বানরকুলের টারজান ও মানবকুলের ভাষা

বানর নানা রকম আওয়াজ করে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করেছবি: সংগৃহীত

জঙ্গলের পশুদের মধ্যে বেড়ে ওঠা শ্বেতাঙ্গ মানবশিশু টারজানের কাহিনি ১০০ বছর ধরে মানুষকে মুগ্ধ করে রেখেছে। গরিলা পরিবারে বেড়ে ওঠা টারজান মানুষের ভাষা জানত না। গলা দিয়ে গরিলাদের মতো অস্ফুট আওয়াজ করত সে।

অনেক পরে পরিণত বয়সে জঙ্গলের মধ্যে এক শ্বেতাঙ্গ অভিযাত্রী দলের মুখোমুখি হয়ে প্রথম সভ্য মানুষের ভাষা শুনতে পায় টারজান। তবে যাঁরা এডগার রাইস বারোজের টারজান অব দ্য এপস নামের মূল বইটি পড়েছেন, তাঁরা কিন্তু একটা মজার ব্যাপার লক্ষ না করে পারেন না। ইউরোপের সভ্য মানুষের ভাষা শুনতে পাওয়ারও বহু আগে জংলি টারজান ইংরেজি ভাষা পড়তে শিখে গিয়েছিল। সে ছিল বইপুস্তকের নিয়মিত পাঠক। কীভাবে এটা সম্ভব হলো?

কাহিনিতে দেখা যাচ্ছে, কিশোর বয়সে ঘুরতে ঘুরতে টারজান জঙ্গলের ভেতর মানুষের একটি পরিত্যক্ত কেবিন বা ঘর খুঁজে পায়। এই কেবিনেই একদা তার দুর্ঘটনাকবলিত বাবা-মা আশ্রয় নিয়েছিল। সেখানে বুনো জন্তুদের আক্রমণে তাঁদের মৃত্যু ঘটে। টারজান তখন দুধের শিশু। ফলে এগুলোর কিছুই সে জানে না। ওই ঘরে বারবার সে ফিরে যায় আর সভ্য মানুষের নানান জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করে। বুঝতে পারে না কোনটা কী, কোনটার কী কাজ। ঘরে অন্য অনেক কিছুর পাশাপাশি কতগুলো বই আবিষ্কার করে টারজান। সেগুলো যে বই, সেটাও তো আর টারজানের জানা ছিল না। তবে ওই বইগুলো নাড়াচাড়া করতে করতেই টারজান একদিন ইংরেজি ভাষা শিখে ফেলে। কীভাবে?

১৯১২ সালে প্রকাশিত টারজান অব দ্য এপস বইয়ের প্রচ্ছদ
ছবি: উইকিপিডিয়া

টারজানের ভাষাশিক্ষার প্রক্রিয়ার কিছু বিবরণ টারজান অব দ্য এপস বইয়ে আছে, আর সেটা খুবই কৌতূহলোদ্দীপক। কেবিনে অন্য অনেক বইয়ের পাশাপাশি শিশুদের অক্ষর শিক্ষার দু-একটি বই ছিল। পশুপাখি বা ফলমূলের ছবির নিচে সেগুলোর নাম ইংরেজিতে লেখা। শুরুতে টারজান বইয়ের ছবি আর তার নিচের অক্ষরগুলোকে আলাদা করতে পারেনি। অক্ষরগুলো তার কাছে কতগুলো অচেনা পোকার ছবি বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু সে লক্ষ্য করল, এলোমেলো এসব পোকার মধ্যে চেহারাগত মিল আছে এবং মিলের কিছু প্যাটার্নও আছে। সব মিলিয়ে ২৬ রকমের পোকা কিলবিল করছে বইয়ের পাতায়। শুধু তা-ই না, কিছু নির্দিষ্ট ছবির পাশে নির্দিষ্ট আকারের পোকা ফিরে ফিরে আসছে। সিংহের ছবির নিচে তিন নম্বরে যে গোলাকার পোকাটা বসে আছে, কমলালেবুর ছবির নিচে সেটাই বসে আছে একেবারে শুরুতে। এভাবে ধীরে ধীরে অক্ষর চিনতে শুরু করে টারজান। তারপর অক্ষর থেকে ধীরে ধীরে সে চিনতে শুরু করে শব্দ। আর শব্দ থেকে একপর্যায়ে ভাষা। এভাবে ইংরেজি পড়তে শিখলেও বলতে শেখেনি টারজান। কেননা শব্দগুলোর উচ্চারণ তার জানা ছিল না।

বুনো জন্তুর পরিবারে বেড়ে ওঠা মানবশিশু টারজান যে অত্যন্ত প্রতিভাবান লোক ছিল, তাতে আর সন্দেহ কী। তবে ভাষাবিজ্ঞান সম্পর্কে যাঁদের সামান্য জ্ঞান আছে তাঁরা স্বীকার করবেন, যত ক্ষুরধার প্রতিভাই থাক না কেন, এভাবে ভাষা শেখা সম্ভব নয়। এডগার রাইস বারোজ আসলে ভাষার প্রকৃতি বুঝতে বড় রকমের ভুল করেছেন। টারজান যা শিখছিল, তা ইংরেজি ভাষা নয়, ইংরেজি ভাষার লিখিত রূপ, একটা বিশেষ ধরনের চিহ্ন পদ্ধতি। অক্ষর মানুষের ভাষার সরাসরি প্রতিনিধিত্ব করে না, প্রতিনিধিত্ব করে ভাষার শুধু ধ্বনিগত রূপটির।

কিন্তু বারোজ তো আর ভাষাশিক্ষার গবেষণাগ্রন্থ লিখতে বসেননি। তিনি ফিকশন রাইটার। লিখতে বসেছেন এক কল্পগল্প। তাঁর এই অজ্ঞতাকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখাই যায়।

আমি বরং বারোজকে কিছু বাড়তি ক্রেডিট দিতে প্রস্তুত। কেননা যত বানোয়াট গল্পই লিখুন না কেন, বারোজ নিজের অজান্তে ঘুরপথে ভাষাশিক্ষার একটি মৌলিক দিক স্পর্শ করে গেছেন। আর সেটা হলো ভাষা শেখার ব্যাপারে মানুষের অন্তর্গত জাদুকরি দক্ষতা। প্রত্যেক মানুষ এ ক্ষেত্রে টারজানের মতোই সুপার প্রতিভাধর। ভাষা শিখে ফেলার একটা সহজাত ক্ষমতা যেন পুরে দেওয়া থাকে মানুষের মগজের মধ্যে। তার বুদ্ধি যেন ভাষা শেখার উপযোগী করেই গড়া।

মার্কিন ভাষাবিজ্ঞানী নোয়াম চমস্কি
ছবি: উইকিপিডিয়া

ভাষা শেখার এই বিশেষ ব্যাপারটি আরও অর্ধশতক পর লক্ষ করেন নোয়াম চমস্কি। তিনি মার্কিন ভাষাবিজ্ঞানী। চমস্কি বিশেষ করে শিশুদের ভাষা শেখার প্রক্রিয়া লক্ষ করে ভাষা বিষয়ে এক বৈপ্লবিক সিদ্ধান্তে পৌঁছান। চমস্কি বলছেন, সবার ধারণা, শিশুরা ভাষা শেখে অনুকরণ করে। কিন্তু ভালো করে লক্ষ করলে বোঝা যাবে, শুধু অনুকরণ করে শিশুদের পক্ষে ভাষার মতো এত জটিল সংকেত পদ্ধতি এত দ্রুত শিখে ফেলা সম্ভব নয়। অনুকরণ করে শিশু বড়জোর শব্দ আর উচ্চারণ শেখে।

কিন্তু শব্দের সঙ্গে শব্দ জোড়া লাগিয়ে নতুন নতুন বাক্য গঠন করে ফেলার সৃজনশীল কাজটি শিশুরা যে রকম অনায়াসে করে ফেলে, যেভাবে বাক্যের জটিল ব্যাকরণ সে রপ্ত করে—তাতে বোঝা যায়, মানুষের মগজের মধ্যে একটা কিছু আছে, এমন কোনো যন্ত্র বসানো আছে, যেটা এই কাজকে সহজ করে দিচ্ছে। চমস্কি তাঁর এই হাইপোথিটিক্যাল যন্ত্রটির নাম দিলেন ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যাকুইজিশন ডিভাইস বা সংক্ষেপে এলএডি। চমস্কির মূল বক্তব্য হলো, ভাষার মধ্যে ব্যাকরণগত যে কাঠামো বিদ্যমান, সেটা মানুষের মগজের মধ্যেই হার্ডওয়্যারিং করে দেওয়া আছে। এ কারণে ভাষার কাঠামোর দিকে তাকালে আমরা আসলে ঘুরপথে মানুষের মগজের কিছু মৌলিক কাঠামোর আভাস পাব। ভাষার আলোচনা শেষ নাগাদ মনোবিজ্ঞানের আলোচনা। চমস্কি ভাষার (বা মগজের) ওই কল্পিত কাঠামোটির নাম রাখলেন ইউনিভার্সাল গ্রামার অর্থাত্ সর্বজনীন ব্যাকরণ। দুনিয়ার সব ভাষার মধ্যে আমরা এই অভিন্ন কাঠামোটি পাব।

ভাষাবিজ্ঞানের অনেকেই চমস্কির সঙ্গে একমত হতে পারেননি। এর একটা কারণ, এ রকম একটা সর্বজনীন ব্যাকরণ দাঁড় করানো সম্ভব হয়নি। ভাষাবিদদের আরেকটা বড় আপত্তি, ভাষাকে শুধুই ব্যাকরণের অনড় কাঠামো হিসেবে দেখলে এর আসল বৈশিষ্ট্যই হারিয়ে যায়। ভাষা নিতান্ত সামাজিক সৃষ্টি। বাক্যের অর্থ বেশির ভাগ সময় লুকিয়ে থাকে নানা রকম উপমা আর

রূপকের মধ্যে। আমরা বলি এক কথা, আর বোঝাই আরেকটা। তাতে অর্থ বুঝতে কারও অসুবিধা হয় না। কেউ যখন বলে, অমুক গতকাল পটল তুলেছেন, তখন কারও বুঝতে বাকি থাকে না কী বলা হলো।

জীববিজ্ঞানীদের মধ্যে ডারউইনই প্রথম লক্ষ করেন, কথা বলার সুবিধার জন্য মানুষ তার স্বরযন্ত্র বা ল্যারিংসটিকে গলার বেশ খানিকটা নিচে নামিয়ে নিয়েছে।

ভাষাবিজ্ঞানীরা যা-ই বলুন, জীববিজ্ঞানীরা কিন্তু চমস্কির কাছাকাছিই থাকলেন। বিশেষ করে জিনবিদ্যা এমন এক জিনিস আবিষ্কার করে বসল, যেটা চমস্কিপন্থীদের উল্লসিত করবে। ১৯৯০-এর দশকে এক ব্রিটিশ পরিবারের সন্ধান পাওয়া গেল। পরিচয় গোপন রাখার জন্য এদের এখনো উল্লেখ করা হয় কেই (KE) আদ্যাক্ষর দিয়ে। এই ‘কেই’ পরিবার এবং তাদের জ্ঞাতিগোষ্ঠীর অর্ধেকের বেশি সদস্যের মধ্যে পাওয়া গেল অভিন্ন এক রোগ: এরা ঠিকমতো কথা বলতে পারে না। কথা বলতে পারে না মানে বোধগম্য বাক্য গঠন করতে পারে না। শিশুরা যেভাবে দুর্বোধ্য কিছু শব্দ আর ইশারা দিয়ে শুরুতে ভাবপ্রকাশ করে, এরাও তা-ই করে। অন্য কোনো সমস্যা নেই। বুদ্ধিশুদ্ধিরও কমতি নেই। কিন্তু কথা বলতে গেলেই এরা দারুণ সমস্যায় পড়ে। চিকিত্সকেরা লক্ষ করলেন, এই পরিবারে রোগটা বংশগতভাবে বাহিত হচ্ছে। তার মানে, কোথাও জিনগত ত্রুটি আছে। বেশ কিছুদিন অনুসন্ধানের পর জিনবিজ্ঞানীরা সেই কালপ্রিট জিনটাকে শনাক্ত করে ফেলেন। তাঁরা এটির নাম দেন ‘ফর্কহেড বক্স প্রোটিন পি২’ বা সংক্ষেপে ‘ফক্সপি২’। এটায় গড়বড় ঘটলে, অর্থাত্ এটা মিউটেট করলে ভাষা শেখায় গড়বড় হয়ে যায়। অনেকে তাই এটাকে ল্যাঙ্গুয়েজ জিন বলে অভিহিত করতে শুরু করলেন। সরল করে বললে, এটাই সেই সুইচ, যা ‘অন-অফ’ করলে মানুষের ভাষা শেখার ক্ষমতাও ‘অন-অফ’ হয়ে যায়।

সুইচ পাওয়া গেল বটে। কিন্তু সুইচটাকেই ভাষা বলে তো আর গ্রহণ করা যায় না। কেননা ‘ফক্সপি২’ জিন মানুষের মধ্যে যেভাবে পাওয়া যায়, ইঁদুরসহ অনেক স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং গানের পাখিদের মধ্যেও ঠিক সেভাবেই সেটি বিদ্যমান। বানর, ইঁদুর, পাখি এবং ছাগলেরা যদিওবা নানা রকম আওয়াজ করে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে থাকে, কিন্তু তারা মানুষের ভাষার মতো জটিল এক সংকেতপদ্ধতি তৈরি করে ফেলেছে—এটা মানতে কেউ রাজি হবে না। তা ছাড়া চমস্কি যে সর্বজনীন ব্যাকরণ খুঁজছেন ভাষা ও মগজের মাঝখানে কোথাও, সেটা যে ‘ফক্সপি২’ জিনের মধ্যে পাওয়া যাবে না, তা বলাই বাহুল্য।

কথা বলার সুবিধার বিনিময়ে আমরা প্রজাতি হিসেবে মৃত্যুর ঝুঁকি কিনেছি। এই সদাইতে আখেরে আমাদের জিত হয়েছে।

শেষ করি ডারউইনের একটি ভাবনা দিয়ে। জীববিজ্ঞানীদের মধ্যে ডারউইনই প্রথম লক্ষ করেন, কথা বলার সুবিধার জন্য মানুষ তার স্বরযন্ত্র বা ল্যারিংসটিকে গলার বেশ খানিকটা নিচে নামিয়ে নিয়েছে। কিন্তু এতে আবার অন্য এক সমস্যা এসে হাজির। খাবার গেলার সময় এই স্বরযন্ত্রটিকে একপাশে ঠেলে সরিয়ে খাবারের দলাকে পাকস্থলীর দিকে যাত্রা করতে হয়। এতে অনেক সময় গলায় খাবারের দলা আটকে গিয়ে অনেকের নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। সারা বিশ্বে বছরে সাত হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটে বিষম খেয়ে। ২০০২ সালের ১৪ জানুয়ারি সকালবেলা হোয়াইট হাউসে বসে বিস্কুট খেতে গিয়ে গলায় খাবার আটকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ প্রায় মরতে বসেছিলেন। পত্রপত্রিকা লিখেছে, তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। বুশের স্বরযন্ত্র অনেকগুলো কঠিন যুদ্ধ ঘোষণার কাজে ব্যবহার হয়েছে বটে, কিন্তু সেটার আকার হোমো স্যাপিয়েন্সদের গড় আকারের চেয়ে বেশি, এমন দাবি কোনো চিকিত্সককে করতে দেখা যায়নি।

কথা হলো, কথা বলার সুবিধার বিনিময়ে আমরা প্রজাতি হিসেবে মৃত্যুর ঝুঁকি কিনেছি। এই সদাইতে আখেরে আমাদের জিত হয়েছে। কেননা কথা বলে অর্থাত্ ভাষা আবিষ্কার করে আমরা তো বহু জীবন বাঁচিয়েও দিয়েছি। আবার ভাষা আমাদের অনেককে অমর করে রেখেছে। তাদের সবাই যে বাগ্মী ছিলেন এমন নয়।

*লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত