‘অরিজিনাল ম্যান’ জামাল নজরুল ইসলাম

আজ ২৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশি বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলামের জন্মদিন। একাধারে তিনি ছিলেন গণিতবিদ, বিশ্বসৃষ্টিতত্ত্ববিদ ও পদার্থবিজ্ঞানী। ১৯৩৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলায় তাঁর জন্ম। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে কসমোলজি বা বিশ্বসৃষ্টিতত্ত্ব পড়িয়েছেন দীর্ঘদিন। সেখান থেকে আবার কেমব্রিজে ফেরেন। আশির দশকে ফিরে আসেন দেশে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভৌতবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের পরিচালক ও গণিত বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেছেন দেশে ফিরে। কেমব্রিজ থেকে প্রকাশিত তাঁর বিখ্যাত বই দি আল্টিমেট ফেইট অব দি ইউনিভার্স অনূদিত হয়েছে একাধিক ভাষায়। তাঁর সর্বশেষ গ্রন্থ দ্য ম্যাথমেটিক্যাল কসমোলজিও প্রকাশিত হতে চলেছে কেমব্রিজ থেকে। জে এন ইসলাম শেষজীবনে কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরি, মহাকর্ষ ও কসমোলজি নিয়ে গবেষণা করেছেন। তাঁর জন্মদিনে চলুন, তাঁর জীবনের নানা দিক জেনে নেওয়া যাক।

জামাল নজরুল ইসলামঅলংকরণ: মাসুক হেলাল

১৯৮৮ সালের কথা। কৃষ্ণবিবর বা ব্ল্যাকহোল নিয়ে আমাদের দারুণ আগ্রহ। এ সম্পর্কে টুকরো টুকরো লেখা পড়েছি। দ্রুত কোনো কিছু পাওয়ার জন্য ইন্টারনেট ব্যবস্থা ছিল না তখন। ব্রিটিশ কাউন্সিল, জার্মান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ও ভারতীয় হাইকমিশন এবং ব্যান্সডকের মতো গ্রন্থাগারগুলো একমাত্র সহায়। এ রকম একটি সময়ে ব্রিটিশ কাউন্সিলে কৃষ্ণবিবর (বা কৃষ্ণগহ্বর) নিয়ে লেখা একটা বই পেয়ে যাই। এ বিষয়ে এতবড় একটি বই পাব, ভাবতেই পারছিলাম না। নাম ব্ল্যাকহোল, দ্য মেমব্রেন প্যারাডাইম, ইয়োলো ইউনিভার্সিটি প্রেস। লেখক কিপ থর্ন, রিচার্ড প্রাইস, ডগল্যাস ম্যাকডোনাল্ডস। ৩৭০ পৃষ্ঠার বইতে কৃষ্ণগহ্বরের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা। যাঁদের আপেক্ষিকতা তত্ত্ব নিয়ে তেমন ধারণা নেই, কিন্তু চিরায়ত পদার্থবিদ্যা নিয়ে পোক্ত অবস্থান, তাঁদের জন্যই বইটি লেখা। এ বইয়ের রেফারেন্সগুলো দেখতে গিয়ে এক জায়গায় চোখ আটকে গেল। একটি বইয়ের নাম দি আলটিমেট ফেইট অব দি ইউনিভার্স, কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, কেমব্রিজ। লেখক অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম। খবর নিয়ে জানলাম, আমাদের দেশের মানুষ। হকিং, পেনরোজ, ডাইসনরা তাঁর বন্ধু। তিনি একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গাণিতিক পদার্থবিদ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং বিশ্ববিখ্যাত কসমোলজিস্ট (বিশ্বসৃষ্টিতাত্ত্বিক)। আন্তর্জাতিক মহলে জে. এন. ইসলাম হিসেবে পরিচিত।

এরপর তাঁর সঙ্গে দেখা হয় ২০০৫ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম মুসলিম হলে, আমার এক বক্তৃতা অনুষ্ঠানে। তিনি উদ্বোধন করে শুভেচ্ছা বক্তব্য দিয়েছিলেন। প্রায় ১৩০০ লোক টিকিট কেটে এসেছিল। আমি ‘কসমিক ক্যালেন্ডার ও দ্য এনিগমা অব টাইম’ শিরোনামে দুটো বিষয়ের ওপর বক্তৃতা দিয়েছিলাম। একটি বিজ্ঞান বক্তৃতায় এত মানুষ দেখে বেশ আপ্লুত হয়ে তিনি বলছিলেন, ‘দেশের জন্য এটা শুভ; সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে বিজ্ঞানকে প্রবাহিত করতে পারলেই সমাজ এগিয়ে যাবে।’

শেষবার দেখি তাঁকে এনায়েতপুরে যমুনার তীরে মহাকাশ উৎসবে। সাংস্কৃতিক জাগরণের অগ্রপথিক ওয়াহিদুল হক তাঁর কথা প্রায়ই বলতেন; বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেশন ধারণা নিয়ে অদ্ভুত সব আলোচনা হতো নাকি তাঁদের। আধুনিক প্রযুক্তির কোনোকিছুই তিনি ব্যবহার করতেন না। ২০১৩ সালের ১৬ মার্চ তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ফুসফুসের সংক্রমণ ও হৃদরোগেই ৭৪ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু ঘটে।

এর আগে, ২০১৩ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বোস গবেষণা কেন্দ্র আয়োজিত দুদিনব্যাপী সেমিনারে এসেছিলেন জামাল নজরুল ইসলাম। জানা যায়, তিনি নাকি মনোমুগ্ধকর এক বক্তৃতা দিয়েছিলেন। সেটাই তাঁর শেষ বক্তৃতা। কোনো সময়ই তাঁকে মাল্টিমিডিয়ার সাহায্য নিতে দেখা যায়নি। তিনি সব সময় হাতে লিখতেন। চক, ডাস্টার আর ব্ল্যাকবোর্ড—এগুলোই ছিল তাঁর বক্তৃতা দানের উপকরণ। ইন্টারনেট ঘেটে তাঁর কোনো পুরোনো ছবি পাওয়া যায় না। একটু নিভৃতে থাকতেই পছন্দ করতেন।

২০১১ সালের অক্টোবরে এনায়েতপুরে মহাকাশ উৎসবে অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলামের সঙ্গে দেখা হলে তাঁকে আমার সম্পাদিত মহাবৃত্ত (আইনস্টাইন সংখ্যা) দিই। আমার সঙ্গে আসা এক বন্ধু, ফ্রিল্যান্স পদার্থবিদ শামসুদ্দিন আহমেদ কৃষ্ণবিবর ও মহাবিশ্ব সংক্রান্ত একটা প্রশ্ন করলে তিনি আপন মগ্নতা নিয়ে কথা বলতে লাগলেন, যেন এই কথাগুলো বলার জন্যই তিনি চট্টগ্রাম থেকে এনায়েতপুরে এসেছেন। তিনি জানতে চাইলেন না প্রশ্নটা কে করেছেন বা তাঁর যোগ্যতা কী? প্রশ্নের উত্তর দেওয়াই তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলাম
ফাইল ছবি: নাসির আলী মামুন

বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলাম আর নেই। তাঁর মতো এ রকম বিশ্বমাপের আরেকজন মানুষ পাওয়া কঠিন হবে। পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক অজয় রায়ের একটি লেখায় একটি কথা এ ব্যাপারে আরও মনযোগ দিতে আবেগ সঞ্চারিত করে। তিনি বলছেন, ‘এতদিন আমার মনে হতো এসব জটিল বিষয়ে কেবল পাশ্চাত্যের পণ্ডিতরাই কাজ করেন। ধারণা ছিল, মহাবিশ্বের রহস্য বুঝতে আর এর সমাধান করতে পারেন পাশ্চাত্যের গুটি কয়েক প্রথম সারির কসমোলজিস্ট। যেমন আলবার্ট আইনস্টাইন, রিচার্ড ফাইনম্যান, স্টিফেন হকিং, অ্যালেন গুথ, মাইকেল টার্নার, লরেন্স ক্রাউস প্রমুখ। কিন্তু আমার ভুল ভাঙ্গল। হঠাৎ করেই ১৯৮৩ সালে এক বাঙালি পদার্থবিজ্ঞানীর বই আমার নজরে এল। বইটির শিরোনাম দি আলটিমেট ফেইট অব দি ইউনিভার্স। প্রকাশিত হয়েছে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে।

অধ্যাপক জামালের গ্রন্থগুলো

এই মানুষটির লেখা দি আলটিমেট ফেইট অব দি ইউনিভার্স বইটি আট-নয়টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এটি বিশ্বের জ্ঞানভান্ডারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হিসেবে থাকবে। বইটি ফরাসি, ইতালীয়, জার্মান, পর্তুগিজ, সার্বোক্রোয়েটসহ পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। পেপারব্যাকও বেরিয়েছে ২০০৯ সালে। বইটির ভূমিকাটি পড়লে আমরা দেখতে পাব—ফ্রিম্যান জন ডাইসন, এস জে আরসেথ, স্টিফেন উইলিয়াম হকিং, এস মিটন, জে.ভি. নারলিকার, মার্টিন জে রিজ, এবং জে সি টেইলরের মতো প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানীদের নাম, যাঁদের কাছে বইটি লেখার জন্য তিনি ঋণস্বীকার করেছেন। মহাবিশ্ব কেমন ছিল, এখন কেমন এবং ভবিষ্যতে কেমন হবে, যদি সে সময় প্রাণ থাকে, তারা কীভাবে শক্তি পাবে—এসব বিষয় নিয়েই এ গ্রন্থ। ইউক্লিডের এলিমেন্টস, জেকব ব্রনওস্কির অ্যাসসেন্ট অব ম্যান, কার্ল সাগানের কসমস গ্রন্থাবলীর মতোই এ বইটিও তেরোটি অধ্যায়ে বিভক্ত—১. আমাদের গ্যালাক্সি, ২. বৃহৎ পরিসরে বিশ্ব-কাঠামো, ৩.মৌলিক কণার প্রাথমিক ধারণা, ৪. বিশ্ব কি আবদ্ধ না উন্মুক্ত?, ৫. তিন উপায়ে নক্ষত্ররাজির মৃত্যুবরণ, ৬. কৃষ্ণবিবর ও কোয়াসার, ৭. গ্যালাক্সীয় এবং সুপার গ্যালাক্সীয় কৃষ্ণবিবর, ৮. কৃষ্ণবিবরের জীবন অনন্ত নয়, ৯. ধীরগতির সুক্ষ্ম পরিবর্তনসমূহ, ১০. প্রাণ ও সভ্যতার ভবিষ্যৎ, ১১. বিস্তরণশীল মহাবিশ্ব, ১২. স্থায়ী অবস্থার তত্ত্ব এবং ১৩. প্রোটনের স্থায়িত্ব। বিগ ব্যাং থেকে শুরু করে ভবিষ্যৎ বিশ্ব-পরিণতির একটি গাণিতিক মডেল দাঁড় করিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন লেখক।

এ ছাড়াও ক্লাসিক্যাল জেনারেল রিলেটিভিটি (১৯৮৪) তাঁর সম্পাদিত একটি বই। এ বইয়ে তাঁর সঙ্গে যৌথভাবে সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন ডব্লিউ. বি. বনর এবং এম.এ.এইচ. ম্যাককুলাম। রোটেটিং ফিল্ডস ইন জেনারেল রিলেটিভিটি (১৯৮৫), কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস। অ্যান ইন্ট্রোডাকশন টু ম্যাথমেটিক্যাল কসমোলজি (১৯৯২), কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস; এটি প্রথম বইটিরই গাণিতিক সংস্করণ; ম্যাথেমেটিক্যাল কসমোলজি বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকায় বিখ্যাত জ্যোতিঃপদার্থবিদ ফ্রেড হয়েলের প্রতি জামাল নজরুল বিশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। ১৯৮৪ সালে এনডেভার ম্যাগাজিনে প্রকাশিত (১৯৮৪) ‘ফার ফিউচার অব দ্য ইউনিভার্স’ উল্লেখযোগ্য। কৃষ্ণবিবর (বাংলায় ১৯৮৫)—বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত; মাতৃভাষা, বিজ্ঞানচর্চা এবং অন্যান্য প্রবন্ধ—রাহাত-সিরাজ প্রকাশনা; শিক্ষা, সাহিত্য ও সমাজ—রাহাত-সিরাজ প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত।

'দি আল্টিমেট ফেইট অব দি ইউনিভার্স' বইয়ের প্রচ্ছদ

এ ছাড়াও জামাল নজরুল জীবনের শেষের ১৭ বছরের গবেষণামূলক গ্রন্থ ইন্ট্রোডাকশন টু ম্যাথমেটিক্যাল ইকোনমিকস অ্যান্ড সোশ্যাল চয়েস কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশের প্রক্রিয়ায় আছে। তিনিই একমাত্র বাঙালি বিজ্ঞানী, যাঁর এ পর্যন্ত অনেকগুলো বই প্রকাশিত হয়েছে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।

বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ২০০১ সালে একুশে পদকে ভুষিত করেন। ২০১০ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজ্জাক-শামসুন আজীবন সম্মাননা পদক লাভ করেন। রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি, কেমব্রিজ ফিলসফিক্যাল সোসাইটি, বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমী এবং এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশের সম্মানিত সদস্য ছিলেন অধ্যাপক জে. এন. ইসলাম। আন্তর্জাতিকভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক পরিমণ্ডলে এমন এক অবস্থানে ছিলেন, এতে মনে হয় তাঁর প্রতি আমাদের আরও গুরুত্ব দাবি করেন। এ ব্যাপারে লোকসাহিত্যবিদ শামসুজ্জামান খান মাসিক উত্তরাধিকার ১৪২০ বৈশাখ সংখ্যায় সম্পাদকীয়তে লিখেছিলেন, ‘তবু স্বাদেশিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে যাঁরা বিশ্বের উন্নত গবেষণাগার ছেড়ে বাংলাদেশে এসে আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা করতে চেয়েছিলেন, তাঁরাও বড় কিছু করে যেতে পারলেন না। এমনই এক বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী ছিলেন জামাল নজরুল ইসলাম। দি আলটিমেট ফেইট অব দি ইউনিভার্স বা কৃষ্ণবিবর-এর মতো গ্রন্থ লিখেও তাঁর যে জায়গায় পৌঁছানোর কথা ছিল, দেশের বিজ্ঞানচর্চার অবকাঠামোগত দূরবস্থার জন্য তা আর হয়ে উঠতে পারেনি। আমাদের এই দেশে অত বড় বিজ্ঞানী হয়েও তিনি যে খুব বড় কোনো সম্মানের জায়গা পেয়েছিলেন, তা-ও না।’ জামাল নজরুল ইসলাম তাঁর কৃষ্ণবিবর গ্রন্থে বলেছেন, ‘মহাবিস্ফোরণে যে প্রাণহীন ও জড়পদার্থ চতুর্দিকে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল, তার মধ্যে একদিন প্রাণী এবং চেতনার আবির্ভাব ঘটেছিল। এই চেতনায় শ্রদ্ধা জাগে প্রকৃতির বিশালতার প্রতি।’ দার্শনিক ও বিজ্ঞানীর কী অভূতপূর্ব সমন্বয়!

জীবিত না থাকায় চিন্তাধারার গভীরতাকে বোঝার জন্য জামাল নজরুলকে তাঁর রচিত বই এবং প্রকাশিত প্রবন্ধমালা, সাক্ষাৎকারগুলো ছাড়া বিচার করার কোনো উপায় নেই। এটা অবশ্য যৌক্তিক পথও

জামাল নজরু ইসলাম এক কর্মময় জীবন কাটিয়েছেন। তিনি লন্ডনের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাপ্লায়েড ম্যাথমেটিকস অ্যান্ড থিওরেটিক্যাল ফিজিকস (প্রায়োগিক গণিত ও তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ) থেকে পিএইচডি ও ডিএসসি ডিগ্রি লাভ করেন যথাক্রমে ১৯৬৪ ও ১৯৮২ সালে। কর্মজীবনে তিনি ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত যুক্তরাস্ট্রের মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরাল ফেলো ছিলেন। ষাটের দশকে কেমব্রিজে রিলেটিভিস্টিক কোয়ান্টাম বলবিদ্যার জনক পল ডিরাক স্বয়ং তাঁকে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার ক্লাস নিতে দেন, কোয়ান্টাম ক্ষেত্র তত্ত্ব (ফিল্ড থিওরি) পড়েছেন জন পলকিংহর্নের কাছে, যিনি কোয়ার্ক তত্ত্বে বিশেষ অবদান রেখেছেন। ১৯৭১ ও ১৯৭২ সালে তিনি ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলোজিতে অতিথি অধ্যাপক ছিলেন। ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালে জামাল লন্ডনের কিংস কলেজে ফলিত গণিতের প্রভাষক, ১৯৭৫-১৯৭৮ সালে কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ে সায়েন্স রিসার্চ ফেলো এবং ১৯৭৮-১৯৮৪ সাল লন্ডনের সিটি ইউনিভার্সিটিতে প্রথমে প্রভাষক ও পরে রিডার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১৯৬৮, ১৯৭৩ এবং ১৯৮৪ সালে তিনি যুক্তরাস্ট্রের প্রিন্সটনে ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্সড স্টাডিজে ভিজিটিং প্রফেসর ছিলেন। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাস্ট্রে একাধিক খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা ও অধ্যাপনা শেষে ১৯৮৪ সালে স্থায়ীভাবে দেশে ফিরে এসে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে যোগ দেন। এখানে তিনি রিসার্চ সেন্টার ফর ম্যাথমেটিক্যাল অ্যান্ড ফিজিক্যাল সায়েন্সেস (RCMPS) নামে একটি বিশ্বমানের গবেষণাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি এই প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ছিলেন। ১৯৮৯ সালে আবদুস সালাম এ কেন্দ্রটির উদ্বোধন করেন। ইমেরিটাস অধ্যাপক হিসাবে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি সুনামের সঙ্গে কাজ করে গেছেন।

জীবিত না থাকায় চিন্তাধারার গভীরতাকে বোঝার জন্য জামাল নজরুলকে তাঁর রচিত বই এবং প্রকাশিত প্রবন্ধমালা, সাক্ষাৎকারগুলো ছাড়া বিচার করার কোনো উপায় নেই। এটা অবশ্য যৌক্তিক পথও। সে সময় বিশ্ববিখ্যাত গবেষণা জার্নালগুলোর আদর্শমান বজায় রাখতেই সম্পাদকরা প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানীদের যাচাইয়ের পর গবেষণাপত্রগুলো ছাপানোর উদ্যোগ নিতেন। জামাল নজরুল ইসলাম তাঁর গবেষণা প্রবন্ধগুলো জমা দিয়েছেন ফ্রেড হয়েল, স্টিফেন হকিং, মার্টিন রিজের মতো বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের কাছে। পঞ্চাশ বছরের বৈজ্ঞানিক জীবনে তিনি ধ্রুপদী সব বিজ্ঞানধারার ওপর কাজ করে গেছেন। তন্মধ্যে আছে কোয়ান্টাম ক্ষেত্রতত্ত্ব, আপেক্ষিকতার সূত্র, নক্ষত্রের গঠন, মহাবিশ্ব তত্ত্ব। তবে প্রধান বিষয় হচ্ছে আপেক্ষিকতাবাদ ও মহাবিশ্বতত্ত্ব। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমার গবেষণার ক্ষেত্র অনেক বিস্তৃত হয়েছে। কিন্তু আমি মনে করি, ওয়াইডার, বাট নট নেসেসারিলি ডিপার (বিস্তৃত, তবে গভীর নয়)।’

'অ্যান ইন্ট্রোডাকশন টু ম্যাথমেটিক্যাল কসমোলজি' বইয়ের প্রচ্ছদ

জামাল নজরুল ইসলামের পিএইচডি থিসিস ছিল পার্টিকেল ফিজিকস বা মৌলিক কণার ওপর। এর তিন-চার বছর পরই তিনি আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি বা সাধারণ আপেক্ষিকতত্ত্ব নিয়ে কাজ শুরু করেন। পরে এর সঙ্গে যুক্ত হয় কসমোলজি। মূলত এই তিনটিই হচ্ছে তাঁর আগ্রহ ও কাজের মূলক্ষেত্র। পরে অবশ্য ফ্লুইড ডায়নামিকস বা প্রবাহীর গতিবিদ্যা নিয়েও কাজ করেছেন। তাঁর রচিত পঞ্চাশটিরও বেশি গবেষণাপত্র রয়েছে। গবেষণাপত্রগুলো অধিকাংশই প্রকাশিত হয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞান জার্নালে।

পিএইচডি শেষে তিনি দুবছরের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ডে চলে যান। মেরিল্যান্ড থেকে কেমব্রিজে ফিরে তিনি জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটির ওপর গবেষণা শুরু করেন। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত তিনি তা অব্যহত রাখেন। সেখানেই কোয়ান্টাম কসমোলজির গবেষক স্টিফেন হকিংয়ের সঙ্গে পরিচয়। এই পরিচয় তাঁকে কসমোলজির প্রতি আরও আগ্রহী করে তোলে। ১৯৭১ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার বিশ্বখ্যাত ক্যালটেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। সেখানেই বিশিষ্ট পদার্থবিদ রিচার্ড ফাইনম্যানের সঙ্গে পরিচয় এবং তাঁর সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠ কিছু সময় কাটে। তিনি এক জায়গায় বলেছেন, ‘ফাইনম্যান দম্পতি একবার আমাকে সস্ত্রীক নৈশভোজে নিমন্ত্রণ করেন। তাঁর স্ত্রী আমাদের একটি মেক্সিকান ট্যাপেস্ট্রি উপহার দেন, যেটা এখনও এই বাড়িতে (চট্টগ্রামে) আছে।’

আরও পড়ুন

এরপর তিনি আবার ফিরে যান প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে। ওখানে পদার্থবিজ্ঞানী ফ্রিম্যান ডাইসনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়। ডাইসন জামাল নজরুল ইসলামের কাজ সম্পর্কে খুব আগ্রহী ছিলেন। ফাইনম্যান, ডাইসন—এই দুই বিজ্ঞানী তাঁর সম্পর্কে অতি উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন। ১৯৭৪ সালে ইংল্যান্ডে ফিরে এসে ইউনিভার্সিটি অব কার্ডিফে আবার আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি নিয়ে কাজ শুরু করেন। ৪০ বছরের মতো দীর্ঘ সময় ধরে আর কেউ আইনস্টাইন উপস্থাপিত সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে কাজ করেনি বলে তাঁর কাছ থেকে জানা যায়। তাঁর অবদানকে চারটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথাক্রমে তাত্ত্বিক কণাপদার্থবিদ্যা, কনফর্মাল মহাকর্ষ তত্ত্ব, মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ, মহাজাগতিক ধ্রুবক ল্যামডা।

জামাল নজরুলের মৃত্যুর পর এক সাক্ষাৎকারে ডাইসন গোলকের জনক ও জ্যোতিঃপদার্থবিদ ফ্রিম্যান ডাইসন জামাল নজরুল ইসলামকে ‘অরিজিনাল ম্যান’ বলে অবহিত করেন, যিনি বাংলাদেশকে আধুনিক বিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে দেশে ফিরেছিলেন। ফিরে গিয়ে শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা করেছেন বিশ্ব বিজ্ঞান সমাজের সঙ্গে যুক্ত হতে।

লেখক: বিজ্ঞান বক্তা; সম্পাদক, মহাবৃত্ত

অমর একুশে বইমেলা ২০২৪-এর আলোচনা প্রবন্ধের সংক্ষিপ্তসার