সর্বকালের সেরা কাহিনি

একদম শুরুতে, মানে প্রায় ১ হাজার ৪০০ কোটি (বা ১৪ বিলিয়ন) বছর আগে গোটা মহাবিশ্ব ছিল খুবই ছোট। এই বাক্য শেষ হতে যতটুকু সময় লাগে, তার চেয়ে ছোট ছিল এর সময়ের ব্যাপ্তি।

কিন্তু সেটা কত ছোট? একটা পিৎজাকে ওই সময়ের ব্যাপ্তি হিসেবে কল্পনা করা যাক। এখন পিৎজাটাকে ১ ট্রিলিয়ন ভাগে ভাগ করো। মহাবিশ্বের সবকিছু, মানে তোমার দেহ যেসব কণা দিয়ে তৈরি হয়েছে সেগুলোসহ, তোমার জানালার বাইরের গাছপালা, বাড়িঘর, তোমার বন্ধুর মোজা, পিটুনিয়া, তোমার স্কুল, আমাদের গ্রহের আকাশচুম্বী পাহাড়-পর্বত আর গভীর মহাসাগর, সৌরজগৎ, বহুদূরের গ্যালাক্সি—সব স্থান, শক্তি—বিশ্বজগতের বস্তুসহ সবকিছু ওই বিন্দুতে ঠাসাঠাসি অবস্থায় ছিল।

সেটা ছিল প্রচণ্ড উত্তপ্ত।

এত্ত ছোট্ট একটা জায়গায় এত বেশি কিছু ঠাসাঠাসা থেকে পরিস্থিতিটা ছিল খুবই উত্তপ্ত। তাই তখন মহাবিশ্বের শুধু একটা কাজ করাই বাকি ছিল।

সেটা হলো প্রসারণ। দ্রুতবেগে।

বর্তমানে এ ঘটনাকে আমরা বলি বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণ। আর ১ সেকেন্ডের অতিক্ষুদ্র ১ ভগ্নাংশ সময়ে (বিশেষভাবে বলতে গেলে ১ সেকেন্ডের ১০ মিলিয়ন ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ভাগের ১ ভাগ) মহাবিশ্ব অতিবেগে বড় হতে লাগল। (১ ট্রিলিয়ন হলো ১,০০০,০০০,০০০,০০০ বা ১০১২ বা ১ লাখ কোটি।)

টেলিস্কোপে তোলা আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রের ছবি। এই গ্যালাক্সিকে বাংলায় বলা হয় আকাশগঙ্গা ছায়াপথ। এতে হাজার হাজার নক্ষত্র দেখা যাচ্ছে

কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমাদের বিশ্বজগতের জীবনের প্রথম পর্যায়ের কথা আমরা কীভাবে জানলাম? বর্তমানে আমরা আবিষ্কার করেছি, মাত্র চারটি মৌলিক বল নিয়ন্ত্রণ করছে মহাবিশ্বকে। গ্রহকে কক্ষপথে ঘোরানো থেকে শুরু করে আমাদের দেহ গঠনকারী ছোট কণা পর্যন্ত সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে চারটি বল। কিন্তু মহাবিস্ফোরণের ঠিক পরমুহূর্তে এই চারটি বলের সব কটি একটিমাত্র বল হিসেবে বিরাজ করছিল।

মহাবিশ্ব প্রসারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা ক্রমে ঠান্ডাও হতে লাগল। ক্ষণিক এ সময় বিজ্ঞানীদের কাছে প্ল্যাঙ্ক যুগ নামে পরিচিত। এই কালের নাম দেওয়া হয়েছে বিখ্যাত জার্মান বিজ্ঞানী ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের নামানুসারে। এ সময়ের শেষ দিকে অন্য সব বল থেকে একটা বল আলাদা হয়ে গেল। সেই বল হলো গ্র্যাভিটি বা মহাকর্ষ। নক্ষত্রগুলো ও গ্রহদের একত্রে ধরে রেখে ছায়াপথ বা গ্যালাক্সি গঠন করে এই মহাকর্ষ। আবার সূর্যের চারপাশে নির্দিষ্ট কক্ষপথে পৃথিবীকে আটকে রাখে এই বল। আবার ১১ বছর বয়সী কোনো শিশুকে বাস্কেটবল ডাঙ্কিং করতে বাধা দেয় এটা। এ ছাড়া আরও অনেক কিছুই রয়েছে। মহাকর্ষ যে সব সময় টানে, তার একটা সরল প্রমাণ দেখানো যাক। তোমার হাতের বইটি বন্ধ করো। এরপর বইটি পার্শ্ববর্তী কোনো টেবিলে কয়েক ইঞ্চি ওপরে তুলে ধরো। এবার বইটি ছেড়ে দাও। কী ঘটল? মহাকর্ষ এভাবেই কাজ করে। (তোমার বইটি যদি নিচে না পড়ে যায়, তাহলে এখনই আশপাশের কোনো অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্টকে খুঁজে বের করো। সেই সঙ্গে মহাজাগতিক জরুরি অবস্থাও ঘোষণা করতে হবে।)

অবশ্য আদিম মহাবিশ্বের প্রথম কয়েক মুহূর্তে সেখানে মহাকর্ষ কাজ করার জন্য কোনো গ্রহ কিংবা কোনো বই বা ১০ বছর বয়সী কোনো বাস্কেটবল খেলোয়াড়ও ছিল না। মহাকর্ষ তার সবচেয়ে সেরা কাজটি করে বড় বস্তুগুলোর সঙ্গে। সেই তুলনায় আদিম মহাবিশ্বে সবকিছু ছিল অকল্পনীয় রকম ক্ষুদ্র।

কিন্তু সেটা ছিল সূচনামাত্র।

বিশ্বজগৎ তখনো কেবল বেড়েই চলছিল।

এরপর প্রকৃতির অন্য তিনটি প্রধান বল পরস্পর থেকে আলাদা হয়ে গেল। এই বলগুলোর প্রধান কাজ হলো মহাবিশ্বের পরিপূর্ণ ক্ষুদ্র কণাদের বা পদার্থের টুকরাগুলোর নিয়ন্ত্রণ করা।

চারটি বল পরস্পর থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার পর যা হলো, সেটাই আসলে একটা মহাবিশ্ব গঠনের জন্য দরকার। চারটি বল হলো মহাকর্ষ, সবল নিউক্লিয়ার বা পারমাণবিক বল, দুর্বল নিউক্লিয়ার বল এবং বিদ্যুৎ–চুম্বকীয় বল।

নক্ষত্রের কাজকারবার ছিল অনেকটা রান্নাঘরের প্রেশার কুকারের মতো। এরা অতিক্ষুদ্র কণাগুলোকে একত্র করে বড় থেকে আরও বড় মৌল গঠন করতে বাধ্য করছিল

শুরুর পর ১ সেকেন্ডের ট্রিলিয়ন ভাগের ১ ভাগ সময় পেরিয়ে গেছে। কিন্তু মহাবিশ্বের আকার তখনো অতিক্ষুদ্র। এত ক্ষুদ্র যে তা কল্পনাও করা যায় না। সেই সঙ্গে উত্তপ্তও বটে। এ সময় বিভিন্ন কণার ভিড় হতে শুরু করে। এই বিন্দুতে কণা ছিল মোট দুই ধরনের। এদের একটার নাম কোয়ার্ক। অন্যটা লেপটন। কোয়ার্ক নাম দেওয়া হয়েছিল মার্ক্সের সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে। কোয়ার্করা অদ্ভুতুড়ে জানোয়ারের মতো। তুমি কখনোই শুধু কোনো কোয়ার্ককে আঁকড়ে ধরতে পারবে না। এরা সব সময় কাছাকাছি থাকা অন্যদের সঙ্গে আটকে থাকবে। আমি নিশ্চিত, তোমার অন্তত একটা বন্ধু অথবা ক্লাসমেট আছে, যাদের আচরণ ঠিক এ রকম। কোয়ার্ক হলো সেই সব বাচ্চার মতো, যারা কখনো একা একা কোনো কাজ করতে চায় না। এমনকি রেস্টরুমেও একা একা যেতে চায় না তারা।

দুটি বা তার চেয়ে বেশি কোয়ার্ককে একধরনের বল একত্র করে রাখে। কোয়ার্কদের আলাদা করতে গেলে সেই বলের পরিমাণ হুট করে আরও বেড়ে যায়। যেন কোয়ার্কগুলো কোনো ধরনের খুদে অদৃশ্য রাবার ব্যান্ড দিয়ে আটকানো। তাদের যথেষ্ট পরিমাণ আলাদা করা সম্ভব হলে ওই অদৃশ্য রাবার ব্যান্ড ছিঁড়ে যায়। তারপর সঞ্চিত শক্তি থেকে প্রতিটির শেষ প্রান্তে তৈরি হয় নতুন একটা করে কোয়ার্ক। এভাবে জোড়া থেকে আলাদা করা প্রতিটির একটা করে নতুন বন্ধু জুটে যায়। মনে মনে একবার ভাবো, তোমার স্কুলে এ রকম অবিচ্ছেদ্য বাচ্চাদের ক্ষেত্রেও যদি একই ঘটনা ঘটত এবং তারা যদি অঙ্কুরিত হয়ে দ্বিগুণ হয়ে যেত, তাহলে ব্যাপারটা কী হতো। তাহলে তোমার শিক্ষক নিঃসন্দেহে বিস্ময়ে একেবারে থ হয়ে যেতেন।

অন্যদিকে লেপটন হলো নিঃসঙ্গ, একা। কোয়ার্কদের যে বল একত্র করে, লেপটনের ওপর তার কোনো প্রভাব নেই। কাজেই লেপটন কখনো গুচ্ছভাবে একত্র হয় না। সবচেয়ে পরিচিত একটি লেপটন হলো ইলেকট্রন।

এসব কণা ছাড়াও মহাবিশ্বে তখন প্রচণ্ড শক্তিতে টগবগ করছিল। আর এই শক্তি বিরাজ করছিল তরঙ্গরূপী প্যাকেট বা আলোকশক্তির গুচ্ছ হিসেবে। এদের বলা হয় ফোটন।

এখানেই সবকিছু অদ্ভুত হয়ে ওঠে।

মহাবিশ্ব এতই উত্তপ্ত ছিল যে এসব ফোটন নিয়মিতভাবে পদার্থ ও প্রতিপদার্থ কণাজোড়ায় রূপান্তরিত হচ্ছিল। এরপর এসব জোড়া পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষের মুখে পড়ে আবার রূপান্তরিত হচ্ছিল ফোটনে। কিন্তু রহস্যময় কোনো কারণে এসব রূপান্তরের এক বিলিয়নের মধ্যে মাত্র একটা পদার্থকণা তৈরি হচ্ছিল কোনো প্রতিপদার্থ সঙ্গী ছাড়াই। এসব নিঃসঙ্গ কিছু যদি বেঁচে না যেত, তাহলে মহাবিশ্বের কোনো পদার্থই আর অবশিষ্ট থাকত না। আর এটা আসলে দারুণ ব্যাপার। কারণ, আমরা সবাই পদার্থ দিয়ে তৈরি।

অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি। এরকম লাখো কোটি গ্যালাক্সি গড়ে উঠেছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, মহাবিশ্ব মাঝে

আমরা টিকে আছি। আমরা জানি, সময় বয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মহাবিশ্ব ক্রমেই প্রসারিত ও শীতল হতে থাকে। মহাবিশ্ব আমাদের সৌরজগতের আকারের চেয়ে বড় হয়ে যাওয়ার পর দ্রুত হারে কমে যেতে থাকে এর তাপমাত্রা। তবু মহাবিশ্ব তখনো অনেক উত্তপ্ত ছিল। কিন্তু এর তাপমাত্রা তখন নেমে এসেছিল ১ ট্রিলিয়ন ডিগ্রি কেলভিনের নিচে।

মহাবিশ্ব শুরু হয়েছিল, বাক্যটি শেষ হতে যে সময় লাগে তার অতিক্ষুদ্র একটা ভগ্নাংশ সময় পেরিয়ে গেছে। ১ সেকেন্ডের মিলিয়ন ভাগের ১ ভাগ। এখন তার আকার আমাদের সৌরজগতের সমান। এর পরিমাণ আড়াআড়িভাবে প্রায় ৩০০ বিলিয়ন কিলোমিটার বা ১৮০ বিলিয়ন মাইল।

১ ট্রিলিয়ন ডিগ্রি কেলভিন তাপমাত্রা খুবই উত্তপ্ত, যা সূর্যের পৃষ্ঠের চেয়েও অনেক বেশি গরম। কিন্তু মহাবিস্ফোরণের একেবারে প্রথম মুহূর্তের সঙ্গে তুলনা করলে ১ ট্রিলিয়ন কেলভিন তাপমাত্রাকে অনেক ঠান্ডাই বলতে হবে। এই কুসুম কুসুম গরম মহাবিশ্ব তখন আর কোয়ার্কগুলোকে রান্না করার মতো যথেষ্ট উত্তপ্ত রইল না। কাজেই তখন নিজ নিজ সঙ্গী খুঁজে নিয়ে ভারী কণা তৈরি করতে লাগল কোয়ার্ক কণারা। কোয়ার্কদের এই সমন্বয়ের ফলে শিগগিরই প্রোটন ও নিউট্রনের মতো পরিচিত পদার্থের রূপের দেখা মিলতে লাগল।

মহাবিশ্ব শুরুর পর এতক্ষণে ১ সেকেন্ড সময় পেরিয়ে গেছে।

মহাবিশ্বের আকার তখন আড়াআড়িভাবে কয়েক আলোকবর্ষ। অর্থাৎ সূর্য থেকে তার সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশী নক্ষত্রগুলোর দূরত্বের প্রায় কাছাকাছি। তাপমাত্রা কমে তখন নেমে গেছে ১ বিলিয়ন ডিগ্রিতে। এই তাপমাত্রাও আসলে প্রচণ্ড গরম। সেটা এতই উত্তপ্ত যে তা দিয়ে ছোট্ট ইলেকট্রন এবং তাদের বিপরীত কণা পজিট্রন রান্না করার জন্য যথেষ্ট। এই দুই আলাদা কণাগুলো হুট করে উদয় হয় এবং পরস্পরকে ধ্বংস করে অদৃশ্য হয়ে যায়। কিন্তু অন্য কণাদের ক্ষেত্রে যে কথা সত্য, ইলেকট্রনের জন্যও তা সত্য। অর্থাৎ ১ বিলিয়নের মধ্যে মাত্র একটা ইলেকট্রন কণা বেঁচে যাচ্ছিল,

কিন্তু ধ্বংস হয়ে গেল বাকি সব কটি।

মহাবিশ্বের তাপমাত্রা এরপর নেমে গেল মাত্র ১০০ মিলিয়ন ডিগ্রি কেলভিনে। কিন্তু তারপরও সেটা ছিল সূর্যপৃষ্ঠের চেয়েও অনেক অনেক গরম।

বড় কণাগুলো তারপর পরস্পরের সঙ্গে ফিউজ হতে লাগল। অর্থাৎ কণাগুলো পরস্পর পারমাণবিকভাবে জোড়া লেগে একত্র হতে লাগল। বর্তমানে আমাদের দৃশ্যমান মহাবিশ্ব যেসব পরমাণু দিয়ে গঠিত, তার মৌলিক উপাদান শেষ পর্যন্ত একত্র হলো। অর্থাৎ নক্ষত্র, গ্রহ, তোমার জানালার বাইরের গাছপালা বা বাড়িঘর, তোমার বন্ধুর মোজা, আমার গোঁফ যেসব পরমাণু দিয়ে গঠিত; তার মৌলিক উপাদান। প্রোটনগুলো অন্য সব প্রোটন ও নিউট্রনের সঙ্গে জোড়া লাগতে শুরু করল। এভাবে একসময় গঠিত হলো পরমাণুর কেন্দ্র। একেই বলা হয় পরমাণুর নিউক্লিয়াস।

মহাবিশ্ব শুরুর পর দুই মিনিট পেরিয়ে গেছে।

সেটি হলে পৃথিবীতে আমাদের চেনাজানা জীবনের উদ্ভব কখনো হতো না। তাহলে বইটি পড়ার জন্য তুমিও কখনো এখানে থাকতে না। মহাবিশ্ব শুরুর পর এতক্ষণে ৯ বিলিয়ন বছর পেরিয়ে গেছে।

সাধারণত প্রোটন ও নিউক্লিয়াসের প্রতি আকর্ষিত হবে মহাবিশ্ব জুড়ে ঘুরে বেড়ানো ইলেকট্রনগুলো। ইলেকট্রনের চার্জ ঋণাত্মক। অন্যদিকে প্রোটন বা নিউক্লিয়াসের চার্জ ধনাত্মক বা পজিটিভ। আর জানোই তো, বিপরীত চার্জ পরস্পরকে আকর্ষণ করে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, তাদের চার্জ ধনাত্মক আর ঋণাত্মক কেন? আবার তুমি এটাও জিজ্ঞেস করতেই পারো, বিপরীত চার্জ পরস্পরকে আকর্ষণ করে কেন?

আসলে এর উত্তরে বলতে হয়, এটাই নিয়ম। তারা আসলে এ রকমই আচরণ করে।

আমার ইচ্ছা করছে, এর চেয়ে ভালো কোনো উত্তর দিই তোমাকে। কিন্তু মহাবিশ্ব আমাদের জন্য বোধগম্য হয়ে উঠবে, এ রকম কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। আমি যেটা বলতে পারি, সেটা হলো বহু বহু বছরের বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে এই দুই ধারণা গড়ে উঠেছে।

এখন হয়তো ভাবতে পারো, তাদের পরস্পরকে আকর্ষণ করতে দিলে তারা একে অপরের সঙ্গে লেগে যাবে বা সংযুক্ত হবে। অবশ্য কয়েক হাজার বছর ধরে মহাবিশ্ব এতই উত্তপ্ত ছিল যে তারা এভাবে একত্র হয়ে উঠতে পারেনি। ইলেকট্রন মুক্তভাবে চলাফেরা করেছে, ফোটনকে সামনে-পেছনে বা এদিক-ওদিক ছুড়ে দিয়েছে। মুক্ত ইলেকট্রন আসলে এ রকমই আচরণ করে।

তবে মহাবিশ্বের তাপমাত্রা ৩ হাজার ডিগ্রি কেলভিনের নিচে নেমে আসার পর এই অবস্থার সমাপ্তি হয়। ৩ হাজার কেলভিন মানে আমাদের সূর্যপৃষ্ঠের প্রায় অর্ধেক তাপমাত্রা। এর ফলে মুক্ত ইলেকট্রনগুলো ওই সব ধনাত্মক চার্জবাহী প্রোটনদের সঙ্গে একত্র হতে থাকে। তারা একত্র হওয়ার পর সব ফোটন মহাবিশ্ব পাড়ি দিতে শুরু করল। এই অক্ষত ফোটন বা আলোকে এখনো শনাক্ত করতে পারেন বিজ্ঞানীরা।

মহাবিশ্ব শুরুর পর ততক্ষণে ৩৮০ হাজার বছর পেরিয়ে গেছে।

এ সময় মহাবিশ্ব এমনভাবে প্রসারিত হচ্ছিল, যেন সেটা এক কখনো না ফাটা বেলুন। মহাবিশ্ব যতই বড় হচ্ছিল, ততই তা শীতল হচ্ছিল। এ সময় কাজ শুরু করে মহাকর্ষ। প্রথম কয়েক হাজার বছরে কণাগুলো সব জায়গায় দৌড়াদৌড়ি বা ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছিল। কিন্ডারগার্টেনের বাচ্চাদের খেলার মাঠে ছেড়ে দিলে যে অবস্থা দাঁড়ায়, এসব কণার অবস্থাও ছিল সে রকম। এ সময় মহাকর্ষ এসব কণাদের একত্রে টানতে শুরু করে মহাজাগতিক বিভিন্ন শহরে। মহাবিশ্বের এই শহরগুলোকে বলা হয় গ্যালাক্সি বা ছায়াপথ।

এভাবে প্রায় ১০০ বিলিয়ন গ্যালাক্সি গঠিত হলো। প্রতিটি গ্যালাক্সিতে নক্ষত্র বা তারার সংখ্যা ছিল কয়েক শ বিলিয়ন।

এসব নক্ষত্রের কাজকারবার ছিল অনেকটা রান্নাঘরের প্রেশার কুকারের মতো। এরা অতিক্ষুদ্র কণাগুলোকে একত্র করে বড় থেকে আরও বড় মৌল গঠন করতে বাধ্য করছিল। বড় নক্ষত্রগুলো উৎপাদন করছিল অনেক বেশি তাপ ও চাপ। সে কারণে সেখানে গঠিত হতে পেরেছিল লোহার মতো ভারী মৌল।

বিগ ব্যাং থেকে মহাবিশ্বের বিস্তৃতি

দানবীয় এসব নক্ষত্রের ভেতরে তৈরি হওয়া মৌলগুলো সেখানেই থেকে গেলে, তা আসলে অনর্থক হতো। কিন্তু এই নক্ষত্রগুলো ছিল অস্থিতিশীল। তাই তারা একসময় বিস্ফোরিত হয়ে তাদের ভেতরের মৌলগুলোকে ছায়াপথের চারদিকে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে দেয়।

মহাবিশ্বের সূচনা হওয়ার ৯ বিলিয়ন বছর পর, মহাবিশ্বের গড়পড়তা একটা অংশে, একটা গড়পড়তা ছায়াপথে জন্ম নেয় একটা গড়পড়তা সাধারণ নক্ষত্র। সেটা ছিল আমাদের সূর্য।

কিন্তু সেটা গঠিত হলো কীভাবে? কণা আর ভারী মৌল দিয়ে ঠাসাঠাসি বিপুল পরিমাণ গ্যাসীয় মেঘ মহাকর্ষের টানে ধীরে ধীরে পুঞ্জীভূত হতে থাকে। ওই সব কণা ও ভারী মৌলের মধ্যে ছিল অতিরিক্ত প্রোটন ও নিউট্রনও। সেগুলো একে অপরকে কেন্দ্র করে ঘুরতে শুরু করলে মহাকর্ষ তাদের পরস্পরের আরও কাছে আসতে বাধ্য করে। এভাবে তারা পরস্পরের সংঘর্ষের মুখে পড়ে এবং জোড়া লেগে একত্র হয়।

একবার সূর্য জন্ম নেওয়ার পরও এই গ্যাসীয় মেঘের ভেতর অবশিষ্ট ছিল প্রচুর পরিমাণে মহাজাগতিক উপাদান। এই গ্যাসীয় মেঘ থেকে বেশ কয়েকটি গ্রহ এবং উল্কা নামের হাজার হাজার মহাকাশীয় পাথর আর কোটি কোটি ধূমকেতু তৈরি হওয়ার মতো যথেষ্ট পদার্থ ছিল। এগুলো তৈরি হওয়ার পরও আরও পদার্থ অবশিষ্ট ছিল সেখানে। অন্য সব মহাজাগতিক বস্তুর দিকে সজোরে ছুটে গেল এই পথভ্রষ্ট আবর্জনা।

এই সংঘর্ষ এতই শক্তিশালী ছিল যে তাদের কারণে পাথুরে গ্রহগুলোর পৃষ্ঠতল গলে গিয়েছিল।

সৌরজগতের চারপাশে এসব আবর্জনার পরিমাণ কমে যাওয়ার কারণে এসব প্রভাবও কমে গেল। তাতে গ্রহদের পৃষ্ঠতলও শীতল হতে শুরু করে। পৃথিবী এমন জায়গায় গড়ে ওঠে, যাকে সূর্যের চারপাশে আমরা একধরনের গোল্ডিলকস জোন বলি। তোমার হয়তো মনে আছে, গোল্ডিলকস কখনো খুব বেশি গরম বা খুব বেশি ঠান্ডা পরিজ খেতে পছন্দ করত না। একইভাবে পৃথিবীও সৌরজগতের এমন এক জায়গায় অবস্থিত, যাকে বলা হয় সূর্য থেকে একেবারে যথার্থ দূরত্ব। পৃথিবী যদি সূর্যের খুব কাছে হতো, তাহলে সাগর-মহাসাগরের সব পানি বাষ্পীভূত হয়ে উবে যেত। আবার সূর্য থেকে বেশি দূরে থাকলেও জমে বরফ হয়ে যেত সাগর-মহাসাগরের সব পানি।

সেটি হলে পৃথিবীতে আমাদের চেনাজানা জীবনের উদ্ভব কখনো হতো না।

তাহলে বইটি পড়ার জন্য তুমিও কখনো এখানে থাকতে না।

মহাবিশ্ব শুরুর পর এতক্ষণে ৯ বিলিয়ন বছর পেরিয়ে গেছে।

এ সময় আমাদের তরুণ ও উত্তপ্ত গ্রহের পাথরগুলোর ভেতরে আটকে পড়া পানি বাষ্পীভূত হয়ে আকাশে উঠে গেল। পৃথিবী ক্রমেই শীতল হচ্ছিল। ফলে ঘনীভূত হয়ে উঠল এই পানি। তারপর বৃষ্টি হয়ে নিচে নেমে এল। এভাবেই একসময় গড়ে উঠল সাগর-মহাসাগর। এই মহাসাগরেই কোনো এক কারণে সরল অণুগুলো একত্র হয়ে প্রাণে রূপ নিল। সেই কারণ আমাদের কাছে এখনো অজানা।

এই গ্রহাণুর আঘাতের ফলে ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রচুর ধুলা ও ধ্বংসাবশেষ বায়ুমণ্ডলে মিশে গিয়েছিল। এতে স্রেফ বিলুপ্ত হয়ে গেল পৃথিবীর বেশির ভাগ প্রাণী। এর মধ্যে রয়েছে বিখ্যাত বিশালদেহী ডাইনোসরের বিলুপ্তি।

মানুষ বায়ুজীবী প্রাণী। আমাদের বেঁচে থাকার জন্য অক্সিজেনসমৃদ্ধ বাতাস দরকার। কিন্তু আদিম মহাসাগরের আধিপত্য বিস্তার করেছিল অবায়ুজীবী ব্যাকটেরিয়া। এই আণুবীক্ষণিক গঠনের প্রাণের বেঁচে থাকার জন্য কোনো অক্সিজেনের দরকার হয়নি। সৌভাগ্য যে এসব অবায়ুজীবী ব্যাকটেরিয়া অক্সিজেন নিঃসরণ করেছিল। বাতাসে মানুষের বেঁচে থাকার উপযোগী উপাদানের জোগান দিয়েছিল আসলে এরাই। অক্সিজেনসমৃদ্ধ এই নতুন বায়ুমণ্ডল আরও জটিল থেকে জটিলতর প্রাণের উদ্ভবের সুযোগ করে দিল।

কিন্তু জীবন নিতান্তই পলকা। মাঝেমধ্যে মহাকাশ থেকে বড় ধরনের ধূমকেতু ও গ্রহাণু আছড়ে পড়ত আমাদের গ্রহে। তাতে নিমেষেই বড় ধরনের ওলট-পালট হয়ে যেত।

৬৫ মিলিয়ন বছর আগে, ১০ ট্রিলিয়ন টন ওজনের একটা গ্রহাণু পৃথিবীতে আঘাত হেনেছিল। জায়গাটি মেক্সিকোর ইউকাটান উপদ্বীপে অবস্থিত। মহাকাশ থেকে আসা ওই পাথরটা ভূপৃষ্ঠে যে খাদের সৃষ্টি করেছিল, তা প্রায় ১১০ মাইল প্রশস্ত এবং ১২ মাইল গভীর। এই গ্রহাণুর আঘাতের ফলে ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রচুর ধুলা ও ধ্বংসাবশেষ বায়ুমণ্ডলে মিশে গিয়েছিল। এতে স্রেফ বিলুপ্ত হয়ে গেল পৃথিবীর বেশির ভাগ প্রাণী। এর মধ্যে রয়েছে বিখ্যাত বিশালদেহী ডাইনোসরের বিলুপ্তি। জীবজন্তু বা প্রাণের কোনো রূপের অস্তিত্বের চরম সমাপ্তি।

এই বিপর্যয় আমাদের স্তন্যপায়ী আদিপুরুষকে সমৃদ্ধ করেছিল। তখন আর তাদের টি–রেক্সের সকালের নাশতা হলো না। এসব স্তন্যপায়ী দলের মধ্যে বড় মস্তিষ্কধারী একটা দলকে বলা হয় প্রাইমেট। তাদের থেকেই একসময় হোমো সেপিয়েন্স নামের প্রজাতির উদ্ভব হয়। তারা নতুন কৌশল উদ্ভাবন ও বিজ্ঞানের যন্ত্রপাতি বানাতে যথেষ্ট চৌকস। আবার মহাবিশ্বের জন্ম ও বিবর্তন সম্পর্কেও আবিষ্কার করতে পেরেছে তারা।

এই প্রাণীই হলাম আমরা।

(নীল ডিগ্রেস টাইসনের অ্যাস্ট্রোফিজিকস ফর ইয়াং পিপল ইন আ হারি থেকে। কিছুটা সংক্ষেপিত)