বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের সন্ধান

জগদীশচন্দ্র বসু বাংলার বিজ্ঞানীদের অগ্রদূত। তিনিই বিশ্ববাসীকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, আমরাও বিজ্ঞানী হতে পারি। গাছের অনুভূতি আছে একথা তিনি প্রথম বলেছিলেন। বসুই রেডিও বা বেতারযন্ত্রের প্রথম উদ্ভাবক। বাংলা ভাষার প্রথম সায়েন্স ফিকশন পলাতক তুফান-এর লেখক কিন্তু জগদীশচন্দ্র বসু। আজ এই বাঙালি বিজ্ঞানীর জন্মদিন। বিজ্ঞানচিন্তার পক্ষ থেকে জগদীশচন্দ্র বসুর জন্য রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।

বাঙালিদের যাঁরা অন্তত মাধ্যমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন, তাঁরা সবাই জগদীশচন্দ্র বসুর নাম শুনেছেন। শুধু শুনেছেন বললে কম বলা হয়, বিজ্ঞানী বলতে বাঙালির মানসপটে প্রথম যাঁর ছবি ভেসে ওঠে, তিনি জগদীশচন্দ্র। এ এক বিরল ঘটনা। ভারতবর্ষে বিজ্ঞানী তিনি একাই নন, বাঙালিদের মধ্যেও আরও অনেক বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী এসেছেন, তবু তাঁর নামটিই কেন সবার আগে মনে আসে? বিজ্ঞানী হিসেবে এ রকম বিরল খ্যাতি লাভ করা, অন্তত বাঙালিদের মধ্যে সহজ কথা নয় তো! এবং এ-ও বিশেষভাবে লক্ষণীয়, তাঁর কাজের পরিধি ও গুরুত্ব সম্বন্ধে তেমন ধারণা না থাকলেও শিক্ষিত বাঙালিমাত্রই জানেন, জগদীশ বসুর প্রধান আবিষ্কার—গাছেরও প্রাণ আছে! (বিষয়টা পুরোপুরি ঠিক নয়, সে বিষয়ে আলোচনা করা হবে এই লেখায়)। তাঁর কাজের পরিধি যে অনেক ব্যাপক ও গভীর, সে কথা খুব বেশি মানুষ জানেন বলে মনে হয় না। না জানার কারণও পরিষ্কার। তাঁর বিজ্ঞানজীবনের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ কাজই এখন পর্যন্ত ব্যাখ্যাতীত এক রহস্যময়তায় ভরা, না বোঝার ফলে যা দূরবর্তী বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আমরা একটু পরই বিস্তারিত কথা বলব এবং এই লেখার মূল বিষয়বস্তু ওটাই।

তাঁর বিজ্ঞানজীবনের তিনটি পর্ব। ১৮৯৫ থেকে ১৮৯৯ পর্যন্ত প্রধানত পদার্থবিদ্যা নিয়ে গবেষণা ও তার ফলাফল প্রকাশ করেছেন তিনি। ১৮৯৯ থেকে ১৯০২ পর্যন্ত পদার্থবিদ্যার ফলাফল বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তিনি এক অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ করেন। আর সেখান থেকেই জড় ও জীবের আচরণের ঐক্য তাঁর মনোযোগ আকর্ষণ করে। আর এরই পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর বাকি জীবন কাটে উদ্ভিদ–জগৎ নিয়ে। যাহোক, ১৮৯৫ থেকে ১৮৯৮—মোটামুটি তিন বছরে তাঁর ১৩টি গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশিত হয়! এত অল্প সময়ে মৌলিক কাজ নিয়ে এতগুলো উন্নত মানের গবেষণা প্রবন্ধ সত্যিই অবিশ্বাস্য। বোঝাই যায়, প্রস্তুতিপর্বটি তিনি গোপনেই সেরে রেখেছিলেন! যাহোক, এই সময়ই তিনি তারবিহীন বিদ্যুৎ–চুম্বকীয় তরঙ্গ (জনপ্রিয় নাম ‘বেতারবার্তা’) প্রেরক ও গ্রাহকযন্ত্র প্রস্তুত, এদের কার্যপ্রণালি ব্যাখ্যা ও এর প্রদর্শনী করে দেখান। তাঁর আগেও কাজটি ইউরোপে করেছিলেন বিজ্ঞানী রুডলফ হার্জ। কিন্তু জগদীশ বসুর কাজ যে পশ্চিমেও ব্যাপক সাড়া ফেলে, তুমুলভাবে সংবর্ধিত ও বিপুলভাবে গৃহীত হয়, তার কারণ, তাঁর কাজের সূক্ষ্মতা ও ব্যাপকতা এবং কলাকৌশলের নিপুণতা। বিষয়টি একটু জটিল বলে সে আলোচনায় যাচ্ছি না। শুধু বলা যায়, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্যের (আজকাল যাকে মাইক্রোওয়েভ বলা হয়) তরঙ্গ উত্পাদন, প্রেরণ ও গ্রহণ করার মতো ক্ষমতাসম্পন্ন যন্ত্রপাতি তৈরি করেছিলেন তিনি, যা এর আগে পৃথিবীতে কেউ করে উঠতে পারেননি। সেই অর্থে তিনি ভারতীয় পরীক্ষণ পদার্থবিদ্যার জনকও বটে।

পলাতক তুফান বইয়ের প্রচ্ছদ
আজকের সলিড স্টেট ফিজিকস বলে পদার্থবিদ্যার যে শাখা বিশ্বজুড়ে চর্চিত হচ্ছে, তার শুরু হয়েছিল জগদীশের এসব পরীক্ষণের ভেতর দিয়েই।

তারবিহীন বার্তা প্রেরক ও গ্রাহকযন্ত্রের (জনপ্রিয় নাম রেডিও ট্রান্সমিটার ও রেডিও রিসিভার) কৃতিত্ব অবশ্য পেয়েছিলেন গুগলিয়েলমো মার্কনি, যদিও তিনি জগদীশ বসুর পূর্ববর্তী ছিলেন না, ছিলেন পরবর্তীকালের বিজ্ঞানী। কাজটির জন্য মার্কনি নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন ১৯০৯ সালে, যদিও তা প্রাপ্য ছিল জগদীশ বসুরই বা যৌথভাবে দুজনেরই। জগদীশ বসু অবশ্য এ নিয়ে কোনো কথাই বলেননি। এমনকি তিনি যে বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ডকে আদৌ ব্যক্তিগত সম্পত্তি মনে করতেন না, তার প্রমাণ মেলে নিজের উদ্ভাবিত বেতারবার্তা প্রেরক ও গ্রাহকযন্ত্রের পেটেন্ট গ্রহণে তাঁর অনীহা ও অস্বীকৃতি থেকে। তিনি পেটেন্ট করিয়ে নিলে স্বীকৃতিটা প্রথমত তাঁকেই দিতে হতো, মার্কনিকে নয়।

তাঁর এসব গবেষণার বহুমাত্রিক গুরুত্ব রয়েছে। যেমন আজকের সলিড স্টেট ফিজিকস বলে পদার্থবিদ্যার যে শাখা বিশ্বজুড়ে চর্চিত হচ্ছে, তার শুরু হয়েছিল জগদীশের এসব পরীক্ষণের ভেতর দিয়েই। (অর্থাৎ জগদীশ বসুর আবিষ্কার ছিল অতি ক্ষুদ্র বেতারতরঙ্গ, যার থেকে তৈরি হয়েছে আজকের মাইক্রোওয়েভ, যা পরবর্তীকালে সলিড স্টেট ফিজিকসের বিকাশে সাহায্য করেছিল।) সেমিকন্ডাক্টর ফিজিকস বা অর্ধপরিবাহী বিজ্ঞানের যাত্রাও তাঁর হাতেই শুরু (সিসার এক যৌগ, নাম গ্যালেনা, সেটিকেই তিনি আবিষ্কার করেছিলেন বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে পরিবাহীর গুণসম্পন্ন হিসেবে। যদিও তখন পর্যন্ত এটাই জানা ছিল যে কেবল ধাতুই পরিবাহীর গুণ ধারণ করে, অন্য কিছু নয়!) এত এত নতুন আবিষ্কারকেও তিনি খুব একটা গুরুত্ব দেননি। কারণ, কাজগুলো করতে গিয়ে তিনি তাঁর নিজ হাতে নির্মিত যন্ত্রপাতির মধ্যে যেসব অদ্ভুত আচরণ লক্ষ করেন, তা তাঁকে নিয়ে যায় এক মরমি জগতে। আর তাই ১৯০১ সালে লন্ডনের রয়্যাল ইনস্টিটিউশনে তিনি যে বক্তব্য দেন, তার প্রধান অংশজুড়ে তাঁর অসামান্য আবিষ্কারগুলো থাকে না; বরং থাকে এই মরমি ভাববাদ। তিনি লক্ষ করেছিলেন, গ্রাহকযন্ত্র বারবার ব্যবহার করলে তার প্রতিক্রিয়া শ্লথ হয়ে যায়, যেন ক্লান্ত হয়ে পড়ে; আবার কিছুক্ষণ বিশ্রাম পেলে আগের মতোই সক্রিয় হয়ে ওঠে। জড় পদার্থ, জীব ও উদ্ভিদ ব্যবহার করে তিনি পরীক্ষাগুলো চালাতে থাকেন, এই আরোগ্যকালও নির্ধারণ করেন এবং স্বনির্মিত আরেক ধরনের যন্ত্রে তিনি এই সাড়া লিপিবদ্ধ করেন! তিনি দেখতে পান, জড় পদার্থ বা উদ্ভিদের সাড়ালিপি হুবহু প্রাণীর মাংসপেশির সাড়ালিপির মতোই। আর এই পর্যবেক্ষণই তাঁকে ভাবতে বাধ্য করে যে জড় ও জীবের মধ্যে একটা ঐক্য আছে বা তারা আসলে একই অরিজিনের বৈচিত্র্যময় প্রকাশ। (গাছের প্রাণ আছে—এ কথা তিনি কোথাও বলেননি; বলেছেন তাদের সাড়ালিপি জীবের মতোই, অতএব তাদের অনুভূতিও জীবের মতো। আর এ কথাই জনপ্রিয়ভাবে প্রচারিত হয়েছে ‘গাছের প্রাণ আছে’ বাক্য দিয়ে!) তাঁর এই ভাববাদী অবস্থানের পেছনে নিশ্চয়ই ভারতীয় দর্শনের প্রভাব ছিল। কারণ, উপনিষদ বলে, ‘যদিদং কিঞ্চ জগৎ প্রাণ এজতি নিঃসৃতং’ (এই যা কিছু জগৎ, তা প্রাণ থেকে নিঃসৃত হয়ে প্রাণেই কম্পমান)। এই প্রভাব যে ছিল, তার প্রমাণও মেলে পূর্বোক্ত বক্তৃতায়, যার শেষ কথা ছিল তিন হাজার বছর আগে গঙ্গার তীরে বসবাস করা তাঁর পূর্বপুরুষের ভাবনাজগতের বিবরণ, অর্থাৎ উপনিষদের প্রসঙ্গ।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে জগদীশ বসু

পদার্থবিজ্ঞানের কাঠখোট্টা পরীক্ষণ ও গবেষণা করতে করতেই তিনি প্রবেশ করেন এক মরমি দার্শনিক জগতে। তাঁর পরবর্তী পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলো চলতে থাকে এই দর্শনকে কেন্দ্রে রেখেই। তাঁর পরবর্তীকালের কাজগুলো পশ্চিমারা গ্রহণ করেনি। সত্যি বলতে কী, তারা সেগুলো বুঝতেই পারেনি। বুঝতে হলে যে ভারতীয় দর্শনটাকে আগে বুঝে নিতে হবে!

বোঝা যাচ্ছে যে জগদীশচন্দ্র বসু মানুষের সঙ্গে তাঁর পরিপার্শ্বের সম্পর্কগুলো বুঝতে চেয়েছিলেন। আর তাঁর গবেষণাগুলো মানবেতিহাসে সূচনা করেছিল এক নতুন অধ্যায়ের। দুঃখজনক হলেও সত্যি, জগদীশ প্রবর্তিত এই ধারা পরবর্তীকালে আর অনুসরণ করা হয়নি। আসলে তাঁর সমকালে (এবং পরবর্তীকালেও) কেউ তাঁকে বুঝতেই পারেননি। দেশেও নয়, বিদেশেও নয়। আরও নির্দিষ্টভাবে বলা যায়, তাঁর ধারায় তিনিই প্রথম ও শেষ বিজ্ঞানী। তাঁর কোনো পূর্বসূরি নেই। তাঁর পরবর্তী গবেষণার মূল কেন্দ্রে ছিল উদ্ভিদ–জগৎ। একজন পদার্থবিদের পক্ষে উদ্ভিদবিদ্যার এসব খুঁটিনাটি কীভাবে বোঝা সম্ভব? কিংবা একজন উদ্ভিদবিদই–বা কীভাবে বুঝবেন পদার্থবিদ্যার এত সব জটিল তত্ত্ব? অথচ জগদীশচন্দ্র বসু করতে চেয়েছিলেন এই দুইয়ের সংমিশ্রণ। তাঁকে না বুঝতে পারার এটিও এক বড় কারণ।

যাহোক, তাঁর নিজের লেখা একমাত্র বাংলা গ্রন্থ অব্যক্ত থেকে কিছু অংশ উদ্ধৃত করলে হয়তো তাঁর মানসজগৎটাকে খানিকটা বোঝা যাবে। বৃক্ষজগৎকে তিনি কীভাবে ভালোবেসেছিলেন, তা নিজেই লিখে রেখে গেছেন।

‘আগে যখন একা মাঠে কিংবা পাহাড়ে বেড়াইতে যাইতাম, তখন সব খালি-খালি লাগিত। তারপর গাছ, পাখি, কীট-পতঙ্গদিগকে ভালোবাসিতে শিখিয়াছি, সে অবধি তাহাদের অনেক কথা বুঝিতে পারি, যাহা আগে পারিতাম না। এই যে গাছগুলি কোনো কথা বলে না, ইহাদের যে আবার একটা জীবন আছে, আমাদের মতো আহার করে, দিন দিন বাড়ে, আগে এসব কিছুই জানিতাম না। এখন বুঝিতে পারিতেছি। এখন ইহাদের মধ্যেও আমাদের মতো অভাব, দুঃখ-কষ্ট দেখিতে পাই। জীবন ধারণ করিবার জন্য ইহাদিগেরও সর্বদা ব্যস্ততা আছে, ইহাদের মধ্যেও তাহার কিছু কিছু দেখা যায়। বৃক্ষদের মধ্যে একে অন্যকে সাহায্য করিতে দেখা যায়, ইহাদের মধ্যে একের সহিত অপরের বন্ধুত্ব হয়। তারপর মানুষের সর্বোচ্চ গুণ যে স্বার্থত্যাগ, গাছে তাহাও দেখা যায়। মা নিজের জীবন দিয়া সন্তানের জীবন রক্ষা করেন। সন্তানের জন্য জীবনদান উদ্ভিদেও সচরাচর দেখা যায়। গাছের জীবন মানুষের জীবনের ছায়ামাত্র।’

মনে হয় গাছ নয়, মানুষ সম্বন্ধেই কথা বলছেন তিনি!

গবেষণাগারে বিজ্ঞানী জগদীশ বসু

আগেই বলেছি, তিনি ছিলেন পদার্থবিজ্ঞানী, জীববিজ্ঞানী নন। যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তিনি দেখেছিলেন, ওই জড় যন্ত্রগুলোও মানুষের মতোই ক্লান্ত হয়, বিশ্রামে সেই ক্লান্তি দূরও হয়, যেন ওই যন্ত্রের মধ্যেও প্রাণের সাড়া আছে। এই পর্যবেক্ষণই তাঁকে জড়জগৎ সম্বন্ধে আগ্রহী করে তোলে। তখন পর্যন্ত গাছকেও জড় বস্তু বলেই গণ্য করা হতো। তিনি একই সঙ্গে দুই দিকেই মনোনিবেশ করেছিলেন, আর এক আশ্চর্য পদ্ধতিতে পরিমাপ করেছিলেন জড় বস্তু ও বৃক্ষের সংবেদনশীলতা এবং দেখেছিলেন এই সংবেদনশীলতা মানুষের সংবেদনশীলতার হুবহু প্রতিরূপ। গাছকে তিনি দেখেছিলেন প্রাণসম্পন্ন স্বতন্ত্র এক সত্তা হিসেবে, যার ইতিহাস মানুষের পক্ষে উদ্ধার করা সম্ভব নয়, যদি না গাছ নিজে তার অনুমোদন দেয়! গাছের ইতিহাস বুঝতে হলে গাছের কাছেই যেতে হবে এবং এই ইতিহাস বৃক্ষের স্বলিখিত এবং স্বাক্ষরিত হতে হবে। মানুষ নিজের বুদ্ধি-বিবেচনা দিয়ে গাছের ইতিহাস উদ্ধার করতে গেলে ভুল হবে। কারণ, ‘মানুষ তাহার স্বতঃপ্রণোদিত ভাব দ্বারা অনেক সময় প্রতারিত হয়’—এ কথা বলে তিনি মানবেতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিলেন। ‘আমাদের মূক সঙ্গী’ গাছকে তিনি দেখেছিলেন গভীর মমতার চোখ দিয়ে।

‘ঘর হইতে বাহির হইলেই চারিদিক ব্যাপিয়া জীবনের উচ্ছ্বাস দেখিতে পাই। সেই জীবন একেবারে নিঃশব্দ।...চিরসহিষ্ণু এই উদ্ভিদরাজ্য নিশ্চলভাবে আমাদের সম্মুখে দণ্ডায়মান। উত্তাপ ও শৈত্য, আলো ও অন্ধকার, মৃদু সমীরণ ও ঝটিকা, জীবন ও মৃত্যু ইহাদিগকে লইয়া ক্রীড়া করিতেছে। বিবিধ শক্তি দ্বারা ইহারা আহত হইতেছে, কিন্তু আহতের কোনো ক্রন্দনধ্বনি উত্থিত হইতেছে না। এই অতি সংযত, মৌন ও অক্রন্দিত জীবনেরও যে এক মর্মভেদী ইতিহাস আছে...কি প্রকারে এই অপ্রকাশকে সুপ্রকাশ করিব?

‘গাছের প্রকৃত ইতিহাস সমুদ্ধার করিতে হইলে গাছের নিকটই যাইতে হইবে। সেই ইতিহাস অতি জটিল ও বহু রহস্যপূর্ণ। সেই ইতিহাস উদ্ধার করিতে হইলে বৃক্ষ ও যন্ত্রের সাহায্যে জন্ম হইতে মৃত্যু পর্যন্ত মুহূর্তে মুহূর্তে তাহার ক্রিয়াকলাপ লিপিবদ্ধ করিতে হইবে। এই লিপি বৃক্ষের স্বলিখিত এবং স্বাক্ষরিত হওয়া চাই। ইহাতে মানুষের কোনো হাত থাকিবে না; কারণ মানুষ তাহার স্বপ্রণোদিত ভাব দ্বারা অনেক সময় প্রতারিত হয়।’…

এবং গাছের সামান্য একটি শাখা বা ফুল বা পাতা যে কেবল বর্তমানেরই নয়; বরং সহস্র বছরের ইতিহাস বহন করছে, সেই কথাও বললেন প্রথমবারের মতো। এমনকি গাছের মৃত্যুবর্ণনাও তাঁর হাতে যেকোনো মানুষের মৃত্যুর বর্ণনার মতোই হৃদয়স্পর্শী ও মর্মভেদী হয়ে উঠল।

‘প্রতি জীবনে দুইটি অংশ আছে। একটি অজর, অমর; তাহাকে বেষ্টন করিয়া নশ্বর দেহ। এই দেহরূপ আবরণ পশ্চাতে পড়িয়া থাকে, অমর জীববিন্দু প্রতি পুনর্জন্মে নূতন গৃহ বাঁধিয়া লয়। সেই আদিম জীবনের অংশ, বংশপরম্পরা ধরিয়া বর্তমান সময় পর্যন্ত চলিয়া আসিয়াছে। আজ যে পুষ্প-কলিকাটি অকাতরে বৃন্তচ্যুত করিতেছি, ইহার অণুতে কোটি বত্সর পূর্বের জীবনোচ্ছ্বাস নিহিত রহিয়াছে...

প্রকৃতির রহস্য অনুসন্ধানে আজীবন নিজেকে ব্যয় করে দিয়েছিলেন যিনি, ‘বহুত্বের মধ্যে একত্বের সন্ধান’ করেছিলেন যিনি, তাঁকেই প্রকৃতি উপহার দিয়েছিল অকৃত্রিম নিঃসঙ্গতা।

‘পরিশেষে উদ্ভিদের জীবনে এরূপ সময় আসে, যখন কোনো এক প্রচণ্ড আঘাতের পর হঠাৎ সমস্ত সাড়া দিবার শক্তির অবসান হয়। সেই আঘাত মৃত্যুর আঘাত। কিন্তু সেই অন্তিম মুহূর্তে গাছের স্থির, স্নিগ্ধ মূর্তি ম্লান হয় না। হেলিয়া পড়া কিংবা শুষ্ক হইয়া যাওয়া অনেক পরের অবস্থা। মৃত্যুর রুদ্র-আহ্বান যখন আসিয়া পৌঁছে, তখন গাছ তাহার উত্তর কেমন করিয়া দেয়? মানুষের মৃত্যুকালে যেমন একটা দারুণ আক্ষেপ সমস্ত শরীরের মধ্য দিয়া বহিয়া যায়, তেমনি দেখিতে পাই, অন্তিম মুহূর্তে বৃক্ষদেহের মধ্য দিয়াও একটা বিপুল কুঞ্চনের আক্ষেপ প্রকাশ পায়।’

বহুকালের চর্চিত জ্ঞানকে চ্যালেঞ্জ করতে গিয়ে তাঁকে বহু বাধাবিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়েছিল। তবু হাল ছাড়েননি, অসামান্য দৃঢ়তায় দেখিয়ে দিয়েছিলেন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের জ্ঞানচর্চার পার্থক্য। আর পরিশেষে তিনি দেখেছিলেন, জ্ঞান-বিজ্ঞানের যে বহুবিধ শাখা প্রসারিত হয়েছে, তার চূড়ান্ত উদ্দেশ্য আসলে একটিই—জীবন ও পৃথিবীর রহস্য অনুসন্ধান; বহুত্বের মধ্যে ‘এক’-এর সন্ধান।

‘পাশ্চাত্য দেশে জ্ঞানরাজ্যে এখন ভেদবুদ্ধির অত্যন্ত প্রচলন হইয়াছে। সেখানে জ্ঞানের শাখা-প্রশাখা নিজেকে স্বতন্ত্র রাখিবার জন্যই বিশেষ আয়োজন করিয়াছে; তাহার ফলে নিজেকে এক করিয়া জানিবার চেষ্টা এখন লুপ্তপ্রায় হইয়াছে।...অপর দিকে বহুর মধ্যে এক যাহাতে হারাইয়া না যায়, ভারতবর্ষ সেইদিকে সর্বদা লক্ষ রাখিয়াছে।...

‘এই যে প্রকৃতির রহস্য-নিকেতন, তাহার নানা মহল, ইহার দ্বার অসংখ্য। প্রকৃতি-বিজ্ঞানবিদ, রাসায়নিক, জীবতত্ত্ববিদ ভিন্ন ভিন্ন দ্বার দিয়া এক-এক মহলে প্রবেশ করিয়াছেন; মনে করিয়াছেন সেই সেই মহলই বুঝি তাঁহার বিশেষ স্থান, অন্য মহলে বুঝি তাহার গতিবিধি নাই। তাই জড়কে, উদ্ভিদকে সচেতনভাবে তাহারা অলঙ্ঘ্যভাবে বিভক্ত করিয়াছেন। কিন্তু এই বিভাগকে দেখাই যে বৈজ্ঞানিক দেখা, এ কথা আমি স্বীকার করি না। কক্ষে কক্ষে সুবিধার জন্য যত দেয়াল তোলাই যাক না, সকল মহলেরই এক অধিষ্ঠাতা। সকল বিজ্ঞানই পরিশেষে সেই সত্যকে আবিষ্কার করিবে বলিয়া ভিন্ন ভিন্ন পথ দিয়া যাত্রা করিয়াছে। সকল পথই যেখানে একত্রে মিলিয়াছে সেইখানেই পূর্ণ সত্য। সত্য খ্ল খ্ল হইয়া আপনার মধ্যে অসংখ্য বিরোধ ঘটাইয়া অবস্থিত নহে। সেই জন্য প্রতিদিনই দেখিতে পাই জীবতত্ত্ব, রসায়নতত্ত্ব, প্রকৃতিতত্ত্ব আপন আপন সীমা হারাইয়া ফেলিতেছে।...

‘বৈজ্ঞানিক ও কবি, উভয়েরই অনুভূতি অনির্বচনীয় একের সন্ধানে বাহির হইয়াছে। প্রভেদ এই—কবি পথের কথা ভাবেন না, বৈজ্ঞানিক পথটিকে উপেক্ষা করেন না।...

‘এই আমাদের মূক সঙ্গী, আমাদের দ্বারের পার্শ্বে নিঃশব্দে যাহাদের জীবনের লীলা চলিতেছে, তাহাদের গভীর মর্মের কথা তাহারা ভাষাহীন অক্ষরে লিপিবদ্ধ করিয়া দিল এবং তাহাদের জীবনের চাঞ্চল্য ও মরণের আক্ষেপ আজ আমাদের দৃষ্টির সম্মুখে প্রকাশিত করিল। জীব ও উদ্ভিদের যে কৃত্রিম ব্যবধান রচিত হইয়াছিল, তাহা দূরীভূত হইল। কল্পনারও অতীত অনেকগুলি সংবাদ আজ বিজ্ঞান স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করিয়া বহুত্বের ভিতরে একত্ব প্রমাণ করিল।’

হায়, প্রকৃতির রহস্য অনুসন্ধানে আজীবন নিজেকে ব্যয় করে দিয়েছিলেন যিনি, ‘বহুত্বের মধ্যে একত্বের সন্ধান’ করেছিলেন যিনি, তাঁকেই প্রকৃতি উপহার দিয়েছিল অকৃত্রিম নিঃসঙ্গতা। শেষ জীবনে কারও সঙ্গেই কথা বলতেন না তিনি, কথা বলার মানুষই ছিল না আসলে!

লেখক: অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ইনডিপেন্ডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা