রোগমুক্ত পৃথিবী গড়া সম্ভব?

১৯৮০ সাল। প্রায় তিন হাজার বছরের পুরোনো প্রাণঘাতী এক রোগ পৃথিবী থেকে নির্মূল হলো। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সগৌরবে ঘোষণা করল, আজ থেকে সারা বিশ্বে গুটিবসন্ত রোগের কোনো অস্তিত্ব নেই! পৃথিবীর হাতে গোনা কয়েকটি দেশের ল্যাবরেটরি ছাড়া গুটিবসন্ত রোগের জীবাণুর বিলুপ্তি ঘোষিত হলো। নিতান্তই গবেষণার জন্য এগুলো কয়েকটি ল্যাবে সংরক্ষণ করা আছে।

১৯৭৭ সালে শেষবার সোমালিয়ায় গুটিবসন্তে আক্রান্ত রোগীর খোঁজ পাওয়া যায়। ১৯৭৫ সালের পর বাংলাদেশেও আর গুটিবসন্ত দেখা যায়নি। বাংলাদেশের শিশু রহিমা বানুর দেহে বিশ্বের সর্বশেষ প্রাকৃতিকভাবে ঘটা ভ্যারিওলা মেজর গুটিবসন্ত দেখা যায়। গুটিবসন্তের পর পৃথিবী থেকে আর একটিমাত্র রোগ নির্মূল হয়েছে—রাইন্ডারপেস্ট। ২০১১ সালে রোগটির বিলুপ্তি ঘোষণা করা হয়। তবে রাইন্ডারপেস্ট গবাদিপশুর রোগ। গুটিবসন্ত থেকে মুক্তির চার দশক পরও এখন পর্যন্ত মানবদেহের আর কোনো রোগ নির্মূল করা সম্ভব হয়নি।

সংক্রামক রোগ ছাড়া পৃথিবীতে আরও নানা ধরনের রোগ রয়েছে। রোগের জীবাণুতত্ত্ব আবিষ্কারের পরে সংক্রামক রোগের নিয়ন্ত্রণ অনেকাংশে মানুষের হাতের মুঠোয় চলে আসে। তখন বাধা হয়ে দাঁড়ায় এমন কিছু রোগ, যেগুলোর জন্য নির্দিষ্ট কোনো জীবাণু দায়ী নয়। এই রোগগুলোর পেছনে উঠে আসে জিনগত, পুষ্টিবিষয়ক, মনস্তাত্ত্বিক, জীবন যাপনের ধরনসহ নানা কারণ। ডায়াবেটিস, হৃদ্‌রোগ, ক্যানসারসহ এ ধরনের রোগের সংখ্যা প্রচুর। আধুনিক বিশ্বে এ রোগগুলোর নানা প্রতিকার আবিষ্কৃত হলেও এগুলোকে একেবারে নির্মূল করা সম্ভব হয়নি।

ডায়াবেটিস ও হৃদ্‌রোগে ব্যক্তির জীবনধারা একটি বড় প্রভাবক। পুরো বিশ্বের মানুষ সচেতন হয়ে উঠলে হয়তোবা কখনো এই রোগগুলো নির্মূল করা সম্ভব হবে! কিংবা আধুনিক প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যতে হয়তো এ ধরনের রোগ নির্মূল করা যাবে! তবে এটি বেশ তর্কসাপেক্ষ বিষয়। প্রতিনিয়ত আমাদের দেহের প্রতিরক্ষাব্যবস্থায় যেমন পরিবর্তন হচ্ছে, তেমনি রোগের ধরনেও আসছে পরিবর্তন। মিউটেশন, ড্রাগ রেজিস্ট্যান্টসহ জলবায়ুগত নানা পরিবর্তনের জন্য রোগের বিস্তৃতিতে নানা বৈচিত্র্য দেখা যাচ্ছে।

রোগ নির্মূল করা একটি চলমান প্রক্রিয়া। বিজ্ঞান প্রতিনিয়তই রোগ সম্পর্কে নতুন ধারণা দিচ্ছে, বিজ্ঞানীরাও রোগনিয়ন্ত্রণের নতুন নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করে চলেছেন।

কোনো রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য হচ্ছে রোগটি একেবারে নির্মূল করা। বিশ্বের কোনো অঞ্চলেই যখন কোনো একটি রোগের অস্তিত্ব থাকবে না, অর্থাৎ একজন মানুষও আক্রান্ত হবে না, তখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঘোষণা করে যে ওই রোগটি ‘নির্মূল’ (Eradicate) হয়েছে। অন্যদিকে বিশ্বের কোনো একটি বা কয়েকটি ভৌগোলিক অঞ্চলে কোনো রোগের অস্তিত্ব না থাকলে সেটি ‘দূর করা’ (Eliminate) হয়েছে বলা হয়। যেমন পৃথিবীর বেশির ভাগ অংশে মিজলস বা হাম রোগ আর হয় না, তবে তা পৃথিবী থেকে একেবারে নির্মূল হয়ে যায়নি।

রোগ নির্মূল করা একটি চলমান প্রক্রিয়া। বিজ্ঞান প্রতিনিয়তই রোগ সম্পর্কে নতুন ধারণা দিচ্ছে, বিজ্ঞানীরাও রোগনিয়ন্ত্রণের নতুন নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করে চলেছেন। শুধু গুটিবসন্ত নির্মূল হলেও বিজ্ঞানীরা পোলিও, গিনি ওর্ম, মিজলস, মাম্পস ও রুবেলার মতো রোগগুলো অচিরেই নির্মূল করার আশা করছেন।

সংক্রামক রোগের ক্ষেত্রে এর বিস্তার বা সংক্রমণকে ঠেকাতে পারলেই রোগটি নির্মূল করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে টিকা, ওষুধ, এমনকি বিশুদ্ধ পানির ব্যবহারও কোনো রোগ নির্মূলে ভূমিকা রাখতে পারে। তবে তাত্ত্বিকভাবে রোগ নির্মূল যতটা সহজ, বাস্তবে এই কাজ বহুগুণ কঠিন। বিজ্ঞানের সঙ্গে রাজনৈতিক, আর্থসামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক নানা বিষয়ের সম্মিলিত প্রয়াসের মাধ্যমেই কোনো রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।

লেখা: শিক্ষার্থী, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ

*লেখাটি ২০২৫ সালে বিজ্ঞানচিন্তার এপ্রিল সংখ্যায় প্রকাশিত