গবেষণা
ডায়াবেটিস নিয়ে গবেষণা
ফ্রন্টিয়ার্স ইন পাবলিক হেলথ জার্নালে প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ৫০ শতাংশ স্কুলশিক্ষার্থী ডায়াবেটিসের সঙ্গে পরিচিত নয়। ডায়াবেটিস কী, কেন হয়, উপসর্গগুলো কী—এসব একজন স্কুলশিক্ষার্থীর জানা কতটা প্রয়োজন? সেই গবেষণা ও এ রকম গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলোর জবাব…
দেশে ডায়াবেটিসের প্রকোপ দিন দিন বাড়ছে। এ মুহূর্তে ১ কোটি ২৫ লাখ ডায়াবেটিস রোগী আছে দেশে। এই রোগ প্রতিরোধে প্রয়োজন ছোটবেলা থেকে সচেতনতা। কিন্তু দেশের ৫২ শতাংশ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থী ডায়াবেটিসের কোনো তথ্য জানে না। মাদ্রাসাশিক্ষার্থীদের ৪০ শতাংশ ডায়াবেটিস শব্দটির সঙ্গে পরিচিত নয়। ডায়াবেটিস রোগ যে ছোটদেরও হতে পারে, এ তথ্য জানে না ৮০ শতাংশ নিম্নমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থী। এমন সব তথ্য উঠে এসেছে সুইজারল্যান্ডের ফ্রন্টিয়ার্স ইন পাবলিক হেলথ জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায়। বাংলাদেশের ১৮ জেলার ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির ২ হাজার ৯ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ডায়াবেটিস সচেতনতা নিয়ে এ গবেষণা পরিচালিত হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন এবং আইইডিসিআরের গবেষকদের পরিচালিত এ গবেষণার নেতৃত্বে ছিলেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ডায়াবেটিস ও হরমোন রোগ বিভাগের প্রধান ফারহানা আক্তার ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জিন প্রকৌশল ও জৈব প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আদনান মান্নান (লেখক)। তত্ত্বাবধানে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিন প্রকৌশল ও জৈবপ্রযুক্তি বিভাগের শিক্ষক এস এম মাহবুবুর রশিদ ও নাসরিন লিপি, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের শিক্ষক নাজমুল আলম ও আইইডিসিআরের (রোগতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র) গবেষক ওমর কাইয়ুম এবং মেহেজাবিন নুরুন্নাহার। দেশের স্কুলশিক্ষার্থীরা ডায়াবেটিস সম্পর্কে কতটুকু জানে ও তাদের পরিবারে ডায়াবেটিস রোগী থাকলে তাকে সহায়তা করতে প্রস্তুত কি না—সে সম্পর্কে জানতে পরিচালিত হয় এ গবেষণা।
ডায়াবেটিস রোগীদের দুটি ব্যাপার খুব গুরুত্বপূর্ণ। এক, ডায়াবেটিস সম্পর্কে শিক্ষা। দুই, পরিবারের সহযোগিতা। এ ক্ষেত্রে ছোটবেলা থেকে ডায়াবেটিস সম্পর্কে সচেতন না থাকলে জীবনযাপনের ধরনে পরিবর্তন আসবে না। ফলে মানুষ ডায়াবেটিসের রিস্ক ফ্যাক্টর বা ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়গুলো এড়াতে পারবে না। যেমন চর্বিজাতীয় খাবার খাওয়া, কোমল পানীয় পান, হাঁটাচলা না করা, পর্যাপ্ত না ঘুমানো ইত্যাদি। তাই এ সম্পর্কে ছোটরা কতটুকু জানে, তা যাচাই করা প্রয়োজন। আবার অনেক ডায়াবেটিস রোগীর পরিবারের সহায়তা দরকার। তাকে ইনসুলিন দিতে সাহায্য করা, খাবারের তালিকা ঠিক করা, কখন চিকিৎসকের কাছে নিতে হবে, কোনো উপসর্গ দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে কী করতে হবে, গ্লুকোজ মাপতে জানা, ব্লাড প্রেশার মাপতে জানা—এগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ। এসব ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি কাজে আসতে পারে কিশোর-কিশোরীরা। কিন্তু তারা আসলে কতটুকু জানে? কতটুকু প্রস্তুত তারা পরিবারে কারও ডায়াবেটিস হলে সুরক্ষা দিতে?
দেশের বাংলা মাধ্যম, ইংরেজি মাধ্যম ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের ওপর পরিচালিত এ গবেষণায় দেখা যায়, ৫৪ শতাংশ শিক্ষার্থী শরীরে চিনি তথা গ্লুকোজের প্রভাব সম্পর্কে জানে না। তারা কেউই ডায়াবেটিসের কারণ কী, তা বলতে পারেনি। ৫৩ শতাংশ শিক্ষার্থী জানে না, ডায়াবেটিস মানুষের আয়ু কমিয়ে দিতে পারে, এমনকি মৃত্যুর কারণ হতে পারে। মাত্র ২৪ শতাংশ শিক্ষার্থী মনে করে, স্থূলতা বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক সমস্যার জন্ম দেয় ও ডায়াবেটিসের কারণ হতে পারে। ৪৫ শতাংশ কিশোর-কিশোরী কখনো ইনসুলিনের নাম শোনেনি। ১৩ শতাংশ শিক্ষার্থী প্রতিদিন সফট ড্রিংকস তথা কোমল পানীয় খায়। তারা জানে না, নিয়মিত কোমল পানীয় খাওয়া ডায়াবেটিসের পেছনে ভূমিকা রাখতে পারে। ২৮ শিক্ষার্থী কোনো রকম খেলাধুলা করে না। এমনকি ক্যালরি কমায়—এমন কোনো শারীরিক কর্মকাণ্ড নেই তাদের প্রতিদিনের জীবনে। গবেষকেরা জানান, ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী জানিয়েছে, তাদের কখনো স্কুল বা আর কোথাও ডায়াবেটিস নিয়ে জানানো হয়নি। বিষয়টিকে আশঙ্কাজনক মনে করছেন গবেষকদের অন্যতম প্রধান ফারহানা আক্তার। তিনি বলেন, ছোটবেলা থেকে যদি ডায়াবেটিসের রিস্ক ফ্যাক্টর তথা পেছনের কারণগুলো জানা না থাকে, তাহলে মানুষ নিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন করবে না। আর পরবর্তী জীবনে ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত হয়ে তীব্র পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়ার পর হয়তো সেই ব্যক্তির রোগ শনাক্ত হবে। সে ক্ষেত্রে আর সুস্থ হয়ে ওঠার কোনো উপায় থাকবে না।
২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলে এ গবেষণা। ১ হাজার ৩৯ জন মেয়ে ও ৯৭০ জন ছেলে এতে অংশ নেয়। অংশ নেয় ৭৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে ৪০টি বাংলা মাধ্যম স্কুল, ২২টি মাদ্রাসা ও ১৬টি ব্রিটিশ কারিকুলামে পরিচালিত ইংরেজি মাধ্যম স্কুল ছিল। বাংলা মাধ্যম স্কুলের মধ্যে আদিবাসী স্কুল ছিল কাপ্তাই, রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ির।
এ গবেষণায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গবেষণা সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন ২৫ শিক্ষার্থী, যাঁরা সবাই চিটাগাং ইউনিভার্সিটি রিসার্চ অ্যান্ড হায়ার স্টাডি সোসাইটি, দৃষ্টি চট্টগ্রাম এবং ডিজিজ বায়োলজি অ্যান্ড মলিকুলার এপিডেমিওলজি রিসার্চ গ্রুপের সদস্য।
এ গবেষণায় মাদ্রাসা ও আদিবাসী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৭০ শতাংশের বেশি ডায়াবেটিস নিয়ে কোনো প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারেনি। ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের নলেজ স্কোর তথা জানার পরিধি বাংলা মাধ্যম ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের চেয়ে উল্লেখযোগ্য হারে বেশি ছিল। গবেষকেরা মনে করেন, স্কুলশিক্ষায় ডায়াবেটিস ও সংক্রমণহীন রোগ পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভূক্ত করা জরুরি, যাতে ভবিষ্যতে তারা ডায়াবেটিসের জটিলতায় না ভোগে।
এ ছাড়া বেশির ভাগ শিক্ষার্থী পরিবারের ডায়াবেটিস রোগীকে সাহায্য করতে প্রস্তুত নয় বলে জানালেন গবেষকেরা। ৬৭ শতাংশ শিক্ষার্থী জানে না ডায়াবেটিস রোগীদের কোন খাবারগুলো পরিহার করা উচিত। ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী জানে না ইনসুলিন কেন দেয় ও কীভাবে দেয়। ব্লাড প্রেশার তথা রক্তচাপ মাপতে জানে না ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী। গ্লুকোমিটারের ব্যবহার জানে না ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী। ২০ শতাংশ শিক্ষার্থী গ্লুকোমিটারের নাম শোনেনি কখনো।
তাই ডায়াবেটিস নিয়ে সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন। সেই সঙ্গে গণমাধ্যমে এ নিয়ে আরও বেশি তথ্য উঠে আসা প্রয়োজন বলে মনে করেন গবেষকেরা।
লেখক: অধ্যাপক, জিনপ্রকৌশল ও জৈব প্রযুক্তি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়