আবহাওয়া অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে

বৃষ্টিপাত ও বায়ুপ্রবাহের তারতম্যের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ উষ্ণমণ্ডলীর মৌসুমি জলবায়ুর দেশ। বর্ষাকালে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর কারণে বাংলাদেশে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। বছরের মোট বৃষ্টিপাতের ৭১ শতাংশই হয় বর্ষাকালে। বৃষ্টির পানি আমাদের কৃষি অর্থনীতিতে যেমন ব্যাপক অবদান রাখে, অন্যদিকে অতিভারী বর্ষণের কারণে জনজীবনে ভোগান্তিও আসে নিয়মিত। এই অতিভারী বর্ষণের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এক দিনে দেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হয়েছে ১৯ জুন ২০০১ সালে—৫৯০ মিলিমিটার। এমনকি ঢাকা শহরে সর্বোচ্চ ৩৪১ মিলিমিটার রেকর্ড হয়েছে ১৪ সেপ্টেম্বর ২০০৪ সালে। এ ধরনের অতিভারী বর্ষণের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার ফলে আকস্মিক বন্যা যেমন বেড়ে যাচ্ছে, তেমনি শহরাঞ্চলে দেখা যাচ্ছে ব্যাপক জলাবদ্ধতা। উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে শীতকালে; অর্থাৎ ডিসেম্বর থেকে বায়ুর কারণে ঠান্ডা ও শুষ্ক আবহাওয়া দেখা যায়। সাধারণত উত্তর মেরুর হিমেল হাওয়া দেশের উত্তরাঞ্চল দিয়ে ঢুকতে শুরু করে এবং ক্রমে কমতে থাকে তাপমাত্রা। রাতের তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নামলেই সেটাকে শৈত্যপ্রবাহ বলা হয়।

তাপমাত্রা কমে যদি ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে চলে যায়, তখন সেটা হলো তীব্র শৈত্যপ্রবাহ। সম্প্রতি সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ২ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় ২০১৮ সালের ৮ জানুয়ারি। ইদানীং রাতের তাপমাত্রা হঠাৎ করে নেমে যাচ্ছে। আবার কোনো কোনো বছর শৈত্যপ্রবাহের সংখ্যা কমে যাচ্ছে আনুপাতিক হারে। এ বছরই একটি উষ্ণতম শীতকালের রেকর্ড হয়ে গেল। শীতের গড় তাপমাত্রা ছিল শীতকালের স্বাভাবিক তাপমাত্রার চেয়ে ১ থেকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। গত ডিসেম্বরেও বঙ্গোপসাগরে একটি ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয়। এর প্রভাবে দেশের শীতকালে স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় ৫০০ গুণ বেশি বৃষ্টির রেকর্ড হয়েছে এই শীতে। এটা ছিল দেশের কৃষিতে একটি বড় ধাক্কা।

এই ফেব্রুয়ারি মাসেও স্বাভাবিকের চেয়ে ৫০ শতাংশ বেশি বৃষ্টির রেকর্ড হয়। এর সঙ্গে দেখা গেছে শিলাবৃষ্টি ও বজ্রঝড়। নিকট অতীতে এ ধরনের রেকর্ড নেই বললেই চলে।

প্রশ্ন হলো, এ ধরনের বৈরী আবহাওয়া কেন দেখা যাচ্ছে?

এর প্রধান কারণ হলো পশ্চিমা লঘুচাপ। এর উৎপত্তিস্থল ভূমধ্যসাগর। পৃথিবীর ঊর্ধ্বাকাশের বাতাস পশ্চিম দিক থেকে পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়। আর পশ্চিমা লঘুচাপগুলো বাতাসের দিক অনুসরণ করে ভূমধ্যসাগর থেকে পূর্ব দিকে ধাবিত হয়। কাশ্মীর, দিল্লি, উত্তর প্রদেশ, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ হয়ে এই লঘুচাপ বাংলাদেশে প্রবেশ করে। ফলে বৃষ্টিপাত, কুয়াশা ও উষ্ণ আবহাওয়ার জন্ম হয়। পশ্চিমা লঘুচাপ তৈরি হওয়ার সময়কাল হলো ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত। প্রতিবছর ৪-৬টি তীব্র পশ্চিমা লঘুচাপ তৈরি হয়। প্রতিটি লঘুচাপের আয়ুষ্কাল ২ থেকে ৪ দিন। চলার গতি হলো প্রতি সেকেন্ডে ১০-১২ মিটার। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, পশ্চিমা লঘুচাপের সংখ্যা ক্রমে বেড়ে চলছে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই ফেব্রুয়ারি মাসেই পাঁচটি লঘুচাপ তৈরি হয়েছে।

এখানে মার্চ থেকে মে মাসে ভয়াবহ বজ্রঝড় হয়। এগুলোকে স্থানীয়ভাবে কালবৈশাখী বলা হয়। এই সময় তাপমাত্রা বেশি থাকে। দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৬ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকে দেশের উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিম এলাকাগুলোতে। তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হলেই সেটাকে দাবদাহ বলে। মাঝেমধ্যে তীব্র দাবদাহ; অর্থাৎ ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রাও উঠে যায়।

ইতিহাসে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪৫ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস, রাজশাহীতে ১৯৭২ সালের ১৯ মে। দেশের মোট বৃষ্টির ১৯ শতাংশ হয় এই সময়ে।

বঙ্গোপসাগরে উষ্ণমণ্ডলীয় ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয় সাধারণত বর্ষা ঋতুর আগে এপ্রিল-মে মাসে। বর্ষার পরে অক্টোবর-নভেম্বর মাসে আবার ঘূর্ণিঝড় হয়। বঙ্গোপসাগরের সৃষ্ট ঝড়গুলো প্রায় আমাদের দেশে চলে আসে এবং ব্যাপক প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি ঘটায়। সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা বাড়ছে। সিডর, আইলা, ফণী, আম্পান ইত্যাদি ঘূর্ণিঝড় দেখেছি, ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এগুলো থেকে।

বিশ্ব উষ্ণায়নের সঙ্গে বাংলাদেশের তাপমাত্রাও বেড়ে চলছে। গত ১০০ বছরে ১ থেকে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বেড়েছে। আর আগামী ২১০০ সালে এটা বেড়ে দাঁড়াবে ২ থেকে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি। তাই আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা মাথায় রেখে আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তন বিরোধী কর্মকাণ্ড বন্ধ করা অতি জরুরি এই মুহূর্তেই।

লেখক: আবহাওয়াবিদ, বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর