সাক্ষাৎকার

মানবিক বুদ্ধিমান মানুষ হয়ে ওঠো—হাসান খুরশীদ রুমী, বিজ্ঞান কল্পগল্প লেখক ও অনুবাদক

হাসান খুরশীদ রুমী বাংলাদেশের সায়েন্স ফিকশনচর্চার অগ্রদূতদের একজন। নিজে সায়েন্স ফিকশন অনুবাদ ও সম্পাদনা করেছেন। নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম সায়েন্স ফিকশন ম্যাগাজিন মৌলিক–এর। সেবা প্রকাশনীতে কাজ করেছেন দীর্ঘদিন। কাজী আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে ছিল তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। কাজ করেছেন কার্টুনিস্ট আহসান হাবীবের সঙ্গেও। সম্প্রতি তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছে বিজ্ঞানচিন্তা। সায়েন্স ফিকশন নিয়ে তাঁর ভাবনা, শৈশবের কথা ও বর্ণময় জীবনের কথা উঠে এসেছে এ সাক্ষাৎকারে। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিজ্ঞানচিন্তার নির্বাহী সম্পাদক আবুল বাসার ও সহসম্পাদক উচ্ছ্বাস তৌসিফ। ছবি তুলেছেন খালেদ সরকার

বিজ্ঞানচিন্তা:

কেমন আছেন?

হাসান খুরশীদ রুমী: ভালো, ভালো, ভালো।

বিজ্ঞানচিন্তা:

বাংলাদেশে সায়েন্স ফিকশনচর্চার অগ্রদূতদের একজন বলা হয় আপনাকে। দীর্ঘদিন ধরে নিজে সায়েন্স ফিকশন অনুবাদ করেছেন, মৌলিক নামে একটি ম্যাগাজিন প্রকাশ করেছেন, সম্পাদনাও করেছেন। সায়েন্স ফিকশনের প্রতি আপনার এই আগ্রহ জন্মাল কীভাবে?

হাসান খুরশীদ রুমী: আম্মা ছোটবেলায় একটা বই কিনে দিয়েছিলেন। এখ্‌লাসউদ্দিন আহ্‌মদের নেংটি ইঁদুরের গল্প। আম্মা প্রচুর বই পড়তেন। এখনো পড়েন। বইটা পড়ে দেখলাম, ইঁদুর অ্যাডভেঞ্চারে বের হবে। আমারও ইচ্ছা হলো অ্যাডভেঞ্চার করার। একদিন বাসা থেকে বেরও হয়ে গিয়েছিলাম। আমাকে খুঁজতে তখন লোক পাঠানো হয়েছিল। আসলে বাসার উল্টো দিকে পুকুরপাড়ে বসে ছিলাম। এর চেয়ে দূরে তখন আর যাব কোথায়? ওই বইটা পড়া শেষ করে আম্মাকে চাপ দিতে লাগলাম যে আরেকটা বই কিনে দাও। মা তখন আমাকে আলেকজান্ডার বেলায়েভের উভচর মানুষ কিনে দিলেন। অ্যাডভেঞ্চারের প্রতি তখন একটা নেশা হয়ে গিয়েছিল। উভচর মানুষ পড়ার পর থেকে সায়েন্স ফিকশনের প্রতি আমার দুর্বলতা কাজ করতে শুরু করে।

১৯৭২ সালের কথা। আমি পড়তাম মুসলিম হাইস্কুলে, ভিক্টোরিয়া পার্কের পাশে ছিল স্কুলটা। আম্মা মাঝেমধ্যে আমাকে নিয়ে বাংলাবাজার যেতেন। বাংলাবাজারে তখন এত দোকান ছিল না। হাতে গোনা কয়েকটা টিনশেড বইয়ের দোকান ছিল। এখন যেখানে বড় বিল্ডিং হয়েছে, পাবলিকেশনস হয়েছে, ওখানে তখন টিনশেড ছিল। ওখান দিয়ে যাওয়ার সময় একদিন দেখলাম, ফুটপাতে প্রচুর বইয়ের দোকান। ওখানে ধূমকেতু নামে একটা বই পেলাম। প্রচ্ছদে রকেট, চাঁদ এসবের ছবি। দেখেই বুঝতে পারলাম, এটা সায়েন্স ফিকশন। আম্মাকে বললাম, এটা কিনে দাও। মা বললেন, ‘এসব বই কেনা লাগবে না।’ কিন্তু আমার তো বইয়ের নেশা ধরে গেছে। টিফিনের ফাঁকে দৌড়ে সেখানে যাই, টিফিনের টাকা দিয়ে বই কিনি। স্কুলে থাকতে আমি স্কুলের লাইব্রেরিতে যেতাম। স্কুলের পাশেই ছিল স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্স। রাশিয়া থেকে ওরা বই নিয়ে আসত। আমরা গোডাউনের ভেতরে চলে যেতাম। যে বই পছন্দ হতো, নিয়ে নিতাম। আমার এক বন্ধু ছিল। ওকে বললে ও বই ম্যানেজ করে দিত। জলপাইয়ের আচার খাওয়াতে হতো আরকি (হাসি)। এভাবে ধীরে ধীরে সায়েন্স ফিকশনের প্রতি আকৃষ্ট হলাম।

নীলক্ষেতে কিছু সায়েন্স ফিকশনের বই পাওয়া যেত। তখন বাংলাদেশি সায়েন্স ফিকশন লেখার ধারা অত জোরদার হয়নি। আমি তখনো হুমায়ূন আহমেদের বই পড়া শুরু করিনি। আমার এক বন্ধু এর মধ্যে খবর দিল, থ্রিল খুঁজতে চাইলে মাসুদ রানা, কুয়াশা পড়া শুরু কর। ওগুলো পড়া শুরু করলাম। ১৯৯৫ বা ৯৬ সালের আগে নীলক্ষেতের কল্যাণে শ–খানেক সায়েন্স ফিকশনের ইংরেজি বই চলে এল আমার হাতে। এখন আমার কাছে বড় একটা সায়েন্স ফিকশন ম্যাগাজিনের সংগ্রহও আছে।

হাবীব ভাই একদিন আমার বাসায় এলেন। আমার সংগ্রহ দেখে তাঁর মাথা চক্কর খেয়ে গেল! বাংলাদেশে হুমায়ূন আহমেদ আর জাফর ইকবাল ছাড়া তখন কেউ সায়েন্স ফিকশন লিখতেন না তেমন।
বিজ্ঞানচিন্তা:

দেশের প্রথম সায়েন্স ফিকশন ম্যাগাজিন মৌলিক–এর যাত্রা শুরু হলো কীভাবে?

হাসান খুরশীদ রুমী: ১৯৯৬–৯৭ সালের কথা। রম্য লেখক আহসান হাবীব ভাইয়ের ‘দিনরাত্রি’ নামে একটা প্রকাশনী ছিল। একদিন আমার বাসায় আনোয়ার সাদাত নামে একজন বুয়েটছাত্র এলেন। বললেন, ‘আপনার একটা সায়েন্স ফিকশন গল্প লাগবে। কাজী আনোয়ার হোসেন বলেছেন, আপনার সায়েন্স ফিকশনের প্রতি আগ্রহ আছে।’ আমার কাছে মৌলিক একটা গল্প চাইলেন। আমি তো মৌলিক গল্প লিখি না। সেবা প্রকাশনী থেকেও আমার একটা বই বেরিয়ে গেছে তত দিনে। কাজীদা আমাকে খুব আদর করতেন। আত্মীয় ছিলেন তিনি। ওনার দুই ছেলে আমাকে মামা ডাকেন। তখন আমি কিশোর পত্রিকায় কাজ করতাম। যা–ই হোক, আমি তাঁকে বললাম, ভাই আমি তো মৌলিক লিখি না। অ্যাডাপ্ট করে দিতে পারি। আনোয়ার সাদাত তাতেই রাজি হলেন। এরপর বই বেরোল। আমি মেলায় গেলাম। সেখানে আহসান হাবীব ভাইয়ের সঙ্গে প্রথম দেখা। স্টলটা দিনরাত্রি প্রকাশনীর।

বললাম, ভাই আমার সায়েন্স ফিকশন গল্প এই বইয়ে আছে। আমি কি লেখক কপি পাব? উনি (মজা করে) বললেন, ‘না। আপনাকে কিনতে হবে। মেলা শেষে এসে লেখক কপি নেবেন।’ আমি সঙ্গে সঙ্গে দুই কপি কিনি। মেলার শেষ দিকে গেলে হাবীব ভাই লেখক কপি তুলে দেন আমাকে।

পরের বছর আনোয়ার সাদাত আবার এলেন। বললেন, ‘আপনার আরেকটা গল্প লাগবে।’ বললাম, আমার গল্প তো দেবই, সঙ্গে আরও কয়েকজনের লেখা দেব। উনি রাজি হলেন। আমি সম্ভবত একসঙ্গে চার–পাঁচটা গল্প দিয়েছিলাম। আবার বই বের হলো। মেলায় গেলাম। হাবীব ভাই আবার একই কাজ করলেন। আমি আবার দুই কপি কিনলাম। এরপর হাবীব ভাই জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি থাকেন কোথায়?’ বললাম, ক্যান্টনমেন্ট। উনি বললেন, ‘আপনি কি খুব সায়েন্স ফিকশন পড়েন?’ বললাম, জি পড়ি। আনোয়ার সাদাত আমার বাসায় গেছেন। উনি দেখেছেন, আমার সায়েন্স ফিকশনের কালেকশন।

তারপর হাবীব ভাই বললেন, ‘আপনি স্টলের ভেতরে আসেন।’ এই প্রথম উনি আমাকে ভেতরে ডাকলেন। এমনভাবে কথা বলতে শুরু করলেন যেন অনেক দিনের পরিচিত আমরা।

জিজ্ঞেস করলেন, ‘চা খাবেন?’ আমি দুধ–চা খাই না। কিন্তু সেদিন দুই কাপ খেয়ে ফেললাম। তারপর বললেন, ‘আমার সঙ্গে আপনি পরে দেখা করতে পারবেন? উন্মাদ অফিসে আসবেন মেলার পর।’ এভাবে উন্মাদ-এ কিছুদিন কাজ করলাম। তারপর একদিন ডেকে বললেন, ‘ভাই কিছু মনে করবেন না। আমার এক বন্ধুর কাছ থেকে একটা পত্রিকা পেয়েছি। একটা সিনে পত্রিকা, নাম মৌলিক। ওটা নাকি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ওরা আর বের করবে না।’ এখন আমি মৌলিক নাম ঠিক রেখে যেকোনো বিষয়ের ওপর পত্রিকা বের করতে পারি। তখনই আমার মাথায় এল, সায়েন্স ফিকশন পত্রিকা বের করলে কেমন হয়। কারণ, এটা বাংলাদেশে নেই।

হাবীব ভাই একদিন আমার বাসায় এলেন। আমার সংগ্রহ দেখে তাঁর মাথা চক্কর খেয়ে গেল! বাংলাদেশে হুমায়ূন আহমেদ আর জাফর ইকবাল ছাড়া তখন কেউ সায়েন্স ফিকশন লিখতেন না তেমন। তার মানে আমরা মৌলিক সায়েন্স ফিকশন খুব কম পাব। আমাদের অনুবাদ আর অ্যাডাপ্টশন করতে হবে। এভাবে আমার সায়েন্স ফিকশন পত্রিকা মৌলিক-এর জগতে ঢোকা।

বিজ্ঞানচিন্তা:

এখন সায়েন্স ফিকশনের অনেক কিছু বাস্তব হয়ে উঠছে। এআই বাস্তব হয়ে উঠেছে, মানুষ মঙ্গলে যাওয়ার চেষ্টা করছে। আপনার কি মনে হয়, এআই বা রোবট পৃথিবী দখল করে নেবে?

হাসান খুরশীদ রুমী: এআই বা রোবটের বিশ্ব জয় করার ধারণা সায়েন্স ফিকশনের একটি জনপ্রিয় বিষয়। কিন্তু বাস্তবতার সঙ্গে কল্পনার পার্থক্য করা জরুরি। যদিও এআই ও রোবোটিকস দ্রুত উন্নতি করছে, এগুলো এখনো মানুষের তৈরি এবং নিয়ন্ত্রিত সরঞ্জাম। এআই ও রোবট ডিজাইন করা হয়েছে সাহায্য করার জন্য, প্রক্রিয়াগুলোকে দাঁড় করার জন্য এবং নির্দিষ্ট কাজ সম্পাদনের জন্য। কাজে দক্ষতা বাড়ানো ছাড়া এদের নিজস্ব কোনো ইচ্ছা বা আকাঙ্ক্ষা নেই। তা ছাড়া এর নৈতিক ব্যবহার নিয়ে প্রচুর কাজ হচ্ছে, এর অপব্যবহার রোধ করতে নিরাপত্তাব্যবস্থা এবং নিয়মকানুন তৈরি হচ্ছে। দিন শেষে সব মানুষের হাতেই নিয়ন্ত্রিত হবে। মানব সম্প্রদায় নিশ্চয়ই তার নিজের অস্তিত্ব সংকটের মুখে ফেলবে না।

বিজ্ঞানচিন্তা:

কলেজে পড়ার সময় আপনি কাজী আনোয়ার হোসেনের কাছে যান, সেবা প্রকাশনীতে কাজ করেন। তাঁর কথা ইতিমধ্যে একবার বলেছেন। সেখান থেকে আপনার প্রথম সায়েন্স ফিকশন প্রকাশিত হয়। সেবায় আপনি দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। সেই অভিজ্ঞতা কেমন? কীভাবে শুরু করেছিলেন?

হাসান খুরশীদ রুমী: ১৯৭৬ সালে আমি কাজীদার কাছে যাই। আমার খালাতো ভাইয়ের সঙ্গে কাজীদার ভালো সম্পর্ক ছিল। তা ছাড়া পারিবারিক একটা সম্পর্ক ছিল আমাদের। আমি সাহস নিয়ে কাজীদার কাছে গিয়েছিলাম। বললাম, আমি অনুবাদ করতে চাই। জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কী অনুবাদ করবা?’ আমি একটা নমুনা লেখা নিয়ে গিয়েছিলাম। তখন কাঁচা হাতের লেখা আমার। দেখে বলেছিলেন, ‘দুই দিন পরে এসো।’ গেলাম দুদিন পর। জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কী করো?’ বললাম, ইন্টারমিডিয়েটে পড়ি। বললেন, ‘শোনো, তোমার ব্যাপারে আমি জানি।’ আমি কিন্তু তখনো আমার পরিচয় দিইনি। অবাক হলাম, জানলেন কী করে? এই দুদিনে আমার ব্যাপারে খোঁজ নিয়েছেন? মাসুদ রানাকে লাগিয়ে দিয়েছিলেন মনে হয় (হা হা হা)। পরে জেনেছিলাম, আমার খালাতো ভাই তাঁকে জানিয়ে দিয়েছিলেন। যাহোক, উনি বললেন, ‘তোমাকে আমি চিনি। এখন এগুলো বাদ দাও। পড়ালেখা শেষ করো। তারপর আমার সঙ্গে দেখা করো।’

কাজীদার সামনে গেলে কেন যেন ঘেমে যেতাম। একটা ভয় কাজ করত। কোনো সময় ভাবিনি তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলব, ছবি তুলব। সেবা প্রকাশনীতে তো আমার যাওয়ার কথা ছিল না। গিয়েছি। ভাগ্য নিয়ে গেছে আমাকে।

এর পর থেকে আমি সায়েন্স ফিকশন গল্প পড়ি আর অনুবাদ করি। একদিন সেগুলো জমা দিলাম সেবায়। কাজীদা এডিট করে দিলেন। রাত জেগে জীবনের প্রথম প্রচ্ছদ বানালাম। কাজীদাকে দেখালাম, উনি পছন্দ করলেন। বললেন, ‘চেষ্টা করে যাও।’ সেবা থেকে আমার প্রথম বই বের হয় আমার করা প্রচ্ছদে। ১৯৯২ সালের দিকের ঘটনা এটা। এরপর আমাকে একদিন ডেকে রয়্যালটির টাকা দিলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘এরপর কী করবে?’ বললাম, কিছু ভাবিনি। তখন মাসিক কিশোর পত্রিকার সঙ্গে নেশার মতো জড়িয়ে গেছি। প্রতিদিন সকালে বের হতাম আর দুপুরে ফিরতাম। কিশোর পত্রিকার জন্য তখন লিখছি, কাজ করছি, কমিকস অনুবাদ করছি। লেখক সুমন্ত আসলাম তখন কিশোর পত্রিকায় এসে লেখা দিয়ে চলে যেতেন। একদিন কাজী শাহনূর হোসেন আমাকে একটা বইয়ের প্রচ্ছদ করতে বলল। রাত জেগে প্রচ্ছদ করে কাজীদাকে দেখালাম। মাঝেমধ্যে উনি কিছু ঠিক করে দিতেন। আমাকে পাঁচ মিনিটের মধ্যে সব বুঝিয়ে, শিখিয়ে দিতেন। তখন আমি কিশোর পত্রিকার পাশাপাশি পুরোদমে প্রচ্ছদ করে যাচ্ছি। কখনো কখনো কাজীদা প্রচ্ছদ দেখে বলতেন, ‘বুলস আই’; কখনো বলতেন, ‘স্বপ্ন তুলে এনেছ।’

বিজ্ঞানচিন্তা:

‘উন্মাদ’ বাংলাদেশের যেকোনো ম্যাগাজিন থেকে একটু ভিন্নধর্মী। এখানে আপনার কাজের অভিজ্ঞতা কেমন?

হাসান খুরশীদ রুমী: আমার অভিজ্ঞতা মজার। কারণ, হাবীব ভাই অনেক মজার মানুষ। আমাদের দুজনের কাছে দুটি চাবি থাকত। যে আগে যেত, সে গিয়ে অফিস খুলত। উন্মাদ-এ থাকতেই মৌলিক ম্যাগাজিন বের করতাম আমরা। টাকার অভাবে বন্ধ হওয়ার পর আমি আর কী করব! তখন হাবীব ভাই বললেন উন্মাদ-এ কাজ করতে। কিন্তু আমি ওখানে কী করব? হাবীব ভাই বললেন বিদেশি হাসির গল্প অনুবাদ করতে। একদিন হাবীব ভাইকে বললাম, ভাই আমি আর এভাবে লিখতে পারব না। ওদের উইটটা (রসিকতা বোধ) আমি ঠিক ধরতে পারছি না। তখন অন্য একজনকে এই দায়িত্ব দেওয়া হলো। পরে আমি কোলাজ ওয়েস্টার্ন কমিকস নিয়ে কাজ করেছি টানা দুই বছর। কোলাজ ওয়েস্টার্ন নিয়ে পরে একটা সংকলনও করেছে উন্মাদ।

দুই দিন পর হুমায়ূন ভাই আমাকে ফোন করলেন। বললেন, ‘আমার বসায় আসো। তোমার নামের বানান ঠিক করতে হবে।’ ওনার বাসায় গিয়ে দেখি, আমাকে বই উৎসর্গ করছেন।
বিজ্ঞানচিন্তা:

হুমায়ূন আহমেদের একটা সায়েন্স ফিকশন গল্পের বইয়ের সঙ্গে আপনি জড়িত ছিলেন। আপনাকে সেই বই উৎসর্গ করেছিলেন তিনি। এত বড় একজন লেখকের সঙ্গে কাজ করতে কেমন লেগেছে?

হাসান খুরশীদ রুমী: সে সময় হাবীব ভাইয়ের সঙ্গে আমার ১৫ বছরের কাজের অভিজ্ঞতা থাকলেও হুমায়ূন ভাইয়ের সঙ্গে ছিল না। একদিন উন্মাদ অফিসে গিয়ে শুনলাম, হুমায়ূন ভাইয়ের পা কেটে গিয়ে সম্ভবত ঘা হয়ে গেছে। হুমায়ূন ভাই হাবীব ভাইকে বললেন, তাঁর জন্য কোনো ডাক্তার থাকলে পাঠিয়ে দিতে। তখন উন্মাদ–এর ডা. কল্লোল (মিজানুর রহমান কল্লোল) বসা ছিল। উন্মাদ-এ আবার ডাক্তারের অভাব ছিল না। ডা. কল্লোল আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘যাবেন নাকি?’ গেলাম ওর সঙ্গে। অবসর থেকে বের হওয়া সায়েন্স ফিকশন অমনিবাস আমার সঙ্গে ছিল। ডা. কল্লোল তাঁকে দেখে ওষুধ দিয়ে আসার সময় হুমায়ূন ভাইকে বইটা দিয়ে চলে এলাম। পাঁচ বছর পর প্রগতি পাবলিশার্সের কর্মকর্তা আবরার মাসুদ হুমায়ূন ভাইয়ের সূর্যের দিন থেকে কমিকস বের করতে চাইলেন। হুমায়ূন ভাইয়ের অনুমতিতে হাবীব ভাই আঁকলেন।

ফাইনালি তাঁকে দেখানোর জন্য যাওয়ার সময় আমি গেলাম সঙ্গে। আমার সঙ্গে তখন হুমায়ূন আহমেদের ছয়টা সায়েন্স ফিকশন আর ফ্যান্টাসি গল্পের ফটোকপি ছিল। আমি ব্যাগ থেকে ওগুলো বের করার জন্য চেইন খুলতে যাব, এর মধ্যে হুমায়ূন ভাইয়ের বডিগার্ড পিস্তল বের করে ফেলল! দেখি, আমার দিকেই ধরা। তখন হুমায়ূন ভাই তাকে ধমক দিয়ে ঘর থেকে বের করে দেন। আমি ফটোকপি দেখাই। তাঁকে জানাই যে এই গল্পগুলো দিয়ে একটা সায়েন্স ফিকশন বই বের করলে ভালো হয়। সঙ্গে হয়তো আরও ছয়টা লিখতে হবে। উনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এগুলো সব কি সায়েন্স ফিকশন গল্প?’ বললাম, না, তিনটা সায়েন্স ফিকশন আর তিনটা ফ্যান্টাসি। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার নিজের পাবলিকেশন আছে?’

বললাম, না। উনি বললেন, ‘তোমার পাবলিকেশন থাকলে এই বইটা তোমাকে দিতাম। কারণ, আমাকে কেউ কোনো দিন এমন কথা বলেনি।’ তখন আমার পাশে আবরার মাসুদ বসা, আমি তার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। আসার সময় বলে এলাম, আপনার এই বইয়ের প্রথম ক্রেতা কিন্তু আমি হব।

এরপর তিন দিন পর আমার টিঅ্যান্ডটি নম্বরে একটা কল এল। কল ধরার পর থেকে আমি একবার বসি, আর একবার দাঁড়াই। ঘাম গড়িয়ে পড়ছে। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি ভালো আছ?’ বললাম, জি ভাই। আপনি ভালো আছেন? বললেন, ‘তুমি তো আমাকে ভালো থাকতে দিচ্ছ না। আমি তো তিনটা গল্প লিখে ফেলেছি। তুমি একটা প্রচ্ছদ বানিয়ে দাও। প্রচ্ছদ নিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করো।’ আমি বলেছিলাম, আমি তো আঁকতে পারি না। বললেন, ‘তোমার বইয়ের প্রচ্ছদ তুমি যেভাবে, অর্থাৎ কোলাজ করবে।’

যাহোক, আমি এক বসায় ১৪টা প্রচ্ছদ করেছিলাম। তিন দিন পর সব কটি প্রচ্ছদ সিডিতে নিয়ে ওনাকে ফোন দিলাম। আমার ফোন পেয়ে তিনি আবার অনেককে ফোন দিয়েছেন এই প্রচ্ছদ দেখানোর জন্য। খুব এক্সাইটেড ছিলেন। প্রকৃতি লেখক মোকারম হোসেনকেও সঙ্গে নিয়ে গেলাম। একটার পর একটা দেখে গেলেন। তারপর সেখান থেকে একটা বাছাই করলেন। বইয়ের নাম দিলেন, অঁহক সায়েন্স ফিকশন গল্পমালা। পরে আবার নাম পরিবর্তন করেছেন। শুধু অঁহক।

দুই দিন পর হুমায়ূন ভাই আমাকে ফোন করলেন। বললেন, ‘আমার বসায় আসো। তোমার নামের বানান ঠিক করতে হবে।’ ওনার বাসায় গিয়ে দেখি, আমাকে বই উৎসর্গ করছেন। আমি তো অবাক। কারণ, চার দিনের পরিচয় আমাদের। এরপর বই বের হলে ওনার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। জিজ্ঞেস করলেন, ‘কাভারের টাকা নিয়েছ?’ বললাম, না। উনি একটা ড্রয়ার খুলে টাকা বের করে হাতে যা আসে, দিয়ে দিলেন। নিতে চাচ্ছিলাম না। বললাম, এই প্রচ্ছদ আমি আপনাকে গিফট করেছি।

বিজ্ঞানচিন্তা:

হুমায়ূন আহমেদ ও মুহম্মদ জাফর ইকবাল, দুজনই বাংলাদেশের অন্যতম সেরা বিজ্ঞান কল্পকাহিনি লেখক। আপনার মতে, দুজনের মধ্যে কে সেরা?

হাসান খুরশীদ রুমী: হুমায়ূন আহমেদ। কারণ, উনি সফটকোর সায়েন্স ফিকশন লেখেন। আর মুহম্মদ জাফর ইকবাল হার্ডকোর সায়েন্স ফিকশন লেখেন, ওনার বেশির ভাগ কাজ মহাকাশ নিয়ে।

এখন পর্যন্ত বিশ্বমানের সায়েন্স ফিকশন না লিখতে পারলেও কাছাকাছি হচ্ছে। সায়েন্স ফিকশনের মতো আমাদের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে।
বিজ্ঞানচিন্তা:

বাংলাদেশে মৌলিক বিজ্ঞান কল্পকাহিনি সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী? আমরা কি বিশ্বমানের সাই–ফাই লিখতে পারছি?

হাসান খুরশীদ রুমী: আগের তুলনায় অনেক এগিয়েছে। আমরা যখন মৌলিক বের করেছিলাম, তখনকার তুলনায় অনেকটা এগিয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত বিশ্বমানের সায়েন্স ফিকশন না লিখতে পারলেও কাছাকাছি হচ্ছে। সায়েন্স ফিকশনের মতো আমাদের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে। অবশ্যই আমরা একদিন বিশ্বমানের সায়েন্স ফিকশন লিখতে পারব। আমাদের নিজেদের মেধা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

বিজ্ঞানচিন্তা:

বর্তমানে ভালো মৌলিক সায়েন্স ফিকশন কারা লিখছেন বলে মনে করেন?

হাসান খুরশীদ রুমী: অনেকেই লিখছেন। তাঁদের মধ্যে দীপেন ভট্টাচার্য আছেন, শিবব্রত বর্মন, মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম, তানজিনা হোসেন, মুস্তফা তানিম, মাশুদুল হক, তানজিম রহমানসহ অনেকেই আছেন।

বিজ্ঞানচিন্তা:

আমাদের ধারণা, একটা দেশের সায়েন্স ফিকশনের মান দেখে বোঝা যায়, সে দেশের বৈজ্ঞানিক বা প্রযুক্তিগত অগ্রগতি কোন পর্যায়ে রয়েছে। আপনি কী মনে করেন, সায়েন্স ফিকশন ও বিজ্ঞান বা প্রযুক্তির আদৌ কি কোনো সম্পর্ক আছে?

হাসান খুরশীদ রুমী: সায়েন্স ফিকশন এবং দেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে সম্পর্ক কিছুটা হলেও আছে। বিজ্ঞান বা সায়েন্স ফিকশনের চর্চা যেখানে বেশি হবে, সেখানে বিজ্ঞান নিয়ে কল্পনার পরিধিও বিস্তৃত হবে, এটাই স্বাভাবিক।

ফাউন্ডেশন সিরিজ আমার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করেছে দারুণভাবে। মানবজাতির ভবিষ্যতের এক মহাকাব্য বলা যায় এটাকে।
বিজ্ঞানচিন্তা:

কোনো বই পড়ে কি আপনার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গিয়েছিল?

হাসান খুরশীদ রুমী: ফাউন্ডেশন সিরিজ আমার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করেছে দারুণভাবে। মানবজাতির ভবিষ্যতের এক মহাকাব্য বলা যায় এটাকে। সিরিজের বিভিন্ন বই এখনো মাঝেমধ্যে পড়ি সময় পেলে। পড়তে গিয়ে মনে আশা হয়, আমরা হয়তো টিকেই যাব এই মহাবিশ্বে। হয়তো নিজেরা নিজেদের ধ্বংস করে ফেলার যে ভয়ানক আশঙ্কা করেন ভবিষ্যৎ বক্তারা, সেটাকে হয়তো আমরা পার করে একটা মাল্টিসোলার কিংবা কে জানে, হয়তো গ্যালাকটিক সভ্যতা গড়ে তুলতে পারব।

বিজ্ঞানচিন্তা:

বিজ্ঞানচিন্তার বেশির ভাগ পাঠক কিশোর ও তরুণ। তাদের উদ্দেশে কী বলবেন?

হাসান খুরশীদ রুমী: বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য একটাই কথা, পড়ো, পড়ো, পড়ো। আশপাশে যা পাবে পড়ে ফেলো। তারপর ভালোটা গ্রহণ করো, খারাপটা ছুড়ে ফেলে দাও। দিন শেষে একজন মানবিক বুদ্ধিমান মানুষ হয়ে ওঠো।

অনুলিখন: অনিক রয়, প্রাক্তন শিক্ষার্থী, তিতুমীর কলেজ, ঢাকা