জ্যোর্তিবিদ্যার অগ্রপথিক আবদুল জব্বার

১৯৩৯ সাল। বছর চব্বিশের এক বাঙালি তরুণ সমুদ্র জাহাজে চেপে চলেছেন বিলেতে। ডক্টরেট ডিগ্রি নিতে। কিন্তু জাহাজ ছাড়ার দুই দিন পর দ্বিতীয় যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। জার্মানরা তখন যেখানে-সেখানে বোমা ফেলছে। ব্রিটিশ জাহাজেও যে বোমা পড়বে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তা ছাড়া ব্রিটিশদের ওপরও মহাখাপ্পা হিটলারের নাৎসি বাহিনী। হিটলারের কোনো যুদ্ধজাহাজ কিংবা আকাশযান যদি টের পায় কোনো এক ব্রিটিশ জাহাজ ভেসে চলেছে ব্রিটেনের দিকে, নির্ঘাত তাতে বোমা পড়বে। সুতরাং জাহাজের ক্যাপ্টেন অন্য পথ ধরলেন। তখন ভারত থেকে জাহাজ বিলেতে যেত সুয়েজ খালের ভেতর দিয়ে। ক্যাপ্টেন জাহাজের মুখ ঘোরালেন আফ্রিকার দিকে। গোটা আফ্রিকা উপকূল ঘুরে জাহাজ পৌঁছাল ব্রিটেনে। নিরাপদে।

জাহাজে থাকা সেই বাঙালি তরুণটিও তাই ভালোয় ভালোয় পৌঁছে গেলেন ইংল্যান্ডে। সেখানে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বছর গবেষণা করেন। তারপর সুযোগ পান ডক্টরেটে ভর্তি হওয়ার। কিন্তু বিধি বাম! তত দিনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অগ্নিশিখা দাউ দাউ করে জ্বলছে বিশ্বজুড়ে। তবে হিটলার বাহিনীতে ইউরোপই বেশি আক্রান্ত। শুধু মিলিটারিতে আর কুলোচ্ছে না মিত্রবাহিনীর। অত সৈন্যই বা পাবে কোথায়! সুতরাং সাধারণ লোককেও বাধ্য করা হচ্ছে যুদ্ধে যেতে। রেহাই পাচ্ছেন না ছাত্র-শিক্ষকেরাও। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হলো। তরুণটি যে শিক্ষকের অধীনে পিএইচডি করছেন, তাঁকেও যেতে হলো যুদ্ধে। সুতরাং তরুণটির পড়াশোনা রীতিমতো শিকেয় উঠল। এরই মধ্যে ব্রিটিশ সরকার ঘোষণা করল বিদেশি যেসব লোক ব্রিটেনে রয়েছে, তাদের ফিরে যেতে হবে নিজ নিজ দেশে। তাই সেই তরুণটিও ডক্টরেট ডিগ্রি না নিয়ে দেশে ফিরলেন। তবে এতে দমে যাননি তিনি। এ দেশে জ্যোতির্বিদ্যা চর্চার ভিত্তিই তৈরি হয়েছিল তাঁর হাত ধরে। তাঁর নাম আবদুল জব্বার।

পাবনার সুজানগর উপজেলার এক নিভৃত গ্রাম গোপালপুর। সেই গ্রামেই বাস করেন মিয়াজান মল্লিক নামের এক মাঝি। টেনেটুনে সংসার চলে। তারপর একদিন নৌকা-বইঠা ছেড়ে ক্ষুদ্র ব্যবসা শুরু করেন। এতে আগের চেয়ে সামান্য ভালো চললেও ঠিক স্বাচ্ছন্দ্য ছিল না মিয়াজান মাঝির সংসারে। ১৯১৫ সালে মিয়াজানের ঘরে জন্ম হয় চতুর্থ সন্তান আবদুল জব্বার। অভাব-অনটনের মধ্যেই বড় হন। গ্রামে একটা পাঠশালা ছিল। সেই পাঠশালার প্রধান শিক্ষক শশীভূষণ দাস বড্ড পছন্দ করেন মিয়াজান মল্লিকের মেধাবী ছেলেদের। তাদের বিনা বেতনে স্কুলে পড়াশোনা করার সুযোগ দিয়েছিলেন তিনি। আবদুল জব্বার লেখাপড়াটা যে শিখতে পেরেছিলেন, তা ওই শশীভূষণ দাসের জন্য। তিনিই জব্বারকে বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। বৃত্তি পেয়েই বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ পান নিশ্চিন্তপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। তারপর ভর্তি হন সাতবাড়িয়া উচ্চবিদ্যালয়ে। ১৯৩২ সেখান থেকে মাধ্যমিক পাস করেন। আইএসসি ভর্তি হন কলকাতার বিখ্যাত প্রেসিডেন্সি কলেজে। ১৯৩৪ সালে সেখান থেকে আইএসসি পাস করেন গণিতে লেটার নিয়ে। পান বৃত্তিও। সুতরাং ওই কলেজে অনার্স ভর্তি হতে বেগ পেতে হয়নি। আবদুল জব্বারের ইচ্ছা ছিল রসায়নে অনার্স করার। কিন্তু তিনি গণিতে লেটার পেয়েছেন। এতে অবশ্য রসায়নে অনার্স ভর্তি হওয়া আটকাত না। সে সময় প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক কুদরাত-এ-খুদা। তিনিই জব্বারকে পরামর্শ দেন গণিতে ভর্তি হতে।

বিএসসি (গণিতে অনার্স) পাসের পর আবদুল জব্বার মাস্টার্সে ভর্তি হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যলয়ের শিক্ষক জার্মান গণিতবিদ ফ্রেডেরিখ উইলহেম লেভি। তিনি অ্যালজেবরা বিভাগ চালু করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। একমাত্র আবদুল জব্বার ছাড়া আর কোনো ছাত্র ওই বিষয়ে পড়ার আগ্রহ দেখাননি। ১৯৩৮ সালে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে এমএসসি পাস করেন জব্বার।

এমএসসি পাসের পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা বৃত্তি লাভ করেন আবদুল জব্বার। লেভির সহকারী হিসেবে গবেষণা শুরু করেন। পাশাপাশি যোগ দেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের প্রভাষক পদেও। ওই সময়ই ভারত সরকারের বৃত্তি নিয়ে কেমব্রিজে পিএইচডি করা সুযোগ পান। কিন্তু যুদ্ধের কারণে ডিগ্রি অসমাপ্ত রেখেই ফিরে আসেন দেশে। বিলেত থেকে ফিরে এসে আবার লেভির গবেষণা সহযোগী হিসেবে কাজ শুরু করেন। ফিরে পান কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের প্রভাষক পদও, তবে বিনা বেতনে ছাত্র পড়াতে হয়। লেভির সহকারী হিসেবে গোটা ভারত চষে বেড়ান বক্তৃতা দেওয়ার জন্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফ থেকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল কোনো পদ খালি হলে স্থায়ীভাবে তাঁকে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হবে। বাস্তবায়ন হয়নি সে আশ্বাসের। তাই গণিতের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন চট্টগ্রাম কলেজে। সেখান থেকে বদলি হয়ে আসেন নিজের প্রতিষ্ঠান প্রেসিডেন্সি কলেজে। পরে নদীয়ার কৃষ্ণনগর কলেজে বদলি হন। এরপর ১৯৪৭, দেশ ভাগ। জব্বার চলে আসেন পূর্ববঙ্গে, প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পান রাজশাহী কলেজে।

তখন পূর্ব বাংলার একমাত্র প্রকৌশল কলেজ হলো ঢাকার আহছানউল্লাহ কলেজ, বর্তমানে যেটার নাম বুয়েট। ১৯৪৮ সালে গণিত বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৬২ সালে কলেজটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করা হয়, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার হিসেবে নিয়োগ পান আবদুল জব্বার। বুয়েটেই সত্যিকারে গবেষণা শুরু করেন আবদুল জব্বার। বাংলাদেশের রাতের আকাশের তারা পরিচিতি লিখতে শুরু করেন বিভিন্ন পত্রিকায়। তৈরি করেন এ দেশের রাতের আকাশের মানচিত্রও। সেই মানচিত্রকে একটা পূর্ণাঙ্গ মডেল গোলক, যেটাকে বলে খ-গোলক—তৈরির কাজ শুরু হয় তাঁরই তত্ত্বাবধানে। আজকাল যে দেশব্যাপী শিক্ষার্থী, গকেষকেরা আকাশ পর্যবেক্ষণ করছেন, এই চর্চার পথপ্রদর্শক হলেন অধ্যাপক আবদুল জব্বার।

ঢাকার আকাশের তারাগুলোর বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে লেখেন ঢাউস একটা বই। তারা পরিচিতি। লেখেন প্রাচীন জ্যোতির্বিদ্যা নামে আরেকখানি মহামূল্যবান বই। সেটার কথা শুরুতেই বলেছি।

বিজ্ঞানচর্চায় বিশেষ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে একুশে পদকে ভূষিত করে। পেয়েছেন বাংলা একাডেমি ও ব্রুনো পদকও। তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য বই হলো খ-গোলক পরিচিতি, বিশ্ব রহস্যে নিউটন আইনস্টাইন, বিশ্ব ও সৌরজগত ইত্যাদি।

পারকিনসনস রোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯৯৩ সালের ২০ জুলাই আবদুল জব্বার মৃত্যুবরণ করেন।

সূত্র:

উইকিপিডিয়া