খাতার পাতাভর্তি একগাদা সারি সারি গাণিতিক হিসাব–নিকাশ। এখানে–ওখানে কাটাকুটি। লাল দাগ, প্রশ্নবোধক চিহ্ন। নিজের হাতে কষা সেই জটিল হিজিবিজি গণনার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন আলবার্ট আইনস্টাইন। ফলাফলটা অবিশ্বাস্য! নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছেন না।
মাত্র দুই বছর আগে নতুন একটি তত্ত্ব খাড়া করেছেন এই জার্মান বিজ্ঞানী। নাম, সাধারণ আপেক্ষিকতা। যেখানে মহাকর্ষকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে স্থান-কালের বক্রতা হিসেবে। কোনো ভারী বস্তু স্থানের চাদরকে বাঁকিয়ে ফেলে। সে কারণে পার্শ্ববর্তী ছোট বস্তু তার চারপাশে ঘুরতে বাধ্য হয়। এভাবেই সূর্যের চারপাশে পৃথিবীর ঘূর্ণনের নতুন ব্যাখ্যা দিলেন আইনস্টাইন। তারপর নিজের তত্ত্ব থেকে আসা সমীকরণগুলো সমাধান করার চেষ্টা করলেন নিজেই। সমীকরণগুলোকে এককথায় বলা যায় জটিল, কুটিল। সমাধান করতে ঘাম ছুটে যায়। গণিতে মেধাবী ও সুদক্ষ না হলে কেউ ভুলেও হাত দিতে চান না। তারপরও সেগুলো প্রচুর শ্রম দিয়ে বেশ কিছু দিন ধরে সমাধান করলেন আইনস্টাইন। সর্বশেষ যে ফলাফল হাতে পেলেন, তা নিজেই মেনে নিতে পারছিলেন না।
আইনস্টাইনের প্রাপ্ত এই ফলাফলের অর্থ মহাবিশ্ব গতিশীল, অস্থির। তিনি ভাবলেন, তা কী করে হয়! মহাবিশ্ব তো স্থিতিশীল, শাশ্বত। এ তো অনেক কাল ধরেই প্রচলিত। রাতের আকাশে বহুদূরের স্থির নক্ষত্র দেখলেই তো তার চাক্ষুষ প্রমাণ মেলে! নক্ষত্রগুলো যে আমাদের কাছ থেকে অনেক দূরে বলেই স্থির বলে মনে হচ্ছে, সে কথা কারও মাথায় আসেনি সে যুগে। এর ব্যতিক্রম কিছু যে হতে পারে, সে কথা কেউ ভাবতেও পারেন না।
সর্বকালের সেরা বিজ্ঞানীদের একজন নিউটনও তাঁর তত্ত্বে সে কথা বলে গেছেন। আইনস্টাইন অবশ্য নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্বের ত্রুটি সংশোধন করে প্রণয়ন করেছেন সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব। কিন্তু তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস, স্থিতিশীল মহাবিশ্বের প্রশ্নে নিউটন ভুল কিছু বলেননি। নিউটনের এ তত্ত্বে ভুল পাননি অন্য বিজ্ঞানীরাও। কাজেই মহাবিশ্ব কোনোভাবেই গতিশীল হতে পারে না। তাতে মহাবিশ্ব কবেই ভেঙেচুরে পড়ত! নিজের আপেক্ষিকতা সমীকরণের কোথাও ভুল আছে বলে ধারণা করলেন আইনস্টাইন। সেটা সংশোধন করার কথা ভাবলেন।
কাজেই মহাবিশ্বকে স্থিতিশীল করতে উঠেপড়ে লাগলেন আপেক্ষিকতার জনক। কিছু দিন চিন্তাভাবনার পর একটি উপায়ও এসে হাজির হলো তাঁর মাথায়। একটি অ্যান্টিগ্র্যাভিটি যোগ করলেই ল্যাঠা চুকে যায়। একটি নতুন ধ্রুবক। তিনি নাম দিলেন, মহাজাগতিক ধ্রুবক। সমীকরণে সেটা চিহ্নিত করলেন ল্যামডা দিয়ে। গ্রিক বর্ণমালার বড় হাতের একটি বর্ণ। ব্যস, মহাবিশ্বের গতিশীলতার সঙ্গে এই অ্যান্টিগ্র্যাভিটি কাটাকাটি হয়ে গঠন করল একটি স্থির, স্থিতিশীল মহাবিশ্ব।
সেটিই ঢুকিয়ে দিলেন নিজের প্রণয়ন করা সাধারণ আপেক্ষিকতার ক্ষেত্র সমীকরণে। এবার নিশ্চিন্ত! আনন্দে মনের অজান্তে শিস বাজালেন আপেক্ষিকতার জনক। জার্মানির রাজধানী বার্লিনে বসে আইনস্টাইন যখন কাজটি করেছেন, তখন ১৯১৭ সাল।
কিন্তু আইনস্টাইন জানতেন না, একদিন এ ধ্রুবকের জন্য তাঁকে আফসোস করতে হবে। ‘জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল’ বলে উল্লেখ করতে হবে জনসমক্ষে। জানতেন না, তাঁর আপেক্ষিকতার সমীকরণে সেই ধ্রুবককে সবাই ডাকবে রূপকথার কুৎসিত হাঁসের ছানা বলে।
২.
রাতের আকাশ কালো বা গাঢ় অন্ধকার থাকবে, সেটিই আমরা স্বাভাবিক বলে ধরে নিয়েছি। মানুষ তার জন্মের পর থেকে চোখের সামনে দেখে আসা জলজ্যান্ত এমন প্রমাণকে অবিশ্বাস করে কীভাবে। কিন্তু সতেরো শতকে সেটা নিয়েই অবাক হয়েছিলেন বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী। তাঁদের একজন জার্মান জ্যোতির্বিদ জোহানেস কেপলার। সে যুগের নামকরা বিজ্ঞানী। গ্রহের গতিসংক্রান্ত সূত্র আবিষ্কার করে বেশ নাম করেছিলেন তিনি।
১৬১০ সালের দিকে জোহানেস কেপলার যুক্তি দেখালেন, মহাবিশ্ব যদি অগণিত নক্ষত্র নিয়ে সব দিকে অসীম পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে থাকে, তাহলে পৃথিবী থেকে মহাকাশের যেদিকেই তাকানো যাক না কেন, আমাদের দৃষ্টিসীমা কোনো না কোনো নক্ষত্রে গিয়ে ঠেকবে। উজ্জ্বল নক্ষত্রগুলোর মাঝখানে ম্লান হলেও কোনো না কোনো নক্ষত্র থাকবে। আবার ম্লান নক্ষত্রগুলোর মাঝখানেও থাকবে কোনো না কোনো ম্লানতর নক্ষত্র। কাজেই মহাকাশের নক্ষত্রগুলোর মাঝখানে কোনো শূন্যস্থান থাকবে না। অনেকটা বনের ভেতর চারদিকে গাছ দেখার মতো। বনের ভেতর যেদিকেই তাকানো যাক না কেন, আমাদের দৃষ্টিসীমা কোনো না কোনো গাছে গিয়ে ঠেকে। তাই ঘন বন ভেদ করে আমরা বাইরে কিছু দেখতে পাই না। তেমনি পৃথিবী থেকে আমাদের দৃষ্টিসীমাও যদি এভাবে কোনো না কোনো নক্ষত্রে গিয়ে ঠেকে, তাহলে গোটা রাতের আকাশ সাধারণ মানের কোনো নক্ষত্রের মতো উজ্জ্বল হওয়ার কথা। মোদ্দাকথা, রাতের আকাশ উজ্জ্বল হওয়া উচিত, কালো অন্ধকারাচ্ছন্ন নয়। কিন্তু পর্যবেক্ষণে ঘটে ঠিক উল্টোটা, অর্থাৎ রাতের আকাশ অন্ধকার দেখা যায়। বড়ই রহস্যময় ব্যাপার! কিন্তু এ রকম হওয়ার কারণ কী?
কেপলারের এই প্রশ্নে জন্ম হলো একটি প্যারাডক্সের। কিছুদিন পর নিউটনের বন্ধুস্থানীয় অ্যাডমন্ড হ্যালিও একই প্রশ্ন তুললেন। হ্যালির ধূমকেতুর জন্য যিনি বিখ্যাত। তবে এই প্যারাডক্স বিজ্ঞানীদের কাছে জনপ্রিয় হলো জার্মান বিজ্ঞানী হেনরিখ অলবার্সের কারণে। উনিশ শতকের শুরুতে, মানে ১৮২৩ সালের দিকে তিনি ব্যাপকভাবে প্রচার করেন সেটি। তাই সবার কাছে এটি অলবার্সের প্যারাডক্স নামে পরিচিত হয়ে উঠল।
১৮৪৮ সালে ‘ইউরেকা’ নামে কিছু গদ্য লেখেন পো। সেখানেই ছিল অলবার্স প্যারাডক্সের সমাধান। মহাবিশ্ব নির্দিষ্ট সময় জন্ম নিয়েছে এবং তা প্রসারণশীল বলে ইঙ্গিত করেছেন পো
এরপর দীর্ঘকাল প্যারাডক্সটা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি হয়েছে, ভ্রু কুঁচকে বারবার রাতের আকাশের দিকে তাকিয়েছেন জ্যোতির্বিদেরা, কিন্তু কেউ কোনো সমাধান দিতে পারেননি। অমীমাংসিত রহস্য হিসেবেই বিজ্ঞানের বইয়ে ঠাঁই করে নিল কয়েক দশক।
মজার ব্যাপার হলো, প্যারাডক্সটা প্রথম যিনি সমাধান করেন, তিনি কোনো বিজ্ঞানী নন। কবি ও কথাসাহিত্যিক। তাঁকে মার্কিন রহস্যকাহিনির জনকও বলেন কেউ কেউ। তিনি অ্যাডগার অ্যালান পো। নিজের লেখা রহস্যকাহিনির মতোই রহস্যময় এক চরিত্র।
১৮৪৮ সালে ‘ইউরেকা’ নামে কিছু গদ্য লেখেন পো। সেখানেই ছিল অলবার্স প্যারাডক্সের সমাধান। মহাবিশ্ব নির্দিষ্ট সময় জন্ম নিয়েছে এবং তা প্রসারণশীল বলে ইঙ্গিত করেছেন পো। কিন্তু কথাসাহিত্যে পো যতই নাম কামান, বিজ্ঞানী হিসেবে তাঁর কোনো কদর ছিল না। আবার এর পেছনে কোনো প্রমাণও ছিল না তাঁর কাছে। বিজ্ঞানজগতে উটকো ধরে নিয়ে তাঁর কথাগুলোকে কেউ পাত্তা দিলেন না। পাত্তা দেবেনই–বা কীভাবে, যুগ যুগ ধরে মানুষ বিশ্বাস করে আসছে, মহাবিশ্ব স্থির, চিরন্তন; সেখানে পো বলছেন একেবারে উল্টো কথা।
দীর্ঘ প্রায় ৮০ বছর পর অ্যালান পোর কথাটাকেই সত্য বলে প্রমাণ করলেন মার্কিন জ্যোতির্বিদ এডুইন হাবল। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার মাউন্ট উইলসনে সে যুগের সবচেয়ে শক্তিশালী টেলিস্কোপ দিয়ে আকাশ পর্যবেক্ষণ করেছিলেন হাবল। ১০০ ইঞ্চির প্রতিফলক টেলিস্কোপ ছিল সেটা। রাতের পর রাত জেগে দূরবর্তী গ্যালাক্সিগুলোর অসংখ্য ছবি তোলেন হাবল। সেগুলো বিশ্লেষণ করে মহাবিশ্ব সম্পর্কে নতুন, যুগান্তকারী আবিষ্কার করে বসেন। হাবলের পর্যবেক্ষণে সিংহভাগ গ্যালাক্সির আলোতে লোহিত বিচ্যুতি পাওয়া গেল। তার সরল অর্থ, গ্যালাক্সিগুলো আমাদের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এভাবে একগুচ্ছ তথ্য–উপাত্ত দিয়ে হাবল প্রমাণ করলেন, মহাবিশ্ব স্থির বা শাশ্বত নয়, বরং তা ক্রমে প্রসারিত হচ্ছে।
এ রকম সাক্ষ৵–প্রমাণ হাজির করার পর কারো আর বিষয়টি অস্বীকার বা অবিশ্বাস করার উপায় রইল না। খোদ আইনস্টাইনকেও তাই আফসোস করতে হলো প্রায় এক দশক পর। কারণ, একদিন নিজের সমীকরণ থেকে পাওয়া গতিশীল মহাবিশ্বের কথা অবিশ্বাস করেছিলেন তিনি। মহাবিশ্বকে স্থির করতে তাতে জোড়াতালি দিয়ে মহাজাগতিক ধ্রুবকও ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন জোর করে। একবার যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়ে সস্ত্রীক বেড়াতে যান ক্যালিফোর্নিয়ার মাউন্ট উইলসনে। হাবলের সব প্রমাণ নিজের চোখে দেখেন। তারপর হার স্বীকার করে নেন। সেখানেই এক সংবাদ সম্মেলনে একে নিজের জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল বলে স্বীকার করে নেন এই জার্মান বিজ্ঞানী।
নিশ্চয়ই ভাবছেন, কিন্তু গতিশীল মহাবিশ্বের সঙ্গে অলবার্স প্যারাডক্সের সম্পর্কটা কী? এখান থেকে সমাধানটাই-বা আসে কীভাবে? চলুন, সেটাই জানা যাক।
হাবলের পর্যবেক্ষণে সিংহভাগ গ্যালাক্সির আলোতে লোহিত বিচ্যুতি পাওয়া গেল। তার সরল অর্থ, গ্যালাক্সিগুলো আমাদের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এভাবে একগুচ্ছ তথ্য–উপাত্ত দিয়ে হাবল প্রমাণ করলেন, মহাবিশ্ব স্থির বা শাশ্বত নয়, বরং তা ক্রমে প্রসারিত হচ্ছে
৩.
রাতের আকাশ কালো—এই পর্যবেক্ষণ তুচ্ছ মনে হতে পারে। কিন্তু এটাই মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের অনেক কথা বলে। এ থেকে যৌক্তিকভাবে সিদ্ধান্তে আসা যায়, মহাবিশ্ব কোনোভাবেই স্থির হতে পারে না।
এখন বৈজ্ঞানিকভাবে বিষয়টা স্বীকৃত, আমাদের মহাবিশ্ব শুরু হয়েছিল ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে। সেটি সত্য হলে দুটি কারণে রাতের আকাশ উজ্জ্বল হবে না, কালো হয়ে থাকবে। প্রথমটা হলো মহাবিশ্বের প্রসারণ। মহাবিশ্ব যেহেতু প্রসারিত হচ্ছে, তাই দূরবর্তী গ্যালাক্সি থেকে আসা আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য প্রসারিত হয়ে লোহিত বিচ্যুতি দেখা যাবে। যত দূরের গ্যালাক্সি থেকে আলো আসবে, এই লোহিত বিচ্যুতির পরিমাণ হবে তত বেশি। যেহেতু নীল আলোর চেয়ে লাল আলোর শক্তি কম, তাই দূরের গ্যালাক্সিগুলো থেকে আসা আলোগুলোর শক্তিও হবে অনেক কম। কাজেই রাতের আকাশে এই আলো আমাদের চোখে ম্লান দেখাবে। মহাবিশ্ব স্থির হলে রাতের আকাশ যতটা উজ্জ্বল হতো, প্রসারণশীল হলে সে তুলনায় কম উজ্জ্বল হবে। কারণ, বহুদূরের গ্যালাক্সি রাতের আকাশের উজ্জ্বলতার পেছনে কম অবদান রাখবে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, মহাবিস্ফোরণের প্রভাবেও রাতের আকাশ কালো থাকবে। আসলে মহাবিশ্ব চিরন্তন নয়, বরং এর একটা সূচনা ছিল। তার মানে, আমাদের দৃষ্টিসীমার সব রেখাই কোনো নক্ষত্রে গিয়ে শেষ হবে না। অথচ কেপলার, অলবার্সসহ অন্যান্য বিজ্ঞানী তেমনটি হবে বলে অনুমান করেছিলেন। এর কারণ, দূরের কোনো নক্ষত্র বা গ্যালাক্সি আমরা তখনই দেখতে পাই, যখন ওই নক্ষত্র বা গ্যালাক্সির আলো আমাদের কাছে এসে পৌঁছানোর জন্য যথেষ্ট সময় পেয়েছে। সেটা না হলে কোনো নক্ষত্র বা গ্যালাক্সির আলো আমরা দেখতে পাই না।
নক্ষত্র বা গ্যালাক্সি থেকে আলো আসে অবিশ্বাস্য গতিতে। সেটা আলোর গতি। যাকে বলে মহাবিশ্বের সর্বোচ্চ গতিসীমা। দৈনন্দিন জীবনের মাপকাঠিতে এই গতি অবিশ্বাস্য মনে হলেও আসলে তা অসীম নয়। আলো সেকেন্ডে পাড়ি দেয় তিন লাখ কিলোমিটার পথ। ঘণ্টার হিসাবে যা প্রায় এক বিলিয়ন কিলোমিটার। কিন্তু আলো দ্রুতগতির হলেও সে তুলনায় মহাবিশ্বের পরিধিও কম নয়। এককথায়, মহাবিশ্ব বিশাল, বিপুল। সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলো আসতে সময় লাগে প্রায় সাড়ে আট মিনিট। আমাদের সবচেয়ে কাছের নক্ষত্র আলফা সেন্টাউরি থেকে আসতে সময় নেয় প্রায় সাড়ে চার বছরের বেশি। তেমনি বহু দূরের গ্যালাক্সির আলো আমাদের কাছে পৌঁছাতে সময় লাগতে পারে কয়েক বিলিয়ন বছর।
আলোর এই সসীম গতির কারণে এই মুহূর্তে সৌরজগৎ থেকে সূর্য নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে আমরা তা জানতে পারব প্রায় সাড়ে আট মিনিট পর। একইভাবে বহু দূরের গ্যালাক্সির যে আলো আজ আমাদের কাছে এসে পৌঁছাল, কে জানে সেই গ্যালাক্সির আজকের অবস্থা কী! অনেক আগেই সেটা মারা গেলেও এখনই তা জানতে পারব না। মোদ্দাকথা হলো, আলোর গতি সসীম। এর মানে, মহাকাশে যতই দূরের বস্তু দেখব, তত অতীতের মহাবিশ্ব দেখতে পাব আমরা।
নির্দিষ্ট সময়ে জন্ম নেওয়া কোনো মহাবিশ্বে আলোর সসীম গতির আরেকটি অনিবার্য পরিণতি রয়েছে। আকাশে অগণিত তারা থাকলেও মহাকাশে দিগন্তের একটি সীমানা থাকবে, যার বাইরে আমরা কোনো কিছু দেখতে পাব না। কারণ, মহাবিশ্বের জন্মের পর যে সময় বয়ে গেছে, সেই সময়ে এই সীমানার বাইরের নক্ষত্র বা গ্যালাক্সি থেকে কোনো আলো এখনো আমাদের কাছে এসে পৌঁছাতে পারেনি। আমাদের অবস্থাটা মহাসমুদ্রে একটি জাহাজের সঙ্গে তুলনা করা যায়। জাহাজের চারদিকেই দিগন্তটাকে শেষ সীমা বলে চালিয়ে দেওয়া যায়, তার পরের কোনো কিছু সেখান থেকে দেখা যায় না। তার মানে এই নয় যে মহাসমুদ্রের ওই দিগন্তসীমার বাইরে কিছু নেই, বরং তত দূর পর্যন্ত আমরা দেখতে পাই। এর বাইরের কিছু আমরা আর দেখতে পাই না। মহাবিশ্বের দিগন্তের বাইরেও ঠিক একই অবস্থা।
আজ বাজারে
আপনার নানা প্রশ্নের জবাব নিয়ে আজ বাজারে আসছে বিজ্ঞানচিন্তার ডিসেম্বর সংখ্যা। হকারকে বলে রাখুন, অথবা অর্ডার করুন প্রথমা ডট কম-এ।
এ রকম একটি নির্দিষ্ট দিগন্তসীমা পর্যন্ত গ্যালাক্সি ও নক্ষত্র দেখতে পাওয়ার কারণে রাতের আকাশ আমরা কালো দেখি। কাজেই সিদ্ধান্তে আসা যায়, মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে জন্ম নেওয়া কোনো মহাবিশ্বে রাতের আকাশ কালো হবে অন্তত দুটি কারণে। প্রথমত, মহাবিশ্বের সসীম বয়স এবং তার প্রসারণ।
কাজেই কেপলার, হ্যালি বা অলবার্স যাকে প্যারাডক্স মনে করেছিলেন, সেটি আদতে কোনো রহস্যই নয়। সে রহস্যের সমাধান দেয় একটি মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে জন্ম নেওয়া মহাবিশ্ব। আরেকটি ব্যাপারেও তাঁরা ভুল করেছিলেন। তাঁদের ধারণা ছিল, রাতের আকাশ সাধারণ নক্ষত্রের মতো উজ্জ্বল হওয়া উচিত। কিন্তু তাঁরা হয়তো ভুলে গিয়েছিলেন, নক্ষত্রও মারা যায়। কবিদের ভাষায়, আকাশ থেকে তারা খসে পড়া। কবি জীবনানন্দ দাশ বলেন, ‘নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়, হয় নাকি?’
সাধারণত ১০ বিলিয়ন বছর (১০,০০০,০০০,০০০ বা ১০১০) বা তার চেয়ে কম সময়ের মধ্যে একটি নক্ষত্র তার ভেতরের জ্বালানি ফুরিয়ে ফেলে। এক হিসাবে দেখা গেছে, নক্ষত্রগুলো যদি রাতের আকাশকে সাধারণ কোনো নক্ষত্রের মতো উজ্জ্বল করে তুলতে চায়, সে জন্য যে পরিমাণ বিকিরণ দরকার, তার জন্য নক্ষত্রদের আয়ু হতে হবে প্রায় ১০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০ বছর বা ১০২৩ বছর (১–এর পর ২৩টি শূন্য)। কিন্তু নক্ষত্রদের আয়ু সে তুলনায় অনেক অনেক কম। তার বহু আগেই জ্বালানি ফুরিয়ে মারা যায় নক্ষত্ররা। কাজেই অলবার্স প্যারাডক্স আসলে কোনো প্যারাডক্সই নয়। সেটা আসলে আমাদের জানা বা বোঝার ভুল।
সূত্র: দ্য থিওরি অব এভরিথিং/স্টিফেন হকিং;
আফটার গ্লো অব ক্রিয়েশন/ মার্কাস চোন;
প্যারালাল ওয়ার্ল্ডস/ মিচিও কাকু;
উইকিপিডিয়া