সুপারচার্জড বায়োটেক ধান

নিপ্পনবেয়ার নামে একটি জাতের জিনের দ্বিতীয় অনুলিপি ইনসার্ট করে ফলন ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়াতে সক্ষম হয়েছেন একদল গবেষক। OsDREB1C নামে পরিচিত জিনের একটি অতিরিক্ত অনুলিপি নিপ্পনবেয়ার ধানের জাতে প্রবেশ করিয়েছে চায়নিজ একাডেমি অব অ্যাগ্রিকালচারাল সায়েন্সেসের গবেষক দলটি।

এই জেনেটিক পরিবর্তন ধানগাছকে আরও বেশি সার শোষণক্ষম করতে সাহায্য করে। সালোকসংশ্লেষণের হার বেড়ে যায় বহুগুণ। ফলে ফুল ফোটা হয় ত্বরান্বিত। এসব বৈশিষ্ট্যই প্রধান প্রধান দানাদার ফসলের ফলনে বিশেষ অবদান রাখে বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। এ বিষয়ে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে সায়েন্স–এ, ২৩ জুলাই।

চায়নিজ একাডেমি অব অ্যাগ্রিকালচারাল সায়েন্সেসের বিজ্ঞানী শাওবো ওয়েই এবং জিয়া লি একটি গ্রিনহাউস পরীক্ষা করেন। তাতে দেখা গেছে, জিনবিহীন গাছগুলো জিন নিয়ন্ত্রণাধীন গাছের তুলনায় কম বৃদ্ধি পেয়েছে। যেসব গাছে OsDREB1C-এর অতিরিক্ত কপি যুক্ত করা হয়েছে, সেগুলোর চারা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে।

এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের রোথামস্টেড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের জেনেটিসিস্ট ম্যাথিউ পল বলেন, ‘আমি মনে করি না, আগে এ রকম সাফল্য দেখেছি। অন্যান্য ফসলেও এই পদ্ধতি ব্যবহারের চেষ্টা করা যেতে পারে।’

একটি ফসলের ফলন অত্যন্ত জটিল প্রক্রিয়ার ওপর নির্ভর করে। কারণ, অনেক জিন উদ্ভিদের উৎপাদনশীলতাকে প্রভাবিত করে। দীর্ঘদীন ধরে জীবপ্রযুক্তিবিদেরা ফসলে একক জিনের অনুসন্ধান করেছেন, যেটি এককভাবে ফলন বাড়ানোর জন্য দায়ী। সাম্প্রতিককালে এ ধরনের বেশ কিছু কাজ হয়েছে। তাঁরা কিছু জিনগুলো স্থানান্তর করেছেন, সেগুলো অন্যান্য জিনকে নিয়ন্ত্রণ করে। এ ছাড়া এটি মাটি থেকে পুষ্টি গ্রহণ, সালোকসংশ্লেষণের গতি বৃদ্ধি এবং পাতা থেকে বীজে খাদ্যের পরিচলন বা সংস্থান নিয়ন্ত্রণ করে। ভুট্টায় এ ধরনের একটি জিন পরিবর্তন করে ১০ শতাংশের বেশি ফলন পাওয়া সম্ভব। ফলে প্রচলিত উদ্ভিদ প্রজননপদ্ধতির তুলনায় একে একটি বড় অর্জন বলে মনে করছেন তাঁরা।

সম্ভাব্য ফলন বৃদ্ধিকারক জিন খুঁজে বের করার জন্য চায়নিজ একাডেমি অব অ্যাগ্রিকালচারাল সায়েন্সেসের উদ্ভিদবিজ্ঞানী ওয়েনবিন ঝোর নেতৃত্বে একটি দল কাজ করছে। তারা ১১৮টি ধান ও ভুট্টার নিয়ন্ত্রক জিনগুলো চিহ্নিত করেছে, সেগুলো ট্রান্সক্রিপশন ফ্যাক্টর নামের প্রোটিনগুলো এনকোড করতে পারে।

প্রচলিত সালোকসংশ্লেষণে প্রভাব বিস্তার করতে পারে, এমন সম্ভাব্য গুরুত্বপূর্ণ জিন চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু ঝোর দল কম নাইট্রোজেনসমৃদ্ধ মাটিতে জন্মানো ধানে কোনো জিন সক্রিয় হয় কি না, তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছিল। কারণ, এ ধরনের জিন মাটি থেকে গাছের পুষ্টি গ্রহণের হার বাড়িয়ে তুলতে পারে। দলটি ১৩টি জিন খুঁজে পেয়েছে। সেগুলো কম নাইট্রোজেনসমৃদ্ধ মাটিতে ধানের চারা জন্মানোর সময় তৈরি হয়। এর মধ্যে পাঁচটি জিন নাইট্রোজেন গ্রহণের হার চার গুণ বা তার চেয়ে বেশি বাড়িয়ে দিতে সক্ষম। ভালো পুষ্টিগুণসম্পন্ন হওয়ার একটি কারণ হলো OsDREB1C। এর অতিরিক্ত কপিসহ গাছগুলো তাদের শিকড়ের মাধ্যমে অতিরিক্ত নাইট্রোজেন গ্রহণ করে এবং এর বেশি অংশ অঙ্কুরে স্থানান্তরিত করে।

এভাবে রূপান্তরিত বা সংশোধিত উদ্ভিদগুলো সালোকসংশ্লেষণে আরও দক্ষ হয়ে ওঠে। এগুলোতে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বেশি ক্লোরোপ্লাস্ট থাকে। এসব উদ্ভিদের মধ্যে সালোকসংশ্লেষী উপাদানও েবশি থাকে। এ ছাড়া এদের পাতায় সালোকসংশ্লেষণের অন্যতম এনজাইম RuBisCO পরিমাণ ৩৮ শতাংশ বেশি থাকে। এ পদ্ধতিতে উদ্ভাবিত উন্নত ধান গত দু–তিন বছরে চীনের তিনটি স্থানে চাষ করা হয়েছে। এগুলো মূলত নাতিশীতোষ্ণ ও গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে উচ্চ ফলন দিয়েছে। গবেষকেরা জিনের একটি অতিরিক্ত অনুলিপি যোগ করে কৃষকদের রোপণ করা একটি উচ্চফলনশীল ধানের জাতও রূপান্তর করেছেন। গবেষকেরা রিপোর্ট করেছেন, এ পরিবর্তিত আধুনিক ধানগাছগুলো প্রতি প্লটে ফলন দিয়েছে ৪০ শতাংশ বেশি। ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি অব ডেভিসের জেনেটিসিস্ট প্যাম রোনাল্ড বলেন, ৪০ শতাংশ ফলন বৃদ্ধি একটি বড় অর্জন এবং আশ্চর্যজনক ব্যাপারও বটে।

ইউনিভার্সিটি অব ইলিনেয়ের আরবানা–শ্যাম্পেইনের উদ্ভিদ শারীরতত্ত্ববিদ স্টিভ লং। তিনি জানান, গ্রিনহাউস পরীক্ষার মতো মাঠেও এ রূপান্তরিত গাছগুলো বেশি ফলন দিয়েছে, এটা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। গবেষকেরা খুব ভালো ধানের জাত নির্বাচন করেছেন। েয ফল তাঁরা পেয়েছেন, তা প্রচলিত উদ্ভিদ প্রজননপদ্ধতির চেয়ে বৈচিত্র্যের দিক থেকে অনেক বেশি চমকপ্রদ ও বিশ্বাসযোগ্য।

এ পদ্ধতিতে রূপান্তরিত গাছগুলোতে তাড়াতাড়ি ফুল ফোটে, যাতে তাদের ছড়ায় শস্যদানা তৈরিতে আরও বেশি সময় পায়। পরিবেশের ওপর নির্ভর করে দ্রুত ফুল ফোটানোর ক্ষেত্রে এটি একটি কার্যকর জাত হতে পারে। এই জাত কৃষকদের প্রতি মৌসুমে আরও বেশি ফসল ফলাতে বা গ্রীষ্মের তাপ প্রখর হওয়ার আগে ফসল কাটা বা অন্যান্য সুবিধা দিতে পারে। যদিও পরিবর্তিত নিপ্পনবেয়ারে ১৯ দিন আগে ফুল ফোটে, যেখানে ব্যাপকভাবে চাষ করা অন্য জাতে মাত্র দুই দিন আগে ফুল ফুটেছে।

বৃহত্তর সম্ভাবনার আশায় গবেষক দলটি গমের একটি জাতের সঙ্গে ধানের OsDREB1C জিন যুক্ত করে একই ধরনের প্রভাব খুঁজে পেয়েছেন। OsDREB1C এবং অনুরূপ জিনগুলো কেবল ধান, গম ও অন্যান্য ঘাসজাতীয় ফসলেই নয়, চওড়া পাতাযুক্ত অনেক উদ্ভিদেও রয়েছে। গবেষকেরা অ্যারাবিডোপসিস নামে একধরনের শর্ষেগাছে এই জিনের একটি অতিরিক্ত অনুলিপি যোগ করে তুলনামূলক ভালো ফল পেয়েছেন।

ঝো ও তাঁর দলের উদ্ভাবিত ট্রান্সজেনিক ধানের জাত কিছু ভোক্তার কাছে অগ্রহণযোগ্য হতে পারে। কিন্তু তাঁরা বলছেন, এই ফলন বৃদ্ধি উদ্ভিদের নিজস্ব জিন সম্পাদনা করে সম্পন্ন করা হলে সমস্যার কিছু দেখেন না, যদি তা অন্য উদ্ভিদ বা উৎস থেকে স্থানান্তর না করা হয়। এটিকে কিছু দেশে এখন ট্রান্সজেনিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের চেয়ে সহজভাবে দেখা হয়। আরেকটি সুবিধা হলো, ফসলের নাইট্রোজেন গ্রহণের হার ও দক্ষতা বৃদ্ধি। এর ফলে ধানের জমিতে অতিরিক্ত সার ব্যবহােরর ফলে জলবায়ু দূষণের যে মাত্র, েসটিও হ্রাস করতে পারে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী মি. স্টিভেন কেলি বলেন, উন্নত সালোকসংশ্লেষণ দক্ষতার কারণে এই উদ্ভাবন বিশ্বব্যাপী খাদ্য উৎপাদনে নতুন মাত্রা যোগ করবে। তিনি আরও বলেন, ‘তাঁরা যদি সঠিক ট্রান্সক্রিপশন ফ্যাক্টর পেয়ে থাকেন, তবে এটি বৈশ্বিক খাদ্যনিরাপত্তার জন্য একটি বিশাল অর্জন বলে আমি মনে করি। আমি নিশ্চিত, এ থেকে দারুণ কিছু হবে।’

লেখক: ঊর্ধ্বতন যোগাযোগ কর্মকর্তা, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট