দুধের রসায়ন

দুধ তরল রাসায়নিক পদার্থ। তাই এরও রসায়ন থাকবে, দুধের রসায়ন! এই রসায়নের পক্ষেই দুধের বিবিধ বিষয়ের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব। এই যেমন দুধ জিনিসটা কেন সাদা, সবাই কেন দুধ খেতে পারে না বা খেলেও হজম হয় না ইত্যাদি। ছবিতে দুধের গঠনের কিছু প্রাথমিক বিষয় তুলে ধরা হয়েছে, তবে আমরা আরেকটু ভেতরের বিষয়েও জানব। সুবিধার জন্য আলোচনায় আমরা খালি গরুর দুধ নিয়েই আলোচনা করব। যদিও যে কথাগুলো বলব, সেগুলো মোটামুটি অন্য সব প্রাণীর দুধের বেলায়ও প্রযোজ্য।

দুধ দেখতে খুব সাধারণ। কিন্তু এর মূলে আছে আসলে এক জটিল রাসায়নিক চরিত্র। এর বেশির ভাগ অংশই পানি। সঙ্গে আছে খুব সামান্য পরিমাণ ফ্যাট বা স্নেহজাতীয় পদার্থ, প্রোটিন, মিনারেল এবং অন্যান্য যৌগিক পদার্থ। পানি এবং ফ্যাট বা স্নেহজাতীয় পদার্থ মেশে না, কিন্তু দুধে কয়েকটা কারণে এরা একধরনের ইমালসনের মতো করে থাকে। দুধে ফ্যাট যেমন ইমালসন করে থাকে, তেমনি দুধ হচ্ছে সহজ অর্থে স্রেফ পানি, যাতে নানা প্রকারের প্রোটিন ভেসে বেড়ায়।

ট্রাইগ্লিসারাইড দুধে সব ফ্যাটজাতীয় পদার্থ তৈরি করে। এই ট্রাইগ্লিসারাইড অণুগুলোতে মূল মেরুদণ্ড হিসেবে কাজ করে গ্লিসারল। এর সঙ্গে যুক্ত থাকে তিনটি ফ্যাটি অ্যাসিড চেইন বা শিকল। ফ্যাটি অ্যাসিড চেইনগুলোর পরিচয় আবার আলাদা আলাদা হতে পারে। মানে একই হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। তবে দুধে সবচেয়ে বেশি যেসব ফ্যাটি অ্যাসিড দেখা যায়, সেগুলো হচ্ছে পামিটিক (Palmitic), ওলিক (Oleic), স্টিয়ারিক (Stearic) এবং মাইরিস্টিক (Myristic) অ্যাসিড। এই ফ্যাটি অ্যাসিডগুলো দুধে কী পরিমাণ থাকবে, তা আবার নির্ভর করে গরু কী খাচ্ছে, তার ওপর। যেমন ধরা যাক, বর্ষায় গরু প্রচুর সবুজ ঘাস খায়, এ সময় এদের দুধে ওলিক অ্যাসিডের মাত্রা বেশি দেখা যায়। অ্যাসিডের মাত্রার এই যে পার্থক্য, এর ওপরই নির্ভর করে যে ফ্যাট যখন দুধ থেকে আলাদা করে ফেলা হয়, তা কতটুকু শক্তপোক্ত হবে।

দুধের খুব ছোট তরল একটা ফোঁটা (ড্রপলেটস) স্বতন্ত্রভাবে মাত্র ৩ থেকে ৪ মাইক্রোমিটার চওড়া হয়। এ রকম একটা ফোঁটার চারদিকটা নানা রকম পদার্থ দিয়ে ঘেরা থাকে। এর মধ্যে আছে প্রোটিন, এগুলো আবার ফোঁটাগুলোকে দুধের জলের সঙ্গে ইমালসন তৈরিতে সাহায্য করে। ফ্যাট বা স্নেহজাতীয় পদার্থের ঘনত্ব পানির চেয়ে কম, তাই এক গ্লাস দুধ একদম নাড়াচাড়া না করে স্থির করে রাখলে দুধের গ্লাসের ওপরের দিকে এসে ফ্যাট জমা হয় এবং তখন এই ফ্যাট খুব সহজেই সরিয়ে ফেলা যায় বা স্কিমড (Skimmed) করে ফেলা যায়। তাতে পাওয়া যায় স্কিমড মিল্ক বা ফ্যাট ছাড়া দুধ।

প্রোটিন হচ্ছে দুধের আরেকটি মূল উপাদান। এই প্রোটিনের কারণেই দুধের রং সাদা হয়। দুধের প্রোটিনের আণবিক গঠন মূলত বেশ লম্বা, যার বিল্ডিং ব্লক হিসেবে থাকে ছোট ছোট অ্যামাইনো অ্যাসিড। এসব ছোট অ্যামাইনো অ্যাসিড ব্লক মিলে চেইনের মতো দেখতে লম্বা আণবিক গঠন তৈরি হয় দুধের প্রোটিনের। দুধে প্রায় কয়েক শ ধরনের প্রোটিন থাকে ঠিকই, তবে মূল প্রোটিনটা হচ্ছে কেসিন।

দুধে মিসেলেস নামের একটা গঠন তৈরি করে প্রোটিন। এরা আবার জন্মায় ক্যালসিয়াম ফসফেটের ছোট ছোট গুচ্ছ থেকে। ক্যালসিয়াম ফসফেটের এই গুচ্ছই মিসেলেসগুলোকে একত্র করে রাখে। এই মিসেলের আবার রয়েছে বিভিন্ন ধরনের মডেল, কোনটা কোন মডেল, সেটা বের করা বেশ সময়সাপেক্ষ ও গবেষণার কাজ।

গড়ে এসব মিসেলেসের ব্যাস প্রায় ১৫০ ন্যানোমিটার। এরা এতই ছোট যে আলোর আঘাতেও এরা ভেঙে যেতে পারে। আলোর আঘাতে এক গ্লাস দুধ বা এক গ্যালন দুধের ভেতর যে এই বিশালসংখ্যক মিসেলেস ভেঙে যাচ্ছে, এ কারণেই দুধকে দেখায় সাদা।

এ ছাড়া দুধে অন্য যেসব উপাদান আছে, তা দুধে থাকা পানিতে মিশ্রিত অবস্থায় থাকে। এর মধ্যে আছে মিনারেল, ভিটামিনের মধ্যে ল্যাকটোজও থাকে। (কিছু ভিটামিন আবার ফ্যাট বা স্নেহজাতীয় পদার্থে দ্রবীভূত হয়, এদের পাওয়া যায় ফ্যাট ড্রপলেটসে বা খুদে ফোঁটায়।

ল্যাকটোজ হচ্ছে চিনির এমন এক ধরনের উপাদান, যা শুধু দুধ ও দুগ্ধজাতসামগ্রীতেই পাওয়া যায়। আমাদের শরীরের এনজাইম ল্যাকটোজ দুধ বা দুগ্ধজাত দ্রব্যের ল্যাকটোজকে ভেঙে দুটি ছোট আকৃতির চিনিতে রূপান্তর করে গ্যালাকটোজ এবং গ্লুকোজে। যা হোক, কিছু মানুষের শরীর দুধ বা দুগ্ধজাত দ্রব্যের ল্যাকটোজকে ভাঙার মতো যথেষ্ট ল্যাকটোজ উৎপাদন করতে পারে না। এরাই মূলত ল্যাকটোজ ইনটলারেন্ট বা ল্যাকটোজ অসহনশীল মানুষ। এই মানুষদের পৌষ্টিক তন্ত্র বা ডাইজেস্টিভ সিস্টেমে ল্যাকটোজ অপরিবর্তিত অবস্থায় পৌঁছে যায় কোলনে। সেখানে থাকা ব্যাকটেরিয়া ল্যাকটোজ ভেঙে গ্যাস উৎপাদন করে খুব অস্বস্তিকর একটা পরিস্থিতি তৈরি করে।

দুধের টক স্বাদের জন্যও দায়ী ব্যাকটেরিয়া। ব্যাকটেরিয়ার কারণে দুধে থাকা ল্যাকটোজ পরিণত হয় ল্যাকটিক অ্যাসিডে। ফলে দুধ টক হয়ে যায়। এতে দুধের অম্লত্ব বাড়ে, এর ফলে দুধে থাকা প্রোটিন ছাড়া ছাড়াভাবে জমাট বেঁধে যায়। সাধারণ দুধের ক্ষেত্রে এ ঘটনা কাম্য নয়। যদিও এই প্রক্রিয়াতেই পনির বানানো হয়। পনির বানানোর ক্ষেত্রেও চমৎকার কিছু রাসায়নিক বিক্রিয়া আছে। সে গল্প নাহয় অন্য কোনো সময় বলা যাবে।

লেখক: কো-অর্ডিনেটর, স্কুল অব পাবলিক হেলথ অ্যান্ড লাইফ সায়েন্সেস, ইউনিভার্সিটি অব সাউথ এশিয়া

সূত্র: কম্পাউন্ড ইন্টারেস্ট