কে পাবেন এবারের পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল

৩ অক্টোবর, মঙ্গলবার জানা যাবে এ বছর পদার্থবিজ্ঞানে কারা নোবেল পুরস্কার পাচ্ছেন। তার আগে জেনে নিন এমন কিছু গবেষণার কথা, যেগুলো এ বছর পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেতে পারে।

নোবেল পুরস্কার

পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে সম্মানিত এই পুরস্কার কাদের হাতে যাবে, তা নিয়ে সবার মধ্যেই কম-বেশি কৌতূহল থাকে। বহুল প্রতীক্ষিত এ পুরস্কারের পুরো প্রক্রিয়া বরাবরই সর্বোচ্চ গোপনীয়তায় ঢাকা। কারা মনোনীত হয়েছেন, তা জানতে অপেক্ষা করতে হয় বহু বছর। তবু আমাদের কৌতূহল থেমে থাকে না। এই লেখায় তাই অনুমানের চেষ্টা করব সম্ভাব্য নোবেলজয়ীদের নাম। সংক্ষেপে জানার চেষ্টা করব, কেন তাঁদের হাতে যেতে পারে এ বছরের পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল।

পদার্থবিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ যে কাজগুলো এখনো নোবেল পুরস্কার পায়নি, সেগুলো প্রায় প্রতিবারই সম্ভাব্য বিজয়ী হিসেবে বিবেচিত হয়। তাই গত বছরের তালিকার প্রায় সবাই থাকবেন এবারও। পদার্থবিজ্ঞানের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার, যেমন উলফ প্রাইজ, ব্রেকথ্রু প্রাইজ, ডিরাক মেডেল, নিউটন মেডেল ইত্যাদি পুরস্কারও ভবিষ্যত নোবেলজয়ী হওয়ার ভালো পূর্বাভাস দেয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৯৭৮ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে দেওয়া ২৬ উলফ প্রাইজ জয়ীর ১৪ জনই পরে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। আবার গবেষণাপত্রের সাইটেশন, এইচ-ইনডেক্স ইত্যাদিও গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা বোঝার ভালো উপায়। তবে অনেক বছর দেখা যায়, আলোচনার বাইরের কোনো পুরোনো গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারকে নোবেল দেওয়া হয়েছে। আরেকটি মজার ধারা গত দুই দশক ধরে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দু-এক বছর পরপর একবার মহাবিশ্ব (জ্যোতির্বিজ্ঞান বা কণাপদার্থবিজ্ঞান) তো অন্যবার আলো ও পদার্থ (Light-Matter)—এভাবে পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। এই ধারার বাইরে গিয়ে অনেক বছর পর স্ট্যাটিসটিক্যাল ফিজিকস বা পরিসংখ্যানমূলক পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল দেওয়া হয় ২০২১ সালে। ২০২২-এ আবার কোয়ান্টাম বলবিদ্যার মৌলিক বিষয়ে দেওয়া হয় নোবেল পুরস্কার।

যাহোক, এবারে চলুন দেখে নিই কাদের হাতে উঠতে পারে এবারের পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল।

কোয়ান্টাম কম্পিউটিং: চার্লস এইচ বেনেট, জিলে ব্রাসা, পিটার শর, ডেভিড ডয়েচ, ইগ্নাসিও সিরাক, পিটার জোলার

গত দশক ও সামনের কয়েক দশকের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিগত আবিষ্কার হতে যাচ্ছে কোয়ান্টাম কম্পিউটার। চার্লস বেনেট ও জিলে ব্রাসা যুগ্মভাবে আবিষ্কার করেন কোয়ান্টাম ক্রিপ্টোগ্রাফির বিবি৮৪ (BB84) প্রোটোকল। দুজন মিলে ২০১৮ সালে পেয়েছেন উলফ প্রাইজ। ২০১৭ সালে বেনেট পান ডিরাক মেডেল। এতে তাঁর সঙ্গী ছিলেন পিটার শর ও ডেভিড ডয়েচ। পিটার শর তাঁর শর অ্যালগোরিদমের জন্য বিখ্যাত। এই অ্যালগোরিদম ব্যবহার করে কোয়ান্টাম কম্পিউটার সাধারণ কম্পিউটারের তুলনায় অনেক অনেক গুণ দ্রুত ক্রিপ্টোগ্রাফি ভাঙতে পারে। ডেভিড ডয়েচ কোয়ান্টাম টুরিং মেশিন ও বেল ইনেকুয়ালিটি বা অপ্রতিসমতা নিয়ে কাজ করেছেন। এই চারজন একসঙ্গে পেয়েছেন ২০২৩ সালের ফান্ডামেন্টাল ফিজিকস ব্রেকথ্রু প্রাইজ। এই চারজনের মধ্যে দুই বা তিনজনকে (সর্বোচ্চ তিনজনকে নোবেল পুরস্কার ভাগ করে দেওয়া হয়) একসঙ্গে নোবেল পুরস্কার পেতে দেখা যেতে পারে।

এদের বাইরে কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের ব্যবহারিক দিক চিন্তা করলে ইগ্নাসিও সিরাক ও পিটার জোলারকে যুগ্মভাবে বিবেচনা করা হতে পারে। তাঁরা যৌথভাবে আয়ন ও কোল্ড অ্যাটম সিস্টেম ব্যবহার করে কোয়ান্টাম কম্পিউটার ও সিমুলেটর তৈরির থিওরি বা তাত্ত্বিক দিক ও এক্সপেরিমেন্ট বা পরীক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। দুজন যৌথভাবে পেয়েছিলেন ২০১৩ সালের উলফ প্রাইজ। জোলার ডিরাক মেডেলও পেয়েছেন।

লেজার ফিজিকস: পল করকাম, ফেরেঙ্ক ক্রাউস, আন লুইলিয়ে, ফেদেরিকো কাপাসো

অটোসেকেন্ড লেজার ও আল্ট্রাফাস্ট (অতি দ্রুতগতির) পদার্থবিজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখায় সর্বশেষ উলফ প্রাইজ পেয়েছেন করকাম, ক্রাউস ও লুইলিয়ে। উলফ প্রাইজ বিজয়ীরা প্রায়ই নোবেল পুরস্কার পান বলে তাঁদেরও সম্ভাব্য বিজয়ীর তালিকায় রাখতে হবে। তাঁদের মধ্যে দুজনের সঙ্গে কোনোভাবে যুক্ত করা হতে পারে ফেদেরিকো কাপাসোকে। কোয়ান্টাম ক্যাসকেড লেজার, মেটাসারফেস, প্লাসমোনিকসে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে।

কসমোলজি: ভিয়াতচেশ্লাভ মুখানভ, রাশিদ  সুনায়েভ, আলেক্সেই স্টারোবিন্সকি, আলান গুথ, আন্দ্রেই লিন্ডে

মহাবিশ্বের শুরুতে পদার্থ ও আলো ছিল সমানভাবে বিস্তৃত, ঠিক স্যুপের মতো। তাহলে আজ কেন মহাবিশ্বের সব ভর গ্যালাক্সির মতো কম্প্যাক্ট অবস্থায় বা একসঙ্গে আছে? এর সমাধান হিসেবে মুখানভ ও চিবিসভ কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের ধারণা দেন। কসমোলজিক্যাল ইনফ্লেশন বা মহাজাগতিক স্ফীতির মাধ্যমে কীভাবে এই ঘনত্বের পরিবর্তন বর্তমান মহাবিশ্ব পর্যন্ত এসেছে, সে বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন স্টারোবিন্সকি। সুনায়েভ ও জেলডোভিচ সময়ের সঙ্গে এই ফ্লাকচুয়েশন কীভাবে পরিবর্তিত হয়েছে এবং বর্তমান পর্যবেক্ষণ কীভাবে মহাবিশ্বের প্রাথমিক অবস্থার ধারণা দিতে পারে, তার তত্ত্ব দেন। আদর্শ ব্ল্যাকবডি বা কৃষ্ণবস্তু থেকে মহাজাগতিক পটভূমি বিকিরণ বা সিএমবিআরের (CMBR) সামান্য যে পরিবর্তন ধরা পড়ে, তাঁদের নামে এর নামকরণ হয়েছে সুনায়েভ-জেলডোভিচ ইফেক্ট। চিবিসভ ও জেলডোভিচ ইতিমধ্যে মারা গিয়েছেন। মুখানভ, সুনায়েভ, স্টারোবিন্সকি একসঙ্গে আগে পেয়েছেন ২০১৯ সালের ডিরাক মেডেল।

অন্যদিকে, নোবেল কমিটি যদি মহাজাগতিক স্ফীতির বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দেয়, তাহলে স্টারোবিন্সকির সঙ্গে যুক্ত হবেন অ্যালান গুথ ও আন্দ্রেই লিন্ডে। তাঁরা তিনজন আগে একসঙ্গে পেয়েছেন ২০১৪ সালের কাভলি প্রাইজ। লিন্ডে ও গুথ একসঙ্গে পেয়েছেন ব্রেকথ্রু প্রাইজ ও গ্রুবার প্রাইজ।

তবে এরাই যে এবার নোবেল পাবেন, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এসবই শুধু অনুমান। আসলেই কাদের হাতে এই গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার উঠবে, তা জানতে অপেক্ষা করতে হবে ৩ অক্টোবর পর্যন্ত। দেখা যাক, কী হয়!

লেখক: স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী, প্যারিস অবজারভেটরি