মেরি কুরি: আজন্ম যাঁর বিজ্ঞান সাধনা

মেরি কুরি

১৯ শতকের গোড়ার দিক। ফ্রান্সের ইকোল সুপেরিওর দে ফিজিকের একটি টিন শেডের দেয়ালের ফাটল দিয়ে হিম বাতাস ঢুকছে শোঁ শোঁ শব্দে। ঘরের ভেতর কয়েকটি উঁচু বেঞ্চ রাখা। নানা যন্ত্রপাতি ছড়ানো। কিছু কাচের বিকার, ফ্লাস্ক ও গ্র্যাজুয়েটেড সিলিন্ডার। হাঁপরের জায়গায় জ্বলছে বুনসেন বার্নার। এক মধ্যবয়সী নারী বেঞ্চের ওপর ঝুঁকে কী যেন একটি পদার্থ হাতে নিয়ে দেখছেন। আলকেমিস্টের ওয়ার্কশপের মতো টিন শেডে ব্যস্ত এই মহীয়সীর নাম মেরি কুরি। পৃথিবীর প্রথম নারী, যিনি পদার্থবিদ্যা ও রসায়নে নোবেল জয় করেছেন। পৃথিবীর প্রথম স্ত্রী, যিনি স্বামীর সঙ্গে যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার জিতেছিলেন। জগতের প্রথম জননী, যাঁর কন্যা, আইরিন কুরি, দ্বিতীয় নারী-নোবেল বিজেতা। এই গুণী মানুষটি যে তেজস্ক্রিয়তার জন্য বিখ্যাত, তা আমাদের জানা। তবে এই আবিষ্কারের পেছনে, বিজ্ঞানের এই জয়যাত্রার পেছনের মানুষটির জীবন যে কত বন্ধুর, তাঁর সংগ্রামের গল্প যে কত মর্মস্পর্শী, তা ভুললে চলবে না। মেরি কুরির ব্যক্তি জীবন নিয়ে জানলেই হয়তো আগামী বাংলাদেশের কোনো কন্যা একদিন আবিষ্কারের স্বপ্ন দেখবে, স্বপ্ন দেখবে নোবেল জয়ের।

স্বামী পিয়ের কুরির সঙ্গে মেরি

২.

আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময়। পোল্যান্ড তখন প্রুশিয়া, রাশিয়া ও অস্ট্রিয়া-শাসিত।

নভেম্বর, ১৮৬৭ সাল। রুশ শাসনাধীন ওয়ারস’ শহরের এক মধ্যবিত্ত ঘরে জন্ম নেন মারিয়া সালোমিয়া স্ক্লোদস্কা। মারিয়া বা মেরির ডাক নাম ছিল মানিয়া। সর্বকনিষ্ঠা। তাঁর বড় তিন বোন ও এক ভাই। রুশ শাসনের বিরোধী ছিলেন মানিয়ার বাবা-মা। তাঁর বয়স যখন নয়, তখন তাঁর বোন সোফিয়া মৃত্যুবরণ করেন। মাকে টিবিতে হারান, যখন তাঁর বয়স ১১। বোন ও মায়ের শোক মানিয়াকে মুহ্যমান করে তোলে। জীবনের আকষর্ণ হারিয়ে ফেলতে শুরু করেন। প্রায় এক দশক লেগেছে মানিয়ার এই শোক কাটিয়ে জীবনের স্বাভাবিক ছন্দে ফিরতে। বোন ও মা-হারানোর শোক এমনই।

মানিয়া ছিলেন কৃশকায়। তাঁর বয়স যখন ১৫, তখন জ্ঞান হারিয়েছিলেন একবার। এ জন্য অপুষ্টিই দায়ী। বড় বোন ব্রনিয়া নিজের বাড়িতে এনে রাখেন তাঁকে। সুশ্রুষার মাধ্যমে আবার সুস্থ-সমর্থ করে তোলেন। মানিয়ার জীবনের একটি দিক সব সময় সত্য হয়ে ধরা দিয়েছে। যখনই তিনি কোনো শোক বা দুর্ভাবনা কিংবা বিষন্নতায় সময় অতিবাহিত করেছেন, তখনি পাঠে ডুবে থেকে নিজেকে সে অবস্থা থেকে মুক্ত করেছেন। এমন জ্ঞান পিপাসা, গ্রন্থপ্রীতি ইতিহাসে বিরল।

মেরি কুরি

আঠারো শতকের ইউরোপ নারী স্বাধীনতায় পিছিয়ে ছিল। নারীরা তখনও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা গ্রহণের অনুমতি পেতেন না। সমাজের এই স্থবিরতা ভেঙে বেরিয়ে এসেছিলেন মানিয়া। ১৮৯১ সালে তাঁর বোন ব্রনিয়া যখন প্যারিসে চিকিৎসক হিসেবে পাড়ি জমান, তখন মানিয়া তাঁর পিছু নেন। তিনি তখন ইম্পেরিয়াল উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে প্রথম স্থান অধিকারী তুখোড় ছাত্রী। তাঁর বোন ও ভগ্নিপতি—দুজনেই চিকিৎসক, সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী। তাঁরা নিজেদের নানা কমিউনিস্ট কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে ফেলতে শুরু করেন। মানিয়া তাঁদের বাড়িতে হাঁপিয়ে উঠতে থাকেন। একটি অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করে উঠে যান। ভর্তি হন ইউনিভার্সিটি অব প্যারিসের (অনেকের কাছে সরবোন বিশ্ববিদ্যালয় নামে পরিচিত) পদার্থবিদ্যা বিভাগে। লেখাপড়ায় এত মনোযোগী ও নিজের স্বাস্থ্যের যত্নে এত অমনোযোগী ছিলেন যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আবার একদিন পাঠাগারে জ্ঞান হারান।

১৮৯৪ সালে পদার্থবিদ্যায় স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। বছর কয়েকের ভেতর ডক্টরাল স্কলার হিসেবে বৃত্তি পান দ্য সিটি অব প্যারিস ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফিজিকস অ্যান্ড কেমিস্ট্রি হায়ার এডুকেশনাল ইনস্টিটিউশনে (প্যারিস শিল্পবিষয়ক পদার্থবিদ্যা ও রসায়ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান)। ইস্পাতের চৌম্বকত্ব নিয়ে পড়ার কথা ছিল। তবে এ বিষয়ে আগ্রহ ছিল না তেমন। তিনি তখন ইউরোপের বিজ্ঞান বিষয়ে অগ্রগতি নিয়ে অনেক পড়াশুনা করেছেন। জেনেছেন উইলহেম রন্টজেনের এক্স-রে আবিষ্কারের খবর। সে সময় রন্টজেন তাঁর স্ত্রীর হাতের আংটি সমেত একটি এক্স-রে ফিল্ম প্রচার করে পপ সংস্কৃতিতেও নিজের স্থান করে নিয়েছেন। তবে পরমাণুর গঠন নিয়ে যে গবেষণা চলছিল আর্নেস্ট রাদারফোর্ড ও হেনরি বেকেরেলের গবেষণাগারে, তা মানিয়াকে আকৃষ্ট করে। তিনি বেকেরেলের ইউরানিক রে বা ইউরেনিয়াম থেকে নির্গত রশ্মি আবিষ্কারে চমকিত হন। সিদ্ধান্ত নেন, এ বিষয়ে গবেষণা করবেন।

আরও পড়ুন
মেরি কুরির এই ভাস্কর্য রয়েছে ওয়ার স'

সে সময়ে একই প্রতিষ্ঠানে পিয়ের কুরির সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। মানুষটি গবেষক। ইলেকট্রোমিটার আবিষ্কার করেছিলেন। তাঁকে বিয়ের মাধ্যমে মেরি কুরি হিসেবে পরিচিত হন মানিয়া। পাশাপাশি পরমাণুর গঠনবিষয়ক গবেষণা অব্যাহত রাখেন। আঠারো শতকের শেষ দিকে পরমাণুর গঠন নিয়ে নানা মতের প্রবর্তন হয়। এই বিতর্কের ভেতর, ১৮৯৮ সালে মেরি কুরি দাবি করেন, পরমাণুর ভেতরে পরিবর্তন ঘটছে। বেকেরেলের ধারণা পরিমার্জন করে মেরি বলেন, কেবল ইউরেনিয়াম থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে পারমাণবিক রশ্মি নির্গত হয় না, অন্যান্য পরমাণু থেকেও তা হতে পারে। তিনি বেকেরেলের ইউরানিক রে-র নাম পরিবর্তন করে একে ‘রেডিওঅ্যাকটিভ রেডিয়েশন’ বলে আখ্যা দেন। অনেকটা একই সময়ে রাদারফোর্ড বলেন, রেডিওঅ্যাকটিভ পরমাণু রেডিয়েশনের পর নিজে রূপান্তরিত হয়। মেরি কুরি ও রাদারফোর্ডের এই ধারণা ছিল সাহসী ও যুগান্তকারী। মেরি ১৯০০ সালে আন্তর্জাতিক পদার্থবিদ্যার কংগ্রেসে বলেন, ‘দ্য স্পন্টেনিটি অব রেডিয়েশন ইজ অ্যান এনিগমা, আ সাবজেক্ট অব প্রোফাউন্ড অ্যাস্টোনিশমেন্ট।’ অর্থাৎ পরমাণুর স্বতঃস্ফূর্ত বিকিরণ অবাক করা এক রহস্য। পদার্থের এই বিস্ময়কর গুণের পেছনের কারণ তাঁকে জানতেই হবে।   

বিস্তর পড়াশোনার সুবাদে তিনি জেনেছিলেন, ১৪ শতকে চেক-জার্মান সীমান্তে রূপার খনিতে ‘পিচব্লেন্ড’ নামের একটি খনিজ পাওয়া গেছে। সে খনিজে ইউরেনিয়াম রয়েছে বলে ধারণা করা হতো। মেরি কুরি বোহেমিয়া থেকে প্রায় ৫ হাজার কেজি পিচব্লেন্ড নিয়ে এলেন নিজ গবেষণাগারে। তিনি ও পিয়ের কুরি এই খনিজ থেকে ইউরেনিয়াম ও অন্যান্য পারমাণবিক পদার্থ আলাদা করার কাজে লেগে পড়েন। তাঁরা নতুন এক পদ্ধতি প্রবর্তন করেন। একে বলা হয় ‘ফ্র্যাকশনাল ক্রিস্টালাইজেশন’। এ পদ্ধতিতে খনিজ পদার্থ উত্তপ্ত করে গলানো হয়। এরপর তা শীতল করার সময় হালকা উপাদান দ্রুত স্ফটিকীকৃত হয়, ভারী উপাদান হয় ধীরে। এভাবে মেরি ও পিয়ের রেডিয়াম আলাদা করতে সক্ষম হন। এই পারমাণবিক পদার্থ পর্যায় সারণিতে ৮৮ নম্বর উপাদান হিসেবে যুক্ত হয়।

মেরি কুরিকে নিয়ে পোস্টার
আরও পড়ুন

১৯০৩ সালে পিয়ের কুরি ও হেনরি বেকেরেলের সঙ্গে যৌথভাবে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পান মেরি। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, একই বছর মেরি পিএইচডি ডিগ্রিও অর্জন করেন। একজন নারীকে নোবেল বিজয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করতে হয়েছে ডক্টরাল ডিগ্রি অর্জন করতে! তবে পরাধীনতার এই প্রাচীর ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন এই মহতী নারী। পরে উচ্চশিক্ষা সহজ হয়ে দাঁড়ায় নারীদের জন্য। ১৯১১ সালে মেরি কুরি রসায়নে আবারও নোবেল জয় করেন। এ ঘটনা অবশ্য সবার জানা। তবে এই পারমাণবিক পদার্থ নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে তিনি হারিয়েছিলেন নিজ স্বাস্থ্য। ওদিকে ১৯০৬ সালে এক সড়ক দুর্ঘটনায় স্বামী পিয়ের কুরিকেও হারান মেরি। স্বামীকে হারানোর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ঠোঁট থেকে হাসিও হারিয়ে গিয়েছিল দীর্ঘদিন।

মেরি কুরির জীবন থেকে আমরা শিখতে পারি, পাঠ ও জ্ঞানার্জন মানুষকে হতাশা ও শোক থেকে মুক্তি দিতে পারে। বুঝতে পারি, নানা বিষয়ে জ্ঞানার্জন কখনো বিফলে যায় না। এ কারণেই মেরি জেনেছিলেন ‘পিচব্লেন্ড’ আবিষ্কারের কথা, জেনেছিলেন পরমাণুর গঠন নিয়ে রাদারফোর্ড ও বেকেরেলের যুগান্তকারী ধারণার কথা। জানতে পারি, কোনো প্রতিকূলতাই অনতিক্রম্য নয়। সাহস ও সাধনায় যেকোনো বাধার দেয়াল ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া যায়। এই ভাঙ্গন, এই বিপ্লব ঘটাতে পারেন যেকোনো রুগ্নপ্রায় কৃশকায় মানবীও।     

লেখক: অধ্যাপক, পরিবেশ প্রকৌশল অনুষদ, ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস, অস্টিন, যুক্তরাষ্ট্র

 

সূত্র:

১. Hürter, T. Too Big for a Single Mind: How the Greatest Generation of Physicists Uncovered the Quantum World. 2020. The Experiment LLC. New York, NY.