ঘূর্ণিঝড় মোকা: নামের পেছনের কথা

ফাইল ছবি

নানারকম ঘূর্ণিঝড়ের নানারকম নাম। কোনোটাকে বলা হয় টাইফুন, কোনোটা সাইক্লোন, আমরা আবার বলি ঘূর্ণিঝড়। এতরকম নাম শুনে বিভ্রান্ত না হওয়াই অস্বাভাবিক। ভাবতে পারেন, এরা হয়তো বৈশিষ্ট্যে অনেক ভিন্ন। আসলে তা নয়। বৈশিষ্ট্য এদের প্রায় একইরকম। তাহলে শ্রেণিগত নাম ভিন্ন কেন? রহস্য খুব জটিল নয়। মূলত স্থানভেদে একইরকম ঘূর্ণিঝড়ের ভিন্ন শ্রেণিগত নাম হতে পারে।

প্রতিটি ঘূর্ণিঝড়ের আবার ভিন্ন ভিন্ন নাম থাকে। বর্তমান ঘূর্ণিঝড়টিকে যেমন বলা হচ্ছে মোকা (অনেক লিখছেন মোখা)। এই নাম কারা দেয়, কীভাবে দেয়? আসুন, জেনে নিই একে একে।

 

শ্রেণিগত নাম

প্রথমে জেনে নিই, ঘূর্ণিঝড় জিনিসটা কী। কর্কটক্রান্তি ও মকরক্রান্তি রেখার মাঝের অঞ্চলটাকে বলা হয় গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চল। এই অঞ্চলে নিম্নচাপের ফলে সামুদ্রিক ঝড় তৈরি হলে দেখা যায় ঘূর্ণি। সেই থেকে নাম হলো ঘূর্ণিঝড়। ইংরেজিতে বলা হয় সাইক্লোন। তবে একে ট্রপিক্যাল সাইক্লোন বা ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়ও বলা হয়।

বৈশিষ্ট্য ও উৎপত্তিগতভাবে প্রায় একইরকম হলেও অঞ্চলভেদে এদের নাম হয়েছে ভিন্ন। ভারত মহাসাগর অঞ্চলে যেমন এদের নাম সাইক্লোন। ইংরেজ বিজ্ঞানী ও কাপ্তান হেনরি পিডিংটন এই নাম দেন। গ্রিক শব্দ ‘কাইক্লোস’ (Kyklos) থেকে এর উৎপত্তি। শব্দটির অর্থ সাপের কুণ্ডলী। ঘূর্ণির কুণ্ডলীত রূপ দেখেই সম্ভবত এমন নামকরণ।

এদিকে অতলান্তিক অঞ্চলের অধিবাসীরা ঘূর্ণিঝড়কে বলেন হারিকেন। আদিবাসী মায়াদের ঝড়ের দেবতার নাম হুরাকান। সেই থেকেই এই নাম। আবার প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলের লোকেরা একে বলেন টাইফুন। এটা এসেছে চীনা শব্দ তাইফুং (Taaifung) বা তাইফেং (Taifeng) থেকে। কথাটির অর্থ শক্তিশালী বায়ু। আরবি থেকে বাংলায় আসা ‘তুফান’ শব্দটিও কিন্তু এই টাইফুন বা শক্তিশালী বায়ুকেই বোঝায়। গ্রিক কিংবদন্তীর বায়ুদৈত্য তুফোনের (Tuphon) নাম থেকে এসেছে।

ঘটনার শুরু বাতাসের বেগ থেকে। নিম্নচাপের ফলে যখন প্রচণ্ড বায়ু ঝড়ের রূপ ধারণ করে, তখন বাতাসের বেগ অনুযায়ী এদের নানা ভাগ করা হয়। ঘণ্টায় ৩০ থেকে ৪০ কিলোমিটার বেগের বাতাসকে বলা হয় দমকা হাওয়া। আর ৪১ থেকে ৬০ কিলোমিটার বেগে বাতাস বইলে বলা হয় ঝড়ো হওয়া। এরচেয়ে বেশি হলেই কালবৈশাখী। এর মধ্যে ৬১ থেকে ৯০ হলো মৃদু। ৯১ থেকে ১২০ হলো মাঝারি আর ঘণ্টায় ১২১ থেকে ১৪৯ কিলোমিটার বেগের ঝড়ো হাওয়াকে বলা হয় তীব্র কালবৈশাখি। আরও উত্তাল হয়ে উঠলে বলা হয় টর্নেডো।

এই হলো বাতাসের বেগের সাধারণ নানা ভাগ। কিন্তু আরও খেপে উঠতে দেখা যায় প্রকৃতিকে। ঘূর্ণি ওঠে বাতাসে। সেই থেকে ঘূর্ণিঝড়—সাইক্লোন, হারিকেন, টাইফুন। প্রকৃতির রুদ্রমূর্তি দেখা যাচ্ছে ইদানীং। নামের আগে তাই যুক্ত হচ্ছে ‘সুপার’। যেমন সুপারসাইক্লোন। অতিঘূর্ণিঝড়।

ঘূর্ণিঝড়ের সুনির্দিষ্ট নাম

একটা সময় ঘূর্ণিঝড়ের সুনির্দিষ্ট নাম রাখা হতো না। ১৯৭০ থেকে ১৯৯০ এর মধ্যে যেসব ঘূর্ণিঝড় হয়েছে, সেগুলোর নাম নেই। বিদেশে অবশ্য ততদিনে ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ শুরু হয়ে গেছে। নাম রাখার কারণ, একটির সঙ্গে আরেকটিকে মিলিয়ে না ফেলা। পাশাপাশি, ঘূর্ণিঝড়ের শক্তি, ধরন ও অন্যান্য তথ্য নিয়ে আলোচনাতেও সুবিধা হয়। তবে ১৯৭৯ সালের আগপর্যন্ত শুধু নারীদের নামে ঘূর্ণিঝড়ের নাম রাখা হতো। সে বছরের পর থেকে নারী-পুরুষ বা এমনিতে যেকোনো শব্দেই নাম রাখা হয়।

বর্তমানে এ নামকরণ করে আন্তর্জাতিক আবহাওয়া সংস্থা ওয়ার্ল্ড মেটিওরোলজিক্যাল অর্গানাইজেশন (ডব্লিউএমও )। ডব্লিউএমও এ জন্য পাঁচটি বিশেষ আঞ্চলিক আবহাওয়া সংস্থার (আরএসএমসি) সঙ্গে সমন্বয় করে ২০০৪ সাল থেকে ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ শুরু করেছে। এই আরএসএমসি আবার সদস্যদেশগুলোর কাছ থেকে নামের তালিকা চেয়ে নেয়। তালিকা অনুযায়ী যাচাই-বাছাই করে সংক্ষিপ্ত তালিকা করে ডব্লিউএমওর কাছে পাঠায়।

বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়ের নামের তালিকা অনুমোদন করে আঞ্চলিক কমিটির একটি প্যানেল। তার নাম ডব্লিউএমও/এসকাপ প্যানেল অন ট্রপিক্যাল সাইক্লোনস। এর মধ্যে আছে ভারত, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, মালদ্বীপ, মিয়ানমার, ওমান, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, ইরান, কাতার, সৌদি আরব, ইয়েমেন ও সংযুক্ত আরব আমিরাত।

২০১৮ সালের আরএমএসসি নতুন করে ঘূর্ণিঝড়ের নামের তালিকা করে। এ সময় ১৩টি দেশ ১৩টি করে নাম দেয়। নামকরণের ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় মেনে চলা হয়। যেমন রাজনীতি বা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, ধর্মীয় বিশ্বাস, সংস্কৃতি বা লিঙ্গ নিরপেক্ষ হতে হবে নামগুলোকে। বিশ্বের কোনো অঞ্চলের কোনো মানুষের অনুভূতিতে আঘাত করে, এমন নাম দেওয়া যাবে না। নাম রূঢ় হতে পারবে না। সংক্ষিপ্ত ও সহজে উচ্চারণ করা যায়, এমন হতে হবে। সর্বোচ্চ আটটি বর্ণ থাকতে হবে ওই নামে। নাম দেওয়ার পাশাপাশি এখানে উচ্চারণও দিয়ে দিতে হবে। সদস্যদেশগুলোর দেওয়া প্রস্তাবিত নাম সময়ে সময়ে সংশোধন করা যাবে।

ইয়েমেনের শহর মোকা

সদস্যরাষ্ট্রগুলোর ইংরেজি নামের আদ্যক্ষর অনুযায়ী নামের তালিকা হয়। যেমন ইংরেজি বর্ণমালা অনুযায়ী এই ১৩ দেশের মধ্যে সবার আগে রয়েছে বাংলাদেশের নাম। আর সবশেষে ইয়েমেনের নাম।

এবারের ‘মোকা’ নামটি ইয়েমেনের প্রস্তাবিত। ‘মোকা’ ইয়েমেনের একটি বন্দর নগরীর নাম। ইয়েমেনের লোহিত সাগর উপকূলের শহর এটি। উনিশ শতকে ইয়েমেনের প্রধান বন্দরে পরিণত হয় এ শহর। কফি বাণিজ্যের জন্য এটি সুপরিচিত। নামটি এসেছে কফির একটি ধরনের নাম থেকে।

যাঁরা কফি খান, তাঁরা জানেন, মোকা নামে একধরনের কফি আছে। একশট স্প্রেসোর সঙ্গে চকলেট পাউডার বা সিরাপ, এবং পরে দুধ বা ক্রিম মেলানো হয় এ কফিতে। অনেকে এটিকে ‘লাতে’-এর একটি ধরনও বলেন। সেই পঞ্চদশ শতক থেকে কফির বড় বাজার ছিল মোকা। সেই সুখ্যাতি রয়ে গেছে এখনো।

অনেকে অবশ্য ‘মোকা’কে ‘মোখা’ও বলছেন। তবে কফির নামানুসারে, নামটির উচ্চারণ ‘মোকা’-ই হয়।

ইয়েমেনের পরে, আগামী ঘূর্ণিঝড়ের নাম রাখা হবে বাংলাদেশের নামের তালিকা থেকে। সে অনুসারে পরের ঘূর্ণিঝড়টির নাম হতে পারে ‘বিপর্যয়’।

লেখক: সহসম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা

সূত্র: ন্যাশনাল ওয়েদার সার্ভিস, যুক্তরাষ্ট্র, উইকিপিডিয়া, প্রথম আলো, দ্য ইকোনোমিক টাইমস, ইন্ডিয়া