বিজ্ঞান নিয়ে গল্পকথা

ছবি: রজত কান্তি রায়

শুরুতে রবীন্দ্রনাথের বিশ্ব পরিচয় থেকে একটা উদ্ধৃতি দিতে চাই: ‘বড় অরণ্যে গাছতলায় শুকনো পাতা আপনি খসে পড়ে, তাতেই মাটিকে করে উর্বরা। বিজ্ঞানচর্চায় দেশে জ্ঞানের ক্ষুদ্র টুকরো জিনিসগুলো ঝরে ঝরে ছড়িয়ে পড়ছে। তাতে চিত্তভূমিতে বৈজ্ঞানিক উর্বরতার জীবধর্ম জেগে উঠতে থাকে। তারই অভাবে আমাদের মন আছে অবৈজ্ঞানিক হয়ে। এ দৈন্য কেবল বিদ্যার বিভাগে নয়, কাজের ক্ষেত্রে আমাদের অকৃতার্থ করে রাখছে।’

এই যে পশ্চিমের উন্নত দেশের কথা রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, সেই দেশকে উন্নতির এ পর্যায়ে আসতে দীর্ঘ মধ্যযুগের অন্ধকার পাড়ি দিতে হয়েছে। ইউরোপে রেনেসাঁ হয়েছে, বুদ্ধির মুক্তি ঘটেছে, আধুনিক বিজ্ঞানের জন্ম হয়েছে এবং শিল্পবিপ্লব হয়েছে। ভারতবর্ষে ঔপনিবেশিক শাসনের জাঁতাকলে এসব পর্যায়ক্রমিক অগ্রগতি সেভাবে ঘটেনি। অবশ্য বাংলায় একটি রেনেসাঁ হয়েছিল। তাতে পশ্চিমের সঙ্গে যোগাযোগের ফলে বৌদ্ধিক জগতে যে পরিবর্তন আসে, তাতে একটি নতুন যুগের সূচনা ঘটে। এটাই আমাদের রেনেসাঁ। কিন্তু তার অনুষঙ্গ হিসেবে ইউরোপে যা যা ঘটেছে, আমাদের দেশে তার কিছুই ঘটেনি।

শিল্পবিপ্লব ঘটার যেসব সম্ভাবনা মোগল আমলে রোপিত হয়েছিল, ব্রিটিশরা সেগুলোর বিলুপ্তি ঘটায়। ফলে ঔপনিবেশিক শাসনে বিজ্ঞানের উল্লেখযোগ্য বিকাশ ঘটেনি। রবীন্দ্রনাথ গাছতলায় যে ভূমির কথা উল্লেখ করেছেন, তা সেরূপ উর্বরতা পায়নি। তাই আমাদের কয়েকজন মহিরুহ বিজ্ঞানী থাকলেও তাঁদের প্রভাবে অজস্র বিজ্ঞানীর জন্ম হয়নি। এই উর্বরতা সৃষ্টির জন্য যা প্রয়োজন, তা আমরা ইউরোপীয় রেনেসাঁয় দেখেছি। কিন্তু আমাদের এখানে এটি তৈরি হয়নি।

বিজ্ঞানের প্রতি আমার আগ্রহ, বিজ্ঞান নিয়ে চিন্তাভাবনা ও লেখালেখির শুরু অনেক বছর আগে। আমি কিশোর-কিশোরীদের জন্য বিজ্ঞান বিষয়ে কিছু লেখালেখি করেছিলাম। প্রথম লিখি সম্ভবত ১৯৬৩ সালে। আমি তখন ঢাকার নটর ডেম কলেজের শিক্ষক। সেখানে উদ্ভিদবিজ্ঞান পড়াই। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হায়াৎ মামুদ একদিন টাপুরটুপুর নামের একটি পত্রিকার সম্পাদক এখলাস উদ্দিন আহমেদকে সঙ্গে নিয়ে নটর ডেম কলেজে এলেন। এখলাস আমাকে তাঁর পত্রিকার জন্য একটি লেখা দিতে বললেন। আমি কিশোরদের জন্য এর আগে কিছু লিখিনি। কিন্তু তাঁদের না বলার উপায় ছিল না।

ভাবতে লাগলাম, কী লিখি। আমার মনে পড়ল আরও কয়েক বছর আগের কথা।

আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভিদবিদ্যার ছাত্র ছিলাম। ১৯৫৮ সালে ফাইনাল পরীক্ষার আগে সামরিক শাসন জারি হয়। সেই সময় গ্রেপ্তার হওয়ার ভয়ে উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের ল্যাবরেটরিতে সপ্তাহ দুয়েক রাত কাটাই। তখন টেবিলের ওপর মোটা মোটা বই বালিশ বানিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করতাম। ঘুম আসত না। নানা অদ্ভুত শব্দ শুনতাম। এটাকে কেন্দ্র করেই একটি গল্প লিখে ফেলি। গল্পটির বিষয় হলো, এক বিজ্ঞানী তাঁর গবেষণাগারে গভীর রাত অবধি কাজ করে চলেছেন। তাঁর কাছে আছে একটি পাথরের টুকরা। তাতে আদিম যুগের কিছু জীবের ফসিলের ছাপ। এগুলো কত বছরের পুরোনো এবং তাতে কী জীবের ছাপ আছে, এটাই তাঁর গবেষণার বিষয়। তখনই এক অশরীরীর সঙ্গে ওই বিজ্ঞানীর আলাপ শুরু হয়। এই আলাপ নিয়েই গল্পটির শুরু।

কিশোর-কিশোরীদের জন্য খুব বেশি বই আমি লিখিনি বা লিখতে পারিনি। এই যে গল্পটির কথা এক্ষুনি বললাম, সে ধরনের গল্প লিখেছি সব মিলিয়ে ১০টি। ওই গল্পগুলো নিয়ে বইঘর নামে চট্টগ্রামের একটি প্রকাশনা সংস্থা বের করে আমার প্রথম বই জীবনের শেষ নেই

আসলে বিজ্ঞানের বিষয়গুলো শিশুদের জন্য সহজ পাঠ্য ও আনন্দদায়ক করে লেখা মোটেও সহজ কাজ নয়। আবদুল্লাহ আল মূতী শরফুদ্দিন এ ক্ষেত্রে আমাদের পথিকৃৎ

সেটা ১৯৭৯ সালের ঘটনা। তারপর লিখেছি গাছের কথা ফুলের কথা, ফুলগুলি যেন কথা, প্রকৃতিমঙ্গল, বৃক্ষ ও বালিকার গল্প, গহন কোন বনের ধারে, এমি নামের দুরন্ত মেয়েটি (একটি রুশ কিশোর গল্পের ভাবানুবাদ) এবং একটি অনুবাদ সবুজ দ্বীপে প্রাণের মেলা। আরও কিছু বইও লিখেছি। সেগুলো কিশোর-কিশোরী ও বড়দের জন্য নানা প্রসঙ্গে। সেগুলোকে ঠিক বিজ্ঞান বলা যায় না। পরে ওই লেখাগুলো আমার কিশোর সমগ্র বইতে সংকলিত হয়।

আমার লেখা বইগুলো কিশোর-কিশোরীদের হাতে কতটা পৌঁছায়, তারা সেগুলো কতটা পছন্দ করেছে, তা বলা মুশকিল। দেখেছি আমার বইগুলোর এক একটি সংস্করণ শেষ হতে অনেক বছর লেগে যায়। কারণ কী হতে পারে? পরে ভেবে দেখেছি, রবীন্দ্রনাথ যেভাবে ‘বলাই’ গল্পটি লিখেছেন, আমরা সেভাবে লিখতে পারিনি। বড়দের পক্ষে শিশুদের মন স্পর্শ করা খুবই কঠিন। এই সমস্যার কথাও বলে গেছেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর পুনশ্চ কাব্যে ‘ছেলেটা’ কবিতায়। কবিতাটির শেষের কয়েকটি লাইন হলো:

আমি বললুম, ‘সে ত্রুটি আমারই।

             থাকত ওর নিজের জগতের কবি,

     তা হলে গুবরে পোকা এত স্পষ্ট হত তার ছন্দে

             ও ছাড়তে পারত না।

কোনোদিন ব্যাঙের খাঁটি কথাটি কি পেরেছি লিখতে—

            আর সেই নেড়ী কুকুরের ট্র্যাজেডি!’

আসলে বিজ্ঞানের বিষয়গুলো শিশুদের জন্য সহজ পাঠ্য ও আনন্দদায়ক করে লেখা মোটেও সহজ কাজ নয়। আবদুল্লাহ আল মূতী শরফুদ্দিন এ ক্ষেত্রে আমাদের পথিকৃৎ। তারপর তেমন কাউকে আমরা পাই না, যিনি মূতী সাহেবের মতো বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে কিশোর-কিশোরীদের জন্য এতগুলো বই লিখেছেন। এর প্রধান কারণ মূলত সাহিত্যের গুণসম্পন্ন বিজ্ঞানী বা বিজ্ঞানের গুণসম্পন্ন সাহিত্যিকের বড় অভাব আমাদের দেশে। যে উর্বর ভূমির কথা রবীন্দ্রনাথ উল্লেখ করেছেন, সেই উর্বর ভূমি আমাদের দেশে আজও ততটা উর্বর হয়ে ওঠেনি। আমাদের দেশ কৃষিপ্রধান ছিল এবং আজও আছে। আমার মনে একটি প্রশ্ন জাগে। আজকের কৃষিও তো একটি বিজ্ঞান, তাহলে কৃষিকেন্দ্রিক বিজ্ঞান সাহিত্য গড়ে ওঠার প্রতিবন্ধকতা কোথায়?

ঢাকার সংসদ ভবন সড়কে সোনালু বীথি

আমি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করিনি। করেছি উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক পর্যায়ে। মার্কিন দার্শনিক হেনরি অ্যাডমস (১৮৩৮-১৯১৮) বলতেন, একজন শিক্ষক কখনোই বলতে পারেন না, তাঁর প্রভাব কত দূর গিয়ে থামে। এ ধরনের উদ্দীপক শিক্ষকের অভাব আমাদের দেশে প্রকট। আমরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে একত্রে মিশিয়ে ফেলি। বিজ্ঞান না হলে প্রযুক্তি যে অসম্ভব, সে কথা আমরা ভুলে যাই। ছাত্রছাত্রীদেরও বিজ্ঞানের প্রভাব ভালোভাবে বোঝাতে পারি না।

আমি মস্কোর প্রগতি প্রকাশনে ২০ বছর অনুবাদকের কাজ করেছি। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্ত হয়, রাষ্ট্রব্যবস্থা বদলে যায়। ১৯৯২ সালে প্রগতি প্রকাশনে আমার কাজ বন্ধ হয়ে যায়। এ অবস্থায় জীবিকা অর্জনের জন্য মস্কোর বাংলাদেশ দূতাবাসে একটি বাংলা স্কুলে তিন বছর পড়াই। আমার জীবনে বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা সেই প্রথম। ছাত্রছাত্রী ছিল ১০ থেকে ১৫ জন। আমি সব বিষয়ই পড়াতাম—বিজ্ঞান, সাহিত্য, ইতিহাস ইত্যাদি। আমি গাছপালা দিয়ে স্কুলটি সাজিয়েছিলাম। বলা বাহুল্য, ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সবাই তেমন চৌকস ছিল না। তারা সবাই ছিল দূতাবাসের তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ছেলেমেয়ে।

আমি এই প্রথম উপলব্ধি করলাম, ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ভালো-মন্দ বলে কিছু নেই। সবকিছু নির্ভর করে শিক্ষার উপকরণ এবং শিক্ষকের দক্ষতা ও ভালোবাসার ওপর। আমি ওদের জীববিদ্যার পাঠ্যবই পড়াতাম। কিন্তু পাঠ্যবইয়ের ওপর খুব বেশি জোর না দিয়ে আমি ওদের প্রকৃতির বিচিত্র জগতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতাম। আমাদের একটি মাইক্রোস্কোপ ছিল। সেটি দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের নানা জীবের অণুকাঠামো দেখাতাম। এ জগতের সঙ্গে ওদের আগে কখনো পরিচয় ঘটেনি। ওরা আশ্চর্য ও মুগ্ধ হতো। ওই স্কুলে কোনো টেলিস্কোপ ছিল না, থাকলে ছাত্রছাত্রীদের মহাবিশ্ব দেখাতাম। আসলে বিদ্যালয়ে যা প্রয়োজন, তা হলো ছাত্রছাত্রীদের মনে বিচিত্র বিষয়ে কৌতূহল সৃষ্টি করা। এই কাজেই আমাদের বড় ঘাটতি। আমাদের ছাত্রছাত্রীরা, বিশেষত যাদের আমরা খারাপ ছাত্র বা খারাপ ছাত্রী বলে থাকি, তারা সবাই ভালো ফলাফল করেছিল। এ নিয়ে আমার একটি লেখা আছে, যেটি সংকলিত হয়েছে বিজ্ঞান ও শিক্ষা: দায়বদ্ধতার নিরিখ বইতে।

আমি এই প্রথম উপলব্ধি করলাম, ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ভালো-মন্দ বলে কিছু নেই। সবকিছু নির্ভর করে শিক্ষার উপকরণ এবং শিক্ষকের দক্ষতা ও ভালোবাসার ওপর

অরণ্যভূমির যে উর্বরতার কথা রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, সেটা সৃষ্টি করতে প্রয়োজন শিল্পবিপ্লব, সমাজবিপ্লব, সাংস্কৃতিক বিপ্লব। অন্যথা এই ভূমি কখনোই নির্মিত হবে না। রাশিয়া অন্যান্য উন্নত দেশের মতো একটি উন্নত দেশ। তাদের বিদ্যালয়গুলো সুসংগঠিত। উপকরণের কোনো অভাব নেই এবং শিক্ষকেরাও দক্ষ। তাঁদের মধ্যে নিশ্চয়ই উদ্বোধক শিক্ষকও আছেন। আমার ছেলেমেয়ে দুজনই বিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রী ছিল। তারা ভালোই করেছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, কেউই বিজ্ঞানী হয়নি। বিজ্ঞানী হওয়ার ব্যাপারটি আরেকটি গভীর রহস্য। হতে পারে সেটা মানবমনের গভীরে সহজাত প্রবৃত্তি হিসেবে লুকানো থাকে। পরিবেশ তার বিকাশে সহায়তা জোগায়। দেখা যায়, উন্নত দেশেও অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী বিজ্ঞানী হয় না। তবে বলা প্রয়োজন, রাশিয়ায় জনপ্রিয় বিজ্ঞান ও কল্পবিজ্ঞান সাহিত্য যথেষ্ট উন্নত এবং তার পরিমাণ বিপুল। আমি রাশিয়ায় থাকাকালে আমাদের ছাত্রছাত্রীদের কথা মনে রেখে দুটি বই অনুবাদ করেছিলাম রসায়নের শত গল্প এবং আমি কেন বাবার মতন। এই বইগুলো এখন আমাদের দেশেও পাওয়া যায়।

আমাদের দেশে, বলা যায় গোটা বিশ্বে, এখন আইটি বা ইনফরমেশন টেকনোলজি এক বিপ্লব সৃষ্টি করেছে এবং তাতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ফারাক মুছে যেতে বসেছে। এ দুটি বিষয়ের মধ্যে পার্থক্য বোঝানোর জন্য বিজ্ঞানের শিক্ষক ও বিজ্ঞান লেখকদের সতর্ক হওয়ার সময় এসেছে। নইলে কিশোর-কিশোরীদের মনে বিভ্রান্তির অনুপ্রবেশ ঘটবে এবং শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞানের বড় রকমের ক্ষতি হবে। ক্ষতি হবে প্রযুক্তিরও।

লেখক: প্রকৃতিবিদ

*বিজ্ঞানচিন্তার অক্টোবর ২০১৬ সংখ্যায় প্রকাশিত