঝতে আমাদের জানতে হবে প্লেট টেকটোনিক বা মহাদেশীয় পাতের কথা।

পৃথিবীর বাইরের দিকটা কিছু পাথুরে পাত দিয়ে তৈরি। সব ভূমি, সাগর-মহাসাগর রয়েছে এসব পাতের ওপরে। এই পাতগুলোকে বলে প্লেট টেকটোনিক বা মহাদেশীয় পাত। এই পাতগুলো নিয়মিতহারে নড়াচড়া করে। পাতগুলোর নিচের পাথরের স্তরটি তুলনামূলক ঘাতসহ (Malleable)। অর্থাৎ, ওই স্তরটির ওপর দিয়ে এই পাতগুলো অনায়াসে নড়াচড়া করতে পারে। ঘাতসহ এই স্তরটির নিচের স্তরকে বলে ম্যান্টল—পৃথিবীর গলিত কেন্দ্রের দিকের একটি স্তর এটি। মূল বিষয়টা হলো, মহাদেশীয় এ পাতগুলোর সীমানাকে বলে ফল্ট লাইন। এই সীমানা অংশগুলো মোটেও সমান বা মসৃণ নয়, আঁকাবাঁকা। মূলত এসব সীমানা অংশে পাতগুলো একে অন্যের সঙ্গে ধাক্কা খেলে বা আটকে গেলেই ভূমিকম্প হয়।

যেভাবে ফাটছে আফ্রিকা
নাসার আর্থ অবজারভেটরি

কথা হলো, আফ্রিকায় কী ঘটছে? পূর্ব আফ্রিকার এই ফাটলের অংশটিতে সোমালিয়ান টেকটোনিক প্লেট মহাদেশটির প্রাচীন ও বিশাল নুবিয়ান টেকটোনিক প্লেটকে পূর্ব দিকে টানছে। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার আর্থ অবজারভেটরির সূত্রে জানা যাচ্ছে এ তথ্য। এই সোমালীয় মহাদেশীয় পাতটি সোমালি প্লেট নামেও পরিচিত। আর নুবীয় পাতটিকে আফ্রিকান প্লেটও বলা হয়।

ওদিকে, এই সোমালীয় এবং নুবীয় পাত আবার আরবীয় পাত থেকে সরছে উত্তরের দিকে। এই পাত তিনটি আবার পরস্পরকে ইথিওপিয়ার আফার অঞ্চলে ছেদ করে, তৈরি করে ইংরেজি ওয়াই (Y) আকৃতির একটি ফাটল। এই তথ্য জানা যাচ্ছে জিওলজিক্যাল সোসাইটি অব লন্ডনের সূত্রে।

এই ফাটল তৈরি হতে শুরু করে প্রায় ৩৫ মিলিয়ন সাড়ে তিন কোটি বছর আগে, আরব অঞ্চল এবং হর্ন অব আফ্রিকার (বাংলায় বলা হয় আফ্রিকার শিং বা শৃঙ্গ) নামের প্রণালীটির মাঝখানে, আফ্রিকা মহাদেশের পূর্বাংশে। ধীরে ধীরে এই ফাটল দক্ষিণে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। প্রায় আড়াই কোটি বছর আগে এটা এসে পৌঁছায় কেনিয়ার উত্তরাঞ্চল পর্যন্ত।

নাসার আর্থ অবজারভেটরি এবং জিওলজিক্যাল সোসাইটি অব লন্ডনের তথ্যানুসারে, এই ফাটলে সমান্তরাল দুটো বড় চিড় আছে। এর একটি, পূর্ব দিকের চিড়টি চলে গেছে ইথিওপিয়া এবং কেনিয়ার মাঝ দিয়ে। আর পশ্চিম দিকের চিড়টি বৃত্তাংশের মতো বাঁকা হয়ে উগান্ডা থেকে মালয়ী পর্যন্ত বিস্তৃত। পূর্ব দিকের অঞ্চলটি শুষ্ক, আর পশ্চিমের অঞ্চলটি কঙ্গোলিজ রেইন ফরেস্টের সীমানায় অবস্থিত। অর্থাৎ এ অঞ্চলে ভালো বৃষ্টিপাত হয়।

এ ফাটলের আশপাশের অঞ্চলে প্রচণ্ড ভূমিকম্প যেমন হয়, তেমনি পাওয়া গেছে বেশ কিছু আগ্নেয়গিরির সন্ধান। এর ফলে আফ্রিকায় বেশ কিছু ফাটল দেখা যাচ্ছে। প্রতিবছর এসব ফাটল চওড়া হচ্ছে ০ দশমিক ২৫ ইঞ্চির বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, সান্তা বারবারার ভূ-বিজ্ঞানের অধ্যাপক কেন ম্যাকডোনাল্ড। এ ফাটলের বিস্তৃতি নিয়ে তিনি বলেন, এটি বর্তমানে খুব ধীরে ধীরে চওড়া হচ্ছে। একজন মানুষের পায়ের নখ বাড়ার মতো এর গতি।

কিন্তু এ ফাটল তৈরি হলো কীভাবে? পৃথিবীর ম্যান্টলের ওপরের উত্তপ্ত ও দুর্বল একটি অংশের নাম অ্যাস্থেনোস্ফিয়ার। এই অংশ থেকে ইথিওপিয়া ও কেনিয়ার মাঝের অঞ্চলে পরিচলন প্রক্রিয়ায় প্রবাহিত প্রচণ্ড তাপের ফলে ভেঙে যায় ওপরের মহাদেশীয় পাত। কারণ, তাপে যেকোনো কিছু প্রসারিত হয়। প্রচণ্ড তাপে মহাদেশীয় পাতের ওই অঞ্চলের পাথর প্রসারিত হতে হতে একসময় আর এত তাপ নিতে পারেনি, ভেঙে গেছে। এর ফলে অগ্ন্যুৎপাতও হয়েছে। এর ফলেই গড়ে উঠেছে আফ্রিকা মহাদেশের এক কালের প্রবল প্রতাপশালী আগ্নেয়গিরি, সব লাভা উগলে দিয়ে বর্তমানে মৃত ও আফ্রিকা মহাদেশের সর্বোচ্চ পর্বত বলে স্বীকৃত—মাউন্ট কিলিমাঞ্জারো। বাংলায়, কিলিমাঞ্জারো পর্বত। উত্তর-পূর্ব তানজানিয়ার সীমান্তে অবস্থিত এই মৃত আগ্নেয়গিরি।

তাহলে, আফ্রিকা মহাদেশ যদি আসলেই ভেঙে যায়, কী ঘটবে?

যুক্তরাষ্ট্রের নিউ অরলিয়েন্সের তুলান ইউনিভার্সিটির ভূতত্ত্ব বিভাগের চেয়ারম্যান সিন্থিয়া এবিঙ্গার। ইউএস স্টেট ডিপার্টপেন্টের ব্যুরো অব আফ্রিকান অ্যাফেয়ার্সের বৈজ্ঞানিক পরামর্শদাতা হিসেবেও কাজ করছেন। তাঁর মতে, এ নিয়ে নানারকম হাইপোথিসিস আছে, ব্যাখ্যা আছে। যেমন একটি ব্যাখ্যা হলো, সোমালীয় পাত আলাদা হয়ে যাবে আফ্রিকার বাকি অংশ থেকে। মাঝে গড়ে উঠবে নতুন কোনো মহাসাগর। নতুন সৃষ্ট এই মহাদেশটিতে তখন সোমালিয়া, ইরিত্রিয়া, জিবুতি, ইথিওপিয়ার পূর্বাঞ্চল, কেনিয়া, তানজানিয়া ও মোজাম্বিক থাকতে পারে। আবার আরেকটি ব্যাখ্যা হলো, শুধু পূর্ব তানজানিয়া ও মোজাম্বিক থাকতে পারে এ নতুন ভূমিতে।

তবে আফ্রিকা শেষ পর্যন্ত নাও ভাঙ্গতে পারে। যে ভূতাত্ত্বিক শক্তি এই ফাটল তৈরি করছে, তা যদি মহাদেশটিকে ভাঙার মতো যথেষ্ট না হয়, তাহলে হয়তো ভেঙ্গে যাবে না এ মহাদেশ। উত্তর আমেরিকায় এরকম একটি মিডকন্টিনেট ফাটল আছে। যেটা মহাদেশটিকে ভেঙে ফেলতে শুরু করেও থেমে গেছে পরে। এমনটাও ঘটতে পারে আফ্রিকায়।

শেষ পর্যন্ত কী ঘটবে, তা আমরা জানি না। আফ্রিকা যদি ভেঙেও যায়, সেজন্য লেগে যাবে কোটি কোটি বছর। কিন্তু এ ঘটনা আমাদের জন্য এক উদাহরণ—কীভাবে মহাদেশ ভেঙে যায়। আর ভূতত্ত্ববিদদের জন্য পৃথিবীর ইতিহাসকে বোঝার এক দারুণ তথ্যভাণ্ডার।

লেখক: সহসম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা

সূত্র: উইকিপিডিয়া, নাসা’স আর্থ অবজারভেটরি, লাইভ সায়েন্স