অপরাধী শনাক্তে ডিএনএ প্রোফাইল

থ্রিলার ছবিতে আমরা প্রায়ই দেখি পুলিশ বা গোয়েন্দা সংস্থা ক্রাইম স্পটে পাওয়া কোনো এভিডেন্স থেকে সংগৃহীত ডিএনএ প্রোফাইল কম্পিউটারে ইনপুট দিচ্ছে আর অমনি ধরা পড়ে যাচ্ছে কে সেই ক্রিমিনাল। মাঝে মাঝে পত্রপত্রিকায়ও আমরা দেখি যে আসামি ধরার জন্য ডিএনএ টেস্ট করার দাবি উঠছে। আসলে কীভাবে ব্যবহার করা হয় এই ডিএনএ প্রোফাইল ম্যাচিং? গোয়েন্দা গল্পে বা সিনেমায় যেমন দেখায়, বাস্তবেও কি এভাবে কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব?

১৯৮৫ সালে লেইসেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের জিনতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক এলেক জেফরি প্রথম একটি টেকনিক আবিষ্কার করেন, যা দিয়ে কোনো ব্যক্তির ডিএনএ প্রোফাইল তৈরি করা যায়। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার হলো যে দুনিয়ায় নানা রঙের নানা চেহারার নানা দেশের মানুষের মধ্যেও শতকরা ৯৯.৯ ভাগ ডিএনএ পরস্পরের সঙ্গে ম্যাচ হয়ে যায়। কিন্তু ওই যে ০.১ শতাংশ ক্ষেত্রে আমরা একে অপরের থেকে আলাদা। ওইটুকু পৃথক সত্তাই যথেষ্ট কাউকে চেনার জন্য। আবার আইডেন্টিকাল টুইন বা যমজদের ক্ষেত্রে ওইটুকু পার্থক্য খুঁজে বের করাও মুশকিল। তো এই কাজ করতে বিজ্ঞানীদের লাগবে কোনো ব্যক্তির সামান্য পরিমাণ রক্ত, লালা, শুক্রাণু, গালের ভেতর থেকে নেওয়া টিস্যু বা দেহের ভেতর থেকে নেওয়া যেকোনো ধরনের তরল পদার্থ। এমনকি ব্যক্তিগত ব্যবহার্য সামগ্রী যেমন টুথব্রাশ, রেজার বা তোয়ালে, জামাকাপড়ে লেগে থাকা শরীর থেকে নিঃসৃত তরল বা পদার্থ হলেও চলবে। ওইটুকু পদার্থ থেকে ডিএনএর রিপিট সিকোয়েন্স করা হয়। এর ফলে যে সিকোয়েন্স পাওয়া যায়, তা কেবল ওই ব্যক্তির আগে সংগৃহীত প্রোফাইলের সঙ্গে বা তার ঘনিষ্ঠ কোনো আত্মীয়র সঙ্গেই ম্যাচ করবে, অন্য কারও সঙ্গে নয়। ধরা যাক, জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার কাছে দেশের সব মানুষের ডিএনএ প্রোফাইল সংরক্ষিত আছে। এখন যেকোনো ক্রাইম সিন থেকে পড়ে থাকা রক্ত বা সিমেন বা একটু চুল নিয়ে সেটা মিলিয়ে দেখা হলো কার সঙ্গে ওটা প্রায় শতভাগ মিলে যায়। ব্যস, আসামি বা ক্রিমিনালটি কে তা খুঁজে বের করতে একটা কম্পিউটার ডেটাবেস থেকে মাত্র কয়েক মিনিটই লাগবে। ডিএনএ প্রোফাইল বের করার সিস্টেম চালু হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন উন্নত দেশের ফরেনসিক সায়েন্স ও ক্রিমিনোলজি বিষয়ের অভূতপূর্ব প্রযুক্তিগত উন্নতি হয়েছে। তাই বলে আমরা যদি আশা করে থাকি যে ডিএনএ মিলিয়ে আমরাও মুহূর্তের মধ্যে আসামিকে ধরে ফেলতে পারব, তাহলে তা হাস্যকরই শোনাবে। কেননা আমাদের কোনো ডিএনএ ডেটাবেস নেই। সংগৃহীত পদার্থের সঙ্গে দেশের ১৬ কোটি মানুষের ডিএনএ ম্যাচিং তো সম্ভব নয়। তবে সন্দেহভাজন কয়েকজনের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা সম্ভব। এখন পর্যন্ত এইটুকুতেই আমাদের ডিএনএ টেস্ট সীমাবদ্ধ হয়ে আছে।

১৯৯২ সালে জন শিনবারগার নামে এক অপরাধী তার ডিএনএ প্রোফাইলকে ধোঁকা দিতে সক্ষম হয়। সব সাক্ষ্য মিলে যাওয়ার পরও ক্রাইম সিনে পাওয়া পদার্থের সঙ্গে জনের ডিএনএ ম্যাচ করতে ব্যর্থ হয় পুলিশ।

ডিএনএ টেস্টকে উপযোগী করে তুলতে বিভিন্ন দেশ নিজস্ব ডেটাবেস গড়ে তুলেছে। সবচেয়ে বড় ডেটাবেস আছে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের কাছে। ২০১৮ সালের মে মাস পর্যন্ত প্রায় ১৩ মিলিয়ন মানুষের কম্বাইন্ড ডিএনএ ইনডেক্স সিস্টেম বা কোডিস সংরক্ষিত আছে তাদের জাতীয় ডেটাবেইসে। ব্রিটেনের জাতীয় ডেটাবেসও বেশ সমৃদ্ধ। ফলে ক্রাইম সিন থেকে প্রাপ্ত ম্যাটেরিয়ালের তথ্যের সঙ্গে মিলিয়ে আসল আসামিকে ধরা তাদের জন্য খুব সহজ হয়ে ওঠে যদি ওই ব্যক্তির তথ্য ডেটাবেসে থেকে থাকে। ইউএস প্যাট্রিয়ট অ্যাক্ট বিল পাস হওয়ার পর অপরাধের সঙ্গে জড়িত আছে এমন যেকোনো সন্দেহভাজন ব্যক্তির ডেটাবেস গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইকে সরবরাহ করতে হবে, এমন আইন পাস হয় যুক্তরাষ্ট্রে। ফলে কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে প্রথমেই এফবিআইয়ের তালিকাভুক্ত ডেটাবেসের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হয়। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ১৯৯৮ সালে শপিং মলে ডাকাতির ঘটনায় একটি লোককে পুলিশ গ্রেপ্তার করে ও নিয়ম অনুযায়ী তার ডিএনএ প্রোফাইল সংরক্ষণ করে রাখা হয়। পরবর্তী সময়ে সেই লোকটি প্রমাণের অভাবে ছাড়াও পেয়ে যায়। কিন্তু ৯ মাস পরে অন্য একটা রেপ ও খুনের মামলার ইনভেস্টিং অফিসার হঠাৎ লক্ষ করেন যে এই লোকের ডিএনএ প্রোফাইল ওই খুনের স্পট থেকে সংগৃহীত একটি চুলের সঙ্গে হুবহু মিলে গেছে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে লোকটিকে আবার গ্রেপ্তার করা হয় এবং এবার সে স্বীকার করে যে এই ডাকাতির ঘটনারও এক বছর আগে সে ওই খুনের সঙ্গে জড়িত ছিল। তাকে বিচারের আওতায় আনা হয়। এই হলো ডিএনএ প্রোফাইলের ম্যাজিক।

তবে ক্রমেই বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার সংস্থা ও সিভিল লিবার্টি গ্রুপগুলো সরকারের প্রতিটি নাগরিকের কাছ থেকে স্যাম্পল নিয়ে প্রোফাইল তৈরি করার বিরুদ্ধে কথা বলতে শুরু করেছে। তাদের চাপাচাপিতেই প্রটেকশন অব ফ্রিডম অ্যাক্ট বিল পাস হয়, যাতে বলা হয় যে নিরপরাধ প্রমাণিত হলে এফবিআইয়ের লিস্ট থেকে সেই ব্যক্তির প্রোফাইল মুছে ফেলতে হবে। নইলে একজন নিরপরাধ ব্যক্তিকে সারা জীবনই হয়রানির সম্মুখীন হতে হয়। তা ছাড়া মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে এভাবে সব মানুষের ডিএনএ প্রোফাইল সংরক্ষণ করা প্রাইভেসি ক্ষুণ্ন করে। কে বলতে পারে যে ভবিষ্যতে এই ডেটাবেস কোনো মন্দ উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হবে না? তার চেয়ে বড় প্রশ্ন হলো এই ডিএনএ প্রোফাইল ব্যবহার করার কারণে যদি কোনো ল্যাবরেটরি বা প্রযুক্তিগত ভুল হয় তবে নিরপরাধ ব্যক্তি সাজা পেতে পারে। তার দায় কে নেবে? অবশ্য বিজ্ঞানীরা বলছেন আরএফএলপি পদ্ধতিতে ডিএনএ প্রোফাইল করা হলে কোনো কো-ইনসিডেন্টাল ম্যাচিং বা ভুল ম্যাচিং হওয়ার সম্ভাবনা এক বিলিয়নে একটা। কিন্তু আগেই বলেছি আইডেন্টিকাল টুইন বা যমজদের বেলায় এই থিওরি সত্য না–ও হতে পারে। গোটা মানবজাতিতে ০.২ শতাংশ মানুষ যমজ—এ কথাও মাথায় রাখতে হবে।

ডিএনএ প্রোফাইলকে কি ধোঁকা দেওয়া যায়? ১৯৯২ সালে জন শিনবারগার নামে এক অপরাধী তার ডিএনএ প্রোফাইলকে ধোঁকা দিতে সক্ষম হয়। সব সাক্ষ্য মিলে যাওয়ার পরও ক্রাইম সিনে পাওয়া পদার্থের সঙ্গে জনের ডিএনএ ম্যাচ করতে ব্যর্থ হয় পুলিশ। পরবর্তী সময়ে দেখা যায় অপরাধের কিছুক্ষণ আগে লোকটি অন্য একজনের রক্ত ও অ্যান্টিকোয়াগুলেন্ট মিশিয়ে নিজের শরীরে প্রবেশ করিয়ে এই কাণ্ড করেছে। এরপর ২০০৯ সালে ইসরায়েলের একদল বিজ্ঞানী দাবি করে যে তারা যেকোনো মানুষের ডিএনএ প্রোফাইল গবেষণাগারে কৃত্রিমভাবে সিকোয়েন্স মিলিয়ে তৈরি করতে সক্ষম। জাতীয় ডেটাবেস হ্যাক করে কারও ডিএনএ সিকোয়েন্স জেনে নিয়ে হুবহু সেটা তৈরি করে কেউ যদি ক্রাইম সিনে ফেলে আসে তবে সহজেই পুলিশকে ধোঁকা দেওয়া সম্ভব। এভাবে একটা ক্রাইম সিন কৃত্রিমভাবে তৈরি করা সম্ভব, যা দেখে ও পরীক্ষা করে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হবে যে অপরাধটা করেছে মিস্টার এক্স, কিন্তু আসল অপরাধী হলো মিস্টার ওয়াই! তাই গোয়েন্দা কাজে ডিএনএ প্রোফাইল ব্যবহারও যে অচিরেই কলুষিত হয়ে উঠবে না তা কে জানে।

*লেখাটি ২০১৮ সালে বিজ্ঞানচিন্তার অক্টোবর সংখ্যায় প্রকাশিত