স্বচ্ছ, অস্বচ্ছ এবং অর্ধ-স্বচ্ছ

সূর্য ডুবে যায়, অর্ধেক পৃথিবীর ওপর অন্ধকার নেমে আসে, দৃশ্যমান বস্তুগুলো অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে যায়। আবার সকাল হয়, সূর্যোদয় হয় জগৎ আলোকিত হয়ে ওঠে। বস্তুগত পৃথিবী আবারও দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। কী অপূর্ব প্রকৃতির এ রকম বিন্যস্ত নিয়মগুলো। আলোর ওপরই প্রকৃতির নিয়মগুলো প্রতিষ্ঠিত।

আমরা আমাদের চারপাশে কত রকম বস্তুই তো দেখি। বই, খাতা, কলম, টেবিল, দরজা-জানালা, দেয়াল, গাছপালা, মাটি, পানি, মানুষ, পশুপাখি, বিভিন্ন ধাতব ও অধাতব বস্তু, চাঁদ, সূর্য, তারা ইত্যাদি। এই সব ধরনের বস্তুকে আমরা তিন রকমভাবে দেখি—স্বচ্ছ, অল্প স্বচ্ছ ও অস্বচ্ছ। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে স্বচ্ছ বা অস্বচ্ছ যেকোনো ধরনের বস্তুই প্রয়োজনীয়। কখনো কি প্রশ্ন জাগে, কোনো বস্তু কেন স্বচ্ছ হয়? অথবা কেন অস্বচ্ছ? পানি বা কাচ স্বচ্ছ পদার্থ। আবার লোহা, অ্যালুমিনিয়াম, রুপা কেন অস্বচ্ছ? আমরা কীভাবে এই স্বচ্ছ বা অস্বচ্ছতার ব্যাখ্যা দিতে পারি? এর ব্যাখ্যা আসলে আলোর মাঝেই আছে। তাহলে আলোর কাছেই ফিরে যাওয়া যাক।

সূর্যের আলোয় সাতটি রং আছে। বস্তুর ওপর এই আলো এসে পড়লে তিনটি ব্যাপার ঘটতে পারে—১. আলো বস্তু দ্বারা শোষিত হয় ২. বস্তুর পৃষ্ঠ থেকে আলো ঠিকরে পুনরায় ফিরে আসে অর্থাৎ প্রতিফলন ঘটে এবং ৩. বস্তু ভেদ করে আলো বেরিয়ে যায়, অর্থাৎ আলোর প্রতিসরণ ঘটে।

বস্তুর ধর্মই হচ্ছে আলো শোষণ করা, প্রতিফলন করা ও প্রতিসরণ করা। সুতরাং এই তিনটি ক্রিয়ার মধ্যেই লুকিয়ে আছে স্বচ্ছতা-অস্বচ্ছতার আসল গল্প। এবার একটু ভেবে দেখা যাক, কোনটা ঘটলে বস্তু স্বচ্ছ, আর কোনটা ঘটলে অস্বচ্ছ দেখাবে।

প্রথমে আসি শোষণ ও প্রতিফলনে। কোনো বস্তুর ওপর সূর্যালোক পড়লে বস্তুটি যদি আলো শোষণ না করে সম্পূর্ণ আলোটুকুর প্রতিফলন ঘটায়, তাহলে বস্তুটি পুরোপুরি সাদা দেখা যাবে। আবার বস্তুটি যদি আপতিত আলোর কিছু পরিমাণ শোষণ করে বাকিটুকুর প্রতিফলন ঘটায়, তাহলে বস্তুটি রঙিন দেখাবে। এই রঙিন দেখানোর ব্যাপারটা নির্ভর করে বস্তুটি কোন কোন রঙের আলোকরশ্মি শোষণ করে, আর কোন কোন আলো শোষণ না করে প্রতিফলন মাধ্যমে ফিরিয়ে দেয়। যেমন গাছের পাতায় যখন সূর্যালোক পড়ে, তখন সেই পাতা ছয়টি রঙের আলোকরশ্মি শোষণ করে নেয়। আর সবুজ রঙের আলোকরশ্মি প্রতিফলনের মাধ্যমে আমাদের চোখে পাঠিয়ে দেয়, তখন আমরা পাতাটা সবুজ দেখি।

এবার আসি প্রতিসরণে। ধরা যাক, বস্তুটি আপতিত আলোটুকু শোষণ করল না, আবার প্রতিফলনও করল না, পুরো আলোটুকুই প্রতিসরণ করল, এ অবস্থায় আমরা বস্তুটি দেখতে পাব না। কারণ বস্তুটিকে দেখতে হলে আলোর প্রতিফলন দরকার। কিন্তু এবার তা হয়নি। ঠিক এই অবস্থাকে বলে স্বচ্ছতা। বস্তুটিকে দেখতে পাব না, কিন্তু বস্তুটির অপর পাশে যা থাকবে, তা সবই দেখা যাবে এই স্বচ্ছতার কারণে। পানি বা কাচ এ কারণেই স্বচ্ছ পদার্থ। এখন পাঠকের মস্তিষ্কে নিশ্চয় একটা জোরালো প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে, পানি ও কাচ স্বচ্ছ, তাহলে পানি বা কাচ দেখতে পাওয়ার কথা নয়। কেন দেখতে পাই?

আসলেই দেখতে পাওয়ার কথা নয়, কিন্তু ওই যে বলা হলো আলোর প্রতিফলনের কথা। স্বচ্ছ পদার্থগুলো সামান্য আলো প্রতিফলন ঘটায়, তাই দেখতে পাই। এ ক্ষেত্রে উল্লেখ্য, কাচ আলোর কতটুকু প্রতিসরণ ঘটাবে, তা নির্ভর করে কাচের পুরুত্ব ও বিশুদ্ধতার ওপর। প্রকৃতিতে এমন বিশুদ্ধ ও পুরুত্ববিশিষ্ট কাচ বা প্রতিসারক পদার্থ নেই, যা সম্পূর্ণ আলোর প্রতিসরণ ঘটাতে পারে। তবে প্রায় সম্পূর্ণ আলোর প্রতিসরণ ঘটাতে পারে পরীক্ষাগারে সে রকম বিশেষ কাচ তৈরি করা যায়।

প্রশ্ন জাগতে পারে, পানি তাহলে বর্ণহীন কেন? পানি আসলে নির্দিষ্ট রঙের আলোকরশ্মি শোষণ করে না। পানি যেটুকু আলোর প্রতিসরণ ঘটায়, সবটুকুতেই সাতটি রঙের আলোকরশ্মির মিশ্রণ থাকে। তেমনি যেটুকু আলোর প্রতিফলন ঘটায়, তাতেও সাতটি রঙের আলোকরশ্মির মিশ্রণ থাকে। আর সামান্য কিছু আলো শোষণ করে, সেখানেও সাতটি রঙের আলোকরশ্মিই থাকে। কাজেই পানি স্বচ্ছ এবং একই সঙ্গে দৃশ্যমান ও বর্ণহীন। স্বচ্ছতার বিপরীত হলো অস্বচ্ছতা। তাই বস্তুর অস্বচ্ছতার কারণটা নিশ্চয়ই এখন বোঝা যাচ্ছে—অস্বচ্ছ পদার্থ আলোর কোনোরূপ প্রতিসরণ ঘটায় না।

এবার অন্য একটি বস্তুর ওপর সূর্যের আলো ফেলা হলো। ধরা যাক, বস্তুটি সূর্যের সাতটি রঙের আলোকরশ্মির মধ্যে কোনোটিরই প্রতিফলন ও প্রতিসরণ ঘটায় না। সব কটি আলোকরশ্মি শোষণ করে নেয়, এমনকি আপতিত আলোর পুরোটুকুই শোষণ করে ফেলে, এ অবস্থায় বস্তুটি কেমন দেখাবে? অবশ্যই কুচকুচে কালো দেখাবে। ‘কালো দেখাবে’—এমন বলা যায় না। আমরা আসলে বস্তুটিকে দেখতেই পাব না। আগেই বলা হয়েছে, কোনো বস্তুকে দেখার ব্যাপারটা নির্ভর করে ওই বস্তু থেকে আলোর প্রতিফলনের ওপর। কালো মানে আসলে রঙের অভাব। এটা কোনো রং নয়। সম্পূর্ণ আলো প্রতিসরণ করলে যেমন বস্তুটিকে দেখা যাবে না। ঠিক তেমনি সম্পূর্ণ আলো শোষণ করলে সে বস্তুও দেখা যাবে না। সম্পূর্ণ আলো শোষণ করার ক্ষমতা আছে, এমন বস্তুর উপস্থিতি পৃথিবীতে আদৌ পাওয়া যায়নি। তবে মহাবিশ্বের কৃষ্ণগহ্বরগুলো আলো শোষণ করে পুরোপুরি, আবার বিকিরণ ঘটার মতো সমূহ কারণ থাকলেও সেই বিকিরিত আলোও বেরিয়ে আসতে দেয় না। টেনে এনে নিজের কাছেই রেখে দেয়। এ জন্য কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিত্ব টের পাওয়া বেশ কঠিন।

বিভিন্ন বস্তু এমন ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম প্রদর্শনের কারণ কী? বস্তুর এমন ধর্মের কারণ হচ্ছে, তাদের পারমাণবিক গঠন। এতক্ষণ যে আলো শোষণ, প্রতিফলন ও প্রতিসরণের কথা বলা হলো, তার সবকিছুর পেছনেই ইলেকট্রনের কারসাজি রয়েছে। ইলেকট্রন আলোকশক্তি শোষণ করলে প্রতিসরণ বা প্রতিফলন হয় না, আবার শোষণ না করলে প্রতিফলন অথবা প্রতিসরণ হয়।

আমরা পৃথিবীতে যে এত রং দেখি, সবকিছুই আসলে আলোকরশ্মির বিভিন্ন রঙের ভিন্ন ভিন্ন তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের রশ্মি। কোনো বস্তুরই নিজস্ব কোনো রং নেই। শুধু বস্তু তার নির্দিষ্ট ধর্মের মাধ্যমে আলো প্রতিসরণ বা প্রতিফলন বা শোষণ করে অথবা প্রতিসরণ, প্রতিফলন ও শোষণের মাধ্যমে তার রূপভেদ প্রকাশ করে।

শুরুর দিকে এক বিজ্ঞানীর পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যাপারে বলছিলাম। মানুষের পেছনের আড়াল থেকে এক্সপেরিমেন্ট দেখতে না পারার ও রকম অসুবিধা দূর করার মতো কিছু উদ্ভাবন করা যেতে পারে হয়তো, এ-ই স্বচ্ছ অস্বচ্ছতার মূলনীতি থেকেই।

লেখক: বঙ্গবন্ধু টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, কালিহাতী, টাঙ্গাইল