মানবসভ্যতা ও সমাজের পেছনে অন্যতম বড় ভূমিকা রেখেছে ভাষা। নিজেদের মধ্যে অর্থপূর্ণভাবে ঠিক করে যোগাযোগ করতে না পারলে সভ্যতা আদৌ গড়ে উঠত বলে মনে হয় না। অন্যান্য প্রাণীর দিকে তাকালেই আমরা এটা বুঝতে পারি।
বর্তমানে পৃথিবীতে হাজারো ভাষা প্রচলিত। প্রশ্ন হলো, এত সব ভাষার প্রচলন কীভাবে হলো? শুরুতে কি সব মানুষের একটি ভাষাই ছিল, নাকি নানা ভাষায় কথা বলত নানা অঞ্চলের মানুষ?
সে জন্য, প্রিয় পাঠক চলুন ফিরে যাই সেই প্রাচীন পৃথিবীতে। যে পৃথিবীর কথা ঘুরেফিরে এসেছে মানুষের ইতিহাসে, কল্পে–গল্পে।
২
কিন্তু শুরুটা কোত্থেকে করা যায়? চট করে ফিরে যাব সেই প্রাচীন পৃথিবীতে? ভাবার চেষ্টা করব, সে সময়ের মানুষ তখন কী করছিল? উঁহু, সেটা করা যাবে না। যুক্তি আমাদের বলে, উল্টো দিক থেকে পুরো জিনিসটা দেখার চেষ্টা করতে হবে। ধীরে ধীরে তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে ফিরে যেতে হবে সেই সময়ে, যখন ভাষার শুরু হয়েছিল।
বিজ্ঞানীরা এটা কীভাবে করেন? মানে ভাষা তো আর ফসিল রেখে যায়নি যে ফসিল বিশ্লেষণ করে, কার্বন ডেটিং করে এর ইতিহাস বের করে ফেলা যাবে। কথা সত্য। কিন্তু আমাদের কয়েক যুগের পূর্বপুরুষের দেহের গঠন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ধীরে ধীরে তারা যোগাযোগের দিকে ঝুঁকছে। তাদের দেহে সেই চিহ্ন ফুটে উঠছে ধারাবাহিকভাবে। সেই সঙ্গে তাদের রেখে যাওয়া বিভিন্ন জিনিসেও আমরা এর ছাপ দেখতে পাই। এসব সূত্র ধরেই বিজ্ঞানীরা ভাষার শুরুর গল্পটা বোঝার চেষ্টা করেছেন।
আগেই বলেছি, কাজটা করতে হবে উল্টোভাবে। সে হিসাবে, প্রথম প্রমাণটা পাওয়া যায় মানুষের লেখালেখির। যে লিখতে পারে, সে যে ভাষা পারবে, তা আর বলতে! কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, মানুষের লেখার ইতিহাসের সূচনা হয়েছে মাত্র কয়েক হাজার বছর আগে। তার মানে এটা আমাদের খুব বেশি দূরে নিয়ে যেতে পারছে না। সে জন্য উনিশ শতকের বিজ্ঞানীরা ভেবেছিলেন, ভাষার উৎপত্তি বের করা মানুষের সাধ্যের বাইরে। শুধু ভেবেই ক্ষান্ত দেননি; ১৮৬৬ সালে প্যারিস ল্যাঙ্গুয়িস্টিক সোসাইটি এ বিষয় নিয়ে আলোচনা-গবেষণাও নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল! তাদের মনে হয়েছিল, এ নিয়ে কাজ করাটা কেবলই সময় নষ্ট।
আশার কথা হলো, সময় বা অর্থ নষ্ট হবে ভেবে কৌতূহলী মানুষ কখনো থেমে যায়নি। সে জন্যই মানুষ চাঁদে পা রাখতে পেরেছে। মানুষের হাতে গড়া ভয়েজার–২ নভোযান পেরিয়ে গেছে সৌরজগতের সীমানা। একইভাবে প্রায় ১০০ বছর পরে এসে জীববিজ্ঞানী ও জীবের ক্রমবিকাশ নিয়ে যে গবেষকেরা কাজ করেন, তাঁদের অনেকে ভাবলেন, ভাষাকে এভাবে ফেলে রাখা যাবে না। আমাদের জীবন ও সভ্যতার এই গুরুত্বপূর্ণ জিনিসের ইতিহাস জানতে হবে। সে জন্য কাজে নামা দরকার। কিন্তু কীভাবে?
ফসিল নেই, নেই যথেষ্ট সূত্র। লেখালেখিও শুরু হয়েছে অল্প কিছুদিন আগে। তাহলে উপায়? বিজ্ঞানীরা ভাবেন। ভেবে ভেবে তাঁরা সেই আপ্ত বাক্যের কাছে ফিরে গেলেন। দশে মিলে করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ! শুধু জীববিজ্ঞানের হাত ধরে হয়তো হবে না। কিন্তু বিজ্ঞানের বাকি সব শাখা আছে কেন? শেষমেশ প্রত্নতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, ভাষাবিজ্ঞান ও কগনিটিভ সায়েন্স—সবকিছু একসঙ্গে নিয়ে মাঠে নামলেন বিজ্ঞানীরা। অবশেষে ফল পাওয়া গেল৷ এর মধ্য দিয়ে শুধু একটি নয়, মানুষের ভাষা খুঁজে পাওয়া নিয়ে দু-দুটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধান মিলে গেল একসঙ্গে।
৩
৪০ হাজার বছর আগের কথা। মানুষ তখন গুহাচিত্র আঁকত। এ ধরনের ছবি আমরা দেখেছি। সেসব ছবির পেছনে চিন্তা, সংস্কৃতি ও বিমূর্ত ভাবনা ছিল, এটুকু বোঝা যায়। ভাষার জন্য ঠিক এই জিনিসগুলোই দরকার। এভাবে কয়েক হাজার বছর থেকে ৪০ হাজার বছর পর্যন্ত পিছিয়ে এলেন বিজ্ঞানীরা। কথা হলো, এ সময়েই কি ভাষার আবির্ভাব হয়েছিল?
হতে পারে, না–ও হতে পারে! সহজ কথায়, সব ঠিকই আছে, কিন্তু এককভাবে এই ব্যাখ্যা যথেষ্ট নয়। আরও প্রমাণ দরকার। সে জন্য বিজ্ঞানীরা সে সময়ের মানবসমাজের দিকে তাকানোর কথা ভাবলেন।
মানুষের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, ৪০ হাজার বছর আগে মানুষ কিন্তু আর এক জায়গায় নেই। গোত্র বা বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে নানা দিকে ছড়িয়ে গেছে। তার মানে, এ সময় যদি ভাষার উৎপত্তি হয়, তাহলে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় একই সঙ্গে বা অল্প সময়ের ব্যবধানে সব মানুষের মধ্যে কিছু পরিবর্তন আসতে হবে। চিন্তার ক্ষমতা তৈরি হলেই শুধু হবে না, সেটা প্রকাশের মানসিক ও শারীরিক ক্ষমতা এবং সে জন্য দেহে প্রয়োজনীয় পরিবর্তনও হতে হবে। এ থেকে আমরা একটি যৌক্তিক সিদ্ধান্তে আসতে পারি।
মানুষ নিশ্চয়ই আরও আগেই ভাষা শিখে গিয়েছিল। সে জন্যই তারা বিমূর্ত চিন্তা করতে শিখেছে ও সেসব গুছিয়ে আঁকতে শিখেছে গুহার দেয়ালে। তাহলে কী দাঁড়াল ব্যাপারটা? তখনকার পৃথিবীতেও ভাষা ছিল, হয়তো বিভিন্ন গোত্র বা দলের মানুষ ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় কথা বলত; কিন্তু উৎপত্তিটা তখন হয়নি। হয়েছে আরও আগে, আরও আদিম পৃথিবীতে।
৪
প্রাণের ক্রমপরিবর্তন ও বিকাশের দিকে তাকালে বুঝব, এপ, হোমো ইরেকটাস, নিয়ান্ডারথাল ও হোমো বার্জেলিয়াস আধুনিক মানুষের কাছাকাছি সময়ের প্রাণী।
এপদের গলায় ছিল বড় আকারের বায়ুথলি। এ দিয়ে তারা ‘গোঁ গোঁ’ ধরনের শব্দ করে প্রতিপক্ষ বা অন্যান্য প্রাণীকে ভয় দেখাত। সমস্যা হচ্ছে, এ ধরনের বায়ুথলি স্বরবর্ণ উচ্চারণে বাধা দেয়। বেলজিয়ামের ফ্রি ইউনিভার্সিটি অব ব্রাসেলসে বিজ্ঞানী বার্ট দ্য বোর এটা সিমুলেশন করে দেখিয়েছেন। কিন্তু মানুষের ভাষার পেছনে স্বরবর্ণ, যাকে বলে আবশ্যক।
এপদের মধ্যে এ ধরনের বায়ুথলি ছিল ঠিকই, কিন্তু হোমো হাইডেলবার্জেনিস প্রজাতির দেহে এ রকম কিছু দেখা যায় না। এই হোমো হাইডেলবার্জেনিস থেকেই পরে নিয়ান্ডারথালরা এসেছে বলে ধারণা করেন বিজ্ঞানীরা। হোমো হাইডেলবার্জেনিস পৃথিবীতে ছিল প্রায় সাত লাখ বছর আগে। তার মানে এ সময় পৃথিবীতে ভাষা না থাকলেও ভাষা তৈরি হওয়ার বেশ কিছু প্রয়োজনীয় উপাদান তত দিনে চলে এসেছে।
আধুনিক মানুষের কথা যদি ভাবি, মস্তিষ্ক থেকে মেরুদণ্ড হয়ে অনেকগুলো স্নায়ু ডায়াফ্রাম ও পাঁজরের মধ্যকার পেশিতে এসে যুক্ত হয়েছে। ঠিকভাবে শ্বাসনিয়ন্ত্রণ ও যথার্থ শব্দ করার জন্য এগুলো জরুরি ভূমিকা রাখে। এই একই জিনিস নিয়ান্ডারথালদের মধ্যেও দেখা যায়।
এই দুই প্রজাতির কানের ভেতরের অংশেও একটা গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন দেখা যায়। ফলে মানুষের উচ্চারিত শব্দের কম্পাঙ্কের যে পরিসীমা আছে, এই সীমায় প্রজাতি দুটির কানের ভেতরে দারুণ সংবেদনশীলতা তৈরি হয়েছে। কথা বলার জন্য শোনা ও এর ভিন্ন ভিন্ন অর্থ বোঝাটা জরুরি। এটার খুব সহজ একটা উদাহরণ আমরা বর্তমানেই দেখতে পাই। যাঁরা কথা বলতে পারেন না, তাঁরা কানেও শুনতে পান না। কারণ, শুনে সেটা প্রকাশ না করতে পারলে, এই ভার মস্তিষ্ক নিতে পারবে না। আবার না শুনলে বলার জন্য প্রয়োজনীয় সক্ষমতা তৈরি হওয়া একরকম অসম্ভব।
এরপরও কথা বলার জন্য আরেকটা জিনিস দরকার। FOXP2 জিন। মস্তিষ্কের যে অংশ কথা নিয়ন্ত্রণ করে, সেখানে কারিকুরি ফলায় এটি। অনেক স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যেই এটা থাকে। কিন্তু মানুষের ভেতরে এই জিন কিছুটা উন্নত। সে জন্যই আমরা মুখ ও চেহারায় ভাষার জন্য প্রয়োজনীয় নড়াচড়াগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। নিয়ান্ডারথালদের মধ্যেও এই জিন ছিল, কিন্তু এতটা উন্নত ছিল না।
এসব তথ্য আমাদের একটা সময়ের দিকে ইঙ্গিত করে। বলা যায়, মোটামুটি তিন লাখ বছর আগে পৃথিবীতে ভাষার উৎপত্তি হয়েছিল। তত দিনে মানুষ নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ গড়ে তুলতে সচেষ্ট হয়ে উঠেছে। প্রয়োজনীয় শারীরিক সক্ষমতা চলে এসেছে তার ভেতরে। ধীরে ধীরে চিন্তার ক্ষমতাও বাড়ছে। সে জন্যই এই ভাবনাগুলো প্রকাশ করা জরুরি হয়ে গেছে। ফলে তৈরি হয়েছে ভাষা।
কিন্তু আরও আগে, প্রায় ২০ লাখ বছর আগে হোমো ইরেকটাসরা যখন শিকার করত, তখন তারা নানা রকম যন্ত্র বানাত। তাহলে তারাও কি ভাষা জানত? হয়তো জানত। হয়তো জানত না। কিন্তু সেই ভাষা যে আধুনিক মানুষের ভাষা ছিল না, এ ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা মোটামুটি নিশ্চিত। মানুষের ভাষার আদিম রূপ, হয়তো ঠিক ভাষা হয়েও ওঠেনি—এমন কিছু থাকলেও থাকতে পারে সে সময়।
এসব মিলিয়ে ধরে নেওয়া যায়, মানুষের মধ্যে ভাষার উদ্ভব হয়েছিল তিন লাখ বছর আগে। আর সেই ভাষাই দিন দিন আরও পরিণত হয়েছে। আবার মানুষ দল বা গোত্রে ভাগ হয়ে যাওয়ার ফলে বিকৃত হয়ে গেছে ভাষা। সেভাবেই তৈরি হয়েছে নানা ধরনের এত সব ভাষা। কিন্তু যতই আলাদা হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি না কেন, ভালোভাবে খুঁজলে আজও আমরা ভিন্ন ভিন্ন ভাষার মধ্যে মিল খুঁজে পাই, খুঁজে পাই কাছাকাছি উচ্চারণ ও অর্থের নানা শব্দ। এ সবকিছুই আমাদের একটি কমন বা সাধারণ ভাষার দিকে ইঙ্গিত করে। অর্থাৎ বিভিন্ন জাতি বা গোত্রের এত সব ভাষার শুরুটা হয়েছিল সাধারণ একটি ভাষা থেকে। একটি প্রজাতির ভাষার শুরু যে একটি সাধারণ ভাষা থেকেই হবে, তা আর আশ্চর্য কী!
৫
ভাষার উদ্ভবের সময়কাল না হয় পাওয়া গেল। কিন্তু কথা হলো, এই সাধারণ ভাষা এল কীভাবে? ভাষার উৎপত্তি যে যোগাযোগের জন্য, সেটা তো বোঝাই যাচ্ছে। কিন্তু এই তাড়না মানুষ অনুভব করা শুরু করল কেন? এ প্রশ্নই মানুষের ভাষা খুঁজে পাওয়া নিয়ে দ্বিতীয় প্রশ্ন। (প্রথম প্রশ্নটা ছিল, ভাষার উৎপত্তিটা কখন হয়েছিল? এই প্রশ্নের উত্তর বের করতে না পারলে সে সময় মানুষ কী কারণে এই তাড়না অনুভব করেছিল, সেটা বের করা কঠিন।)
দ্বিতীয় এই প্রশ্নের তিনটা সম্ভাব্য উত্তর আছে। প্রথম উত্তরটা হলো, বিভিন্ন প্রাণীকে সঙ্গী নির্বাচনের কৌশল হিসেবে অদ্ভুত সব কাজকর্ম করতে দেখা যায়। মানুষও সে রকম কিছু করতে চাইত। এর ফলে প্রোটোল্যাঙ্গুয়েজ বা ‘আদি ভাষা’ ধরনের একটা কিছু একটা গড়ে ওঠে। অবশ্য এই আদি ভাষার সরাসরি কোনো অর্থ ছিল না। যেমন পাখির ডাক।
আদিম পুরুষেরা সেই আদি ভাষা ব্যবহার করে আদিম মানবীদের আকর্ষণ করতে চাইত। প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যাওয়ার জন্য তারা আদি ভাষা নিয়ে আরও ভাবতে থাকে এবং আরও জটিল ও সুমধুর কোনো ধ্বনি প্রকাশের চেষ্টা করতে থাকে। এভাবেই ভাষা গড়ে ওঠে। উদাহরণ হিসেবে আরেকটি প্রাণীর কথা বলা যায়। গিবন নামের প্রাইমেটরাও এভাবে গেয়ে গেয়ে নারী গিবনদের আকৃষ্ট করতে চায়। মাছদের মধ্যেও নারীদের আকর্ষণের জন্য নানা কিছু করতে দেখা যায়। কেউ কেউ পরে এই অনুমানের ওপরে ভিত্তি করে বলেছেন, শুধু পুরুষেরা এমনটা না–ও করতে পারে। নারীরাও হয়তো একইভাবে পুরুষদের আকৃষ্ট করতে চাইত। বর্তমানেও আমরা এটা দেখতে পাই। সঙ্গী নির্বাচন বা কাউকে পছন্দ করার পেছনে তার ভাষার ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আকর্ষণীয় কথা বলা বা কোনো কিছু ব্যাখ্যার ভঙ্গি আমাদের মুগ্ধ করে।
কিন্তু এ রকম হলে, এর ফলে জন্ম নেওয়া বাচ্চাদের বাকিদের তুলনায় অনেকটা এগিয়ে থাকার কথা। বাড়তি কোনো বৈশিষ্ট্য বা সুবিধা পাওয়ার কথা তাদের। আবার একই জিনিস বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়া সব কটি গোত্র বা দলের মধ্যেই ঘটতে হবে। এ সবকিছু বিবেচনা করে এই উত্তরকে সঠিক বলে মনে হয় না।
কিন্তু এই আইডিয়ার ওপরে ভিত্তি করেই দ্বিতীয় উত্তর বা ধারণাটি গড়ে ওঠে। বিজ্ঞানীরা খেয়াল করে দেখলেন, স্বাভাবিক মানুষ, এমনকি অন্ধরাও সাধারণত হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলার চেষ্টা করে। তাহলে ‘আদি ভাষা’টা হয়তো স্বরনির্ভর নয়, গড়ে উঠেছিল ভঙ্গিনির্ভর ভাষা হিসেবে। সে ব্যাপার এখনো আমাদের মধ্যে রয়ে গেছে। হয়তো সে জন্যই এখনো আমরা কিছু বোঝাতে না পারলে হাত বা কাঁধ নেড়ে অঙ্গভঙ্গি করি। আবার, সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে এই ভঙ্গি ভালো রকম প্রভাব রাখতে পারে। যেমন বক্তব্যের সময় মানুষের ভঙ্গি দেখে আকৃষ্ট হই আমরা। নাচের মুদ্রা দেখে আকৃষ্ট হই। এই ব্যাপারগুলোর ব্যাখ্যাও পাওয়া যায় কিছুটা করে।
আবার খেয়াল করলে দেখা যাবে, অন্যান্য বেশ কিছু প্রাণীও টুকটাক অঙ্গভঙ্গি করে। মানুষ হয়তো ভাবতে শেখার কারণে এই ভঙ্গিকে এগিয়ে নিয়েছিল আরও অনেক দূর। আর অঙ্গভঙ্গি করে যে পুরোপুরি যোগাযোগ করা যায়, সেটা তো আমরা জানিই। মূক-বধির অনেকেই এভাবে যোগাযোগ করেন।
দারুণ চিন্তাভাবনা হলেও এই প্রস্তাবনারও একটা বড় ঝামেলা আছে। ভঙ্গিনির্ভর এই ভাষা থেকে স্বরনির্ভর ভাষা এল কীভাবে?
এটা বোঝার জন্য তৃতীয় আরেকটি আইডিয়া বা উত্তর নিয়ে ভাবলেন বিজ্ঞানীরা। এ আইডিয়াই বর্তমানে সবচেয়ে ভালোভাবে ভাষাকে ব্যাখ্যা করতে পারে। এটাকে বলে ওনোম্যাটোপিয়া (Onomatopoeia)। মানে কোনো শব্দ শুনে সেটা নকল করার চেষ্টা। এখনো মানবশিশুদের এ রকম শব্দ শুনে শুনে বলার চেষ্টা করতে দেখা যায়।
মানুষের যদি ভাষা বলার মতো যথেষ্ট বোধ না–ও থেকে থাকে, তবু শুনে শুনে এই নকল করতে পারাটা খুব জটিল কিছু নয়। আগেই বলেছি, ভাষা আসতে আসতে তত দিনে মানুষের মধ্যে ধ্বনি উচ্চারণের শারীরিক সক্ষমতা চলে এসেছে। তা ছাড়া নতুন কিছু গবেষণা থেকে বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছেন, অন্যান্য প্রাইমেটও বেশ ভালোভাবেই শ্বাস ও গলার নড়াচড়া নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
যৌক্তিকভাবে ব্যাপারটা থেকে আমরা একটি কল্পনা দাঁড় করাতে পারি। বিভিন্ন প্রাণীর ডাক শুনে শুনে মানুষ সেটিকে নকল করতে শিখেছে। সেসব প্রাণীর বিরুদ্ধে টিকে থাকতে গিয়ে বানাতে হয়েছে সরঞ্জাম। সেই সঙ্গে সে রকম কোনো প্রাণী, যেমন বাঘ আসতে দেখলে বাকিদের সাবধান করে দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা তৈরি হয়েছে। বাঘের গর্জন নকল করে নিজেদের লোকজনকে সতর্ক করে দেওয়ার চেয়ে সহজ আর কী আছে? তাতে করে ভিন্ন ভিন্ন প্রাণীকে শনাক্ত করতে পারছে মানুষ। আবার ধীরে ধীরে এসব ধ্বনি বা ডাকের মধ্যে পরিবর্তন করার চেষ্টা করছে। আরেকটি ভালো ব্যাপার হলো, বিভিন্ন প্রাণীর ডাক নকল করে শিকারের জন্য তাদের প্রলুব্ধ করে ফাঁদেও ফেলা সম্ভব ছিল। এভাবে ধীরে ধীরে অর্থবোধক ধ্বনি বুঝতে শিখেছে মানুষ। বুঝতে শিখেছে, ধ্বনির মাধ্যমে চাইলে অন্যদের কিছু বোঝানো যায়।
সেই সঙ্গে অঙ্গভঙ্গিও শিখছিল মানুষ। এটা অবশ্য অনেকটাই সহজাত (মানুষ ছাড়া অন্যান্য প্রাণীর মধ্যেও এটা দেখা যায়)। তা ছাড়া সরঞ্জাম বানাতে গিয়েও হাত-পা অর্থবোধকভাবে নাড়ানোর কৌশল বুঝতে পারছিল মানুষ। এভাবেই, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গড়ে উঠতে শুরু করে ভাষা।
একটা সময়, হয়তো রাতের বেলায় আগুনের পাশে বসে মজা করে বিভিন্ন প্রাণীর ডাক নকল করতে গিয়ে বা নিজেদের মতো করে কিছু বোঝাতে গিয়ে মানুষ গাইতে শিখেছে। টের পেয়েছে, গলার তাল-লয় নিয়ন্ত্রণ করে অর্থবোধক ধ্বনিকে আরও সুমধুর করে তোলা যায়।
ভাষার ব্যবহার শেখার পেছনে গান গাওয়ার বেশ বড় ভূমিকা আছে বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা। সাধারণ বাক্যে ‘আমরা’ বা দলগত বোধটা সেভাবে প্রকাশ পায় না। গানে সেটা সহজেই করা যায়। একজন গাইতে থাকলে বাকিরা গলা মেলাতে পারে। এটাও আসলে আমাদের সহজাত প্রবৃত্তির অংশ। এখনো সে জন্যই গান শুনলে আমরাও গলা মেলাই, মেলাতে চাই। শব্দ করে না হলেও মনে মনে গেয়ে উঠি একই বাক্য।
ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের নৃতত্ত্ববিদ জেরোম লুইস মনে করেন, এভাবেই গড়ে উঠেছে ভাষা। এই প্রস্তাবনা সত্যি হলে এটি যেমন ভাষা ও গানের উৎপত্তির ব্যাখ্যা দিতে পারবে, তেমনি বলতে পারবে এগুলোর উৎপত্তির সময়কালও। আর এই উৎপত্তির সময়টা পেলে দিন দিন ভাষার ওপরে কী প্রভাব পড়েছে এবং ভাষা কীভাবে বদলেছে, তার একটি মোটামুটি হিসাব আমরা দাঁড় করাতে পারব।
‘পারব’ বা ভবিষ্যৎমূলক বাচ্যে বলার কারণ, ভাষা নিয়ে বিজ্ঞানীদের এ গবেষণা এখনো চলমান। প্রচুর প্রমাণ আছে সত্যি, তবে অনেক সুতা এখনো বাঁধা যায়নি ঠিকভাবে।
শব্দ হয়তো ফসিল রেখে যায় না, রেখে যায় না কোনো চিহ্ন। কিন্তু এত বছর পরে হলেও আমরা এর ইতিহাস লেখার কিছু সূত্র খুঁজে পেয়েছি। হয়তো আরও কিছুটা সময় লাগবে কিন্তু আমরা নিশ্চয়ই লিখে ফেলতে পারব ভাষার ইতিহাস। মানুষের ইতিহাসের ওপরে এর প্রভাব ও সময়ের বাঁকে বাঁকে ঘটে এর দিকবদল। বিজ্ঞানীরাও সে জন্যই ভাষার গল্পটা বোঝার চেষ্টা করে গেছেন নিরন্তর।
কারণ, ভাষার ইতিহাস ছাড়া মানুষের ইতিহাস কোনোভাবেই পূর্ণতা পায় না।
লেখক: সদস্য, সম্পাদনা দল, বিজ্ঞানচিন্তা
সূত্র: নিউ সায়েন্টিস্ট, উইকিপিডিয়া