বিজ্ঞান জাদুঘরে একবেলা

আজ বিশ্ব জাদুঘর দিবস। আন্তর্জাতিকভাবে জাদুঘরগুলো যেসব সমস্যার সম্মুখীন হয়, সেগুলোকে প্রতিফলিত করে প্রতিবছর প্রতিপাদ্য পরিবর্তন হয়। এ বছরের প্রতিপাদ্য জাদুঘরের স্থায়িত্ব ও সমৃদ্ধি।

রাজধানীর আগারগাঁওয়ে শান্ত-নিরিবিলি পরিবেশে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর। চলুন, আন্তর্জাতিক জাদুঘর দিবসে ঘুরে আসি আমাদের বিজ্ঞান জাদুঘরে।

উইকিপিডিয়া
মজা নিয়ে বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য আমাদের সবেধন নীলমণি হলো জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর। ছুটির দিনের একঘেয়েমি কাটানোর পাশাপাশি বিজ্ঞানের মজাটাও উপভোগ করা যায় এখানে। তাই অন্তত এক দিনের জন্য হলেও রাজধানীর আগারগাঁওয়ের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরে ঘুরে আসা উচিত

‘মামা, এই যে জন্তুটা, এরা কি সত্যিই ছিল?’ বিরাট ডাইনোসরটার দিকে একবার তাকিয়ে ভাড়া নিতে নিতে কথাটা জিজ্ঞেস করলেন রিকশাচালক।

‘ছিল তো।’ জবাব দিলাম।

‘এরা তাইলে গেল কই?’ রিকশাচালকের খুব কৌতূহল।

‘বিলুপ্ত হয়ে গেছে।’ বিজ্ঞের মতো ভাব নিয়ে বললাম।

‘ভাগ্যিস, গেছে। যে বিরাট সাইজ, বাঁইচা থাকলে বনবাদাড় সব খাইয়া শ্যাষ কইরা ফেলত।’ বলেই আর দাঁড়ালেন না রিকশাচালক।

হেসে বিজ্ঞান জাদুঘরের ফটকের দিকে এগোলাম। এই একটা জায়গায়ই ঈষৎ হাঁ করে অতিথিদের স্বাগত জানায় বিরাট উচ্চতার টি-রেক্স। এই প্রজাতির ডাইনোসরের দৈর্ঘ্য অনুযায়ী তৈরি করা হয়েছে ভাস্কর্যটি। ডাইনোসরটি জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরের প্রতীকেই পরিণত হয়ে গেছে। দূর থেকেই দেখা যায় ডাইনোসরটি। এর ঠিক পাশেই আছে সৌরজগৎ। আমাদের সৌরজগৎ পাথর কিংবা গ্যাস দিয়ে তৈরি হলেও এই সৌরজগৎ ঝোপালো গাছ দিয়ে তৈরি। তাই এর নাম সৌরবাগান। বৃহস্পতি-শনি এখানে স্থির হয়ে আছে। ওপর থেকে দেখলে মনে হয়, ডাইনোসর সৌরবাগানের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টার করছে তাদের বিলুপ্ত হওয়ার কারণ।

বিজ্ঞান জাদুঘরের ফটকে বিশাল ডাইনোসরের প্রতিকৃতি
ছবি: খালেদ সরকার, তানভীর আহমেদ

একটু এগোলেই দেখা যায় সূর্যঘড়ি। কোনো ব্যাটারি কিংবা কাঁটা ছাড়াই কেবল সূর্যের আলো-ছায়ার মাধ্যমে আপনি বুঝতে পারবেন সময়। তবে আমি যখন গিয়েছিলাম, তখন সূর্যের আলো তেমন ছিল না। তাতে অবশ্য সমস্যা হয়নি, হাতের ঘড়ি দেখেই বুঝে নিয়েছি, বারোটা বেজে গেছে। বাইরে ঘোরাঘুরি না করে ভেতরে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। কারণ, জাদুঘরের আসল প্রদর্শনী তো ভেতরেই।

ঢাকার আগারগাঁওয়ে অবস্থিত জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরে সাধারণত দুই ধরনের মানুষ আসে।

১. যারা বিজ্ঞান বোঝে

২. যারা বিজ্ঞান বোঝে না

আমি দ্বিতীয় দলের প্রতিনিধি। কিন্তু মাত্র ১০ টাকার টিকিট কেটে ভেতরে ঢোকার পর আমার মতো অবৈজ্ঞানিক মানুষকেও দেখা গেল নিউটনের সূত্র, মাধ্যাকর্ষণ বল কিংবা গতিবিদ্যার নানা তত্ত্ব শুনে আগ্রহের সঙ্গে মাথা দোলাতে। জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরের উদ্দেশ্য একটাই—সব মানুষকে বিজ্ঞানমনস্ক করে তোলা এবং মানুষের ভেতরে বিজ্ঞানবিষয়ক সচেতনতা তৈরি করা। জাদুঘরের মহাপরিচালক মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী বলেন, ‘কুসংস্কারমুক্ত বিজ্ঞানসচেতন সমাজ গড়তে শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা থাকাটা জরুরি। এ জন্য শিক্ষার্থীরা যাতে মজা নিয়ে বিজ্ঞান শিখতে পারে, তার সব ব্যবস্থা রয়েছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরে।’

সেই লক্ষ্য নিয়েই ১৯৬৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর। সাধারণত দেশের কোনো জাদুঘরেই আপনি জাদুর দেখা পাবেন না। জাদুঘর মানেই অতীতের স্মৃতিরোমন্থন। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম সাতটি গ্যালারিতে সাজানো জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর। এখানে বিজ্ঞানের জাদু তো আছেই, আছে ভবিষ্যতের পৃথিবীর আভাস। আর অতীত তো আছেই। শিক্ষার্থীরা পাঠ্যবইতে যে বিজ্ঞান পড়ে, তার প্রায়োগিক জ্ঞান তারা এই জাদুঘরে এসে নিতে পারবে খুব ভালোভাবেই।

সৌরঘড়ির কার্যকারিতা বুঝিেয় দিচ্ছেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরের কিউরেটর সুকল্যান বাছাড়

প্রদর্শনীর একটা অংশে রয়েছে নিউটনের প্রথম সূত্রের প্রমাণ। ‘বাইরে থেকে কোনো বস্তুর ওপর বল প্রয়োগ না করলে স্থির বস্তু চিরকাল স্থির থাকবে এবং গতিশীল বস্তু চিরকাল সমবেগে সরলরেখায় বা সরল পথে চলতে থাকবে’—পাঠ্যবইতে থাকা এই সূত্র পড়েই বড় হয়েছি আমরা সবাই। কিন্তু সূত্রটা আসলে ঠিক কীভাবে কাজ করে, তা বোঝা হয়নি সেভাবে। ছোটবেলায় স্কুলের স্যারকে যখন বলেছিলাম, ‘স্যার, বুঝতে পারছি না’। স্যার কড়া গলায় বলেছিলেন, ‘কান ধরে দাঁড়িয়ে মুখস্থ করতে থাক। বুঝতে পারবি।’

কান ধরে না দাঁড়িয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরে এলে খুব সহজে বোঝা যেত কীভাবে বাইরে থেকে বল প্রয়োগে একটা স্থির বস্তু গতিশীল থাকে। নিউটনের বাকি দুটি সূত্রের প্রমাণও রয়েছে জাদুঘরে।

শুধু যে বিজ্ঞানের সূত্রের প্রমাণ দিয়েই পরিপূর্ণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর, তা বললে ভুল হবে। মূলত বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখাকে এক ছাদের নিচে নিয়ে আসার চেষ্টা করেছে জাদুঘর কর্তৃপক্ষ। আছে পদার্থবিজ্ঞান গ্যালারি, জীববিজ্ঞান গ্যালারি, পরমাণু কর্নার। আছে বাংলাদেশের সেরা বিজ্ঞানীদের ব্যবহার্য জিনিসপত্র নিয়ে একটি অংশ। প্রদর্শনীর এই অংশ দেখলেই অনুধাবন করা যায়, সে সময় কত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও কত বড় বড় গবেষণা করে গেছেন সত্যেন বোস কিংবা কুদরাত-এ-খুদার মতো বিজ্ঞানীরা। কয়েক ঘণ্টার জন্য শহরের জ্যাম, ধুলা, অফিসের চাপ, বাসের ভিড় ভুলে দর্শকেরা হারিয়ে যেতে পারবেন বিজ্ঞানের দুনিয়ায়।

হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম শিল্পপ্রযুক্তি গ্যালারিতে। বিভিন্ন শিল্পের প্রাচীন যন্ত্রপাতি থেকে শুরু করে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি দেখলে বোঝা যায়, কীভাবে দিন দিন আধুনিকতার দিকে এগিয়েছি আমরা। বাংলাদেশের প্রথম আইবিএম কম্পিউটারটিও রাখা আছে এই গ্যালারিতে। বর্তমান যুগের সহজে বহনযোগ্য কম্পিউটার ব্যবহারের পর সীমিত শক্তির বিশাল এই কম্পিউটার দেখে বিস্মিতই হতে হয়।

ভ্রাম্যমান ল্যাবরেটরি হিসেবে ব্যবহৃত হয় এমন ছয়টি বাস
বিজ্ঞানবিষয়ক ত্রিমাত্রিক সিনেমা দেখার ব্যবস্থা রয়েছে ভ্রাম্যমান বাসে

বিস্ময়ের ঘোর আরও বাড়ে মহাকাশ বিজ্ঞান গ্যালারিতে এসে। কৃত্রিম একটা সৌরজগৎ আছে, আছে টেলিস্কোপের রেপ্লিকা, ছাদের ওপর ছোট একটা মানমন্দির।

জীববিজ্ঞান গ্যালারিতে ঢোকার মুখেই দেখতে পেলাম বিশাল এক তিমির কঙ্কাল। ২০০৬ সালে চট্টগ্রামের কাট্টলি সমুদ্র উপকূলে ধরা পড়া তিমিটি দীর্ঘদিন ধরেই জাদুঘরের বাসিন্দা।

একটা গ্যালারিতে ঢুকে চমকে উঠলাম। বাঁ পাশে দেখি, বাক্সের ওপর বেশ কিছু ফল। তার মাঝখানে তরুণীর ছিন্ন মস্তক! চমকে ওঠার মতোই ব্যাপার। একটু এগোতেই বুঝলাম, এটা অপটিক্যাল ইলিউশন। কঙ্কালের সাইকেল চালানো, আয়না দিয়ে ইনফিনিটির জগৎ তৈরির চেষ্টা—এমন মজার মজার প্রজেক্ট নিয়ে সাজানো হয়েছে মজার গ্যালারি। নানা তত্ত্ব-আলোচনা, বৈজ্ঞানিক প্রমাণের মধ্যে বিনোদন দেওয়ার জন্যই এই মজার বিজ্ঞান গ্যালারি। এখানেই আছে জাদুর কেটলি। কেটলির পানির কোনো শেষ নেই, অনবরত পানি পড়ছে। কেন? জানতে হলে একদিন দলবল নিয়ে ঘুরে আসতে পারেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরে।

গ্যালারিগুলো ঘুরতে গিয়ে কয়েক ঘণ্টা কখন পার হয়ে গেল, টেরই পেলাম না। মূল ভবন থেকে বেরিয়ে এসেই চোখে পড়ল ‘মহাকাশের সন্ধানে-২’ নামের একটি বিশাল বাস। মহাকাশের সন্ধানে স্পেসশিপ যায় শুনেছি, প্রযুক্তির উৎকর্ষে আজকাল কি বাসও মহাকাশে যাচ্ছে? কিউরেটর জানালেন, বাস যাচ্ছে ঠিকই, তবে মহাকাশে নয়; বিভিন্ন জেলায়। বিশেষায়িত এই বাস থেকে আকাশ দেখার সুব্যবস্থা আছে। জাদুঘর ভবনের পাশেই রয়েছে এমন বেশ কয়েকটি আধুনিক বাস। এই বাসগুলো একেকটা মিনি বিজ্ঞান জাদুঘর। এ রকম ছয়টি বাস আছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরের। বিশেষায়িত ওই বাসে আকাশ দেখার জন্য স্কুল-কলেজ কর্তৃপক্ষ আবেদন করলেই সাড়া দেয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষ। বিভিন্ন জেলায় গিয়ে প্রদর্শনী করে আসে এই বাসগুলো। আবেদন করার পুরো প্রক্রিয়াই সম্পন্ন করা যায় অনলাইনে।

কাটা মুণ্ডু দেখে আঁতকে উঠবেন না, আয়না আর অপটিক্যাল ইলিউশনের চমৎকার সমন্বয় এটি
জাদুঘরের নিচতলায় বিশাল এক তিমির কঙ্কাল

আবেদন করা থেকে শুরু করে যাবতীয় তথ্যের জন্য একটা ওয়েবসাইট আছে জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরের। www.nmst.gov.bd সাইটের হোমপেজের গাছ বিিক্রর দরপত্র কিংবা অন্যান্য আদেশ, কর্মবণ্টন–সংবলিত নোটিশ বোর্ড এড়িয়ে ডানের ট্যাবগুলোতেই পাবেন প্রয়োজনীয় তথ্য ও লিংক। ওপরেই আছে প্রদর্শনীর সময়সূচি, আকাশ দেখা কার্যক্রম–সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য। আপনি চাইলে জাদুঘরের ই–টিকিট ওয়েবসাইট থেকে কিনতে পারেন। তবে কোনো কারণে এই লিংক কাজ না করলেও সমস্যা নেই। জাদুঘরের গেটেই আছে টিকিট কেনার সুব্যবস্থা।

জাদুঘর কর্তৃপক্ষ জানায়, প্রতিনিয়ত নতুন নতুন সংগ্রহ যুক্ত করার চেষ্টা করছে তারা। এক পাশে তৈরি হচ্ছে টাইটানিক আদলের বিশাল এক জাহাজ। পানির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা এই টাইটানিকে উঠতে পারবেন দর্শনার্থীরা। তুলতে পারবেন ছবি। পাশাপাশি সামনাসামনি বুঝতে পারবেন টাইটানিক ডুবে যাওয়ার কারণ। কীভাবে আইসবার্গের সঙ্গে ধাক্কা লেগে ডুবে গিয়েছিল অতিকায় টাইটানিক, তা সহজভাবে বোঝানোর জন্যই নির্মিত হচ্ছে এই জাহাজ।

রবি থেকে বুধবার সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর। ফলে শিক্ষার্থী কিংবা চাকরিজীবীদের জন্য সময় বের করাটা একটু কঠিনই বটে। তবে চিন্তা নেই, শুক্রবারও খোলা থাকে জাদুঘর। এটা শুনে খুশি হয়ে সকাল সকাল চলে যাবেন না যেন। শুক্রবার জাদুঘর খোলে বেলা আড়াইটা থেকে। চলে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত। আকাশ পরিষ্কার থাকলে শুক্র ও শনিবার বিকেল থেকে জাদুঘরের ছাদে শুরু হয় আকাশ পর্যবেক্ষণ কর্মসূচি। সব মিলিয়ে ছুটির দিনটা বেশ ভালোভাবেই কাটাতে পারবেন জাদুঘরে।

লেখক: সহযোগী সম্পাদক, কিশোর আলো