সাক্ষাৎকার

‘পুরস্কার পেতেই হবে, এমন ভেবে গণিত অলিম্পিয়াডে আসার দরকার নেই’—মুনির হাসান, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি

বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সাধারণ সম্পাদক তিনি। বাংলাদেশ বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ সমিতির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি। তাঁর নেতৃত্বে জুনিয়র সায়েন্স অলিম্পিয়াড, আন্তর্জাতিক রোবট অলিম্পিয়াডসহ একাধিক আন্তর্জাতিক আয়োজনে অংশ নেয় বাংলাদেশ। শুধু বিজ্ঞান নয়, বিডিওএসএনের মাধ্যমে ব্যবসা ও স্টার্টআপ সংস্কৃতির পরিসর বৃদ্ধিতেও কাজ করছেন। পাশাপাশি তিনি প্রথম আলোর ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন ও যুব কার্যক্রমের প্রধান সমন্বয়ক। বাংলাদেশের কিশোর-তরুণ-যুবকদের এগিয়ে যাওয়ার পেছনে তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য। তিনি মুনির হাসান।

বিজ্ঞানচিন্তার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি নিজের গল্প শুনিয়েছেন, প্রত্যাশার কথা বলেছেন। গণিত অলিম্পিয়াড, গণিত পড়া, কারিকুলামসহ সাক্ষাৎকারের নির্বাচিত কিছু অংশ প্রকাশিত হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিজ্ঞানচিন্তার নির্বাহী সম্পাদক আবুল বাসার ও সহসম্পাদক উচ্ছ্বাস তৌসিফ

বিজ্ঞানচিন্তা:

কেমন আছেন?

মুনির হাসান: আছি, ভালো আছি।

বিজ্ঞানচিন্তা:

আপনি গণিত অলিম্পিয়াড, রোবট অলিম্পিয়াড, জুনিয়র সায়েন্স অলিম্পিয়াড, বিডিওএসএনসহ বিভিন্ন আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত। আপনার কী মনে হয়, আপনার কোন কাজটা মানুষ দীর্ঘদিন মনে রাখবে?

মুনির হাসান: আমার মনে হয়, মানুষ আমার কোনো কাজই মনে রাখবে না। বাঙালি কিছুই মনে রাখে না। হয়তো বলতে পারে, গণিত অলিম্পিয়াড এই লোকটা শুরু করেছিল। এ ছাড়া আর কিছু মনে রাখবে বলে আমার মনে হয় না। যদিও কাজটি আমি একা করিনি। অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যার, মোহাম্মদ কায়কোবাদ স্যার, মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যার, প্রথম আলো সম্পাদক মতি ভাইদের (মতিউর রহমান) মতো মানুষের সাহায্য, প্রথম আলো বন্ধুসভা, এক দল লড়াকু ভলান্টিয়ার পেয়েছি বলে কাজটা আমরা করতে পেরেছি। বর্তমানে এটি একটি পর্যায় অতিক্রম করেছে। সারা বিশ্বে ১০০টির বেশি দেশ অংশগ্রহণ করে, এমন কোনো প্রতিযোগিতা থেকে বাংলাদেশের একমাত্র সোনার পদকটি আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াড থেকে এসেছে।

গণিত উৎসবে বক্তব্য দিচ্ছেন মুনির হাসান
ছবি: ফাইল ছবি/ তানভীর আহমেদ
বিজ্ঞানচিন্তা:

গণিত অলিম্পিয়াড বা অন্য অলিম্পিয়াড তো খুব কঠিন ও পরিশ্রমের একটা কাজ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সরকারিভাবে এগুলো করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে প্রথম এটাকে একটা উৎসব হিসেবে আয়োজন করা হয়। এখানে আপনার বড় ভূমিকা রয়েছে। কাজটা কীভাবে শুরু করলেন?

মুনির হাসান: আমরা যেভাবে উৎসব আকারে অলিম্পিয়াড করি, এ রকম আর কোনো দেশে করা হয় না। ব্রাজিল ও অস্ট্রেলিয়ার ম্যাথ অলিম্পিয়াড কিন্তু আমাদের চেয়ে বড়। ওরা কী করে? স্কুলে একটা পরীক্ষা নেয়। তারপর জেলাভিত্তিক পরীক্ষা নিয়ে ধীরে ধীরে বাছাই করে। মানে, ওগুলো একটা সাধারণ পরীক্ষার মতো হয়। কিন্তু আমরা একটু অন্যভাবে চেষ্টা করেছি।

দুটি কারণে আমরা উৎসবের চেষ্টা করেছি। প্রথমত, আমাদের দেশে পরীক্ষা বললে হয়তো এর মধ্যে কোচিং সেন্টার, সিলেবাস ইত্যাদি ঢুকে যাবে। সে জন্য শুরু থেকে আমরা বলছি, এটা একটা উৎসব। সিলেবাস বলতে কিছু নেই। তোমার বইয়ের ও বইয়ের বাইরে থেকে প্রশ্ন থাকবে। দ্বিতীয়ত, তোমাকে আমরা সবকিছু দিয়ে দেব, কিন্তু কোনো প্রশ্ন রিপিট করা হবে না। শিক্ষার্থীরা যাতে আনন্দ পায়, সে জন্য আমরা এই চেষ্টা করি।

শুরুটা হয় কায়কোবাদ স্যারের মাধ্যমে। আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডের কথা আমি জানতাম। একবার এমনিতে ইন্টারনেট খুঁজে বিস্তারিত জানলাম। মেইল করলাম আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডের সেক্রেটারিকে। তিনি জানালেন, ড. কায়কোবাদ মেইল করেছেন এ ব্যাপারে। আপনি তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করুন। তখন আমি কায়কোবাদ স্যারের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। তখনই বুঝে গেছি, আমাদের কিছু একটা করতে হবে। এর মধ্যে একদিন কায়কোবাদ স্যার আমাকে বললেন, চলুন আপনাকে একজনের বাসায় নিয়ে যাব। তখন আমরা দুজনেই বুয়েটের। স্যার আমাকে নিয়ে মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের বাসায় গেলেন। তখন আমরা ওখানে বসে আলোচনা করলাম। প্রতি শুক্রবার আমরা এই আলোচনা করতাম।

প্রতি শুক্রবার সকাল সাড়ে ছয়টায় কায়কোবাদ স্যার আমার বাসায় আসতেন। তারপর দুজনে জাফর স্যারের বাসায় গিয়ে একসঙ্গে সকালের নাশতা করতাম। গল্পগুজব করে কায়কোবাদ স্যার নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটিতে পড়াতে যেতেন। আমি ফিরতাম বাসায়। এভাবে ধীরে ধীরে শুরু হলো। তখন আমি বললাম, স্যার আমরা প্রথম আলোতে প্রশ্ন ছাপাই। তাঁরা রাজি হলেন। তারপর বললাম, আমরা প্রথম সপ্তাহে শুধু প্রশ্ন ছাপাব, পরের সপ্তাহে সেগুলোর উত্তর দেব। জাফর স্যার বললেন, না। উত্তর ছাপানো যাবে না। শিক্ষার্থীরা উত্তর লিখে আমাদের পাঠাবে। সেগুলো আমরা দেখে দেব।

সমাধান চেক করার জন্য আমরা মুসা ইবরাহিমকে (মাউন্ট এভারেস্ট জয়ী) যুক্ত করলাম। তার আগে, ২০০২ সালের এপ্রিল মাসে জাফর ইকবাল ও কায়কোবাদ স্যার আলাপ–আলোচনা করে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানের সঙ্গে কথা বললেন যে আমরা এ রকম অলিম্পিয়াডের একটা পাতা করতে চাই প্রথম আলোয়। তিনি রাজি হলেন। প্রথম আলোতে প্রতি সপ্তাহে ‘নিউরনে অনুরণন’ নামে একটা বিভাগে প্রশ্ন ছাপা হতে লাগল। এভাবে শুরু হলো। অনেক উত্তর আসতে লাগল। মুসা ইবরাহিম এটা কো-অর্ডিনেট করত। তার কাছে একটা খাতা ছিল। সে সবার নাম লিখে রাখত। কোনো শিক্ষার্থী ৩০টি উত্তর পাঠালে আমরা তাকে উত্তর দিতাম যে তোমার এতগুলো সমাধান সঠিক হয়েছে। কিন্তু কোনটা সঠিক আর কোনটা ভুল, তা বলতাম না। যাতে তারা সব সময় সেগুলো নিয়ে চর্চা করতে পারে। এ রকম প্রশ্ন যখন ২০০ হলো, তখন সেগুলোর একটা সংকলন বই আকারে করার কথা ভাবা হলো। সেটি প্রকাশও করা হলো।

অন্যদিকে ২০০২ সালে ২৬ জানুয়ারি ঢাকার কারওয়ান বাজারের সিএ ভবনের ৯ তলায় আমরা প্রথম গণিত অলিম্পিয়াডের আয়োজন করি। ১১৫ জন প্রতিযোগী ছিল সেখানে। সেই থেকে আমাদের পথচলা শুরু। আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে কেবল হাইস্কুলের শেষের দিকের শিক্ষার্থীরা অংশ নেয়। কিন্তু আমরা তৃতীয় থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত গেলাম।

তখন আমরা আসলে কোনো ফরম্যাট জানতাম না। কারণ, তখন তো দেশে অলিম্পিয়াড নামে কোনো কিছু ছিল না। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আমরা এখনকার এই ফরম্যাট দাঁড় করিয়েছি। শুরুতে আমরা পরীক্ষা পর্বের পর ম্যাথ ড্রিল করা, সমস্যাগুলো সমাধান করার সেশন করতাম খাতা দেখার সময়ে। পরে ধীরে ধীরে আজকের ফরম্যাট হয়েছে অনেক পরীক্ষা–নিরীক্ষার পর।

২০১০ সালের দিকে যখন আমরা রংপুরে বইমেলা করি, তখন অনুষ্ঠান শেষে অনেক শিশু আমাদের ঘিরে ধরে। তারা জানায়, যখন আমরা বইমেলা করতে আসি, তখন শুধু গণিতের বইগুলো পাওয়া যায়। বাকি সময় এ বই তারা পায় না। বিশেষ করে গণিতের বই। তত দিনে কিন্তু আমরা ২০-২৫টি গণিতের বই লিখে ফেলছি। এখন তো সেটা প্রায় ৩০০ ছাড়িয়ে গেছে। সেই সমস্যা সমাধানের জন্যই কিন্তু অনলাইনভিত্তিক বইয়ের বাজার রকমারি ডট কমের জন্ম হয়েছে।

গণিত উৎসব ২০১১-এর প্রশ্নোত্তর পর্ব
ছবি: ফাইল ছবি
বিজ্ঞানচিন্তা:

শিশু-কিশোরেরা তো আগে গণিত ভয় পেত। এখন দেখা যাচ্ছে, শিশুদের গণিতভীতি কিছুটা হলেও কমেছে। তারা এখন গণিত ভালোবাসে। এখন দেশে আরও অনেক অলিম্পিয়াড আছে। এটা একটা বিজ্ঞান আন্দোলন। এটাকে আপনি কীভাবে দেখেন?

মুনির হাসান
ছবি: ফাইল ছবি

মুনির হাসান: আমরা কখনোই গণিতভীতি বলতাম না। বলতাম গণিত শিক্ষকভীতি। আমাদের কিছু শিক্ষক নিজের মতো করে অঙ্ক না করলে কেটে দিতেন। কিন্তু একটা অঙ্ক যে হাজার রকমভাবে করা যায়, তা কখনো শিক্ষকেরা বোঝাতেন না। সে জন্য আমরা শুরুতেই চেষ্টা করলাম, অঙ্ক যেভাবেই করুক, তা ঠিক থাকলে নম্বর দিতে হবে। এর জন্য আমরা অনেক ধরনের পুরস্কার চালু করি যেমন বিউটিফুল সলিউশন, জাজেস চয়েস ইত্যাদি। আমরা আরও দেখলাম, আমাদের শিক্ষার্থীরা জ্যামিতি করতে চায় না। কারণ, এটা মুখস্থ করা কঠিন।

পরীক্ষায় আসে একটি উপপাদ্য প্রমাণ করতে হবে। কিন্তু এই প্রমাণে তো আনন্দ নেই। তবে এই প্রমাণ করে একটা সমস্যার সমাধান করতে পারলে আনন্দ পাওয়া যায়। সুতরাং আমরাই প্রথম সংখ্যাভিত্তিক জ্যামিতিক সমস্যাগুলো নিয়ে কাজ শুরু করি। এতে কিন্তু জ্যামিতি সহজ হয়ে যায়। কারণ, এখানে মুখস্থের ব্যাপার নেই। ক্যালকুলেশন করবে, হিসাব–নিকাশ করে বের করবে। এর মধ্যে একটা মজা আছে। এই যেমন আমরা তিনজন বসে আছি চেয়ারে। তিনজনে চারটা চেয়ারে কতভাবে বসা যায়, সেটা খুঁজে বের করতে বলি। এগুলো পারমুটেশন-কম্বিনেশনের সূত্র না কষেও সমাধান করা যায়। সেগুলো আবার আমরা ভিয়েতনাম থেকে শিখে এসেছি। এখন বাংলাদেশে সরকারি প্রাইমারি স্কুলে যেভাবে গণিত শিখায়, তার নামই গণিত অলিম্পিয়াড পদ্ধতি। এই অ্যাকটিভিটিনির্ভর পড়াশোনা আমরা বের করেছি।

বিজ্ঞানচিন্তা:

আগের তুলনায় এখনকার পাঠ্যবই আরও রঙিন হয়েছে। ম্যাথ অলিম্পিয়াডের সঙ্গে যুক্ত মানুষেরাই তো এই বইয়ের সঙ্গে যুক্ত। এই বইগুলোর কতটা উন্নতি হয়েছে বা আরও পরিবর্তন করা এখনো বাকি আছে কি না?

মুনির হাসান: আমাদের পাঠ্যপুস্তকের একটা সাধারণ সমস্যা আছে। সেটা হলো, বই লেখার আগে বলে দেওয়া হয়, এত পৃষ্ঠার বেশি বই লেখা যাবে না। ফর্মা হিসাব করে বই লিখতে হয়। এগুলো মাথায় রাখতে গিয়ে সব বইয়ে ঠিকভাবে সবকিছু দেওয়া সম্ভব নয়। তা ছাড়া টিচার্স গাইডের কনসেপ্ট এখনো আমাদের দেশে জনপ্রিয় নয়। ওখানে শিক্ষকদের জন্য যে সমস্যা দেওয়া হয়েছে, এগুলোতে এখনো একটু অসুবিধা আছে। আর বিদেশে একটি বই লিখতে প্রায় ৩ থেকে ৫ বছর সময় দেওয়া হয়। সেখানে আমাদের দেশে ২ থেকে ৩টি বই লিখতে হয় এক বছরে। তবে হয়তো জিনিসটা এখন ভালোর দিকে যাচ্ছে।

একটা গ্রাম বা বাজারে গেলে অনেক চায়ের দোকান দেখা যায়। সেখানে শিশুরা কাজ করে। ওরা কিন্তু নিখুঁতভাবে হিসাব করতে পারে। কতজন খেল, কী খেল, কতটা খেল—সবকিছু মাথায় রেখে সে কিন্তু হিসাবটা করতে পারে। কিন্তু এই একই কাজ আমাদের পঞ্চম শ্রেণি পাস করা শিক্ষার্থীরা করতে পারে না। সমস্যা হলো, আমাদের স্কুলে শেখানো গাণিতিক সমস্যাগুলো দেখে এগুলো ভিজ্যুয়ালাইজ করা শেখা যায় না। আমাদের সিলেবাসের আরও একটা বড় দুর্বলতা ছিল, আন্দাজ করতে পারা। আমরা যখন গণিত অলিম্পিয়াডে জিজ্ঞেস করতাম, এক মিটার কত বড়, তখন তারা বিভিন্ন সাইজ দেখাত। সে এক মিটার পড়েছে, ওটা জানে। কিন্তু ৭ মিটার কত বড়, এটা ভিজ্যুয়ালাইজ করতে পারে না। ৬ কিলোমিটার কত দূর, তা বুঝতে পারে না। আমাদের দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি—এটা কত মানুষ, তা বুঝতে পারে না। এই ১৬ কোটি মানুষকে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে গেলে কী হবে, এটা তারা বুঝতে পারে না। কারণ, আমাদের সিলেবাসে এই জিনিস নেই। আমরা শুধু ছেলেমেয়েদের ক্যালকুলেটর বানানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু আমাদের উদ্দেশ্য তো এটা নয়। তারা তো একটা সমস্যার সমাধান করতে শিখবে। এ জন্য পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি গণিত অলিম্পিয়াড ও অন্যান্য বইয়ের সমস্যা সমাধান করতে হবে।

যাদব চক্রবর্তী সম্পর্কে বলা হয়, পরীক্ষায় ১০টি প্রশ্ন ছিল (মোট ১০০ নম্বর, প্রতিটিতে ১০)। তিনি এর একটা অঙ্ক ১০ ভাবে করেছেন। ১০-ই পেয়েছেন। বাকি ৯টা তিনি করেন নাই। তাই ওনাকে আর কোনো নম্বর দেওয়া যায়নি। এ জন্য তিনি ফেল করেছিলেন।

আসলে সবচেয়ে বড় কথা হলো, আমাদের গণিত কেন করতে হবে? আমাদের দেশের ছেলেমেয়েদের এটা কখনো বলা হয় না, তুমি কেন এটা শিখবে? কেন এটা জানা দরকার বা কেন এটা হয় না? সৃজনশীল মেধা অন্বেষণে এসে ফাইনাল স্টেজে ওদের সঙ্গে আমাদের দেখা হয়। আমরা ওদের (a+b)2 = a2 + 2ab + b2 কীভাবে হলো, তা প্রমাণ করতে বলি। অনেক ছেলেমেয়ে এটা পারে না। আবার যদি বলি, ab রেখাংশ cd-এর সমান। জ্যামিতিতে এর তাৎপর্য কী? এটা তারা বোঝে না। জবাব দিতে পারে না এই প্রশ্নের। এগুলো তারা মুখস্থ করে ফেলে।

আবার আমাদের দেশে জ্যামিতি শেখানোর যে পদ্ধতি, এর মধ্যে বড় ধরনের ভুল আছে। আমরা সব সময় শর্টকাট খুঁজি। কিন্তু জ্যামিতি শিখতে হবে ইউক্লিডের পদ্ধতিতে। একটা ছোট শিশু অর্ধেক চেনে না, কিন্তু আমরা তাকে বলছি একটা রেখার অর্ধেকের চেয়ে বেশি নিয়ে একটা বৃত্তচাপ আঁক। এভাবে রেখাটা অর্ধেক করো (মধ্যবিন্দু বের করো)। এটা তো হলো না। আগে কেউ একজন এ রকম করেছে, তাই এখনো চলছে। এ কারণে ঝামেলা আমাদের গণিত, রসায়ন সবখানে আছে। তবে ভালো দিক হলো, নতুন কারিকুলামে অনেক কিছু ঠিক করা হয়েছে। যেকোনো কারিকুলাম ঠিক হতে ২ বা ৩ বছর লাগে। আমাদের তো এখন বই হয়ে গেল। এরপর বইগুলো রিভিশন হবে, অনেক কারেকশন হবে। এভাবে চলতে চলতে দু-এক বছরের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে।

আমাদের দেশের শিক্ষা আধুনিক করার একটা সহজ সংজ্ঞা আগে ছিল। সেটা হলো অষ্টম শ্রেণির জিনিস সপ্তম শ্রেণিতে দিয়ে দাও। সপ্তম শ্রেণিরটা আবার ষষ্ঠ শ্রেণিতে দাও। এরপর পঞ্চম, চতুর্থ, এভাবে চলতে থাকবে। কিন্তু এভাবে তো আধুনিক হওয়া যাবে না। বয়স অনুসারে তাকে এগোতে হবে। এর মধ্যে কিছুদিন ষষ্ঠ শ্রেণিতে তিন ধরনের সিস্টেম দিয়েছিল। এর তো কোনো দরকার নেই। বাইনারিও দিয়েছিল। আমরা বাদ দিয়েছি। এগুলোর কোনো দরকার নেই। তারপর সংখ্যারেখা পড়ত হাইস্কুলে ওঠার আগে। কোনো দরকার নেই। ওগুলো ষষ্ঠ শ্রেণিতে দেওয়া হয়েছে এখন। আমাদের দেখতে হবে, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তার যে ম্যাচুরিটি (বোঝার ক্ষমতা) হয়েছে, তা ঠিকভাবে ইনপুট দিয়ে প্রবলেম সলভিংয়ের জন্য তৈরি করতে পারি কি না। এটাই এখন শুরু হয়েছে।

সারা দেশে বিজ্ঞানচিন্তার মতো একটা ম্যাগাজিন বের করে সবার কাছে পৌঁছে দেওয়া কঠিন কাজ বলে মন্তব্য করেন মুনির হাসান; বিজ্ঞানচিন্তার অষ্টম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে
ছবি: খালেদ সরকার
বিজ্ঞানচিন্তা:

বর্তমান সময়ে অষ্টম থেকে দশম শ্রেণির শিক্ষাক্রম নিয়ে বিতর্ক চলছে। এটা নিয়ে আপনার কি মনে হয়?

মুনির হাসান: আমাদের প্রচুর টেকনোলজির লোক দরকার। প্রচুর ডিবেটের লোক, অ্যাকাউন্টের লোক দরকার। আমাদের প্রচুর রংমিস্ত্রি, রাস্তা বানানোর লোক দরকার। আমাদের দেশে আমরা মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখি না। রিকশাচালককে দেখি রিকশাচালক হিসেবে। এ জায়গাটা যেহেতু আমরা তৈরি করতে পারি নাই, তাই সবাই মনে করে তাদের একটা ডেস্ক জব পেতে হবে। অন্য কাজের কোনো ভ্যালু নেই যেমন আমাদের দেশে কত ছেলেমেয়ে ডাক্তারি পড়বে? ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বে কতজন? সবাই তো ডাক্তার আর ইঞ্জিনিয়ার হবে না। এই কয়েকজন ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার তৈরির জন্য লাখ লাখ ছেলেমেয়েকে ব্রহ্মগুপ্ত বা অ্যাপোলোনিয়াসের উপপাদ্য পড়ানো হয়। সবার তো এসব উপপাদ্য পড়ার দরকার নেই। কারণ, সবাই ইঞ্জিনিয়ার হবে না। সুতরাং শুধু শুধু এতগুলো কঠিন জিনিস আমরা শিশুদের পড়াব কেন?

আমাদের দরকার এফেক্টিভ লোক। সামনে পড়াশোনা আরও পরিবর্তন হবে। হয়তো চ্যাটজিপিটির মাধ্যমে পড়ে ফেলবে। সেখানে আমরা শিশুদের কেন কষ্টের মধ্যে ফেলব? ভবিষ্যতে ছেলেমেয়েদের প্রোগ্রামিংও পড়তে হবে না। প্রযুক্তিই সেগুলো করে দেবে। আমাদের চেষ্টা করতে হবে, সে যেন চিন্তা করতে পারে। চিন্তা করতে হলে, উদ্ভাবক হতে হলে গল্প-উপন্যাস পড়তে হবে। শুধু গণিত করলে হবে না। এই যে আমাদের ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সঙ্গে মানবিক ও দর্শনের সম্পর্ক নেই, তাতে কিন্তু আখেরে আমাদের মানবিক প্রকৌশলী খুব একটা হয় নাই।

ভবিষ্যতে ছেলেমেয়ে নিজের ইচ্ছায় সাবজেক্ট চেঞ্জ করতে পারবে। ১০টা সাবজেক্ট বাধ্যতামূলক পড়বে। বছরে হয়তো দুটি পরীক্ষা দেবে। তবে ঘটা করে পুলিশ বা সরকারি লোক রেখে যে পরীক্ষার সিস্টেম, তা আর থাকবে না। যেকোনো জায়গায় বসে পরীক্ষা দিতে পারবে।

বিজ্ঞান উৎসব ২০২২-এর উদ্বোধনী পর্বে অতিথিরা
ছবি: খালেদ সরকার
বিজ্ঞানচিন্তা:

গণিত অলিম্পিয়াডের অনেকেই ভালো রেজাল্ট করছে। বিদেশে পড়তে যাচ্ছে, গবেষণা করছে। তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার কোনো পরিকল্পনা কি আপনাদের আছে? বা তারা যদি দেশে ফিরে আসতে চায়, তাহলে তাদের জন্য কী করা উচিত?

মুনির হাসান: তারা এসে প্রাইভেট বা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে জয়েন করতে পারে। দেশে টুকটাক গবেষণা করার কিছু প্রতিষ্ঠান আছে। আমরা নিজেরাও একটা গবেষণা প্রতিষ্ঠান দাঁড় করানোর চেষ্টা করছি, যাতে তারা এসে কাজ করতে পারে। তবে ফিজিক্যালি এসে কাজ করা খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়। একটা ছেলে বা মেয়ে বিদেশে থেকেও দেশের জন্য কাজ করতে পারে। পিএইচডিতে গাইড করতে পারে।

আমাদের দুর্ভাগ্য যে আমার শিক্ষক প্রফেসর রেজওয়ান খান, উনি বুয়েটে থাকতে কয়েকজনকে পিএইচডি করিয়েছেন। উনার বয়স হয়েছে, ফ্যাসিলিটি বেড়েছে। কিন্তু উনি যেহেতু প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে আছেন, তাই উনি আর পিএইচডি গাইড করাতে পারছেন না। অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে, যারা পিএইচডি দিতে পারে। কিন্তু  প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি চাইলেই পিএইচডি করাতে পারে না। অনেক সময় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভালো সুযোগ-সুবিধা দিতে পারে তারা। সুতরাং এগুলো নিয়ে আমাদের অনেক কাজ করতে হবে। না হলে গবেষণা এগোবে না।

আর সামনের দিনগুলো কিন্তু অনেক খারাপ। মাটি কাটার জন্য তো একসময় বাংলাদেশ থেকে লোক নিয়ে যেত। কিন্তু মাটি কাটার জন্য এখন রোবট আছে। এ রকম বহু কায়িক শ্রমের কাজ ভবিষ্যতে রোবট দিয়ে করানো যাবে। এখানে আমি কাজটাকে ছোট করছি না, কায়িক শ্রমের বিষয়টা বোঝাচ্ছি। আমরা যে আনস্কিলড লোকদের বিদেশে পাঠিয়ে টাকা পাই, সেগুলো আমরা ভবিষ্যতে পাব না। কাজেই আমাদের গবেষণা ও রিসোর্স নিয়ে চিন্তা করতে হবে।

আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশ দলের অংশগ্রহণ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলন। বসে বাঁ দিক থেকে (অতিথি): বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সাধারণ সম্পাদক মুনির হাসান, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) সহিদুর রহমান খান, বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সহসভাপতি অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল, বিজ্ঞানচিন্তার সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম। ওপরে বাঁ দিক থেকে (শিক্ষার্থী): মো. ফোয়াদ আল আলম, তাহমিদ হামিম চৌধুরী, নুজহাত আহমেদ দিশা, তাহজিব হোসেন খান, মো. আশরাফুল ইসলাম ফাহিম, এস এম এ নাহিয়ান। ঢাকা, ৫ জুলাই
ছবি: দীপু মালাকার
বিজ্ঞানচিন্তা:

ভবিষ্যতে যারা গণিত অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ করতে চায়, তাদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?

মুনির হাসান:  শুধু গণিত অলিম্পিয়াড করার জন্য গণিত অলিম্পিয়াডের দরকার নেই। স্বপ্নপূরণের অংশ হিসেবে গণিত অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ করতে হবে। পুরস্কার পেতেই হবে, এমন ভেবে গণিত অলিম্পিয়াডে আসার দরকার নেই।

অনুলিখন: অনিক রয়, শিক্ষার্থী, উদ্ভিদবিজ্ঞান, সরকারি তিতুমীর কলেজ