ফিচার
বাংলায় বিজ্ঞানচর্চা ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সাহিত্যের পাশাপাশি বিজ্ঞানেও আগ্রহী ছিলেন তিনি। সে কালে বিশ্বনন্দিত বিজ্ঞানীদের সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়েছে, লিখেছেন বিজ্ঞানবিষয়ক বই। আজ ২৫ বৈশাখ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন। এই দিনে জেনে নিন তাঁর বিজ্ঞান ভাবনার নানা দিক…
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাংলা সাহিত্যের সব ক্ষেত্রেই আলোড়িত এক উপস্থিতি। নক্ষত্রমণ্ডলীর মতো বিস্তৃত তাঁর সাহিত্যের দুনিয়া। কী নেই সেই মণ্ডলীতে? একটা নক্ষত্রমন্ডণ্ডলীতে মহাবিশ্বের যত নমুনা থাকে, রবীন্দ্র সাহিত্যও যেন সেরকম—বিপুল বিস্তৃত। সেই নক্ষত্রমণ্ডলে নীহারিকার মতো উপন্যাস, সৌরজগতের মত কবিতা, গ্রহাণুর মতো ছোট গল্প আর উল্কার মতো ছন্দের গাঁথুনি। এর এক কোণে বিজ্ঞানের আনাগোনাও ঠিক চোখে পড়ে।
শৈশবে সীতানাথ দত্তের (সীতানাথ তত্ত্বভূষণ) কাছে প্রকৃতিবিজ্ঞান শিক্ষা নিতেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পরেও বিজ্ঞানচর্চা, বিজ্ঞানে আগ্রহকে বেশ গুরুত্ব দিতেন তিনি। তাই লিখেছেন, ‘বিজ্ঞান থেকে যাঁরা চিত্তের খাদ্য সংগ্রহ করতে পারেন তাঁরা তপস্বী।—মিষ্টান্নমিতরে জনাঃ, আমি রস পাই মাত্র।’
পিতা দ্বারকানাথ ঠাকুর, যাঁকে পিতৃদেব নামে ডাকতেন তিনি। তাঁর কাছে বিজ্ঞানের অনেক বিষয়ে জানার সুযোগ পান রবীন্দ্রনাথ। একদিন তাঁর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ গিয়েছিলেন ভারতের হিমাচল প্রদেশের ডালহৌসি পাহাড়ে। সন্ধ্যাবেলায় এক ডাকবাংলোর চৌকিতে বসে আকাশ চেনার সুযোগ পান। পিতৃদেবের কাছে নানা নক্ষত্র, গ্রহ চিনেছেন সে সময়। বাবার কাছে বিজ্ঞানের নানা বিষয় জেনে জীবনে প্রথম ধারাবাহিক রচনা লেখেন বিজ্ঞান নিয়ে, বৈজ্ঞানিক সংবাদ নিয়ে। পরে যখন ইংরেজি ভাষা আয়ত্ব করেন, তখন সহজবোধ্য জ্যোতির্বিজ্ঞানের বই পড়তে আগ্রহী হন। স্যার রবার্ট বলের লেখা বই পড়ে বেশ আনন্দ পেতেন। তিনি লিখেছেন, ‘এই আনন্দের অনুসরণ করবার আকাঙ্ক্ষায় নিউকম্বোস, ক্লামরিয়ঁ প্রভৃতি অনেক লেখকের অনেক বই পড়ে গেছি—গলাধঃকরণ করেছি শাসসুদ্ধ বীজযুদ্ধ। তার পরে একসময়ে সাহস করে ধরেছিলুম প্রাণতত্ত্ব সম্বন্ধে হক্সলির একসেট প্রবন্ধমালা। জ্যোতির্বিজ্ঞান আর প্রাণবিজ্ঞান কেবলি এই দুটি বিষয় নিয়ে আমার মন নাড়াচাড়া করেছে।’
বিজ্ঞানের জটিল সব বিষয়কে সহজভাবে জানতে ও লিখতে পছন্দ করতেন রবীন্দ্রনাথ। বিশ্বপরিচয়-এ তিনি লিখেছেন, ‘রাতের আকাশে মাঝে মাঝে নক্ষত্রপুঞ্জের সঙ্গে সঙ্গে দেখা যায় লেপে দেওয়া আলো।
রবীন্দ্ররচনায় বিজ্ঞান
তাঁর বিভিন্ন সাহিত্য রচনায় আমরা বিজ্ঞানের ছাপ দেখি। বিজ্ঞান তো জীবনেরই অংশ। সাহিত্যে সেই বিজ্ঞানের আবহে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দারুণ সব আধুনিক সাহিত্য সৃষ্টি করেন। সবার জন্য বিজ্ঞান জানার বিষয়টিকে বেশ গুরুত্ব দিতেন তিনি। এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ‘শিক্ষা যারা আরম্ভ করেছে, গোড়া থেকেই বিজ্ঞানের ভাণ্ডারে না হোক, বিজ্ঞানের আঙিনায় তাদের প্রবেশ করা অত্যাবশ্যক।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ১৩৪৪ সনের আশ্বিনে বিশ্বপরিচয় বইটি প্রকাশ করেন। বইতে ৬টি অধ্যায় ছিল। সেগুলো হলো পরমাণুলোক, নক্ষত্রলোক, সৌরজগৎ, গ্রহলোক, ভূলোক ও উপসংহার। আমরা সেই বইতে তিনটি চিত্র দেখতে পাই। অ্যান্ড্রোমিডা নীহারিকা, হ্যালির ধূমকেতু (১৯১০) এবং শনি ও পৃথিবীর আয়তনের তুলনামূলক চিত্র। বইটি উৎসর্গ করেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে। তিনি হিগস বোসন কণার সেই বিজ্ঞানী বসু বা বোস। বাংলার মানুষের মনে কেন অবৈজ্ঞানিক ভাব আসে, তা নিয়ে আক্ষেপ ছিল ঠাকুর মশায়ের। তিনি লিখেছেন, ‘আমি বিজ্ঞানের সাধক নই সে কথা বলা বাহুল্য। কিন্তু বালককাল থেকে বিজ্ঞানের রস আস্বাদনে আমার লোভের অন্ত ছিল না।’
বিজ্ঞানের জটিল সব বিষয়কে সহজভাবে জানতে ও লিখতে পছন্দ করতেন রবীন্দ্রনাথ। বিশ্বপরিচয়-এ তিনি লিখেছেন, ‘রাতের আকাশে মাঝে মাঝে নক্ষত্রপুঞ্জের সঙ্গে সঙ্গে দেখা যায় লেপে দেওয়া আলো। তাদের নাম দেওয়া হয়েছে নীহারিকা। এদের মধ্যে কতকগুলি সুদূরবিস্তৃত অতি হাল্কা গ্যাসের মেঘ, আবার কতকগুলি নক্ষত্রের সমাবেশ। দুরবীনে এবং ক্যামেরার যোগে জানা গেছে যে, যে-ভিড় নিয়ে এই শেষোক্ত নীহারিকা, তাতে যত নক্ষত্র জমা হয়েছে, বহু কোটি তার সংখ্যা, অদ্ভুত দ্রুত তাদের গতি। এই যে নক্ষত্রের ভিড় নীহারিকামণ্ডলে অতি দ্রুতবেগে ছুটছে, এরা পরস্পর ধাক্কা লেগে চুরমার হয়ে যায় না কেন। উত্তর দিতে গিয়ে চৈতন্য হোলো এই নক্ষত্রপুঞ্জকে ভিড় বলা ভুল হয়েছে। এদের মধ্যে গলাগলি ঘেঁষাঘেঁষি একেবারেই নেই।’
সহজবোধ্য বাংলায় বিজ্ঞানের নানা বিষয় দেখা যায় তাঁর লেখনীতে। তিনি লিখেছেন, ‘ধূমকেতু শব্দের মানে ধোঁয়ার নিশান। ওর চেহারা দেখে নামটার উৎপত্তি।
বিভিন্ন কঠিন কঠিন বিষয়কে সহজ উদাহরণের মাধ্যমে প্রকাশের চেষ্টা ছিল তাঁর। নক্ষত্রপুঞ্জের উদাহরণে তিনি লেখেন, ‘পরমাণুর অন্তর্গত ইলেকট্রনদের গতিপথের দূরত্ব সম্বন্ধে সর জেমস জীনস যে উপমা দিয়েছেন এই নক্ষত্রমণ্ডলীর সম্বন্ধেও অনুরূপ উপমাই তিনি প্রয়োগ করেছেন। লণ্ডনে ওয়াটর্লু নামে এক মস্ত স্টেশন আছে। যতদূর মনে পড়ে সেটা হাওড়া স্টেশনের চেয়ে বড়োই। স্যর জেমস্ জীনস বলেন সেই স্টেশন থেকে আর সব খালি করে ফেলে কেবল ছটি মাত্র ধুলোর কণা যদি ছড়িয়ে দেওয়া যায় তবে আকাশে নক্ষত্রদের পরস্পর দূরত্ব এই ধূলিকণাদের বিচ্ছেদের সঙ্গে কিছু পরিমাণে তুলনীয় হোতে পারবে। তিনি বলেন, নক্ষত্রের সংখ্যা ও আয়তন যতই হোক আকাশের অচিন্তনীয় শূন্যতার সঙ্গে তার তুলনাই হোতে পারে না।’
আমাদের কাছের নক্ষত্র সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘আমাদের সবচেয়ে কাছের যে তারা, যাকে আমাদের তারা-পাড়ার পড়শি বললে চলে, সংখ্যা সাজিয়ে তার দূরত্ব বোঝাবার চেষ্টা করা বৃথা। সংখ্যা-বাঁধা যে পরিমাণ দূরত্ব মোটামুটি আমাদের পক্ষে বোঝা সহজ, তার সীমা পৃথিবীর গোলকটির মধ্যেই বদ্ধ, যাকে আমরা রেলগাড়ি দিয়ে মোটর দিয়ে স্টীমার দিয়ে চলতে চলতে মেপে যাই। পৃথিবী ছাড়িয়ে নক্ষত্র-বসৃতির সীমানা মাড়ালেই সংখ্যার ভাষাটাকে প্রলাপ বলে মনে হয়। গণিতশাস্ত্র নাক্ষত্রিক হিসাবটার ওপর দিয়ে সংখ্যার যে ডিম পেড়ে চলে সে যেন পৃথিবীর বহুপ্রসূ কীটেরই নকলে।’
সহজবোধ্য বাংলায় বিজ্ঞানের নানা বিষয় দেখা যায় তাঁর লেখনীতে। তিনি লিখেছেন, ‘ধূমকেতু শব্দের মানে ধোঁয়ার নিশান। ওর চেহারা দেখে নামটার উৎপত্তি। গোল মুণ্ড আর তার পিছনে উড়ছে উজ্জ্বল একটা লম্বা পুচ্ছ। সাধারণত এই হোলো ওর আকার। এই পুচ্ছটা অতিসূক্ষ্ম বাষ্পের। এত সূক্ষ্ম যে কখনো কখনো তাকে মাড়িয়ে গিয়েছে পৃথিবী, তবু সেটা অনুভব করতে পারিনি। ওর মুণ্ডটা উল্কাপিণ্ড দিয়ে তৈরি। এখনকার বড়ো বড়ো পণ্ডিতেরা এই মত স্থির করেছেন যে ধূমকেতুরা সূর্যের বাঁধা অনুচরেরই দলে। কয়েকটা থাকতে পারে যারা পরিবারভুক্ত নয় যারা আগন্তুক।’
বিজ্ঞানী আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুকে নিয়ে তিনি বলেন, ‘আচার্য জগদীশ জড় ও জীবের ঐক্যসেতু বিদ্যুতের আলোকে আবিষ্কার করিয়াছেন।
বিজ্ঞানের নানা পথে রবিঠাকুর
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা বিজ্ঞানবিষয়ক নিবন্ধের মধ্যে দেখা যায় সামুদ্রিক জীব, বৈজ্ঞানিক সংবাদ, গতি নির্ণয়ের ইন্দ্রিয়, ইচ্ছামৃত্যু, মাকড়সা-সমাজে স্ত্রীজাতির গৌরব, উটপাখির লাথি, জীবনের শক্তি, ভূতের গল্পের প্রামাণিকতা, মানব শরীর, রোগশত্রু ও দেহরক্ষক সৈন্য, উদয়াস্তের চন্দ্রসূর্য, অভ্যাসজনিত পরিবর্তন, ওলাউঠার বিস্তার, ঈথর/ ইথার, ভূগর্ভস্থ জল এবং বায়ুপ্রবাহ। বিজ্ঞানী আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুকে নিয়ে তিনি বলেন, ‘আচার্য জগদীশ জড় ও জীবের ঐক্যসেতু বিদ্যুতের আলোকে আবিষ্কার করিয়াছেন। আচার্যকে কোনো কোনো জীবতত্ত্ববিদ বলিয়াছিলেন, আপনি তো ধাতব-পদার্থের কণা লইয়া এতদিন পরীক্ষা করিয়া আসিতেছেন, কিন্তু যদি আস্ত একখণ্ড ধাতুপদার্থকে চিম্টি কাটিয়া তাহার মধ্য হইতে এমন কোনো লক্ষণ বাহির করিতে পারেন, জীব-শরীরে চিম্টির সহিত যাহার কোনো সাদৃশ্য পাওয়া যায়, তবে আমরা বুঝি!’ আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুর যুক্তরাজ্যের রয়েল ইনস্টিটিউশনে বক্তৃতার খবর অনুবাদ করেও প্রকাশ করেন রবীন্দ্রনাথ।
এভাবে বিজ্ঞানে তাঁর আগ্রহের কথা প্রকাশ পেয়েছে বারেবারে। তাঁর সাহিত্যের নক্ষত্রমণ্ডলীর সবটাজুড়েই তা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।