সবকিছুর তত্ত্বের খোঁজে নিউটন

কেপলারের পরে এলেন গ্যালিলিও। তিনি বুঝতে পারেন, বস্তুর বেগ পরিবর্তনের জন্য বলের প্রয়োজন হয়। কিন্তু সমবেগে চলমান বস্তুর বেগ অপরিবর্তনীয় থাকার জন্য বলের দরকার পড়ে না

৫ জুলাই ১৬৮৭। প্রকাশিত হলো ফিলোসফিয়া ন্যাচারালিস প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমেটিকা। বাংলা করলে যার মানে দাঁড়ায়, প্রাকৃতিক দর্শনের গাণিতিক নীতি। থিওরি অব এভরিথিং বা সবকিছুর তত্ত্বের দিকে বিজ্ঞানীদের পথচলার শুরুটা হয়েছিল এর হাত ধরে। এ বইতে নিউটন দেখিয়েছিলেন, যে কারণে আপেল মাটিতে পড়ে, সেই একই কারণে গ্রহগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে সূর্যের চারপাশে, একই কারণে হচ্ছে জোয়ার-ভাটা, চাঁদ পড়তে চাচ্ছে পৃথিবীর দিকে এবং আমরা সবাই হাঁটতে পারছি পৃথিবীর বুকে। এর নাম নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্ব। পাশাপাশি তিনি দেখিয়েছিলেন, মাত্র তিনটি সূত্র দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় সব ধরনের বস্তুর গতি। সার্বিক এ সূত্রগুলো ‘নিউটনের গতিসূত্র’ নামে খ্যাত। এই সূত্রগুলোই আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান ও চিরায়ত বলবিদ্যার ভিত্তি। এ লেখায় আমরা এসব সূত্রের ভেতরে একটুখানি উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করব। বোঝার চেষ্টা করব, এরা আসলে কী বলতে চায়। কীভাবে গড়ে উঠল এসব সূত্র।

প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল ছিলেন সেকালের সবচেয়ে প্রভাবশালী বিজ্ঞানী। তিনি মনে করতেন, স্থিরাবস্থায় বস্তু তার স্বাভাবিক অবস্থায় থাকে। আর মহাবিশ্বে সব বস্তুর জন্য নির্ধারিত সাধারণ স্থান আছে। যেকোনো বস্তু সেই নির্ধারিত স্থানে স্থিরাবস্থায় থাকতে চায়। যেমন পাথর বা এ ধরনের ভারী বস্তু স্বাভাবিকভাবে মাটিতে থাকতে চায়, ধোঁয়া বা হালকা ধরনের বস্তু থাকতে চায় আকাশে আর নক্ষত্রদের সাধারণ স্থান হলো মহাকাশ (গ্রিকদের ভাষায়, স্বর্গ)। তাঁর মতে, যেকোনো বস্তু সরলরেখা বরাবর একই বেগে (পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় বলে ‘সমবেগ’, মানে সমান বেগ বা একই বেগ) চলমান থাকতে হলে বাড়তি ‘কিছু একটা’ লাগবে। এই ‘কিছু একটা’ বস্তুটিকে প্রতি মুহূর্তে সামনে এগিয়ে নেবে। আর ‘কিছু একটা’ কাজ করা বন্ধ করে দিলে বস্তু আর সামনে এগোবে না, থেমে যাবে। বলা বাহুল্য, এই ‘কিছু একটা’ হলো বল। পাশাপাশি অ্যারিস্টটল মনে করতেন, মহাবিশ্বের কেন্দ্রে আছে পৃথিবী। সূর্য ও অন্যান্য গ্রহ-উপগ্রহ-নক্ষত্র (অ্যারিস্টটলের ভাষায়, স্বর্গীয় সবকিছু) পৃথিবীকে ঘিরে ঘুরপাক খায়।

তারপর এলেন কেপলার। প্রথমত তিনি আবিষ্কার করলেন, গ্রহরা সূর্যকে ঘিরে উপবৃত্তাকার পথে ঘোরে। বৃত্তের যেমন একটি কেন্দ্র থাকে, তেমনি উপবৃত্তের দুটি ফোকাস থাকে। এ রকম একটি ফোকাসে থাকে সূর্য। উপবৃত্ত মানেই কিন্তু ডিম্বাকৃতি না। গাণিতিকভাবে বললে: দুটি নির্দিষ্ট বিন্দু বা ফোকাস থেকে যেসব বিন্দুর দূরত্বের যোগফল একটি ধ্রুব সংখ্যা, তাদের সঞ্চারপথই হচ্ছে উপবৃত্ত। আর একদম সহজ করে বললে, একে চ্যাপ্টা বৃত্ত বলা যেতে পারে।

কেপলারের দ্বিতীয় পর্যবেক্ষণ ছিল, সূর্যকে ঘিরে গ্রহরা সব সময় নির্দিষ্ট বেগে ঘোরে না। সূর্যের কাছাকাছি, মানে, উপবৃত্তের যে ফোকাসে সূর্য আছে, সেদিকে থাকলে তারা দ্রুতবেগে চলে, আর সূর্য থেকে দূরে থাকলে এরা তুলনামূলকভাবে ধীরে চলে। এভাবে কক্ষপথ বরাবর প্রতিটি গ্রহের বেগ বা কক্ষীয় বেগ এমন হয় যে সমান সময়ে ব্যাসার্ধ ভেক্টর দিয়ে আবদ্ধ ক্ষেত্রফল একদম সমান হয়।

তৃতীয় সূত্রটি কেপলার অনেক পরে আবিষ্কার করেন। এই সূত্র বাকি দুটি সূত্র থেকে আলাদা। কারণ, এটি কেবল একটি গ্রহ নিয়ে কাজ করে না, বরং এক গ্রহের সঙ্গে আরেক গ্রহের সম্পর্ক তৈরি করে। এই সূত্র বলে, যেকোনো দুটি গ্রহের কক্ষীয় পর্যায়কাল আর কক্ষপথের আকার তুলনা করলে দেখা যায়, পর্যায়কাল ও কক্ষপথের আকারের ৩/২ ঘাত একে অন্যের সমানুপাতিক। এখানে পর্যায়কাল মানে, পুরো কক্ষপথ একবার পাড়ি দিতে একটি গ্রহের যে সময় লাগে, তা। আর কক্ষপথের আকার মানে, উপবৃত্তাকার কক্ষপথের সবচেয়ে বড় ব্যাসের দৈর্ঘ্য। বিজ্ঞানের ভাষায় এর নাম মেজর এক্সিস বা পরাক্ষ। জটিল এ কথাকে সহজ করে বলা যায়, গ্রহগুলো যদি বৃত্তাকার পথে ঘুরত—বৃত্তাকারে না ঘুরলেও এর কাছাকাছি আকৃতির পথ ধরেই ঘোরে—তাহলে একবার পুরো কক্ষপথ ঘুরে আসতে যে সময় লাগত, তা ওই বৃত্তের ব্যাসের (অথবা ব্যাসার্ধের) ৩/২ ঘাতের সমানুপাতিক হতো।

কেপলারের পরে এলেন গ্যালিলিও। তিনি বুঝতে পারেন, বস্তুর বেগ পরিবর্তনের জন্য বলের প্রয়োজন হয়। কিন্তু সমবেগে চলমান বস্তুর বেগ অপরিবর্তনীয় থাকার জন্য বলের দরকার পড়ে না। আমরা জানি, বেগের পরিবর্তন মানে ত্বরণ। অর্থাৎ গ্যালিলিওর মতে, ত্বরণের জন্য বল প্রয়োজন হয়। কিন্তু সমবেগে চলমান বস্তুর বেগের পরিবর্তন না হলে বস্তুটি এমনিতেই সমবেগে চলতে থাকে, সে জন্য বারবার বলের প্রয়োজন পড়বে না। একবাক্যে গ্যালিলিওর বিবৃতিটি এমন: বলের অনুপস্থিতিতি সমবেগে চলমান বস্তু একই বেগে চলতে থাকবে।

প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমেটিকা

নিউটন এই সব কটি ভাষ্যের ভেতরটুকু পর্যন্ত বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি তাই গতির প্রথম সূত্রকে বললেন ‘প্রিন্সিপল অব ইনারশিয়া’ বা ‘জড়তার নীতি’। এই নীতি বলে, কোনো বস্তুকে যদি বাইরে থেকে কিছু স্পর্শ না করে বা প্রভাবিত না করে, তাহলে স্থির যেকোনো বস্তু স্থিরই থাকবে, আর চলমান যেকোনো বস্তু আজীবন সেই একই বেগে সরলরেখা বরাবর চলতেই থাকবে। (চলমান বস্তুটা একইভাবে চলতে থাকবে কেন? রিচার্ড ফাইনম্যানের ভাষায়, আমরা জানি না। কিন্তু প্রকৃতিতে এমনটাই ঘটতে দেখা যায়।) যেহেতু এর মূল কথাটুকু গ্যালিলিওই বলে গিয়েছিলেন, নিউটন তাই এর সম্পূর্ণ কৃতিত্ব দেন গ্যালিলিওকে এবং সে কথা উল্লেখ করে যান প্রিন্সিপিয়ায়। এভাবে স্থির ও সমবেগে চলমান বস্তুর জড়তার বিষয়টি এক সুতায় গেঁথে দেওয়ার পাশাপাশি নিউটন এই বিষয়গুলোকে গাণিতিকভাবে প্রকাশ করেন—

∑F=0 ⇔ dv/dt=0

এই সূত্র দেখে জটিল মনে হলে ঘাবড়ানোর কিছু নেই। ∑F মানে প্রয়োগকৃত বলের মোট পরিমাণ। এখানে ∑ চিহ্নটি হলো সামেশন, এটি ভেতরে লেখা রাশিটির মোট যোগফল বোঝায়। ⇔ মানে, এর বাঁ পাশের অংশ সত্যি হলে ডান পাশের অংশও সত্যি। আবার ডান পাশের অংশ সত্যি হলে বাঁ পাশের অংশ সত্যি হবে। আর ডান পাশে লেখা dv/dt কথাটি দিয়ে ক্যালকুলাস বা কলন গণিতের ভাষায় বলা হচ্ছে, সময়ের সাপেক্ষে বেগের পরিবর্তন। মানে, সময় পরিবর্তিত হলে বেগ কতটুকু বাড়ছে বা কমছে। এটার আরেক নাম ত্বরণ, যাকে লেখা হয় a দিয়ে। অর্থাৎ, dv/dt=a। মানে, ওপরের গাণিতিক বাক্যটি বলছে, মোট প্রয়োগকৃত বলের পরিমাণ শূন্য হলে সময়ের সাপেক্ষে বেগের পরিবর্তনের হার, মানে ত্বরণের পরিমাণও হবে শূন্য। আর ত্বরণের পরিমাণ শূন্য হলে বুঝতে হবে বস্তুটির ওপর প্রয়োগকৃত বলের মান শূন্য। সহজ কথায়, ওপরে যা বলা হয়েছে, কথাটা তা-ই। বাইরে থেকে বল প্রয়োগ না করলে স্থির বস্তু স্থির থাকে এবং গতিশীল বস্তু সমবেগে সরল পথে চলতে থাকে। আর এই গাণিতিক রূপটি প্রথমবারের মতো লিখেছেন নিউটন।

গতির দ্বিতীয় সূত্রটি বলে, বস্তুর ওপর প্রয়োগকৃত বলের পরিমাণ এর ভর ও ত্বরণের গুণফলের সমান এবং বল যেদিকে প্রয়োগ করা হয়, বস্তুটির ত্বরণ (a) সেদিকেই হয়। আগেই বলেছি, ত্বরণ মানে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেগের পরিবর্তনের হার, কী হারে বেগ বাড়ছে বা কমছে, সেটা। যদিও সূত্রটির মূল ভাষ্য হচ্ছে, কোনো বস্তুর ভরবেগের পরিবর্তনের হার তার ওপর প্রযুক্ত বলের সমানুপাতিক। বল যেদিকে কাজ করে, বস্তুটির ভরবেগের পরিবর্তনও সেদিকে হয়।

খুব সহজেই আমরা বিষয়টা চিন্তা করতে পারি। প্রথম সূত্র থেকে আমরা দেখেছি, বল প্রয়োগ না করলে স্থির বস্তু স্থিরাবস্থায় থাকে, আর গতিশীল বস্তু সমবেগে সরল পথে চলতে থাকে। দ্বিতীয় অংশে, গতিশীল বস্তু যে সরল পথে চলতে থাকবে, এই চলার জন্য কিন্তু তার ওপর আগে একটা বল প্রয়োগ করতে হয়েছে। এই বলের মান কত? সেটা বের করতে পারব তার ভর ও ত্বরণকে গুণ করে। আর বস্তুটি কোন দিকে গতিশীল হবে, তা বুঝতে পারব বলের দিক দেখে। এই দ্বিতীয় সূত্রের গাণিতিক রূপ হলো—

F= dP/dt;

যেখানে P মানে ভর ও বেগের গুণফল, অর্থাৎ mv। এটাকে তাই এভাবে লেখা যায়—

F= m dv/dt বা F=ma;

যেহেতু আগেই দেখেছি, dv/dt=a। এখন প্রশ্ন হলো, এই সূত্র নিউটন পেলেন কোত্থেকে? কীভাবে তিনি এই সূত্রের বিষয়টি বুঝলেন। এখানেও নিউটন নির্ভর করেছেন তাঁর আগের মহাজ্ঞানীদের ভাষ্যের ওপর। সত্যি বলতে, গাণিতিক রূপটি না থাকলেও, প্রথম সূত্রের মতো এই সূত্রের বিষয়টিও নিউটনের সময়ে সবাই মোটামুটি জানতেন। অর্থাৎ, নিউটন এই সূত্রের পেছনের তত্ত্বটি আবিষ্কার করেননি, তবে এর গাণিতিক রূপটি তিনি আবিষ্কার করেছেন, প্রমাণ করেছেন হাতে-কলমে। তবে এর মূল বক্তব্যটিও মূলত গ্যালিলিও গ্যালিলেইয়ের আবিষ্কার।

কেপলার যখন গ্রহদের গতির সূত্র আবিষ্কার করছেন, গ্যালিলিও তখন গবেষণা করছেন গতির নিয়মনীতি নিয়ে। গ্যালিলিও ভাবলেন, এই যে গ্রহেরা সূর্যের চারদিকে ঘুরছে, এই ঘোরার পেছনে কারিকুরিটা কে ফলাচ্ছে? সে সময় প্রস্তাবিত তত্ত্বগুলোর একটি ছিল, দেবদূতেরা স্বর্গীয় ক্ষমতাবলে পেছন থেকে কারিকুরি করেন, তাই গ্রহরা ঘোরে। পাখা নেড়ে নেড়ে তারা গ্রহদের সামনের দিকে পরিচালিত করে।

গ্যালিলিও তত দিনে জড়তার নীতিটা বুঝে ফেলেছেন। কেপলারের নীতিগুলোকে বোঝার জন্য এই জড়তার বিষয়টি বোঝা জরুরি ছিল। আগেই বলেছি, নিউটন আইডিয়াটি পরিমার্জন করেছেন। তাঁর ভাষ্যমতে, কোনো বস্তুর গতি পাল্টানোর একমাত্র উপায়, এর ওপর বল প্রয়োগ করা। কোনো বস্তুর বেগ বেড়ে যাওয়ার অর্থ, গতির দিকে একটা বল প্রয়োগ করা হয়েছে। আর কোনো বস্তুর গতির দিক বদলের অর্থ, গতির দিকে নয়, বরং পাশের কোনো দিকে বল প্রয়োগ করা হয়েছে। অর্থাৎ নিউটনের আইডিয়াটি বলে, বল প্রয়োগ করলে সেটা হয় বস্তুর গতি পরিবর্তন করবে আর না হয় এর দিক পরিবর্তন করবে। এটাই আমরা ওপরে দেখেছি।

বিষয়টি ভালোভাবে বোঝার জন্য একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ধরা যাক, সুতার সঙ্গে বাঁধা একটা পাথর বৃত্তাকার পথে ঘুরছে। পাথরটাকে বৃত্তাকার পথে রাখার জন্য কিন্তু বল প্রয়োগ করতে হবে। সুতাটা ধরে আমাদের ভেতরের দিকে টানতে হবে। বল প্রয়োগের ফলে এ ক্ষেত্রে যে ত্বরণ তৈরি হয়, তা বস্তুর ভরের ব্যস্তানুপাতিক। কথাটা এভাবেও বলা যায়: প্রয়োগকৃত বল, ভর আর ত্বরণের গুণফলের সমানুপাতিক। (মানে, F = ma, গতির দ্বিতীয় সূত্র।) তার মানে, একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ ত্বরণ তৈরি করতে চাইলে কোনো বস্তুর ভর যত বেশি হবে, তাকে তত বেশি বল দিতে হবে। (একই সুতার মাথায় ভিন্ন ভরের পাথর বেঁধে, একই বেগে, একই বৃত্তাকার পথে ঘুরালে বিষয়টা বোঝা যাবে। দেখা যাবে, ভর কম হলে একই পথে, একই বেগে ঘোরাতে বল কম দেওয়া লাগছে। আবার ভর বেশি হলে বল বেশি দিতে হবে।) এভাবে ভাবলে দারুণ যে আইডিয়াটি বেরিয়ে আসে তা হলো, গ্রহদের তাদের কক্ষপথে রাখার জন্য স্পর্শক বরাবর কোনো বল দিতে হয় না (অর্থাৎ দেবদূতদের সারাক্ষণ গ্রহের পেছনে ছোটার দরকার নেই)। কারণ, গ্রহরা এমনিতেই এই পথ ধরেই ছুটবে। যদি গ্রহদের কেউ বিরক্ত বা প্রভাবিত না করত, তাহলে তাদের এমনিতে সরলরেখা বরাবর ছুট দেওয়ার কথা (গতির প্রথম সূত্রের কথা ভাবুন)। কিন্তু বাস্তবে বল প্রয়োগ না করলে যে রেখা বরাবর তাদের চলার কথা, সেখান থেকে তারা সরে আসে। এই সরে আসাটা তাদের গতির দিকে হয় না, বরং তাদের গতির সঙ্গে সমকোণে ঘটে। কথাটা এভাবে বলা যেতে পারে, জড়তার নীতির কারণে, সূর্যের চারপাশে গ্রহদের ঘোরা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যে বল দরকার হয়, সেটা সূর্যের চারপাশে গ্রহদের কক্ষপথ বরাবর কাজ করে না, বরং সূর্যের দিকে কাজ করে। বলা বাহুল্য, এই বল আসে সূর্য থেকে। হ্যাঁ, এটা মহাকর্ষ বল! (মহাকর্ষ বল নিয়ে পরবর্তী সময়ে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করব)।

নিউটনের তৃতীয় সূত্রটির ভাষ্য সবচেয়ে সহজ। প্রতিটি ক্রিয়ার সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। উদাহরণ দিই। আমরা যখন চেয়ারে বসি, তখন চেয়ারের ওপর যে পরিমাণ বল দিই, চেয়ার আমাদের ওপর একই পরিমাণ বল দেয়। এখানে আমাদের দেওয়া বলটিকে যদি বলি ক্রিয়া, তাহলে চেয়ারের বলটি প্রতিক্রিয়া। দুটি বল, মানে ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া কাজ করছে বিপরীত দিকে। সে জন্যই আমরা চেয়ারে বসে থাকতে পারছি। যদি আমার দেওয়া বলের পরিমাণ বেশি হয়, চেয়ারটা ভেঙে যাবে এবং বসার জায়গাটা নিচের দিকে পড়ে যাবে। কারণ, নিউটনের দ্বিতীয় সূত্র বলে, বল প্রয়োগের দিকে বস্তুর (মানে, চেয়ারের বসার অংশটির) ভরবেগের পরিবর্তন হবে!

বলা বাহুল্য, এ সূত্রের ব্যাপারেও নিউটন আগে থেকে খানিকটা জানতেন। মূলত ক্রিশ্চিয়ান হাইগেনস এ নিয়ে কাজ করেছিলেন। তাঁর কাজের ওপর ভিত্তি করে স্যার ক্রিস্টোফার রেন ও ড. ওয়ালিস ১৬৬৮ সালে রয়্যাল সোসাইটিতে একটি গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেন। হাইগেনস তাঁর কাজের সত্যিকার স্বীকৃতি পাননি। কৃতিত্ব পেয়েছিলেন রেন এবং ওয়ালিস। ১৭৭০ সালে দুটি বস্তুর সংঘর্ষের ফলে কী হতে পারে, এ নিয়ে একটি পরীক্ষা করেছিলেন এডমি ম্যারিওট। রয়্যাল সোসাইটির সদস্য হিসেবে এ সবই নিউটনের হাতে ছিল। তিনি সে জন্য ম্যারিওটকে কৃতিত্বও দিয়েছিলেন, কিন্তু হাইগেনসকে প্রাপ্য কৃতিত্ব দেননি সেভাবে। সে যা–ই হোক, পরবর্তী সময়ে নিউটন নিজের মতো করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন এবং সূত্রটির গাণিতিক রূপ দাঁড় করান।

FA=-FB

অর্থাৎ একটি বস্তু A আরেকটি বস্তু B–এর ওপর যে বল প্রয়োগ করছে, B উল্টো দিকে A–এর ওপরও একই পরিমাণ বল প্রয়োগ করছে।

গতির সূত্র তিনটি দিয়ে সাধারণভাবে যেকোনো বস্তুর গতি ব্যাখ্যা করা যায়। এ জন্য অবশ্যই রেফারেন্স ফ্রেম বা জড় কাঠামোর প্রয়োজন হয়। অর্থাৎ একটি বস্তু স্থির নাকি চলমান, সেটা একটা কাঠামোর সঙ্গে তুলনা করে বুঝতে হয়। সেটাই জড় কাঠামো। ত্রিমাত্রিক জড় কাঠামো বোঝানোর জন্য সাধারণত x, y ও z অক্ষ ব্যবহার করা হয়, আর দ্বিমাত্রিক কাঠামোতে থাকে শুধু x ও y অক্ষ। নবম-দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের এই জড় কাঠামো ও গতির সূত্র নিয়ে পড়ানো হয়।

নিউটন ছিলেন পদার্থবিজ্ঞানের বরপুত্র। তাঁর কাজের পরিধি অনেক দূর বিস্তৃত। তিনি একই সঙ্গে আলোকবিজ্ঞান নিয়ে কাজ করেছেন, কাজ-ক্ষমতা-শক্তি নিয়ে কাজ করেছেন, শক্তির সংরক্ষণশীলতা বিষয়ে কাজ করেছেন

নিউটন তাঁর মায়ের আপেলবাগানে বসে আছেন। তাঁর মাথার ওপর একটি আপেল পড়ল। অবাক বিস্ময়ে তিনি ভাবলেন, আপেলটা নিচের দিকে পড়ল কেন? কেন ওপরের দিকে উঠে গেল না?

এটা প্রচলিত কিংবদন্তি। আসলেই এমন কিছু হয়েছিল কি না, তা নিয়ে তর্ক আছে। তবে নিউটন যে প্রকৃতির কাজকর্ম দেখে মুগ্ধ-বিস্মিত হয়েছিলেন, প্রশ্ন করেছিলেন, কেন এমন হচ্ছে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি নিজের প্রতিভার চরম প্রকাশ দেখালেন। আবিষ্কৃত হলো মহাকর্ষ সূত্র। যে সূত্রের হাত ধরে পদার্থবিজ্ঞানের গণ্ডি পেরিয়ে গেল পৃথিবীর সীমানা। তিনি দেখালেন, শুধু পৃথিবীই না, মহাবিশ্বের অন্যান্য সবখানেই আসলে পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলো একই রকমভাবে কাজ করে। তিনি বললেন, মহাবিশ্বের সবকিছুর গতি-প্রকৃতি আসলে আমাদের খুবই পরিচিত, বোধগম্য এবং চাইলেই আগে থেকে এর সবকিছুই হিসাব করে বের করে ফেলা যায়। যে মহাকর্ষের টানে গাছ থেকে আপেল মাটিতে পড়ে, সেই একই মহাকর্ষের টানে চাঁদও পৃথিবীর চারপাশে ঘোরে। কোনো জিনিসকে কৌণিকভাবে মাটি থেকে ছুড়ে মারলে সেটি যে উপবৃত্তাকার পথে উড়ে যায়, এর পেছনেও আছে মহাকর্ষ। এখানেই শেষ নয়। এই যে এত এত গ্রহ, উপগ্রহ, গ্রহাণু ও ধূমকেতু নিজেদের কক্ষপথে সূর্যকে ঘিরে ঘুরছে, এমনকি মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে এত বিলিয়ন বিলিয়ন নক্ষত্র যে নিয়ত নিজেদের কক্ষপথে ছুটে চলেছে, নিউটন হিসাব কষে দেখিয়ে দিলেন, এই সবকিছুর পেছনেই আছে ওই একই জিনিস। মহাকর্ষ!

সূত্রটি কীভাবে কাজ করে, তা আমরা জানি। সূত্রটি বলে, মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তু একে অন্যকে একটা বল দিয়ে আকর্ষণ করে। যেকোনো দুটি বস্তুর জন্য এই বলের মান তাদের ভরের গুণফলের সমানুপাতিক এবং তাদের মধ্যকার দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক। কথাটিকে গাণিতিকভাবে নিচের সমীকরণটি দিয়ে প্রকাশ করা যায়— F=G mm’/r2

এর সঙ্গে আরেকটা ব্যাপার যোগ করতে হবে। কোনো বস্তু বলের প্রতি সাড়া দিলে বলের দিকে এর ত্বরণ ঘটে। এই ত্বরণের মান বস্তুর ভরের ব্যস্তানুপাতিক। এটুকু বুঝলে বলা যায়, মহাকর্ষের ব্যাপারে জানার মতো সবকিছু আমাদের মোটামুটি জানা হয়ে গেছে।

গতির তত্ত্ব কেপলারের চেয়ে ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিলেন নিউটন। বুঝেছিলেন, সূর্যই হতে পারে গ্রহদের গতি নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজনীয় বলের আধার। (এ নিয়ে দ্বিতীয় সূত্রের উদাহরণে বলেছি)। নিজের কাছে তিনি প্রমাণ করেছিলেন, বল প্রয়োগ না করলে গ্রহরা যে সরলরেখা বরাবর ছুট দিত, সেটা থেকে তারা ব্যাসার্ধ বরাবর সরে আসে। সমান সময়ে গ্রহদের সমান ক্ষেত্রফল অতিক্রম করাটা আসলে এরই ইঙ্গিত দেয়। গ্রহদের ওপর প্রযুক্ত এসব বল সূর্যের দিকে কাজ করে। ক্ষেত্রফল–সম্পর্কিত নীতিটিও আসলে এরই ফলাফল।

কেপলারের তৃতীয় সূত্র বিশ্লেষণ করে দেখানো যায়, গ্রহ যত দূরে, বলের টানও তত দুর্বল। সূর্য থেকে ভিন্ন দূরত্বে অবস্থানরত দুটি গ্রহের ক্ষেত্রে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, বলগুলো তাদের দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক। এই দুই নীতির সমন্বয় করে নিউটন সিদ্ধান্তে এলেন, এমন একটা বল আছে, যেটা বস্তু দুটির সংযোগকারী সরলরেখা বরাবর কাজ করে এবং এর মান তাদের দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক হয়।

সবকিছুকে এক সুতায় গাঁথা, সবকিছুর জন্য সাধারণ কিছু একটা খুঁজে বের করার জন্য সব সময় সচেষ্ট নিউটন ভাবেন। ভেবে ভেবে তাঁর মনে হয়, চারপাশের গ্রহদের সূর্যের ধরে রাখার বাইরেও সম্পর্কটি নিশ্চয়ই আরও সাধারণভাবে অন্যান্য বস্তুর জন্যও কাজ করে। তত দিনে মানুষ গ্রহদের চাঁদের কথা জানত। পৃথিবীর চারপাশে যেমন পৃথিবীর চাঁদ ঘোরে, তেমনি বৃহস্পতির চারপাশেও তার চাঁদ ঘোরে। নিউটন ভাবলেন, এই গ্রহরা নিজের চাঁদকে নিশ্চয়ই একটা বল দিয়ে ধরে রাখে। শুধু ভাবাই নয়, নিজের ভেতরে কেমন একটা নিশ্চয়তা টের পান তিনি। যে বল আমাদের পৃথিবীতে ধরে রেখেছে, তার ব্যাপারেও তত দিনে তিনি জেনে গেছেন। সব মিলিয়ে নতুন এক প্রস্তাব দিলেন নিউটন। বললেন, এটি আসলে একটি সর্বজনীন বল। এই বল দিয়ে সবকিছু সবকিছুকে টানে।

এর পরের প্রশ্নটা হলো, পৃথিবী এর পৃষ্ঠের মানুষকে যেভাবে টানে, চাঁদকেও কি সেভাবে টানে? মানে, এই টানের মান কি দূরত্বের ব্যস্তানুপাতিক? স্থিরাবস্থা থেকে পৃথিবীপৃষ্ঠের কোনো বস্তুকে নিচের দিকে ছেড়ে দিলে তা যদি প্রথম সেকেন্ডে ১৬ ফুট নিচে পড়ে, একই সময়ে চাঁদ কতটুকু পড়বে? এই জায়গায় এসে আমরা হয়তো বলব, চাঁদ তো পড়ে না। চাঁদের ওপর যদি কোনো বল কাজ না করত, সে একটা সরলরেখা বরাবর চলে যেত। কিন্তু চাঁদ বৃত্তাকার পথে ঘোরে। তার মানে, বল না থাকলে সরলরেখার যে বিন্দুতে সে থাকত, সেখান থেকে সে সরে এসেছে বা পড়ে গেছে। চাঁদের কক্ষপথের ব্যাসার্ধ (প্রায় ২,৪০,০০০ মাইলের মতো) এবং পৃথিবীর চারপাশে একবার ঘুরে আসতে এর যে সময় লাগে (প্রায় ২৯ দিনের মতো), তা থেকে চাঁদ এক সেকেন্ডে কক্ষপথের ওপর কতটুকু দূরত্ব পাড়ি দেয়, তা আমরা হিসাব করতে পারি। এ থেকে এক সেকেন্ডে তার কতটুকু পতন হয়, সেটা হিসাব করে বের করা যায়। সে জন্য এক সেকেন্ড আগে চাঁদ তার কক্ষপথের যে বিন্দুতে ছিল, সে বিন্দুতে একটা স্পর্শক আঁকতে হয়। তারপর, বর্তমানে সে যে বিন্দুতে আছে, সে বিন্দুটি স্পর্শকের কতটুকু নিচে, সেই দূরত্বটি বের করতে হয়। এইটুকু দূরত্বই সে সরে এসেছে। দেখা যায়, এই দূরত্বের মান সেকেন্ডে ১/২০ ইঞ্চির মতো। দূরত্বের ব্যস্তানুপাতিক সূত্রের সঙ্গে এটি খাপ খেয়ে যায়। কারণ, পৃথিবীর ব্যাসার্ধ ৪,০০০ মাইল। পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে ৪,০০০ মাইলের মতো দূরের কিছু যদি সেকেন্ডে ১৬ ফুট নিচে পড়ে; ২,৪০,০০০ মাইল, মানে আরও প্রায় ৬০ গুণ দূরের কিছু একটার তাহলে সেকেন্ডে ১৬ ফুটের ১/৩৬০০ অংশ পরিমাণ নিচে পড়ার কথা। যেটা ওই ১/২০ ইঞ্চির মতোই হয়। নিউটনও মহাকর্ষ তত্ত্বকে এ রকমই একটি হিসাব কষে পরীক্ষা করে দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বেশ যত্ন করে, খুঁটিয়ে হিসাব করতে গিয়ে তিনি এত বিশাল অমিল পেলেন যে তিনি ভাবলেন, তথ্য-উপাত্ত মহাকর্ষ তত্ত্বকে সমর্থন করছে না। তিনি এই ফলাফল আর তখন প্রকাশই করেননি। ছয় বছর পরে এসে জ্যোতির্বিদেরা যখন পৃথিবীর আকার নিয়ে নতুন করে মাপজোখ করলেন, দেখা গেল, তাঁরা পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব এত দিন ভুল হিসাব করছিলেন। এটা শোনার পর নিউটন আবার হিসাব কষতে বসলেন। সঠিক দূরত্ব বসিয়ে হিসাব করতেই সবকিছু একেবারে খাপে খাপে মিলে গেল।

মহাকর্ষকে একইভাবে একাধিক নক্ষত্রের জন্য, বিভিন্ন গ্যালাক্সির জন্য পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। দেখা গেছে, এই মহাকর্ষ সর্বজনীন। পরবর্তী সময়ে আইনস্টাইন নিউটনের এই মহাকর্ষ তত্ত্বকে খানিকটা পরিমার্জন করে সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব দিয়েছেন। কিন্তু তাতে নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র কিন্তু অকার্যকর হয়ে যায়নি। এই সূত্র ব্যবহার করেই জোয়ার-ভাটাকে ব্যাখ্যা করা যায়, এর হাত ধরেই মানুষ চাঁদে গিয়ে নিরাপদে ফিরে এসেছে!

প্রিজম নিয়ে নিউটনের কারিকুরি, শিল্পীর তুলিতে

নিউটন ছিলেন পদার্থবিজ্ঞানের বরপুত্র। তাঁর কাজের পরিধি অনেক দূর বিস্তৃত। তিনি একই সঙ্গে আলোকবিজ্ঞান নিয়ে কাজ করেছেন, কাজ-ক্ষমতা-শক্তি নিয়ে কাজ করেছেন, শক্তির সংরক্ষণশীলতা বিষয়ে কাজ করেছেন (যা তাঁর তৃতীয় সূত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত)। আর ক্যালকুলাস নামে গণিতের আস্ত একটি শাখাই আবিষ্কার করেছেন তিনি। এই ক্যালকুলাস বা কলন গণিত ছাড়া আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান এককথায় বিকল।

সংক্ষিপ্ত পরিসরের এ লেখায় তাঁর সব কাজ নিয়ে আলোচনা করা সম্ভব নয়। শেষ করার আগে শুধু একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন নিয়ে বলি। কেউ জিজ্ঞেস করতে পারেন, নিউটন তো গতির সূত্রগুলো আগে থেকেই মোটামুটি জানতেন। তাহলে তাঁর কৃতিত্বটা এখানে কী?

মহাবিশ্বের সব বস্তুর গতি-প্রকৃতি, সব ধরনের ঘটনার ব্যাখ্যা—সবকিছুকে এক সুতায় গাঁথার চেষ্টায় বিজ্ঞানীরা নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছেন। যে সূত্রের হাত ধরে এমনটা করা সম্ভব হতে পারে, তার নাম দেওয়া হয়েছে ‘দ্য থিওরি অব এভরিথিং’, মানে সবকিছুর তত্ত্ব। নাম থাকলেও, এই তত্ত্ব বিজ্ঞানীদের হাতে ধরা দেয়নি আজও। এই প্রচেষ্টা আসলে দীর্ঘদিনের। রসায়নের দিকে তাকালে দেখতে পাব, এই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে গড়ে উঠেছে পর্যায় সারণি। এক পৃষ্ঠায় রসায়নের সবকিছু ঠাঁই পেয়েছে। আর পদার্থবিজ্ঞানে? উত্তরটা আগেই দিয়েছি, সবকিছুকে এক সুতায় গাঁথার তত্ত্ব বিজ্ঞানীরা আজও আবিষ্কার করতে পারেননি। কিন্তু চেষ্টা করে যাচ্ছেন নিরন্তর।

এই চেষ্টার শুরুটা করেছিলেন মূলত নিউটন। তাঁর আগে যুক্তির সিঁড়ি বেয়ে, গণিতের হাত ধরে মহাবিশ্বের সব ধরনের গতি-প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে, এ রকম ভাবনা কারও মাথায় সেভাবে আসেনি। প্রকৃতিকে বোঝার চেষ্টা ছিল মূলত দর্শনশাস্ত্রের কাজ। দার্শনিকেরা যুক্তি খাটিয়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করতেন প্রাকৃতিক বিভিন্ন ঘটনাকে। প্রিন্সিপিয়ার নাম থেকেই বিষয়টি বোঝা যায়, প্রাকৃতিক দর্শনের গাণিতিক নীতি। অর্থাৎ নিউটন দর্শনের এই বিষয়গুলোকে গাণিতিক নিয়মে বেঁধেছেন। তাঁর আগে প্রকৃতিকে যুক্তি দিয়ে বোঝার চেষ্টা ছাড়া ছাড়াভাবে হয়েছে। টাইকো ব্রাহে, নিকোলাস কোপার্নিকাস, জোহানেস কেপলার বা গ্যালিলিও গ্যালিলেইয়ের নাম এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। কেন, তা আমরা দেখেছি। কিন্তু সবকিছুকে এক সুতায় বাঁধা, মাত্র ৩টি সূত্র দিয়ে বস্তুর সাধারণ সব ধরনের গতির ব্যাখ্যা দেওয়ার বিষয়টি ছিল কল্পনাতীত। পাশাপাশি, মহাকর্ষ সূত্র দিয়ে পৃথিবীর সীমা ছাড়িয়ে যাওয়া, গ্রহ-উপগ্রহ-গ্যালাক্সিসহ সবকিছুকে এক সুতায় গেঁথে দেওয়া, এটাই নিউটনের মাস্টারস্ট্রোক।

আপনি চেয়ারে বসে থাকুন কিংবা বই রেখে দিন টেবিলের ওপর, কোনো কিছুকে ধাক্কা দিয়ে এগিয়ে দিন সামনে, ছুড়ে দিন যেকোনো দিকে—সবকিছু ব্যাখ্যা করা যাবে এই সূত্রগুলো দিয়ে। রকেট উৎক্ষেপণ করার কাজেও লাগে নিউটনের গতিসূত্র। আর গাণিতিক রূপ দেওয়ার বিষয়টি তো আছেই।

বিজ্ঞানের সংজ্ঞায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি শর্ত জুড়ে দিয়েছিলেন গ্যালিলিও, সবকিছুকে পরিমাপ করতে হবে। শুধু তত্ত্ব দিয়ে বললে হবে না। পরিমাপ করে দেখাতে হবে, একটা বিষয় কী রকম বা কীভাবে কাজ করছে। একটা গাড়িকে একটি বাস এসে আস্তে (পড়ুন, ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটার বেগে) ধাক্কা দিলে যা হবে, জোরে (পড়ুন, ঘণ্টায় ৭০ কিলোমিটার বেগে) ধাক্কা দিলে তা হবে না। এখানে শুধু ‘আস্তে’ বা ‘জোরে’ ধাক্কা দিয়েছে বললে আসলে তেমন কিছুই বোঝা যায় না। সে জন্যই দরকার পরিমাপ। আর স্বাভাবিকভাবেই, পরিমাপের জন্য প্রয়োজন গণিত। নিউটনের জিনিয়াসের দিকটা হলো, গাণিতিক নিয়ম মেনে এই হিসাব-নিকাশ কীভাবে করতে হয়, তিনি তা আমাদের বলে দিয়ে গেছেন। তিনি বলে দিয়ে গেছেন, কোন গ্রহ কোন সময় কোথায় থাকবে, কোন গ্যালাক্সি কী রকম আচরণ করবে, পৃথিবীতে বসেই কীভাবে সেসব হিসাব করে বের করে ফেলা যায়!

তাই নিউটন শুধু পদার্থবিজ্ঞানের বরপুত্রই নন, সবকিছুর তত্ত্বের খোঁজে পথচলার কান্ডারিও। তিনি না হলে এভাবে সবকিছুকে এক সুতায় বাঁধার চেষ্টা কে কবে শুরু করতেন, তা বলা কঠিন। পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাস যে তখন অন্য রকম হতো, আমরা যে অনেকটাই পিছিয়ে যেতাম জ্ঞান-বিজ্ঞানে, তা নিশ্চয়ই আলাদা করে আর বলে দেওয়ার প্রয়োজন নেই।

লেখক: সহসম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা

সূত্র: আমেরিকান জার্নাল অব ফিজিকস

নিউটনিয়ান মেকানিকস/এ পি ফ্রেঞ্চ, এমআইটি ইন্ট্রোডাক্টরি ফিজিকস সিরিজ;

সিক্স ইজি পিসেস/ রিচার্ড ফাইনম্যান, অনু: উচ্ছ্বাস তৌসিফ, প্রথমা

উইকিপিডিয়া, ব্রিটানিকা, ফিজিকস স্ট্যাক এক্সচেঞ্জ, ভার্জিনিয়া ডটএডু