হেনরিয়েটা লেভেট: চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়

হার্ভার্ড মানমন্দিরে বেশ কয়েক মাস সেফিড ভেরিয়েবল নিয়ে গভীর মনোযোগে কাজ করেন লেভেট। বলতে গেলে, প্রায় নাওয়াখাওয়া ভুলে। প্রথম দেখায় নক্ষত্রগুলোকে এলোমেলো, বেসুরো মনে হয়। কিন্তু একসময় এগুলোর উজ্জ্বলতার ওঠানামার মধ্যে একটা ছন্দ খুঁজে পান লেভেট। কিন্তু এর পেছনের কারণটা কী?

আজ বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে ৯ম ইন্টারন্যশনাল ডে অব ওমেন অ্যান্ড গার্লস ইন সায়েন্স। এই দিনে লেভেটের অমর আবিষ্কারের পেছনের কাহিনি পড়ুন...

নোবেল পুরস্কারের চেয়েও অনেক বড় পুরস্কার পেয়ে গেছেন লেভেট। কারণ, জ্যোতির্বিজ্ঞানে তাঁর আবিষ্কৃত পদ্ধতিটা খুবই দরকারি আর কার্যকর

লোকটার নাম এডওয়ার্ড পিকারিং। বেশ রাশভারী মানুষ। একমুখ দাড়ি–গোঁফ। যুক্তরাষ্ট্রের নামকরা হার্ভার্ড কলেজ মানমন্দিরের পরিচালক তিনি। গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বটা পেয়েছেন ১৮৭৭ সালে। তখন তাঁর বয়স ৩১ বছর। তার পর থেকেই হার্ভার্ডের মানমন্দির থেকে মহাকাশের ছবি তোলা এবং সেগুলো বিশ্লেষণের কাজ করে যাচ্ছেন এই মার্কিন জ্যোতির্বিদ ও পদার্থবিদ।

মহাকাশের ছবি বিশ্লেষণের জন্য শুরুতে একদল মানুষকে নিয়োগ করলেন পিকারিং। ঘণ্টায় ৫০ সেন্ট চুক্তিতে। তাঁদের বলা হতো মানব কম্পিউটার। সেকালে হার্ভার্ড মানমন্দির থেকে ছবি তুলে সেগুলো ডেভেলপ করে বানানো হতো ফটোগ্রাফিক প্লেট। প্রতিটি প্লেটে থাকত শত শত নক্ষত্র। বিন্দু বিন্দু দাগের মতো। এসব নক্ষত্রের উজ্জ্বলতা পরীক্ষা করে সেগুলোর দূরত্ব মাপাই ছিল মানব কম্পিউটারের কাজ। বেশ চ্যালেঞ্জিং আর শ্রমসাধ্য একটি ব্যাপার।

বিজ্ঞানী এডওয়ার্ড পিকারিং

শুরুতে পিকারিংয়ের দলের কর্মকাণ্ড চলছিল বেশ ভালোই। কিন্তু অচিরেই দেখা গেল, মানব কম্পিউটাররা কাজে ফাঁকি দিতে শুরু করেছেন। ঠিকমতো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন না। কাজেও তেমন আগ্রহ নেই, কোনো প্রাণ নেই। শুধু নির্ধারিত সময়ে টাকা হাতে পেতেই যেন তাঁদের নিয়মিত এই মানমন্দিরে আনাগোনা। হতাশ হন পিকারিং। মাঝেমধ্যে লোকজনকে উৎসাহিত করার চেষ্টা করেন, তাঁদের ওপর রেগেও যান, মন দিয়ে কাজ করার তাগিদ দেন। কিন্তু দিন শেষে খুব বেশি লাভ হয় না।

একদিন আর কোনোমতেই রাগ সামলাতে পারলেন না পিকারিং। প্রচণ্ড রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, তাঁদের চেয়ে তাঁর কাজের বুয়াও কাজটা অনেক ভালোভাবে করতে পারবেন। ব্যস, সেদিনই সব কজনকে ছাঁটাই করলেন তিনি। তারপর সত্যি সত্যিই নক্ষত্র বিশ্লেষণের কাজটাতে এনে বসালেন তাঁর বুয়াকে। তাঁর নাম উইলিয়ামিনা ফ্লেমিং। কথাটা শুনতে হাস্যকর মনে হতে পারে, কিন্তু মানব কম্পিউটারের নেতৃত্বে পিকারিং যাঁকে এনে বসালেন, তিনি যে সত্যিই যোগ্য, তার প্রমাণ পাওয়া গেল কদিন পরেই।

আসলে উইলিয়ামিনা ফ্লেমিংয়ের আদিবাস ছিল স্কটল্যান্ডে। সেখানে একটা স্কুলে শিক্ষকতা করতেন তিনি। বসতি গড়ার আশায় একদিন আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে স্বামীর হাত ধরে আমেরিকায় এসেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, তিনি যখন সন্তানসম্ভবা, তখন তাঁর স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়। অথই জলে পড়েন উইলিয়ামিনা ফ্লেমিং। বাধ্য হয়ে অন্য মানুষের বাসায় হাউসকিপার হিসেবে কাজ জুটিয়ে নেন। এভাবেই জ্যোতির্বিদ এডওয়ার্ড পিকারিংয়ের বাসা সামলানোর দায়িত্ব পান তিনি। কিছুদিনের মধ্যেই বাড়ির মালিক পিকারিং তাঁর গুণের খবর পেয়ে গেলেন। তাই হার্ভার্ডের মানমন্দিরে নক্ষত্র বিশ্লেষণের কাজে ফ্লেমিংকে নিয়োগ দেন তিনি।

পিকারিংয়ের হারেম তথা হার্ভার্ডের মানমন্দিরের কয়েকজন নারী মানব কম্পিউটার ফটোগ্রাফিক প্লেট বিশ্লেষণে ব্যস্ত

অবশ্য মানব কম্পিউটার পদে নারীদের নিয়োগ দেওয়ার আরও কিছু কারণও ছিল। যেমন পুরুষ কর্মীকে যেখানে ঘণ্টায় ৫০ সেন্ট দিতে হতো, সেখানে অর্ধেক খরচেই পাওয়া যেত নারী কর্মীদের। তা ছাড়া পুরুষ কর্মীরা যেমন ফাঁকিবাজ ছিলেন, নারীদের ক্ষেত্রে ফলাফল পাওয়া গেল পুরো উল্টো। এসব কারণে শুধু উইলিয়ামিনা ফ্লেমিংই নন, একে একে আরও অনেক নারীকে নিয়োগ দেওয়া হলো হার্ভার্ড মানমন্দিরে। একসময় স্থানীয় ব্যক্তিদের কাছে এই দলের পরিচয় দাঁড়ায় ‘পিকারিংয়ের হারেম’।

এ দলে ছিলেন অ্যানি জাম্প ক্যানন। ১৯১১ থেকে ১৯১৫ সাল পর্যন্ত তিনি মাসে প্রায় ৫০ হাজার তারার ক্যাটালগ তৈরি করেন। এসব তারার অবস্থান, উজ্জ্বলতা ও রং বিশ্লেষণ করে নক্ষত্রদের সাতটি শ্রেণিতে ভাগ করেন তিনি। সেগুলো হলো O, B, A, F, G, K ও M। একটা নেমোনিক ব্যবহার করে একে সহজে মনে রাখা যায়: ‘Oh, Be A Fine Guy—Kiss Me!।’ তাঁর সেই শ্রেণিবিন্যাস এখনো গুরুত্বপূর্ণ। জ্যোতির্বিজ্ঞানের আন্ডারগ্র্যাজুয়েটের শিক্ষার্থীদের এখনো এই শ্রেণিবিন্যাস শিখতে হয়। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নারী হিসেবে সম্মানসূচক পিএইচডি পান অ্যানি। এ ছাড়া নামকরা ড্র্যাপার স্বর্ণপদকসহ পান আরও একগাদা পুরস্কার।

আদতে ছোটবেলাতেই ভয়াবহ স্কারলেট ফিভারে আক্রান্ত হয়েছিলেন। অনেক দিন রোগে ভুগে একসময় সুস্থ হন বটে, কিন্তু চিরকালের জন্য বধির হয়ে যান। অনেকে বলেন, শ্রবণশক্তি হারানোর কারণেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিশক্তি পেয়েছিলেন তিনি। তাই নক্ষত্র সম্পর্কে এত গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারটা করতে পেরেছিলেন অ্যানি। কথাটা যে সত্যি, সে প্রমাণ পাওয়া গেল পিকারিংয়ের মানব কম্পিউটার দলের আরেক সদস্য হেনরিয়েটা লেভেটের কাছ থেকে। তিনিও বধির ছিলেন। অথচ দিনের পর দিন ফটোগ্রাফিক প্লেটে নক্ষত্র নিয়ে অক্লান্ত গবেষণা করে জ্যোতির্বিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ একটা আবিষ্কার করে বসেন। তাতেই পাল্টে যায় জ্যোতির্বিজ্ঞান, তথা চেনাজানা মহাবিশ্বের ইতিহাস।

হার্ভার্ড মানমন্দিরে জ্যোতির্বিদ হেনরিয়েটা সোয়ান লেভেট

তাঁর পুরো নাম হেনরিয়েটা সোয়ান লেভেট। জন্ম যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটসের ল্যানচেস্টারে। ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা দিবসে, ৪ জুলাই ১৮৬৮ সালে। বাবা জর্জ রসওয়েল লেভেট, কংগ্রেশনাল চার্চ মিনিস্টার এবং মা হেনরিয়েটা সোয়ান কেনড্রিক।

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রেডক্লিফ কলেজ থেকে ১৮৯২ সালে গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি পান লেভেট। কিন্তু গুরুতর অসুস্থতার কারণে পরের দুই বছর গৃহবন্দী হয়ে পড়েন। অনেকের ধারণা, তিনি মেনিনজাইটিসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। এতে শ্রবণশক্তি হারান লেভেট। সুস্থ হয়ে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যোগ দেন হার্ভার্ড কলেজ মানমন্দিরে। পিকারিংয়ের দলে তাঁর দায়িত্ব, ফটোগ্রাফিক প্লেটের ভেরিয়েবল স্টার বা বিষম তারা নিয়ে গবেষণা। প্লেট থেকে এসব নক্ষত্র খুঁজে বের করে তা তালিকাভুক্ত করা। অচিরেই এতে নিজের দক্ষতার প্রমাণ দেন লেভেট।

সে যুগে ভেরিয়েবল স্টার শনাক্ত করতে পরপর দুই দিন রাতের আকাশে ছবি তোলা হতো। এরপর দুই দিনের ফটোগ্রাফিক প্লেট তুলনা করে নক্ষত্রের উজ্জ্বলতার তফাত পরীক্ষা করা হতো। এভাবে কোনো নক্ষত্রের উজ্জ্বলতার পরিবর্তন বোঝা যেত। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে লেভেট প্রায় আড়াই হাজার ভেরিয়েবল স্টার শনাক্ত করেন। সে যুগে শনাক্ত করা মোট ভেরিয়েবল স্টারের অর্ধেকই ছিল তাঁর আবিষ্কৃত। কাজে মুগ্ধ হয়ে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক চার্লস ইয়াং তাঁর নাম দিয়েছিলেন ‘ভেরিয়েবল স্টারের বন্ধু’।

মহাবিশ্বে বিভিন্ন রকম ভেরিয়েবল স্টার রয়েছে, তার মধ্যে লেভেটের বিশেষ পছন্দ ছিল সেফিড বা শেফালি তারা। নির্দিষ্ট সময় পরপর এই নক্ষত্রগুলোর উজ্জ্বলতা বাড়ে-কমে। প্রথম সেফিড শনাক্ত হয়েছিল ১৭৮৪ সালে। সেটা করেন ব্রিটিশ জ্যোতির্বিদ এডওয়ার্ড পিগট। এর কয়েক মাস পর ডেলটা সেফাই নক্ষত্র–ব্যবস্থায় আরেকটি সেফিড তারা শনাক্ত করেন, তাঁর জ্যোতির্বিদ বন্ধু জন গুডরিক। সেখান থেকেই এই নক্ষত্রগুলোর নাম হয়েছে সেফিড। এ আবিষ্কারের সময় গুডরিকের বয়স ছিল মাত্র ১৮ বছর।

বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, জন্ম থেকেই গুডরিক কথা বলতে বা কানে শুনতে পারতেন না। তবে তাঁর দৃষ্টিশক্তি ছিল প্রখর। বিজ্ঞানে আগ্রহী হন ছেলেবেলাতেই। তখন সবে বধিরদের জন্য পড়ালেখা চালু হয়েছে। তাই গুডরিকও পড়ালেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হননি। সেফিড নিয়ে আরও কিছু পরীক্ষার পর সেগুলোর উজ্জ্বলতার বাড়া-কমা প্রায় নিখুঁতভাবে মাপতে সক্ষম হন এই জ্যোতির্বিদ। সে জন্য পার্শ্ববর্তী স্থির ও নন-ভেরিয়েবল নক্ষত্রের উজ্জ্বলতার সঙ্গে তুলনা করেছিলেন তিনি। সে যুগের তুলনায় তাঁর কাজটাকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বলতেই হবে।

সেফিড ভেরিয়েবল স্টার সম্পর্কে এখন আমরা বেশ ভালোভাবেই জানি। সেগুলোর উজ্জ্বলতার ওঠানামা কিংবা অন্য নক্ষত্রের সঙ্গে সেগুলোর তফাতের কারণও আমাদের জানা। আসলে বেশির ভাগ নক্ষত্রের ভারসাম্য অবস্থা বেশ স্থিতিশীল। তার মানে, এসব নক্ষত্রের বিপুল ভর নক্ষত্রটিতে একটা অন্তর্মুখী টানের সৃষ্টি করে। এতে নিজের মহাকর্ষের টানে নক্ষত্রটি চুপসে যেতে চায়। নক্ষত্রটি সংকুচিত হলে নক্ষত্রের ভেতর নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া শুরু হয়। এতে হাইড্রোজন ফিউজ হয়ে হিলিয়াম তৈরি হতে থাকে। কিন্তু নক্ষত্রের ভেতর এই নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ায় যে তীব্র তাপ ও চাপের সৃষ্টি হয়, তা নক্ষত্রটিকে বাইরের দিকে প্রচণ্ডভাবে ঠেলে দেয়। এই প্রক্রিয়া অবিরাম চলছে নক্ষত্রের বুকে। এভাবে নক্ষত্রটি একটা ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় থাকে।

তবে সেফিড ভেরিয়েবল নক্ষত্রে ভারসাম্য নেই, তা অস্থিতিশীল। কোনো সেফিড তুলনামূলকভাবে শীতল অবস্থায় থাকলে, তার কেন্দ্রের নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া আর মহাকর্ষ বলকে টেক্কা দিতে পারে না। ফলে নক্ষত্রটি চুপসে যেতে থাকে। এই সংকোচনে নক্ষত্রের কেন্দ্রের জ্বালানি চুপসে যায় এবং তাতে শক্তি বেড়ে নক্ষত্রটি আবারও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। তখন আবারও প্রসারিত হতে থাকে নক্ষত্রটি। এই প্রসারণের সময় এবং পরে শক্তি নিঃসৃত হতে থাকে। ফলে নক্ষত্রটি আবারও শীতল ও সংকুচিত হয়ে যায়। এভাবে নক্ষত্রটিতে একই প্রক্রিয়া বারবার ঘটতে থাকে। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, সংকোচন ধাপে নক্ষত্রটির বাইরের স্তর সংকুচিত হয়, ফলে তা অনেক বেশি অস্বচ্ছ হয়ে ওঠে। তাতে নক্ষত্রটি বাইরে থেকে ম্লান দেখা যায়। অন্যদিকে প্রসারণের সময় নক্ষত্রটিকে দেখা যায় বেশ উজ্জ্বল।

গুডরিকের যুগে এসবের কিছুই জানা ছিল না। নতুন ধরনের এ নক্ষত্র আবিষ্কার ছিল অবশ্যই বেশ বড় ঘটনা। সে জন্য বেশ কিছু পুরস্কার পান গুডরিক। স্বীকৃতি হিসেবে মাত্র ২১ বছর বয়সে পান ব্রিটেনের রয়্যাল সোসাইটির সদস্যপদ। এ গুরুত্বপূর্ণ অর্জনের মাত্র ১৪ দিন পর নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান মেধাবী এ জ্যোতির্বিদ। মহাকাশে নতুন ধরনের নক্ষত্র নিয়ে গবেষণা করে মহাবিশ্বের গোপন এক পর্দা খুলে দিয়েছিলেন গুডরিক। এর পরের শতকে আরও অনেকে সেফিড নিয়ে গবেষণা করতে থাকেন। তাঁদের মধ্যে আছেন জ্যোতির্বিদ উইলিয়াম হার্শেলের ছেলে জন হার্শেল, লুইস দ্যাগুরেসহ আরও অনেকে। তাঁদের মধ্যে সর্বসেরা কাজটা ছিল হেনরিয়েটা লেভেটের।

হার্ভার্ডের মানমন্দিরের নারী মানব কম্পিউটারের দল

হার্ভার্ড মানমন্দিরে বেশ কয়েক মাস সেফিড ভেরিয়েবল নিয়ে গভীর মনোযোগে কাজ করতে থাকেন লেভেট। বলতে গেলে, প্রায় নাওয়াখাওয়া ভুলে। প্রথম দেখায় নক্ষত্রগুলোকে এলোমেলো, বেসুরো মনে হয়। কিন্তু একসময় এগুলোর উজ্জ্বলতার ওঠানামার মধ্যে একটা ছন্দ খুঁজে পান লেভেট। কিন্তু এর পেছনের কারণটা কী? সেটা জানতে ব্যাকুল হয়ে ওঠেন তিনি। রহস্যটা উন্মোচন করতে এর পেছনে আরও সময় দিতে থাকেন। সেফিড সম্পর্কে তখন মাত্র দুটো তথ্য জানা সম্ভব হয়েছিল। তা হলো সেগুলোর অবস্থা পরিবর্তনের সময়কাল ও উজ্জ্বলতা।

এই দুইয়ের মধ্যে কি কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে? সেটাই একদিন ভাবলেন লেভেট। তাঁর মনে হলো, উজ্জ্বল সেফিডগুলোর অবস্থা পরিবর্তনের কাল হয়তো ম্লানগুলোর তুলনায় বেশিও হতে পারে। কিংবা কে জানে, উল্টোটাই হয়তো সত্যি। সারি সারি ফটোগ্রাফিক প্লেট থেকে সেফিড তারাগুলোর উজ্জ্বলতা সম্পর্কে কোনো সুদৃঢ় ধারণা করা প্রায় অসম্ভব বলে মনে হলো লেভেটের। কারণ, রাতের আকাশে যে নক্ষত্রটা আমাদের কাছে উজ্জ্বল মনে হচ্ছে, সেটা হয়তো বেশ ম্লান। কিন্তু সেটা অনেক কাছে রয়েছে বলেই হয়তো তাকে ওই রকম উজ্জ্বল লাগে। আবার অনেক উজ্জ্বল নক্ষত্র যদি বহু দূরে থাকে, তাহলে তাকেও ম্লান দেখানোর কথা। তাহলে সেগুলোর সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়ার উপায়টা কী?

অনেক আগে থেকেই জ্যোতির্বিদেরা বুঝতে পারছিলেন, বহু দূরের কোনো নক্ষত্রের শুধু আপাত উজ্জ্বলতা পরিমাপ করা সম্ভব, প্রকৃত উজ্জ্বলতা নয়। এই সীমাবদ্ধতা হতাশার জন্ম দিয়েছিল জ্যোতির্বিদদের মধ্যে। একসময় নক্ষত্রের প্রকৃত উজ্জ্বলতা মাপার আশা ত্যাগ করেন তাঁরা। কিন্তু লেভেট ছিলেন অন্য ধাতুতে গড়া। প্রচণ্ড ধৈর্য, আত্মত্যাগ আর মনোযোগ নিয়ে লেগে থাকেন তিনি। কয়েক দিন পরেই দারুণ এক আইডিয়া আসে তাঁর মাথায়। ইতিহাস পাল্টে দেওয়া সেই আবিষ্কার তিনি করলেন স্মল ম্যাগেলানিক ক্লাউডের দিকে চোখ রেখে। বাংলায় একে বলা হয় ছোট ম্যাগেলানের মেঘ। ষোলো শতকের দুঃসাহসী পর্তুগিজ নাবিক ফার্দিনান্দ ম্যাগেলানের নামে এই নাক্ষত্রিক গঠনের নাম রাখা হয়েছে। পৃথিবীর চারপাশে এক চক্কর দেওয়ার অভিযানে গিয়ে দক্ষিণ সাগরে এই নাক্ষত্রিক ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করেছিলেন ম্যাগেলান। সে কারণেই তার নাম জুড়ে গেছে এর সঙ্গে।

তবে স্মল ম্যাগেলানিক ক্লাউড উত্তর গোলার্ধ থেকে দেখা যায় না, শুধু দক্ষিণ গোলার্ধ থেকেই দেখা যায়। সে জন্য এই মেঘের ফটোগ্রাফিক প্লেটের জন্য হার্ভার্ড মানমন্দিরের পেরু শাখার সহায়তা নেন লেভেট।

ছোট ম্যাগেলানের মেঘে প্রায় ২৫টি সেফিড নক্ষত্র খুঁজে পান লেভেট। সেগুলোর দূরত্ব জানতেন না। ধারণা করলেন, পৃথিবী থেকে ম্যাগেলানিক মেঘটা অনেক দূরে এবং তার ভেতরের সেফিডগুলোও মোটামুটি একই দূরত্বে অবস্থিত। এভাবে হুট করেই যা চাইছিলেন, তাই হাতের নাগালে পেয়ে গেলেন লেভেট। সেফিডগুলোর দূরত্ব যদি মোটামুটি একই হয়, তাহলে একটা চমৎকার সমাধান মেলে। সেখানকার একটা সেফিড যদি অন্যটার চেয়ে উজ্জ্বল হয়, তাহলে এর কারণ হবে তার উজ্জ্বলতা আসলেই বেশি, সেটা আপাত উজ্জ্বলতার কারণে নয়।

ছোট ম্যাগেলানের মেঘের সেফিডগুলোর দূরত্ব পৃথিবী থেকে মোটামুটি একই—এই অনুমান প্রকৃত সত্য না হলেও বেশ যুক্তিযুক্ত বলা যায়। লেভেটের এই চিন্তাধারার সঙ্গে আকাশে দল বেঁধে উড়ে যাওয়া ২৫টি পাখির তুলনা করা যায়। পাখিগুলোর প্রতিটির দূরত্ব তুলনামূলক কম, তবে একজন পর্যবেক্ষকের কাছে পুরো দলটাই প্রায় একই দূরত্বে অবস্থিত। কাজেই ওই পাখির দলে একটা পাখিকে যদি দূর থেকে ছোট মনে হয়, তাহলে আসলেই তার আকার ছোট। কিন্তু ২৫টি পাখির প্রতিটি যদি আকাশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকে, তাহলে সেই পাখি আসলেই ছোট নাকি সেটা পর্যবেক্ষকের কাছ থেকে অনেক দূরে আছে, তা নিশ্চিত হওয়া কঠিন।

এই গুরুত্বপূর্ণ অনুমানের পর, সেফিডগুলোর উজ্জ্বলতা এবং সেগুলোর উজ্জ্বলতা ওঠানামার কালের মধ্যে কোনো সম্পর্ক আছে কি না, তা নির্ণয়ের চেষ্টা চালালেন লেভেট। সে জন্য ছোট ম্যাগেলানের মেঘের সব কটি সেফিডের আপাত উজ্জ্বলতা ও সেগুলোর অবস্থার ওঠানামার উপাত্ত একটা গ্রাফে বসালেন। গ্রাফের একদিকে আপাত উজ্জ্বলতা এবং অন্যদিকে সেগুলোর উজ্জ্বলতার ওঠানামা। এতে যে ফল পাওয়া গেল, তা এককথায় বিস্ময়কর। এতে কোনো সেফিডের প্রকৃত উজ্জ্বলতা এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার আপাত উজ্জ্বলতার পার্থক্যের মধ্যে একটি গাণিতিক সম্পর্ক বেরিয়ে এল। দেখা গেল, যে সেফিডের উজ্জ্বলতা যত বেশি, তার আপাত উজ্জ্বলতার ওঠানামার সময়কালও তত বেশি। এ নিয়ম মহাবিশ্বের অন্য যেকোনো সেফিডের জন্যই সত্য বলে ধারণা করলেন লেভেট।

হেনরিয়েটা লেভেট: বিজ্ঞানের এক অমর নক্ষত্র

তাঁর এই গবেষণার ফল অচিরেই একটা জার্নালে প্রকাশিত হলো। শিরোনাম: পিরিয়ডস অব ২৫ ভেরিয়েবল স্টারস ইন দ্য ম্যাগেলানিক ক্লাউড। লেভেটের এই আবিষ্কারের কারণে আকাশের দুটি সেফিডের মধ্যে এবং পৃথিবী থেকে সেগুলোর আপেক্ষিক দূরত্ব মাপা সহজ হয়ে গেল। পদ্ধতিটা বেশ সহজ। ধরা যাক, আকাশের আলাদা জায়গায় যদি দুটি সেফিড থাকে এবং সেগুলোর উজ্জ্বলতার ওঠানামা যদি প্রায় কাছাকাছি হয়, তাহলে লেভেটের সূত্র ব্যবহার করে জানা সম্ভব যে ওই সেফিড দুটির উজ্জ্বলতা একই হারে পরিবর্তিত হবে। কাজেই ওই দুটির কোনো একটি আরেকটির তুলনায় যদি ৯ ভাগ ম্লান হয়, তাহলে সেটি অবশ্যই অনেক বেশি দূরে অবস্থিত। ৯ ভাগ ম্লান হওয়ার কারণ সেটি ৩ গুণ বেশি দূরে রয়েছে। কারণ, উজ্জ্বলতা ও দূরত্বের মধ্যে একটা বর্গীয় সম্পর্ক চিহ্নিত করেন লেভেট। অর্থাৎ উজ্জ্বলতা যত ভাগ ম্লান হয়, দূরত্বও বাড়বে তার বর্গমূল অনুপাতে। তাই ৯ ভাগ ম্লান মানে তার দূরত্ব ৯-এর বর্গমূল বা ৩ গুণ দূরে। কিংবা ধরা যাক, কোনো সেফিড যদি একই সময়কালে আরেকটির তুলনায় ১৪৪ ভাগ ম্লান হয়, তাহলে সেটি অবশ্যই ১২ গুণ বেশি দূরে রয়েছে। কারণ, ১৪৪-এর বর্গমূল ১২।

তবে লেভেটের আবিষ্কৃত পদ্ধতির একটা সীমাবদ্ধতাও ছিল। এ পদ্ধতি ব্যবহার করে দুটো সেফিড নক্ষত্রের উজ্জ্বলতা মেপে সেগুলোর মধ্যকার আপেক্ষিক দূরত্ব মাপা যেত, সেগুলোর কোনোটার পরম দূরত্ব নয়। আসলে কোনো সেফিডের দূরত্ব জানা সম্ভব হলেই কেবল অন্য সেফিডদের প্রকৃত দূরত্ব জানা সম্ভব। অবশ্য সেটাও সম্ভব হলো বেশ দ্রুতই। সেটা করা গেল মার্কিন জ্যোতির্বিদ হার্লো শ্যাপলি এবং ডেনমার্কের জ্যোতির্বিদ এজনার হার্টস্প্রাংসহ অন্যদের গবেষণার কারণে। তাঁরা নক্ষত্রদের দূরত্ব মাপতে প্যারালাক্সসহ আরও কিছু পদ্ধতির সমন্বয় করলেন। এভাবে একটা সেফিড ভেরিয়েবলের প্রকৃত দূরত্ব পাওয়া গেল। ফলে লেভেটের পদ্ধতিটা হয়ে উঠল মহাবিশ্বের বহু দূরের নক্ষত্র বা গ্যালাক্সিদের দূরত্ব মাপার চূড়ান্ত মানদণ্ড। সেফিড ভেরিয়েবল নক্ষত্র হয়ে দাঁড়াল মহাবিশ্বের গজফিতা।

সংক্ষেপে বলতে হয়, এরপর মাত্র তিনটি ধাপ অনুসরণ করে যেকোনো সেফিডের দূরত্ব মাপতে সক্ষম হলেন জ্যোতির্বিদেরা। প্রথমত জানতে হবে, সেফিডটার উজ্জ্বলতা কী হারে ওঠানামা করে। দ্বিতীয়ত, তার উজ্জ্বলতা কেমন এবং তৃতীয়ত, নির্ণয় করতে হবে, প্রকৃত উজ্জ্বলতাকে কত দূরত্বে নিলে তা আপাত উজ্জ্বলতায় পরিণত হয়। লেভেটের এই যুগান্তকারী পদ্ধতি ব্যবহার করে অচিরেই বেশ কয়েকটি নেবুলার (পরে দেখা গেল সেগুলো গ্যালাক্সি) দূরত্ব মাপেন। এরপর একই পদ্ধতিতে এম৩১ গ্যালাক্সিতে একটা সেফিডের দূরত্ব মেপে আমাদের মহাবিশ্বের প্রকৃতি আয়তন বহুগুণে বাড়িয়ে দেন মার্কিন জ্যোতির্বিদ এডুইন হাবল।

লেভেটের এই কাজ দেখে একদিন চোখে পড়ল গোস্টা মিটাফ-লেফার। খুবই মুগ্ধ হলেন সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্সেসের এই অধ্যাপক। তাই ১৯২৪ সালে লেভেটকে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত করার চিন্তা করলেন লেফার। তাঁর সম্পর্কে আরেকটু খোঁজখবর নিতে গিয়ে দেখেন, তত দিন সবকিছুর ঊর্ধ্বে চলে গেছেন হেনরিয়েটা লেভেট। মাত্র তিন বছর আগে ক্যানসারে ভুগে মারা গেছেন মার্কিন এই নারী জ্যোতির্বিদ। ১৯২১ সালের ১২ ডিসেম্বর তিনি যখন মারা যান, তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ৫৩ বছর।

অবশ্য নোবেল পুরস্কারের চেয়েও অনেক বড় পুরস্কার পেয়ে গেছেন লেভেট। কারণ, জ্যোতির্বিজ্ঞানে তাঁর আবিষ্কৃত পদ্ধতিটা খুবই দরকারি আর কার্যকর। তাই তিনি আমাদের মধ্যে না থাকলেও জ্যোতির্বিজ্ঞানজুড়ে তাঁর কাজ রয়ে গেছে শক্ত একটা ভিতের মতো। লেভেটের জন্য রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর কবিতার কয়েকটা লাইন ধার করে বলা যায়:

চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়...

...চলে গেলে তোমারও অধিক কিছু থেকে যাবে

তোমার না-থাকাজুড়ে।

কথাগুলো জ্যোতির্বিদ হেনরিয়েটা সোয়ান লেভেটের জন্য দারুণভাবে মানানসই।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা

সূত্র: বিগ ব্যাং/ সাইমন সিং, উইকিপিডিয়া