জানা-অজানা
আসল চা, নাকি নকল চা
চা পছন্দ করেন না, এমন কাউকে বোধ হয় খুঁজে পাওয়া যাবে না। অনেকেরই দিন শুরু হয় চা খেয়ে। নামের সঙ্গে 'চা' শব্দটা থাকলে সব সময় সেটি আসল চা না-ও হতে পারে। বাজারে নকল চা-ও পাওয়া যায়। তবে চায়ের বিশেষ কিছু গুণ আছে। সেসব গুণের সুফল পেতে হলে আসল চা সম্পর্কে জানা জরুরি। কী থাকে চায়ে? জেনে নিন...
চা অপেক্ষাকৃত কম ক্যালরিযুক্ত নিরাপদ বিশুদ্ধ পানীয়। এতে চর্বি বা ফ্যাট নেই। তবে পটাশিয়ামসমৃদ্ধ। এটি মুহূর্তেই সজীবতা আনে, ঝিমানো ভাব দূর করে, মনঃসংযোগ বাড়ায়, চিন্তাশক্তি জাগ্রত করে। ক্যানসার ও হৃদ্রোগের ঝুঁকি কমায়। মাত্র ১৭০ মিলিলিটারের এক কাপ চা প্রতিদিনের অ্যান্টি-অক্সিডেন্টের চাহিদার উল্লেখযোগ্য অংশ সরবরাহ করতে পারে। চা সামাজিক বন্ধন ও বন্ধুত্বের প্রতীক। অন্য কোনো পানীয় এত সহজে মানুষকে আপন করে নিতে পারে না।
চায়ের প্রেমে মানুষ আদিকাল থেকে মজে আছে। শতসহস্র স্তুতিবাক্য, গল্প, কবিতা, উপন্যাস, গবেষণাকর্মে চা একটি প্রধান উপজীব্য। জাপানে চা পান অনুষ্ঠান তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের মতোই ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে পালিত হয়। মার্কিন মনোবিদ মার্ক তুলিনের ভাষায়, ‘ইট ইজ লিগ্যাল ইন এভরি স্টেট অ্যান্ড মেকস আ বেটার পারসন উইদাউট আননেসেসারি সাইড ইফেক্ট।’
ঘটনাটি খ্রিষ্টপূর্ব ২৭৩৭ সালের। চীনা সম্রাট শেন নাং ঘুরতে বেরিয়েছিলেন লোকলস্কর নিয়ে। একদিন রাস্তার পাশে যাত্রাবিরতি করেছিলেন তিনি। কেটলিতে তাঁর জন্য গরম পানি ফুটছিল। এ সময় পাশের জঙ্গল থেকে বাতাসে কয়েকটি শুকনা পাতা এসে পড়ে গরম পানির কেটলিতে। চমত্কার নির্যাস এবং ঘ্রাণে মোহিত হয়ে সম্রাট সেই পানি পান করেন। সঙ্গে সঙ্গে দেহমনে আসে সজীবতা ও প্রশান্তি। বলা হয়, শেনের ওই আবিষ্কার মানবজাতিকে চা উপহার দিয়েছিল।
চায়ের ইতিহাস নিয়ে একটি গল্প প্রচলিত আছে। ঘটনাটি খ্রিষ্টপূর্ব ২৭৩৭ সালের। চীনা সম্রাট শেন নাং ঘুরতে বেরিয়েছিলেন লোকলস্কর নিয়ে। একদিন রাস্তার পাশে যাত্রাবিরতি করেছিলেন তিনি। কেটলিতে তাঁর জন্য গরম পানি ফুটছিল। এ সময় পাশের জঙ্গল থেকে বাতাসে কয়েকটি শুকনা পাতা এসে পড়ে গরম পানির কেটলিতে। চমত্কার নির্যাস এবং ঘ্রাণে মোহিত হয়ে সম্রাট সেই পানি পান করেন। সঙ্গে সঙ্গে দেহমনে আসে সজীবতা ও প্রশান্তি। বলা হয়, শেনের ওই আবিষ্কার মানবজাতিকে চা উপহার দিয়েছিল। তিনি চায়ের বিভিন্ন ভেষজ গুণ সম্পর্কে পরীক্ষা-নিরীক্ষাও চালান। তাঁর এবং দ্য হারবাল ক্যানন অব শেন নাং শিরোনামের বইয়ে উল্লেখ করেন, চায়ের নির্যাস ৭২ ধরনের বিষকে নির্বিষ করার ক্ষমতা রাখে।
চা-গাছ একটি বহুবর্ষজীবী চিরসবুজ মাঝারি আকৃতির ঝোপাকৃতি বৃক্ষ। এর বৈজ্ঞানিক নাম Camellia sinensis L.। পৃথিবীর সব চা-গাছ একই প্রজাতিভুক্ত। তবে এ প্রজাতির কিছু ভ্যারাইটি আছে। চা-গাছের পাতা সরল, একান্তর, কিনারা খাঁজকাটা। ফুল সম্পূর্ণ, উভলিঙ্গ। বৃত্যাংশ পাঁচটি, দলাংশ পাঁচটি, পুংকেশর অসংখ্য, পরাগধানী দ্বিকোষী, গর্ভাশয় অধিগর্ভ।
ক্রোমোজোম ডিপ্লয়েড (2n=30)| পর পরাগায়ন কার্যকর, স্বপরাগায়ন সার্থক হয় না। চায়ের কচি পাতা থেকেই চা তৈরি হয়। ‘দুটি পাতা একটি কুঁড়ি’ সংগ্রহ করে চা–কারখানায় চা তৈরি হয়। প্রাচীনকালে উঁচু চা-গাছ থেকে বানরের সাহায্যে পাতা সংগ্রহ করা হতো। কালক্রমে চা-গাছকে নির্দিষ্ট উচ্চতায় ছাঁটাই করে ঝোপালো করার চল তৈরি হয়। এতে চা-পাতা সংগ্রহ যেমন সহজ হয়েছে, তেমনি উত্পাদনশীলতা ও গুণগত মানও বেড়েছে।
চা-পাতা সংগ্রহ চা-শিল্পে সবচেয়ে শ্রমসাধ্য কাজ। নারী চা-শ্রমিকেরা পরম যত্নে টিলায় টিলায় দল বেঁধে কাজটি করেন এবং তারপর মাথায় করে বা ট্রাক্টরের সাহায্যে তা চা কারখানায় নিয়ে আসা হয়। কারখানায় চা তৈরির একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া চলে। এ প্রক্রিয়ায় আছে উইদারিং, রোলিং, ফার্মেন্টেশন, ড্রাইং, গ্রেডিং ইত্যাদি। প্রতিটি ধাপে অসাধারণ দক্ষতা, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা ভালো চা তৈরির পূর্বশর্ত।
ইদানীং নকল চায়ের সংস্কৃতি শুরু হয়েছে। বিভিন্ন পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে বলা হচ্ছে, পাটপাতা থেকে নাকি চা উত্পাদিত হচ্ছে। তা ছাড়া তেজপাতা চা, এলাচি চা, মরিচ চা, পুদিনা চা ইত্যাদি কত নামে যে ‘চা’ বিক্রি হচ্ছে, তার ইয়ত্তা নেই। দোকানের শেলফে প্যাকেটজাত বিভিন্ন অদ্ভুত চায়ের সমাহার। ক্রেতার পক্ষে তাই প্রতারিত হওয়া খুবই স্বাভাবিক। চা-পিয়াসীদের তাই আসল চা চিনে কিনে নিতে হবে। তা না হলে চায়ের অসাধারণ উপকারিতা থেকে আমরা বঞ্চিত হব। এ ছাড়া চা-শিল্পে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে, আসল চা বিক্রি কমে যেতে পারে। এ বাস্তবতায় চায়ের প্রচার এবং প্রসারে যত্নবান হওয়ার পাশাপাশি চা নামের শিল্পটিকে টিকিয়ে রাখা যেতে পারে। কারণ, আমরা সবাই আসল চা পান করতে চাই, নকল চা নয়।
লেখক: সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট