হুমাসন: সামান্য থেকে অসামান্য জ্যোতির্বিদ

প্রথম মহাযুদ্ধের পর মাউন্ট উইলসনে আসেন মার্কিন জ্যোতির্বিদ এডউইন হাবল। খুব দ্রুত বিখ্যাত হয়ে ওঠেন তিনি

বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে দূরবর্তী গ্যালাক্সিগুলোর লোহিত বিচ্যুতি বা রক্তিম সরণ আবিষ্কারে বিশ্বের সবচেয়ে বড় টেলিস্কোপ বসানো হচ্ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসের স্বচ্ছ আকাশ লক্ষ্য করে মাউন্ট উইলসনে এই টেলিস্কোপ বসানোর কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। একদল খচ্চরের পিঠে টেলিস্কোপের বড় অংশগুলো টেনে তুলতে হয়েছিল পাহাড়ের ওপরে। মিউল স্কিনার বা খচ্চর দলের তত্ত্বাবধানকারী ছিলেন এক তরুণ। নাম মিল্টন হুমাসন। তিনি যান্ত্রিক ও আলোক যন্ত্রপাতি, বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী ও উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের পর্বতশীর্ষে নিয়ে যেতেও সহায়তা করতেন। ঘোড়ার পেছনে থাকা খচ্চর দলকে এগিয়ে নিতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতেন হুমাসন। তাঁর শিকারি সাদা কুকুরটি ঘোড়ার জিনের পেছনে দাঁড়িয়ে সামনের থাবা রাখত হুমাসনের কাঁধে। হুমাসন ছিলেন তামাকসেবী, ডকশ্রমিক, দক্ষ জুয়াড়ি ও পুল খেলোয়াড়। কিন্তু প্রথাগত শিক্ষায় অষ্টম শ্রেণিও পার হতে পারেননি। অথচ এই মার্কিন নাগরিক পরে পরিণত হন সবচেয়ে দক্ষ পরীক্ষণ জ্যোতির্বিদে।

তাঁর পুরো নাম ছিল মিল্টন লা স্যালে হুমাসন। জন্ম যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটার ডজ সেন্টারে। মাত্র ১৪ বছর বয়সে স্কুল থেকে ঝরে পড়েন হুমাসন। এরপর আর আনুষ্ঠানিক লেখাপড়া করেননি বা করতে পারেননি। তিনি পাহাড়-পর্বত ভালোবেসেছিলেন। তাঁর বিশেষ পছন্দের ছিল মাউন্ট উইলসন। উইলসন অবজারভেটরি নির্মাণ করার সময় পর্বতের ওপরে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি মিউল স্কিনার বা খচ্চর প্রতিপালকের দায়িত্ব পান। এরপর ১৯১৭ সালে লা ভার্নে একটি প্রজননকেন্দ্রে কাটানোর পর মানমন্দিরের দ্বাররক্ষকের দায়িত্ব পান তিনি। প্রবল উৎসাহ নিয়ে অবজারভেটরিতে নাইট সহকারী হয়েছিলেন উইলসন। প্রযুক্তিগত দক্ষতা ও শান্ত স্বভাব তাঁকে পাহাড়ে জনপ্রিয় করে তোলে। ১৯১৯ সালে জর্জ এলারি হেল তাঁকে মাউন্ট উইলসনের স্টাফ সদস্য করে নেন। এটি নজিরবিহীন ছিল। যেহেতু হুমাসনের পিএইচডি, এমনকি উচ্চবিদ্যালয়ের ডিপ্লোমাও ছিল না। তিনি দ্রুত হেলের সিদ্ধান্তকে সঠিক প্রমাণিত করেন। কারণ, কয়েকটি মৌলিক পর্যবেক্ষণমূলক আবিষ্কার করেছিলেন তিনি। তাঁর পর্যবেক্ষণগুলো হাবলের সূত্রসহ ভৌত কসমোলজির বিকাশে বড় ধরনের ভূমিকা নিয়েছিল।

মাউন্ট উইলসনে টেলিস্কোপ নির্মাণের যন্ত্রপাতি হুমাসন খচ্চরচালিত গাড়িতে করে উঁচুতে নিয়ে যেতেন। এ জন্য প্রচুর পরিশ্রম করতে হয় তাঁকে। শুধু নিয়ে যাওয়াই নয়, যন্ত্রপাতিগুলোর ব্যাপারে ছিল তার প্রবল উত্সাহ ও স্বাভাবিক কৌতূহল। প্রথমে মানমন্দিরটিতে তিনি ইলেকট্রিশিয়ানের সহকারী দ্বাররক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করেন। নিজে যেসব টেলিস্কোপ স্থাপনে সাহায্য করেছেন, সেগুলোর মেঝে পরিচ্ছন্নতার কাজও তাঁকে করতে হতো। একদিন টেলিস্কোপ সহকারী অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন তাঁর কাজ হুমাসনকে করতে বলা হলো, যদি তিনি পারেন। অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে যন্ত্রপাতিগুলো ব্যবহার করলেন তিনি। এ ঘটনাই তাঁর ভাগ্য বদলে দিল। পেয়ে গেলেন টেলিস্কোপ অপারেটরের চাকরি। ধীরে ধীরে পর্যবেক্ষণে সহায়ক হয়ে উঠলেন।

প্রথম মহাযুদ্ধের পর মাউন্ট উইলসনে আসেন মার্কিন জ্যোতির্বিদ এডউইন হাবল। খুব দ্রুত বিখ্যাত হয়ে ওঠেন তিনি। হাবল ছিলেন মেধাবী, সংস্কৃতিমান ও সামাজিক। হাবলই অবশেষে দেখান, সর্পিলাকার নীহারিকাগুলো আসলে ‘দ্বীপবিশ্ব’ বা ‘আইল্যান্ড ইউনিভার্স। অর্থাৎ আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির মতো বিশালসংখ্যক নক্ষত্রের পুঞ্জ সেগুলো। আবার তিনি এমন এক নাক্ষত্রিক আদর্শ প্রদীপ বা স্ট্যান্ডার্ড ক্যান্ডল বের করেন, যাকে গ্যালাক্সিগুলোর দূরত্ব পরিমাপে কাজে লাগানো যায়। হাবল ও হুমাসন মিলিতভাবে বেশ ভালোভাবে কাজটি এগিয়ে নেন। বেমানান জোড়া হওয়া সত্ত্বেও একত্রে সমঝোতা-সম্প্রীতির মধ্য দিয়ে এগিয়ে যান তাঁরা। লয়েল মানমন্দিরে জ্যোতির্বিদ ভি এম স্লিফারের নেতৃত্বে তাঁরা দূরবর্তী গ্যালাক্সিগুলোর বর্ণালি পরিমাপ শুরু করেন।

দূরবর্তী গ্যালাক্সিগুলো নিয়ে পর্যবেক্ষণের সুযোগ পান হুমাসন। সেখান থেকে আসা বর্ণালি ও আলোকচিত্র বিশ্লেষণেও দেখান অসামান্য পারদর্শিতা। একেবারে পেশাদার জ্যোতির্বিদের মতো। ১৯৫০ সালে লুন্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডিএসসি ডিগ্রি দেয়। ১৯৫৭ সালে তিনি অবসর নেন। এর আগে মাউন্ট উইলসন অবজারভেটরির পূর্ণ স্টাফ সদস্য হয়েছিলেন তিনি। নিজের কাজের গুরুত্ব, সেগুলোর বৈজ্ঞানিক ভিত্তিও গভীরভাবে বুঝেছিলেন। আবার জ্যোতির্বিদ সম্প্রদায়ের গভীর শ্রদ্ধা নিয়েই পৃথিবী থেকে বিদায় নেন তিনি।

আধুনিক কসমোলজির সবচেয়ে বড় তত্ত্ব হলো বিগ ব্যাং ও মহাবিশ্বের প্রসারণ। এই তত্ত্ব জন্ম হয় আলোক বর্ণালিতে ডপলার ইফেক্ট প্রয়োগ করে

ধূমকেতু সি/১৯৬১ আবিষ্কার করেছিলেন হুমাসন। ধূমকেতুটি বিশাল পেরিহেলিয়নের জন্য বিখ্যাত। স্রেফ সুযোগের অভাবে প্লুটো আবিষ্কারের কৃতিত্ব থেকে বঞ্চিত হন। প্লুটোর আবিষ্কারকের মর্যাদা পান ক্লাইড টম্বগ। কিন্তু তাঁর ১১ বছর আগেই চারটি ছবি তুলেছিলেন, যেগুলোতে প্লুটোর ছবি ছিল।

অনেকের ধারণা, বামন গ্রহটি তার আবিষ্কার না করতে পারার কারণ এই নয় যে তিনি বুঝতে পারেননি, বরং ফটোগ্রাফিক প্লেটের ত্রুটি স্থানে ছবিটি পড়েছিল। যেভাবেই হোক, তিনটি ভিন্ন রাত ধরে চারটি পৃথক ফটোগ্রাফে এটার উপস্থিতি প্রায় অসম্ভবই লেগেছিল।

হুমাসন যেসব কাজ করেছিলেন, সেগুলোর বেশির ভাগের ফলই হাবলের কাছে জমা হয়েছিল। বহু বছর একসঙ্গে কাজ করেছিলেন দুজন। তিনি ক্যালিফোর্নিয়ার মেনডোসিনোয় মারা যান।

কোনো গ্যালাক্সি থেকে আসা আলোর মধ্যে লুকিয়ে থাকে শতকোটি নক্ষত্রের বিকিরিত আলোর সমষ্টি। গ্যালাক্সির বাইরের স্তরের নক্ষত্রগুলোর পরমাণু নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সি বা রং শোষণ করে। এই নক্ষত্রগুলো আলো হিসেবে সেগুলোই নিঃসরণ করে। ফলে সেখান থেকে পাওয়া বর্ণালি তথ্যগুলো বলে দেয়, আমাদের প্রতিবেশী নক্ষত্রের মতো একই রাসায়নিক উপাদান দিয়েই সেসব নক্ষত্র তৈরি। হুমাসন ও হাবল দূরবর্তী গ্যালাক্সিগুলোর বর্ণালিতে রক্তিম সরণ খুঁজে পান। বর্ণালির এই রক্তিম সরণ বা লোহিত বিচ্যুতিই বলে দেয়, সেগুলো আমাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। তাঁরা ডপলার ইফেক্ট ব্যবহার করে দেখেন, যেসব নক্ষত্রের দূরত্ব যত বেশি, সেগুলোর বর্ণালিরেখার রক্তিম সরণও তত বেশি। অর্থাৎ যে নক্ষত্রের অবস্থান যত দ্রুত, সেগুলোর দূরে সরে যাওয়ার গতি তত বেশি।

এখন কথা হলো, কেন গ্যালাক্সি বা নক্ষত্রগুলো আমাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে? বিশ্বে আমাদের যে অবস্থান, তার পেছনে এগুলোর কি কোনো ভূমিকা রয়েছে? আমাদের মিল্কিওয়ে কি সেগুলোর সঙ্গে আক্রমণাত্মক আচরণ করছে, ফলে সেগুলো দূরে সরে যেতে বাধ্য হচ্ছে? এভাবে ভাবার চেয়ে বরং অন্যভাবে চিন্তা করাই যুক্তিসংগত ছিল। ভাবনাটি হলো, মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে। সেটাই ভেবেছিলেন হাবল ও হুমাসন। এর মাধ্যমে প্রকারান্তরে তাঁরা বিগব্যাং তত্ত্বই আবিষ্কার করেছিলেন।

কার্ল সাগানের বিখ্যাত ডকুমেন্টরি কসমস। এর দশম পর্বে হুমাসনের জীবন ও কর্মের কাহিনি বলা হয়েছে। চাঁদের একটি খাদের নামকরণ করা হয় হুমাসনের নামানুসারে—হুমাসন ক্রেটার। ফ্রিৎজ জুইকির সঙ্গে তাঁর নাম জুড়ে একটা নক্ষত্রের নামকরণ করা হয়েছে হুমাসন-জুইকি স্টার।

আধুনিক কসমোলজির সবচেয়ে বড় তত্ত্ব হলো বিগ ব্যাং ও মহাবিশ্বের প্রসারণ। এই তত্ত্ব জন্ম হয় আলোক বর্ণালিতে ডপলার ইফেক্ট প্রয়োগ করে। আগে শুধু শব্দের ক্ষেত্রে ডপলার ইফেক্ট প্রয়োগ করা হতো। সহজ কথায়, কোনো শব্দের উৎস যখন আপনার দিকে এগিয়ে আসে, তখন শব্দের তীক্ষ্ণতা এক রকম। যখন উৎস আপনার কাছে এসে স্থির হয়, তখন শব্দের তীক্ষ্ণতা আরেক রকম। উৎস যখন আপনার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, তখন তীক্ষ্ণতা অন্য রকম। এর কারণ, উৎস যখন গতিশীল হয়, তখন শব্দের কম্পাঙ্কের পরিবর্তন হয়। তেমনি আলো বা বর্ণালির ক্ষেত্রেও হয়। আলোর উৎস যখন দূরে সরে যায়, সেই আলোর কম্পাঙ্ক বিচ্যুত হয়ে লালের দিকে সরে যায়। এটাই হলো রক্তিম সরণ বা লোহিত বিচ্যুতি। তেমনি মহাকর্ষ বলের ক্ষেত্রেও এমন লাল বিচ্যুতি কাজ করে। আলো যখন কোনো শক্তিশালী মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের মধ্য দিয়ে যায়, তখন এর রক্তিম সরণ ঘটে। এই সরণ পর্যবেক্ষণের একজন পথিকৃৎ হচ্ছেন হুমাসন।

লেখক: বিজ্ঞানবক্তা; সম্পাদক, মহাবৃত্ত