শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস
মুক্তিযুদ্ধে ঝরে যাওয়া এক বিজ্ঞান সাধকের কথা
৩০ লাখ মানুষের রক্ত ও প্রাণের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি এই স্বাধীন দেশ। বাংলাদেশ। ৭১-এ পাক সেনাবাহিনী যে নির্মম তাণ্ডব চালিয়েছিল এ দেশে, তার জবাব দিয়েছিল বাংলার সাধারণ মানুষ। উন্নত অস্ত্র বা সামরিক প্রশিক্ষণ ছিল না। কিন্তু বুকে ছিল অদম্য সাহস, মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। ৯ মাস যুদ্ধ শেষে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ঠিকই, কিন্তু ঝরে গেছে লাখো প্রাণ। তাঁদের আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। সর্বোচ্চ মর্যাদা দিই। চিরস্মরণীয় শহীদদের মধ্যে ছিলেন অনেক বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষক।
তাঁদের অনেকে বিজ্ঞানের চর্চা করেছেন, দেশকে জ্ঞান-বিজ্ঞানে সুশিক্ষিত করে এগিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছেন। দেশের ভেতর অনেক বিজ্ঞানী ও বুদ্ধিজীবী যেমন মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন, তেমনি অনেকে পাক সেনাবাহিনীর গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সমর্থনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকে বেগবান করতে চেয়েছিলেন। দেশের অধ্যাপক, বিজ্ঞানী, গবেষকদের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে কাজ করেছেন অনেক প্রবাসী বিজ্ঞানীরাও। তাঁদের সবাই স্বাধীনতার পর বিজ্ঞানচর্চা চালিয়ে যেতে পারেননি, যুদ্ধের করাল থাবায় থমকে যেতে হয়েছে অনেককেই। এ রকম একজন আতাউর রহমান খান খাদিম। জেনে নিন এই স্বাধীনতাকামী বিজ্ঞান ব্যক্তিত্বের কথা।
বিখ্যাত ফিলিপস ইলেকট্রিক কোম্পানিতে তিনি এক্স-রে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে শুরু করেন কর্মজীবন। তারপর গোটিংগেনে।
নাম শুনে হয়তো চিনতে পারেননি। খান খাদিম ১৯৬০ সালে জার্মানির গোটিংগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার ওপর পিএইচডি করে দেশে ফিরে যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
তাঁর জন্ম ১৯৩৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ার খড়মপুরে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জর্জ এইচ ই হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। ইন্টারমিডিয়েট শেষ করেন ঢাকা কলেজ থেকে। মেধাতালিকায় তাঁর অবস্থান ছিল ১১তম।
অনার্স করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে। স্নাতকোত্তর শেষ করেন ১৯৫৪ সালে। বিখ্যাত ফিলিপস ইলেকট্রিক কোম্পানিতে তিনি এক্স-রে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে শুরু করেন কর্মজীবন। তারপর গোটিংগেনে। কোয়ান্টাম বলবিদ্যায় পিএইচডি শেষ করে বৃত্তিপ্রাপ্ত গবেষক হিসেবে যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল তাত্ত্বিক পারমাণবিক পদার্থবিজ্ঞান। ১৯৬৩ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে অস্থায়ী প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। দুই বছর পরে চাকরি স্থায়ী হয়।
ইলেকট্রনিকসের পাশাপাশি সমান পারদর্শী ছিলেন তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে। বেশ ভালো পড়াতেন খান খাদিম। তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক ক্লাস নিতেন তিনি। থাকতেন শহীদুল্লাহ্ হলের ওয়েস্ট হাউসের বাবুর্চিখানার ওপরে দ্বিতীয় তলায় শিক্ষকদের বাসভবনে।
২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী শহীদুল্লাহ্ হলে হামলা চালায়। তারা নির্মমভাবে খুন করে অনেক শিক্ষার্থী ও দুজন আবাসিক শিক্ষককে। তাঁদের একজন ছিলেন খান খাদিম। তবে তিনি কীভাবে মারা যান, সে বিষয়ে বিস্তারিত জানা যায়নি।
তাঁর শিক্ষক ও পরে সহকর্মী অধ্যাপক হিরণ্ময় গুপ্তের স্মৃতিচারণা থেকে জানা যায়, খান খাদিম ছিলেন স্বল্পভাষী। তবে তাঁর বক্তব্য ছিল স্পষ্ট। ঠোঁটে সব সময় লেগে থাকত স্মিত হাসি।
তাঁর স্মৃতি ধরে রাখতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের মাইনর ল্যাবরেটরির নাম রাখা হয় ‘খান খাদিম ল্যাবরেটরি’। সেখানেই তিনি শিক্ষার্থীদের প্রথম ব্যবহারিক পাঠ দিয়েছিলেন।
* লেখাটি বিজ্ঞানচিন্তার ডিসেম্বর ২০২১ সংখ্যায় স্বাধীনতা ও বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষ্যে প্রথম প্রকাশিত হয়।