বিজ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা

আজ, বৃহস্পতিবার রিচার্ড ফাইনম্যানের ১০৫তম জন্মবার্ষিকী। ১৯১৮ সালের ১১ মে জন্মগ্রহণ করেন এই মহান পদার্থবিজ্ঞানী। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে মিনিং অব ইট অল বইয়ের সামান্য অংশের বাংলা রূপান্তর প্রকাশ করা হলো। রূপান্তর করেছেন উচ্ছ্বাস তৌসিফ।

১৯৬১ সালে জন ও জেসি ড্যানজ দম্পতি ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনকে কিছু অর্থ উপহার দিয়েছিলেন। তিনি সত্যিকার অর্থেই ছিলেন একজন জনদরদী ও পরোপকারী মানুষ। ড্যানজ দম্পতির এই অর্থ দিয়ে ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয় ‘জন ড্যানজ ফান্ড’ গঠন করে। এ ফান্ড ব্যবহার করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিখ্যাত সব ব্যক্তিত্বকে লেকচার দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানাত বিশ্ববিদ্যালয়টি। ১৯৬৩ সালের এপ্রিলে জন ড্যানজ লেকচার সিরিজে বক্তব্য রাখার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয় পদার্থবিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যানকে। বিজ্ঞানের দর্শন, এর বৈশিষ্ট্য, প্রয়োজনীয়তা, এর অনিশ্চয়তাসহ নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন তিনি। ফাইনম্যানের বক্তব্যের গভীরতা তাঁর ভাষ্যেই মানায়। তাঁর সেই লেকচারগুলো মিনিং অব ইট অল নামের একটি বইতে গ্রন্থিত হয়।

প্রতিদিন নতুন প্রজন্মের মানুষ জন্ম নেয়। মানবজাতির ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে এত দারুণ সব আইডিয়া গড়ে উঠেছে! প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এসব আইডিয়া স্পষ্টভাবে ছড়িয়ে দেওয়া না গেলে এরা কিন্তু একসময় বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

আজকের এ লেকচারে আমি বিজ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কথা বলব। বিজ্ঞানের বাইরের অন্যান্য ক্ষেত্রগুলোতে মানুষের বিভিন্ন আইডিয়ার ওপরে বিজ্ঞানের প্রভাব নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করব। বিভিন্ন বিষয়ের ওপরে একটা নির্দিষ্ট বিষয়ের আইডিয়াগুলোর প্রভাব নিয়ে কথা বলা আর নিজের বোকামী জাহির করা মোটামুটি একই কথা। আসলে, নির্দিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠার এই যুগে জ্ঞানের একাধিক শাখার ব্যাপারে যথেষ্ট গভীর জ্ঞান রাখেন এবং কথা বলতে গেলে কোনোটাতেই নিজের বোকামী প্রকাশ করবেন না—এমন মানুষের সংখ্যা একেবারে হাতেগোনা।

যে আইডিয়াগুলো নিয়ে আমি কথা বলতে চাচ্ছি, এগুলো আসলে প্রাচীন। সতের শতকের দার্শনিকেরা এর কোনোটা নিয়েই কথা বলা বাদ রাখেননি। সত্যি বলতে কী, আজ রাতে আমি তাদের কথার বাইরে গিয়ে নতুন কিছু বলতেও পারব না। তাহলে, আবার এই পুনরাবৃত্তি কেন? কারণ, প্রতিদিন নতুন প্রজন্মের মানুষ জন্ম নেয়। মানবজাতির ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে এত দারুণ সব আইডিয়া গড়ে উঠেছে! প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এসব আইডিয়া স্পষ্টভাবে ছড়িয়ে দেওয়া না গেলে এরা কিন্তু একসময় বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

প্রাচীন কিছু আইডিয়া আমাদের কাছে সাধারণ জ্ঞানের মতোই পরিচিত। এসব নিয়ে তাই নতুন করে কিছু বলার বা ব্যাখ্যা করার দরকার আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু চারপাশ দেখে যদ্দুর বুঝি, বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত সমস্যাগুলো এবং সংশ্লিষ্ট আইডিয়াগুলো এর মধ্যে পড়ে না। সবাই এসব নিয়ে ঠিক আগ্রহীও নয়। তবে আগ্রহী মানুষের সংখ্যাও প্রচুর। বিশেষ করে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনেকেই এসব ব্যাপারে আগ্রহী বলে আমার মনে হয়েছে। আবার এমনও হতে পারে, আপনারা আমার জন্য সঠিক ধরনের শ্রোতা নন (মানে, এসব ব্যাপারে আগ্রহী নন)।

বই পড়ছেন রিচার্ড ফাইনম্যান

যাহোক। বিভিন্ন বিষয়ের ওপরে একটা নির্দিষ্ট বিষয়ের আইডিয়াগুলোর প্রভাব নিয়ে কথা বলার যথেষ্ট কঠিন এই কাজটা আমি শুরু করব একেবারে শেষ মাথা থেকে। আমি বিজ্ঞানের ব্যাপারে জানি। এর আইডিয়া এবং পদ্ধতিগুলো বুঝি। জ্ঞানের ব্যাপারে এর মনোভাব জানি। এর অগ্রগতির উৎস এবং মানসিক শৃংখলার ব্যাপারেও জানি। তাই, এ লেকচারের শুরুতে আমি যে বিজ্ঞানকে জানি, তা নিয়েই কথা বলব।

এখন কথা হলো, বিজ্ঞান কী? এই শব্দটা সাধারণত তিনটা জিনিস বা এদের মিশ্র কিছু বোঝাতে ব্যবহৃত হতো। একেবারে স্পষ্ট করে কিছু বলার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। বেশি স্পষ্ট করে সবকিছু বলতে যাওয়াটা সব সময় ভালো নয়। যাহোক, কখনও বিজ্ঞান মানে, কিছু জিনিস খুঁজে বের করার বিশেষ এক পদ্ধতি। কখনও এর মানে, খুঁজে পাওয়া জিনিস থেকে গড়ে ওঠা জ্ঞানের অবকাঠামো। আবার, কিছু একটা খুঁজে বের করতে পারলে আপনি নতুন যেসব জিনিস করতে পারবেন—বিজ্ঞান বলতে কখনও কখনও একেও বোঝানো হয়। শেষ যেটার কথা বললাম, সেটাকে বলে প্রযুক্তি। কিন্তু টাইম ম্যাগাজিন-এর বিজ্ঞান বিভাগের দিকে তাকালে দেখবেন, ৫০ শতাংশ লেখা থাকে, ‘নতুন যা যা জানা গেছে’—তার ওপর। বাকি ৫০ শতাংশ থাকে ‘নতুন কী করা যাবে আর কী কী করা হচ্ছে’—তার ওপর। কাজেই, বিজ্ঞানের জনপ্রিয় সংজ্ঞা বলতে আংশিকভাবে প্রযুক্তিকেও বোঝায়।

বিজ্ঞানের এই তিনটা দিক নিয়ে আমি উল্টো দিক থেকে আলোচনা করব। যেসব নতুন জিনিস আপনি করতে পারবেন, অর্থাৎ প্রযুক্তি দিয়ে কথা শুরু করব আমি। বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর প্রয়োগ। বিজ্ঞানের হাত ধরেই মানুষ কিছু করতে পারে, তার সেই ক্ষমতাটা তৈরি হয়—এই তথ্যটা-ই বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় পরিচয়গুলোর একটি। আর এ ক্ষমতার পাল্লা যে কতদূর বিস্তৃত, সেটা নিয়ে নতুন করে বলার আসলে কোনো প্রয়োজন নেই। বিজ্ঞানের অগ্রগতি না হলে ‘শিল্প বিপ্লব’ জিনিসটা একরকম অসম্ভব হয়েই থাকত। পৃথিবীর এই বিপুল জনসংখ্যার জন্য প্রয়োজনীয় খাবার উৎপাদন কিংবা অসুস্থতা নিয়ন্ত্রণে রাখা—এসব কিছুই সম্ভব হতো না। তার ওপর, এত বিপুল জিনিসপত্র তৈরির জন্য মানুষকে যে দাস হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে না, মানুষ যে মুক্তভাবে ঘুরে বেড়াতে পারছে; উৎপাদনের পেছনের বিজ্ঞানের অগ্রগতি হওয়ার ফলেই কেবল এসব সম্ভব হয়েছে।

এত কিছু করতে পারার এই ক্ষমতার ফলাফল ভালো হবে নাকি খারাপ, সেটা নির্ভর করে এর ব্যবহারের ওপর। এ ক্ষমতাকে কীভাবে ব্যবহার করা হবে, সেটা কি ভালো কাজে ব্যবহৃত হবে, নাকি মন্দ কাজে—সে ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা কিন্তু দেওয়া নেই। আমরা উন্নত মানের উৎপাদন ক্ষমতা চাই ঠিকই, কিন্তু স্বয়ংক্রিয়তা নিয়ে আমাদের সমস্যা আছে। ওষুধপত্রের অগ্রগতি নিয়ে আমরা বেশ খুশি। কিন্তু মানুষের জন্মহার এবং যেসব রোগ আমরা চিরতরে সারিয়ে ফেলেছি, সেসব রোগে কেউ মারা না যাওয়া নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। ব্যাকটেরিয়া নিয়ে আমাদের যে জ্ঞান, গোপন গবেষণাগারে তা ব্যবহার করে, দিনরাত খেটে এমন সব ব্যাকটেরিয়াও মানুষ তৈরি করতে চাচ্ছে—যার কোনো প্রতিরোধক বা চিকিৎসা কেউ আবিষ্কার করতে পারবে না। বায়ুর মধ্য দিয়ে যাতায়াতের ব্যবস্থা গড়ে তোলায় আমরা খুশি। আবার একইসঙ্গে, আকাশপথে যুদ্ধের ভয়াবহতা নিয়ে আমরা আতংকিত। দেশ থেকে দেশান্তরে যোগাযোগ করার ক্ষমতা নিয়ে আমরা সন্তুষ্ট। আবার, অন্য দেশ যে আড়ি পেতে আমাদের গোপন তথ্য জেনে যেতে পারে, এ নিয়ে আমরা সবাই যথেষ্ট উদ্বিগ্ন। মহাকাশে যাওয়ার উপায় আবিষ্কৃত হয়েছে—এ নিয়ে সবাই বেশ উত্তেজিত হলেও, এরও খারাপ দিক আছে, সমস্যা আছে। সেসব নিয়ে আমাদের দুশ্চিন্তাও কিন্তু কম না, তাই না? আর এতসব ভারসাম্যহীনতার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো পারমাণবিক শক্তির উৎকর্ষ এবং সংশ্লিষ্ট সমস্যা।

তাহলে, বিজ্ঞানের কি আদৌ কোনো মূল্য আছে?

আমার কাছে মনে হয়, কিছু করতে পারার ক্ষমতা মানেই এর মূল্য আছে। ফলাফল ভালো না খারাপ হবে, সেটা অবশ্যই ব্যবহারের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু ক্ষমতা মানেই, আমার কাছে এর একটা মূল্য আছে।

বিজ্ঞানের ব্যাপারেও একই কথা। এটা স্বর্গের দরজার চাবি হলেও, একই চাবি দিয়ে নরকের দরজাও খোলে। তবে কোনটা যে কিসের দরজা—সে ব্যাপারে আমাদের কাছে কোনো নির্দেশনা নেই। তাহলে, আমরা কি এই চাবি ছুঁড়ে ফেলে দেব, আর স্বর্গে প্রবেশের সম্ভাবনা বন্ধ করে দেব চিরতরে? নাকি, কীভাবে সবচেয়ে ভালোভাবে এই চাবি ব্যবহার করা যায়—সেই সমস্যা নিয়ে কষ্ট করব দিনের পর দিন? এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রশ্ন।
'মিনিং অব ইট অল' বইয়ের প্রচ্ছদ

একবার হাওয়াইতে আমাকে একটা বৌদ্ধমন্দির দেখতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই মন্দিরের একজন আমাকে বলেছিলেন, ‘আপনাকে আমি একটা কথা বলতে চাই। কথাটা আপনি কোনোদিন ভুলতে পারবেন না, আমি জানি।’ একটুক্ষণ থেমে থাকার পর তিনি বলেছিলেন, ‘প্রত্যেক মানুষকেই স্বর্গের দরজার চাবি দেওয়া হয়। কিন্তু এই চাবি দিয়ে নরকের দরজাও খোলে।’

বিজ্ঞানের ব্যাপারেও একই কথা। এটা স্বর্গের দরজার চাবি হলেও, একই চাবি দিয়ে নরকের দরজাও খোলে। তবে কোনটা যে কিসের দরজা—সে ব্যাপারে আমাদের কাছে কোনো নির্দেশনা নেই। তাহলে, আমরা কি এই চাবি ছুঁড়ে ফেলে দেব, আর স্বর্গে প্রবেশের সম্ভাবনা বন্ধ করে দেব চিরতরে? নাকি, কীভাবে সবচেয়ে ভালোভাবে এই চাবি ব্যবহার করা যায়—সেই সমস্যা নিয়ে কষ্ট করব দিনের পর দিন? এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রশ্ন। তবে আমার মনে হয়, স্বর্গের দরজার চাবির মূল্য আমরা অস্বীকার করতে পারি না।

বিজ্ঞান আর সমাজের সম্পর্কের মাঝের সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলো কিন্তু এই অংশটার মধ্যেই। যখন কোনো বিজ্ঞানীকে বলা হয়, সমাজের ওপরে তার যে প্রভাব, এ ব্যাপারে তার আরো বেশি দায়িত্বশীল হওয়া উচিৎ; তখন বিজ্ঞানের এ প্রায়োগিক দিকটার কথাই বলা হয়। কেউ যদি পারমাণবিক শক্তির উন্নতির জন্য কাজ করে, সেটা যে খারাপভাবে ব্যবহৃত হতে পারে, এটাও তার বোঝা লাগবে। তাই কোনো বিজ্ঞানী যখন এরকম কোনো আলোচনা করতে চান, আপনি হয়তো ভাবতে পারেন, তার আলোচনায় এই বিষয়টা-ই ০সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাবে। কিন্তু আমি এ নিয়ে আর সামনে এগোব না। কারণ, আমার কাছে মনে হয়, এসব সমস্যাকে ‘বৈজ্ঞানিক সমস্যা’ বলাটা বাড়িয়ে বলা ছাড়া আর কিচ্ছু নয়। এগুলোকে বরং মানবাধিকারকর্মী বা সমাজকর্মীদের সমস্যা বলা যায়। একটা ক্ষমতাকে কীভাবে কাজে লাগানো যায়—এটুকু স্পষ্ট, কিন্তু সেটাকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়—সেটা স্পষ্ট না হলে, সেটা বৈজ্ঞানিক সমস্যা কীভাবে হয়? ক্ষমতা কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, এর মধ্যে বৈজ্ঞানিক তেমন কিছু নেই। আর বিজ্ঞানীরা এ ব্যাপারে তেমন কিছু জানেনও না।

একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা আরও ভালো বোঝা যাবে। আমি কেন এ নিয়ে আর কথা বলতে চাই না, সেটা আপনাদের একটু বুঝিয়ে বলি। কিছুদিন আগের কথা। ১৯৪৯ বা ’৫০ সাল হবে। পদার্থবিজ্ঞান শেখানোর জন্য আমি সেবার ব্রাজিল গিয়েছিলাম। তখনকার দিনে ‘পয়েন্ট ফোর প্রোগ্রাম’ নামে একটা কার্যক্রম ছিল। সবাই অনুন্নত দেশগুলোকে সাহায্য করার জন্য যেত। দারুণ ছিল কার্যক্রমটা! তাদের মূলত প্রায়োগিক বা প্রযুক্তিগত জ্ঞানটুকু শেখা দরকার ছিল।

রিচার্ড ফাইনম্যানের নোবেল মেডাল

ব্রাজিলের রিও শহরে ছিলাম আমি। রিওতে পাহাড়জুড়ে ভাঙ্গাচোরা কাঠের টুকরো-টাকরা দিয়ে ঘর বানিয়ে থাকত দরিদ্ররা। পুরোনো বিভিন্ন সাইনবোর্ড ইত্যাদি থেকে যে কাঠ পাওয়া যায়, তা দিয়েই ওরা ঘর বানাত। বোঝাই যাচ্ছে, মানুষগুলো অসম্ভব দরিদ্র ছিল। সুয়ারেজ বা পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা তো দূরের কথা, পানির ব্যবস্থাও ছিল না তাদের। পানি আনতে মাথায় করে পুরোনো গ্যাসোলিনের ড্রাম বয়ে পাহাড়ের নিচে নিয়ে যেতে হতো। নতুন একটা ভবন তৈরি হচ্ছিল কাছেই। সিমেন্ট মেশানোর জন্য পানি ছিল সেখানে। সেই পানি ড্রামে ভরে আবার বয়ে নিয়ে আসতে হতো পাহাড়ের মাথায়। আসার সময় পানি তো পড়তই। পরে দেখা যেত, বেয়ে বেয়ে সেই পানি পাহাড়ের মাথা থেকে নিচ পর্যন্ত পুরো জায়গাটাকে নর্দমা বানিয়ে ফেলেছে (জমা ময়লা তো ছিলই)। মানে, ভয়াবহ অবস্থা। দুঃখজনক একটা ব্যাপার।

এই পাহাড়গুলোর ঠিক পাশেই আবার গড়ে উঠেছে কোপাকাবানা সৈকতের দারুণ সব ভবন, সুন্দর সব অ্যাপার্টমেন্ট ইত্যাদি।

পয়েন্ট ফোর প্রোগ্রামে আমার সঙ্গের বন্ধুদের বললাম, ‘এটা কি প্রযুক্তিগত জ্ঞানের অভাবের ফলে তৈরি হওয়া কোনো সমস্যা, বলো? পাহাড়ের মাথা পর্যন্ত একটা পাইপ কীভাবে বসাতে হয়, সেটা কি তারা জানে না? পাহাড়ের মাথায় একটা পাইপ বসিয়ে দিলে তো মানুষগুলো অন্তত খালি ড্রাম নিয়ে পাহাড়ের ওপরে উঠে, ড্রাম ভরে নিচে নিয়ে যেতে পারে, নাকি?’

তারমানে, এটা প্রযুক্তিগত জ্ঞানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো সমস্যা না। চোখ মেলে একটু আশেপাশে তাকালেই ব্যাপারটা আরও নিশ্চিতভাবে বোঝা যায়। পাশের অ্যাপার্টমেন্ট ভবনগুলোতে পাইপ আছে, পাম্পও আছে। আমরা এখন বুঝি, সমস্যাটা কোথায়। যথাসম্ভব সমস্যাটা হলো, আর্থিক সহায়তার অভাব। এখন, আসলেই এটা অর্থনৈতিক সমস্যা কি না কিংবা এটা কীভাবে সমাধান করা যায়, আমরা জানি না। কিন্তু ‘প্রতিটা পাহাড়ের চূড়ায় একটা করে পাইপ আর পাম্প বসাতে কত খরচ হতে পারে’- এটা আদৌ আলোচনা করার মতো কোনো প্রশ্ন বলে ‘আমার’ মনে হয় না।

সমস্যাটা সমাধানের উপায় আমরা জানি না ঠিকই, তারপরও একটা কথা মনে করিয়ে দিতে চাই। প্রায়োগিক জ্ঞান এবং আর্থিক সহায়তা—অন্তত এই দুটো উপায়ে সমস্যাটা সমাধানের চেষ্টা করে দেখেছি আমরা। দুটো উপায়ের কোনোটাতেই কাজ হয়নি। তাই আর কোনোভাবে কিছু করা যায় কি না, সেটাও চেষ্টা করে দেখছি। পরে আপনারা বুঝতে পারবেন জিনিসটা, এই ব্যাপারটাকে আমার কাছে বেশ উৎসাহব্যঞ্জক বলে মনে হয়। মনে হয়, নতুন নতুন সমাধান খুঁজে বের করার চেষ্টা চালিয়ে গেলেই কেবল কোনোকিছু করা সম্ভব।

এগুলোই হলো বিজ্ঞানের প্রায়গিক দিক। নতুন যা কিছু আপনি করতে পারেন আরকি। এগুলো এতই অবশ্যম্ভাবী যে, এসব নিয়ে আরো কথা বলার প্রয়োজন দেখি না আমি।

আমাদের সময়ের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর এই অভিযানের ব্যাপারটুকু আপনি যদি বুঝতে না পারেন, কিংবা এর মূল্য উপলব্ধি করতে না পারেন, তাহলে বিজ্ঞান জিনিসটা যে আসলে কী, আর এর সঙ্গে অন্য সব কিছুর সম্পর্ক-ই বা কী- এর কিছুই বুঝবেন না আপনি।

বিজ্ঞানের পরবর্তী দিক হলো এর বিষয়বস্তু। মানে, যেটুকু জ্ঞান এখন পর্যন্ত জানা গেছে। যেসব জিনিস আমরা খুঁজে বের করতে পেরেছি। এগুলোই আসল জিনিস। খাঁটি স্বর্ণ। রক্তে অনুভূত প্রবল উত্তেজনা। এত কঠোর পরিশ্রম এবং নিয়মতান্ত্রিক চিন্তা-ভাবনার ফসল। প্রায়োগিক দিক থেকে ভাবলে, কাজ কিন্তু এখানেই শেষ নয়। তবে, যেটুকু খুঁজে বের করতে পেরেছেন, এতদিনের পরিশ্রমের ফল, তার কথা ভেবে উত্তেজনা বোধ করা—সে হিসেবে এটাকে একরকম শেষ বলা যায়। উপস্থিত শ্রোতাদের বেশিরভাগই হয়তো এটা জানেন। তবে যাঁরা জানেন না, তাঁদের জন্য বলি। গুরুত্বপূর্ণ এই দিকটা নিয়ে এক লেকচারে কথা বলে শেষ করা প্রায় অসম্ভব। তবে এটাই হলো বিজ্ঞান চর্চার আসল কারণ। সবচেয়ে উত্তেজনাকর জিনিসও আসলে এটাই। আর, এটা না বুঝলে এই বক্তব্যের মূল কথাটাই বুঝতে পারবেন না আপনি। মিস করে যাবেন। আমাদের সময়ের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর এই অভিযানের ব্যাপারটুকু আপনি যদি বুঝতে না পারেন, কিংবা এর মূল্য উপলব্ধি করতে না পারেন, তাহলে বিজ্ঞান জিনিসটা যে আসলে কী, আর এর সঙ্গে অন্য সব কিছুর সম্পর্ক-ই বা কী- এর কিছুই বুঝবেন না আপনি। এই রোমাঞ্চকর, প্রবল উত্তেজনা এবং রক্তে বয়ে যাওয়া লাগামহীন আনন্দটুকু অনুভব করতে না পারার মানে হলো, ছোট্ট এই জীবনে আপনি বাঁচার মতো বাঁচতে পারবেন না। আপনার সেই অনুভবটুকুই নেই।