কাজি আজিজুল হক : আঙুলের ছাপের বিজ্ঞানী

বারো বছর বয়সী বালক আজিজুলের গণিতের মাথা বিশেষ ভালো ছিল এবং খাবারদাবারের প্রতি তাঁর ভালোবাসাও অনেক। নৌকা দুর্ঘটনায় বাবাকে হারানো আজিজুলদের পরিবার তাঁর জ্যেষ্ঠ ভাইয়ের ওপর নির্ভরশীল। খাবারের প্রতি তাঁর দুর্দান্ত আকর্ষণ প্রায়ই আজিজুলের কষ্টের কারণ হতো। কারণ, আজিজুল তাঁর নিজের ভাগের খাবার শেষ করে প্রায়ই অন্যদের খাবার খেয়ে ফেলতেন। সে রকম একদিন বড় ভাই বাড়িতে খেতে বসে আবিষ্কার করেন আজিজুলের ব্যাপারটা। সেদিন কেবল বকাঝকাতে ব্যাপারটা শেষ হলো না। ক্লান্ত-শ্রান্ত বড় ভাইয়ের হাতে বেধড়ক মার খেলেন আজিজুল হক। সঙ্গে মনোবেদনা। সিদ্ধান্ত নিলেন, যেদিকে চোখ যায় চলে যাবেন। বাড়ি থেকে বেরিয়ে চলে গেলেন রেলস্টেশনে। যে ট্রেন পেলেন, সেটাতেই উঠে পড়লেন। ট্রেন তার শেষ গন্তব্য কলকাতার হাওড়া স্টেশনে থামল। সেখানেই নেমে পড়লেন আজিজুল। ভাবলেন, এখানেই থাকবেন। এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়িয়ে রাতে আজিজুল এক বাড়ির বারান্দায় ঘুমিয়ে পড়লেন।

সকালে ঘুম ভেঙে বাড়ির কর্তা বারান্দায় হাফপ্যান্ট ও শার্ট পরা আজিজুলকে আবিষ্কার করেন। কেন জানি আজিজুলকে দেখে তাঁর মায়া হলো। তাঁকে তিনি বাসায় আশ্রয় দিলেন। বাসার ফুটফরমাশ খাটার বিনিময়ে আজিজুল সেখানে থাকতে শুরু করেন। আর এভাবে পূর্ব বাংলার পিছিয়ে পড়া এক গ্রাম্য কিশোরের আস্তানা হয়ে ওঠে সেই সময়কার সম্ভ্রান্ত কলকাতা। সেটি ১৮৮৪ সাল। তখন কে জানত, এর এক যুগ পরই আজিজুলের হাতেই সূচিত হবে হাতের আঙুলের ছাপ দিয়ে অপরাধী শনাক্তকরণের বিশেষ পদ্ধতি! আর সে সূত্রে আজিজুল হবেন খান বাহাদুর কাজি আজিজুল হক!

গাণিতিক পদ্ধতিতে যাওয়ার আগে তাঁরা এই সাত হাজার আঙুলের ছাপকে খিলান, বৃত্ত ও ঘূর্ণিতে ভাগ করেন। দেখতে পান, এগুলোর মধ্যে মাত্র ৫% খিলান, ৬০% চক্র ও ৩৫% ঘূর্ণি।

জন্ম ও ছোটবেলা

বর্তমান খুলনা জেলার ফুলতলার পয়গ্রাম কসবাতে আজিজুল হকের জন্ম ১৮৭২ সালে। সেখানকার স্কুলে পড়ার সময় গণিতে তাঁর বিশেষ প্রতিভা লক্ষ করা যায়। কিন্তু নৌকা দুর্ঘটনায় বাবার মৃত্যুতে পুরো পরিবার আর্থিক অনটনে পড়ে। বড় ভাই সংসারের দায়িত্ব নেন। কিন্তু আগের মতো খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারটি না থাকায় আজিজুলের সবিশেষ অসুবিধা হয়। কারণ, আজিজুল খেতে ভালোবাসতেন। স্কুলের পড়া তাঁর অব্যাহত থাকলেও ১২ বছর বয়সে উল্লিখিত ঘটনার জের ধরে আজিজুল চলে যান কলকাতায়।

কলকাতায় পড়াশোনা

কলকাতার আশ্রয়দাতার বাড়িতে শুধুই ফুটফরমাশ খেটে সময় পার করলেন না আজিজুল। তাঁর মনোযোগ ওই বাড়ির ছেলেমেয়েদের ওপরও। খেয়াল করলেন, তিনি গণিতের যে সমস্যাগুলো সহজে সমাধান করতে পারেন, সেগুলো বাড়ির ছেলেমেয়েরা সমাধানে গলদঘর্ম হয়। ছেলেমেয়েরা যখন পণ্ডিতের কাছে পড়তে বসে, তখন আজিজুল তাঁর প্রতিভা দেখাতে শুরু করেন। হকচকিত পণ্ডিত একটি কাজের ছেলের গাণিতিক প্রতিভা দেখে অবাক হন এবং তাঁর আরও পরীক্ষা নেন। সে পরীক্ষাতেও পাস করে যান আজিজুল। পণ্ডিত তাঁর প্রতিভার কথা জানান বাড়ির কর্তাকে। কর্তাও অবাক হন এবং তখন জানতে পারেন, আজিজুল বাড়ি থেকে পালিয়ে আসার আগে স্কুলে পড়তেন। কর্তাটি উদার ছিলেন। তিনি আজিজুলকে ভর্তি করিয়ে দেন কলকাতার স্কুলে। আজিজুল সেখান থেকে এফএ পাস করে নিজের যোগ্যতায় প্রেসিডেন্সি কলেজে গণিতে ভর্তি হন। সেখানে অচিরেই তিনি গণিতের শিক্ষকদের নজরে পড়েন এবং অধ্যক্ষ তাঁর প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে বিশেষ স্নেহ করতে থাকেন। এখান থেকেই তিনি গণিতে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন।

স্যার এডওয়ার্ড হেনরি

পুলিশের চাকরি ও আঙুলের ছাপ

হাতের রেখা ও আঙুলের ছাপ নিয়ে আলোচনা, গবেষণা ইত্যাদি শুরু হয় ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে। কিন্তু এর মাধ্যমে কাউকে শনাক্ত করা যেতে পারে, এমন ধারণা কিন্তু মাত্র দেড় শ বছর আগে ভারতবর্ষে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৮৫৯ সালের দিকে তৎকালীন ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষের হুগলি জেলার চিফ ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন স্যার উইলিয়াম জেমস হার্শেল। তিনি লক্ষ করলেন, কোনো মানুষের আঙুলের ছাপ তার জীবনকালে মোটামুটি একই থাকে এবং একজনের আঙুলের ছাপ অন্যজনের সঙ্গে মেলে না। আর একটু খোঁজখবর ও গবেষণা করে তিনি ১৮৭৭ সালে ভারতবর্ষে আঙুলের ছাপ ও হাতের ছাপ দিয়ে মানুষকে শনাক্ত করার পদ্ধতি আনুষ্ঠানিকভাবে চালু করেন। এর ফলে দলিল ও আইনি কাগজে আঙুলের ছাপ দেওয়া বৈধ হয়ে যায়। তবে এ রকম রেকর্ড কেবল একজনের সঙ্গে একজনের শনাক্তকরণ তুলনা করার জন্য ব্যবহৃত হতো। হাতের ছাপ সার্চ করার কথা তখনো কারও মাথাতে আসেনি।

কাছাকাছি সময়ে, ১৮৮০ সালে বিলেতে ড. হেনরি ফাউল্ডস বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইনের কাছে একটি চিঠি লেখেন। সেই চিঠিতে ফিঙ্গারপ্রিন্টের শ্রেণীকরণের একটি পদ্ধতি নিয়ে সহায়তা চান। কিন্তু ডারউইন তাঁকে সময় দিতে পারেননি। কিন্তু চিঠিটি তাঁর তুতো ভাই স্যার ফ্রান্সিস গ্যালটনের কাছে পাঠিয়ে দেন। যদিও তাঁরা দুজন খুব বেশি যোগাযোগ করেননি, কিন্তু এক দশকের মধ্যে তাঁরা দুজনই প্রায় একই রকম পদ্ধতি বের করেন। এর মধ্যে ড. ফাউল্ডস আগে সেটি করেন। কিন্তু স্যার ফ্রান্সিস গ্যালটন ১৮৯২ সালে তাঁর বিখ্যাত ও জনপ্রিয় বই ফিঙ্গারপ্রিন্ট-এ তাঁর পদ্ধতি প্রকাশ করেন। এই প্রথম আমরা জানতে পারি, মানুষের আঙুলে তিন ধরনের প্যাটার্ন থাকে—খিলান (আর্চ), চক্র (লুপ) ও ঘূর্ণি (হোর্লস)।

সেই সময় অপরাধীদের শনাক্তকরণের জন্য তাদের শরীরের বিভিন্ন মাপ লিপিবদ্ধ করা হতো। এই নৃতাত্ত্বিক পদ্ধতি বেশ জটিলই ছিল। কিন্তু কোনো সহজ বিকল্পও ছিল না। ১৮৯২ সালে ভারতের ব্রিটিশ পুলিশ এই অ্যানথ্রোপোমেট্রি পদ্ধতি চালু করে।

১৮৯৪ সালে বেঙ্গল পুলিশের অধিকর্তা বা ইন্সপেক্টর অব পুলিশ ছিলেন স্যার এডওয়ার্ড হেনরি। গ্যালটনের বই পড়ে তিনি ফিঙ্গারপ্রিন্টের মাধ্যমে অপরাধী খুঁজে বের করার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ১৮৯৬ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি বাংলার পুলিশ বাহিনীকে অপরাধীদের অ্যানথ্রোপোমেট্রিক ডেটা ছাড়াও ১০ আঙুলের ছাপ ও হাতের ছাপ সংরক্ষণের নির্দেশ দেন।

আঙুলের ছাপ নিয়ে বিশদ কাজ করার জন্য তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যক্ষের কাছে গণিত ও পরিসংখ্যানে অত্যন্ত দক্ষ একজন স্নাতককে চান। ঠিক সেই সময়ে কাজি আজিজুল হক গণিতে মাস্টার্স শেষ করেছেন। অধ্যক্ষের সুপারিশে কাজি আজিজুল হক পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর হিসেবে যোগ দেন। তাঁর সঙ্গে যোগ দেন হেমচন্দ্র বসু। স্যার হেনরি পুলিশের দুই সাব-ইন্সপেক্টর আজিজুল হক ও হেমচন্দ্রকে নিয়ে একটি আলাদা টিম গঠন করেন।

হাতের ছাপের শ্রেণীকরণ

আমরা যখন কোনো কিছুকে শ্রেণিবদ্ধ করতে চাই, তখনই প্রথমে আসে বর্ণক্রমিক চিন্তা। কিন্তু অপরাধীদের তথ্য বর্ণক্রম অনুসারে সাজানোর তেমন কোনো অর্থ নেই। কারণ, অপরাধীরা নিজের নামধাম, ঠিকানা, ধর্ম, এমনকি কোনো কোনো সময় নিজেদের চেহারাও পাল্টে ফেলে। এ জন্যই অর্থোপোমেট্রিকের সূচনা। কিন্তু সেটি জটিল বলেই স্যার হেনরি হাতের ছাপ দিয়ে কিছু করা যায় কি না, সেটি ভেবেছেন।

আজিজুল ও হেমচন্দ্র কাজে যোগ দেন। ঘেঁটেঘুঁটে অনেক অপরাধীর হাতের ছাপের রেকর্ড গবেষণার জন্য পেয়ে যান। এরই মধ্যে কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিংয়ে অর্থোপোমেট্রিক ডেটা সংরক্ষণের ব্যুরো গড়ে ওঠে। আজিজুল হক ও হেমচন্দ্র যখন কাজ শুরু করেন, তত দিনে সেখানে প্রায় সাত হাজার অপরাধীর আঙুলের ছাপ ও হাতের ছাপ সংরক্ষিত ছিল।

সেই ডেটাগুলো বিশ্লেষণ করার পাশাপাশি তাঁরা দুজন স্যার হেনরির সঙ্গে একমত হন, এটি সহজভাবে ব্যবহার করতে হলে অবশ্যই একটি গাণিতিক সূত্র বের করতে হবে। তবে গাণিতিক পদ্ধতিতে যাওয়ার আগে তাঁরা এই সাত হাজার আঙুলের ছাপকে খিলান, বৃত্ত ও ঘূর্ণিতে ভাগ করেন। দেখতে পান, এগুলোর মধ্যে মাত্র ৫% খিলান, ৬০% চক্র ও ৩৫% ঘূর্ণি। যেহেতু খিলানের সংখ্যা পরিসাংখ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ নয়, কাজেই তাঁরা সেটিকে ঘূর্ণির সঙ্গে একীভূত করে ফেললেন। ফলে হাতের আঙুলের ছাপ হয়ে গেল দুই রকমের—চক্র ও ঘূর্ণি। তারপর তাঁরা এদের চিহ্নিত করলেন যথাক্রমে L ও W হিসেবে।

এরপর দুই হাতের ১০ আঙুলকে পাঁচটি জোড়ায় ভাগ করা হলো। এ জন্য ছবিতে দেখানো পদ্ধতিতে তালু নিচে রেখে ডান হাতকে বাঁ দিকে ও তালু ওপরে রেখে বাঁ হাতকে ডানে বসানো হলো।

ছবিতে দেখানো পদ্ধতি জোড়া তৈরি করা হলো। জোড়া তৈরিকে এভাবে লেখা যায়।

এখন প্রথম জোড়া ডান তর্জনী ও ডান বৃদ্ধাঙ্গুলির যেকোনোটি চক্র (L) বা ঘূর্ণি (W) হতে পারে। কাজেই মোট চার রকমের বিন্যাস আমরা দেখতে পাব।

১. ডান তর্জনী চক্র (L), ডান বৃদ্ধাঙ্গুলি ঘূর্ণি (W)

২. ডান তর্জনী ঘূর্ণি (W), ডান বৃদ্ধাঙ্গুলি চক্র (L)

৩. উভয়টি চক্র (L) এবং

৪ উভয়টি ঘূর্ণি (W)

একইভাবে বাকি চারটি জোড়াতেও এ রকম চারটি করে বিন্যাস হতে পারে। তার মানে, মোট পাঁচ জোড়াতে বিন্যাস হবে = 4×4×4×4×4=1024

1024 কে লেখা যায় 32×32 হিসাবে।

তার অর্থ হলো, আমরা যদি 32টি ক্যাবিনেটের প্রতিটিতে 32টি করে ফাইল রাখি, তাহলে আমরা 1024 জন অপরাধীর তথ্য যথাযথভাবে সংরক্ষণ করতে পারব।

এখন প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম জোড়াতে যদি কোনো ঘূর্ণি থাকে, তাহলে সেটির গাণিতিক মান হবে যথাক্রমে 16, 8, 4, 2 ও 1। আর চক্রের বেলায় যা–ই থাকুক না কেন, সেটির গাণিতিক মান হবে 0।

আমরা একটা উদাহরণ দেখি। ধরা যাক, কোনো অপরাধীর ডান বৃদ্ধাঙ্গুলি, ডান অনামিকা, বাম মধ্যমা, বাম তর্জনী এবং বাম অনামিকাতে ঘূর্ণি আর অন্যগুলো চক্র।

এখন হরে ও লবে 1 যোগ করে

আমরা চূড়ান্ত ফলাফল পেলাম, অর্থাৎ এই লোকের তথ্য পাওয়া যাবে ২০ নম্বর ক্যাবিনেটের ১১ নম্বর ফাইলে।

যদি সব আঙুলের ছাপই চক্র হয়, তাহলে এটির মান হবে 0/0। যেহেতু শূন্য ক্যাবিনেট বা শূন্য ফাইল বলে কিছু নেই, তাই 1/1 যোগ করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ জন্য যে ব্যক্তির সব আঙুলেই চক্র, তার ছাপ থাকবে প্রথম ক্যাবিনেটের প্রথম ফাইলে।

আঙুলের ছাপের শ্রেণীকরণের এই প্রাথমিক পদ্ধতিকে ইচ্ছেমতো সেকেন্ডারি বা টারশিয়ারি শ্রেণীকরণের মাধ্যমে লাখ লাখ ডেটা সংরক্ষণ করা সম্ভব।

হেনরির সিস্টেম

কিছুদিন কাজ করে আজিজুল হক ও হেমচন্দ্র বসু আঙুলের ছাপের শ্রেণীকরণের কাজটা করে ফেলেন। এর মধ্যে গাণিতিক পদ্ধতিটির মূল কৃতিত্ব আজিজুল হকের। নিয়মিত তাঁদের অগ্রগতি স্যার হেনরিকে অবহিত করতেন।

যখন বোঝা গেল সিস্টেমটি ভালো, তখন স্যার হেনরি আনুষ্ঠানিকভাবে গভর্নর জেনারেলের দপ্তরকে জানান। একটি কমিশন পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে পদ্ধতিটিকে অর্থোপোমেট্রিক পদ্ধতির চেয়ে উন্নত বলে রায় দেয়। কাজেই পুলিশ এটি গ্রহণ করে ১৮৯৭ সালে এবং ওই বছরই কলকাতায় বিশ্বের প্রথম ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যুরো স্থাপিত হয়। ১৮৯৯ সালে স্যার হেনরি বিলেতের ডোভারে গিয়ে এই পদ্ধতি সম্পর্কে একটি পেপার উপস্থাপন করেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, হেনরি শুরু থেকে আজিজুল হক ও হেমচন্দ্র বসুর অবদান সম্পর্কে কোথাও কোনো স্বীকৃতি দেননি। ১৮৯৯ সালে ব্রিটিশ সরকার হেনরির পেপারটি মুদ্রণ করে প্রকাশ করে। ফলে এটি ছড়িয়ে পড়ে। ১৯০০ সালে ব্রিটিশ সরকার একই পদ্ধতি চালু করার জন্য স্যার হেনরিকে দক্ষিণ আফ্রিকাতে পাঠায় এবং তিনি সেখানেও সাফল্যের সঙ্গে এটি চালু করেন। তারপর থেকে বিশ্বব্যাপী এই পদ্ধতি ‘হেনরির সিস্টেম’ নামে চালু হয়ে যায়।

খুলনার সঙ্গে যোগাযোগ, বিয়ে ও বিহারে বদলি

কাজের কোনো স্বীকৃতি না পাওয়া সত্ত্বেও আজিজুল হক ও হেমচন্দ্র ওই ব্যুরোতে কাজ করতে থাকেন। এর মধ্যে আজিজুল হক নিজের জন্মস্থানে ফিরে যান। তাঁর ভাইয়েরা তাঁর সাফল্যের কথা শুনে উচ্ছ্বসিত হন এবং এক নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে তাঁর বিয়ের ব্যবস্থা করেন। ১৯১২ সালে বিহার বাংলা থেকে পৃথক হয়ে আলাদা রাজ্যে পরিণত হয়। আজিজুল হক ভাবলেন, ব্যুরোতে চাকরি করার পরিবর্তে তিনি পুলিশের মূল চাকরিই করবেন এবং সেটা বিহারে। তারপর তিনি সেখানে চলে যান। বিহারে গিয়ে তিনি সেখানেই স্থায়ী হন।

অবশেষে স্বীকৃতি

অনেক বছর পর যখন আজিজুল হক ফিঙ্গারপ্রিন্ট শ্রেণীকরণের কাজে তাঁর অবদানের জন্য ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে স্বীকৃতি এবং ক্ষতিপূরণ চেয়েছিলেন, স্যার হেনরি প্রকাশ্যে হকের অবদানকে স্বীকৃতি দেন এবং পরে বোসের ক্ষেত্রেও একই কাজ করেন। জি এস সোদি এবং যশজিৎ কৌর দুই ভারতীয় পুলিশ কর্মকর্তার ফিঙ্গারপ্রিন্ট বিকাশে অবদানের বিষয়টি নিয়ে একটি বিস্তৃত গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। তাঁদের গবেষণাপত্রে তাঁরা দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকাতে ‘ইন্ডিয়ান অ্যাফেয়ার্স ইন লন্ডন’ নামে নিবন্ধ থেকে উদ্ধৃত করেন, ‘একজন মুহাম্মাদান উপপরিদর্শক ফিঙ্গারপ্রিন্ট শ্রেণিবিন্যাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন, কিন্তু তিনি পর্যাপ্ত স্বীকৃতি পাননি।’ আঙুলের ছাপ শ্রেণিবিন্যাসে হকের অবদানকে সমর্থন করার জন্য সোদি ও কৌর আরও কয়েকটি উৎস উদ্ধৃত করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, বিহার ও ওডিশার সরকারি অফিশিয়াল চিফ সেক্রেটারি জে ডি সিফটন একটি চিঠি লিখেছিলেন (চিঠি নম্বর 7676১ পিআর, তারিখ ১৫ জুন ১৯৫২),

‘আজিজুল হককে আঙুলের ছাপগুলোকে শ্রেণিবদ্ধকরণের একটি পদ্ধতিতে গবেষণাকাজ শুরু করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল এবং কয়েক মাস পরীক্ষার পর তিনি তাঁর প্রাথমিক শ্রেণিবিন্যাসটি বিকশিত করেছিলেন, যা স্যার ই আর হেনরিকে বিশ্বাস করিয়েছিলেন যে ফিঙ্গারপ্রিন্টগুলোকে শ্রেণিবদ্ধকরণের কার্যকর পদ্ধতি সরবরাহ করে সমস্যা সমাধান করা যেতে পারে। খান বাহাদুর (হক) এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।’

পরে স্যার হেনরি আরেকটি চিঠিতে পরিষ্কার করেন, ‘হক এ গবেষণায় অন্য সবার চেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করেছেন এবং তিনি আমার সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন। হক ভারতীয় পুলিশের জন্য সম্মান বয়ে এনেছেন।’ পরবর্তী সময়ে হেমচন্দ্র বসুকেও এই গবেষণার জন্য স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

আজিজুল হক ১৯১৩ সালে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে ‘খান সাহেব’ এবং ১৯২৪ সালে ‘খান বাহাদুর’ উপাধিতে ভূষিত হন। এ ছাড়া তিনি বিহারের মতিহারিতে জায়গিরও (রাষ্ট্র কর্তৃক বন্দোবস্তকৃত ভূমি) লাভ করেন। হেমচন্দ্র বসুও একই সমতুল্য ‘রায় সাহেব’ ও ‘রায় বাহাদুর’ উপাধি লাভ করেন। পাশাপাশি দুজনই ৫ হাজার রুপি করে অর্থ পুরস্কারও পান। ২০০১ সালে কলিন বিভানের আঙুলের ছাপবিষয়ক একটি বই এবং ২০০৫ সালে কারেন্ট সায়েন্স জার্নালে আজিজুল-হেমচন্দ্রকে নিয়ে বিশেষ প্রবন্ধ প্রকাশিত হলে তাঁদের বিষয়ে বিশ্বব্যাপী নতুন করে আগ্রহের সৃষ্টি হয়। বর্তমানে ব্রিটেনের ফিঙ্গারপ্রিন্ট ডিভিশনে ‘হক অ্যান্ড বোস অ্যাওয়ার্ড’ নামে বিশেষ একটি পুরস্কারও প্রচলিত রয়েছে, যার মাধ্যমে আঙুলের ছাপ নিয়ে কাজ করে চলা উদ্ভাবনী ব্যক্তিদের পুরস্কৃত করা হয়।

মৃত্যু

একজন বিশিষ্ট পুলিশ অফিসার হিসেবে আজিজুলের সামনে ছিল নিজের কর্মস্থল নিজেই বেছে নেওয়ার সুযোগ। ১৯১২ সালে বিহার বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার পর তিনি বিহার পুলিশ সার্ভিসকে পছন্দ করেন নিজের কর্মস্থল হিসেবে। সেখানেই কাজ চালিয়ে যান তিনি এবং অবসর গ্রহণের পর বিহারের মতিহারিতে স্থায়ী হন। ১৯৩৫ সালে সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন এবং সেখানেই তাঁকে চিরশায়িত করা হয়।

লেখক: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি