বুদ্ধির রাজ্যের নিয়মকানুন

বাংলাদেশের এক নম্বর দাবাড়ু গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমানকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ‘ভালো দাবাড়ু হতে প্রথম কী করতে হবে?’ তাঁর উত্তর, ‘দাবা খেলায় চালের সম্ভাবনা অসংখ্য। তবে নিয়ম খুব অল্প। কিন্তু সে অল্প নিয়মকানুনের মধ্যেই ঢুকে গেছে কিছু ভুল ধারণা। ভালো খেলোয়াড় হতে হলে সেগুলো দূর করতে হবে। ভালো দাবাড়ু হওয়ার প্রথম ধাপ হলো সঠিক নিয়মকানুনগুলো শিখে নেওয়া।’

দাবায় লড়াইটা বুদ্ধির, নিয়মের মারপ্যাঁচ খুব বেশি নেই। কয়েকটা নিয়ম আছে একটু অপ্রচলিত। সেগুলো জেনে নিলে খেলাটা নিয়মমাফিকই খেলা যাবে।

দাবার ছক

দাবা খেলার মাঠ হলো আট সারি আট কলামের একটা ছক। ওপর-নিচ বরাবর কলামগুলোকে বলা হয় ফাইল, পাশাপাশি সারিগুলো র‍্যাংক। আর কোনাকুনি ঘরগুলোকে বলা হয় ডায়াগোনাল। দাবার ছকে নিচের দিকে থাকে সব সময় সাদার ঘুঁটি। বাঁ দিক থেকে ডান দিকের ফাইলগুলোর নাম a, b, c, d, e, f, g ও h। আর নিচ থেকে ওপরের দিকে ফাইলগুলোর নাম ইংরেজিতে 1 থেকে 8। ফাইল আর র‍্যাংক পাশাপাশি লিখলে হয় কোনো একটা ঘরের নাম। যেমন ১ নম্বর ছবিতে রাজা আছে e8 ঘরে, মন্ত্রী আছে d8 ঘরে।

দাবার বোর্ডে ঘুঁটিবাজি

দাবার ঘুঁটিগুলো হলো রাজা বা King (K), মন্ত্রী বা Queen (Q), নৌকা বা Rook (R), ঘোড়া বা Knight (N), হাতি বা Bishop (B) আর সৈন্য বা Pawn। ব্র্যাকেটের মধ্যে ইংরেজি বর্ণটি ঘুঁটিটির সংক্ষিপ্ত নাম। সৈন্যের ক্ষেত্রে সাধারণত কোনো সংক্ষিপ্ত নাম ব্যবহার করা হয় না।

চাল অনুযায়ী ঘুঁটিগুলোর তুলনামূলক ক্ষমতা একেকটি সংখ্যা দিয়ে প্রকাশ করা হয়। আপেক্ষিক এই শক্তির মান খেলার সময় মনে রাখা উচিত। সংখ্যাগুলো হলো Q=9, R=5, B=3, N=3 এবং Pawn=1। রাজার ক্ষমতা কোনো সংখ্যা দিয়ে প্রকাশ করা হয় না, এর ক্ষমতা অসীম। পুরো খেলা তো রাজাকে বাঁচানোরই খেলা। সব সময় হয়তো ঘুঁটির ক্ষমতা কাজ দেবে না, তবে সেটা মনে রাখলে কাজে লাগে।

দাবার ঘুঁটিগুলো হলো রাজা বা King (K), মন্ত্রী বা Queen (Q), নৌকা বা Rook (R), ঘোড়া বা Knight (N), হাতি বা Bishop (B) আর সৈন্য বা Pawn। ব্র্যাকেটের মধ্যে ইংরেজি বর্ণটি ঘুঁটিটির সংক্ষিপ্ত নাম। সৈন্যের ক্ষেত্রে সাধারণত কোনো সংক্ষিপ্ত নাম ব্যবহার করা হয় না।

ক্যাসলিং বা দুর্গ প্রতিষ্ঠা

খেলার সময় রাজাকে নিরাপদ অবস্থানে নিয়ে যেতে ক্যাসলিং খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি চাল। শুধু এই চালেই একই চালে দুটি ঘুঁটি একসঙ্গে চালা যায়। ক্যাসলিং দুই ধরনের, কিং-সাইড ক্যাসলিং ও কুইন-সাইড ক্যাসলিং। কিং-সাইড ক্যাসলিং করা হয় রাজার পাশের নৌকার সঙ্গে আর কুইন সাইড ক্যাসলিং করা হয় মন্ত্রীর পাশের নৌকার সঙ্গে। ক্যাসলিং করতে হলে পূরণ করতে হবে পাঁচটি শর্ত। ১. রাজা এবং যে নৌকার সঙ্গে ক্যাসলিং হবে তার মাঝে অন্য কোনো ঘুঁটি যদি না থাকে। ২. রাজা বা ওই নৌকা খেলার শুরু থেকে এই পর্যন্ত কোনো চাল না দিয়ে থাকে। ৩. রাজা চেক অবস্থায় (কিস্তিতে) না থাকে। ৪. ক্যাসলিংয়ের পর রাজা যাতে চেকে না পড়ে। ৫. রাজা চলার পথে অর্থাৎ যে ঘরগুলো পাড়ি দিয়ে ক্যাসলিং করছে, সেগুলোতে চেকে না পড়ে। এই শর্তের কোনো একটা পূর্ণ না করলে ক্যাসলিং করা যাবে না।

এবার ২ নম্বর ছবিটা দেখা যাক। ধরা যাক সাদা কিং-সাইড আর কালো কুইন-সাইড ক্যাসলিং করবে। তাহলে ক্যাসলিং করার পর অবস্থান হবে ৩ নম্বর ছবির মতো। এবার ৪ নম্বর ছবিটি দেখুন। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন সাদার রাজা কিং-সাইড ক্যাসলিং করতে পারবে না, তবে কুইন-সাইড ক্যাসলিং করতে পারবে।

 En passant: সৈন্যের বাহাদুরি

এমনিতে সৈন্য চলে সোজাসুজি এক ঘর। কিন্তু ঘুঁটি খাওয়ার সময় যায় কোনাকুনি এক ঘর। আর প্রথম চালে সৈন্য যেতে পারে দুই ঘর। এখন ধরা যাক কালোর একটা ঘুঁটি আছে 4b-তে। সাদা 2a হতে 4a-তে একটা সৈন্য চালল (২ ঘর)। এমন অবস্থায় কালোর 4b-এর সৈন্য 2b-তে গিয়ে 4b-এর সাদার ঘুঁটিটা খেয়ে নিতে পারবে। ব্যাপারটা এমন যে সাদা তার সৈন্য একঘর চাল দিয়েছিল। ৫ নম্বর ছবিতে ব্যাপারটা ধাপে ধাপে দেখানো আছে। এমন চাল দিতে পারবে কালোও। তবে এই চাল শুধু সৈন্য দিয়েই দিতে হবে। আর দেওয়া যাবে পরের ধাপেই, মাঝে অন্য কোনো ঘুঁটির চাল দিয়ে এভাবে খাওয়া যাবে না। এই চালের  ফরাসি নাম En Passant।

প্রমোশন: সৈন্য যখন মন্ত্রী

সাদার সৈন্য ৮ বা কালোর কোনো সৈন্য ১ নম্বর র‍্যাংকে পৌঁছালে তা আর সৈন্য হিসেবে থাকতে পারবে না। সৈন্য বদলে নিজের অন্য যে কোনো একটা ঘুঁটি নিতে হবে। সাধারণত সবাই মন্ত্রী নেয়, কারণ মন্ত্রীর ক্ষমতা (৯) সবচেয়ে বেশি। একে বলে Promotion বা উত্তরণ। তবে অনেক সময় অন্য ঘুঁটি ওঠানোর প্রয়োজন হতে পারে স্ট্র্যাটেজি অনুযায়ী। সে ক্ষেত্রে তাকে বলে আন্ডার প্রমোশন। উত্তরণের সময় যেকোনো সৈন্যকে যেকোনো ঘুঁটিতে রূপান্তর করা যাবে। এ হিসেবে একসঙ্গে বোর্ডে একজন খেলোয়াড়ের একাধিক মন্ত্রী বা তিনটা ঘোড়া থাকতে পারে। খেলার সময় প্রয়োজনীয় ঘুঁটি না থাকলে সাময়িকভাবে অন্য বস্তু দিয়ে ঘুঁটি বানিয়ে নেওয়া যায়।

একই চাল পাঁচবার পুনরাবৃত্তি হলে দাবি করতে হবে না, খেলা এমনিতেই ড্র হয়ে যাবে। যদি পরপর ৫০ চাল কোনো সৈন্যের চাল দেওয়া না হয় এবং উভয় পক্ষের কোনো ঘুঁটি কাটা না পড়ে তবেও কোনো খেলোয়াড় চাইলে ড্র দাবি করতে পারে।

সমানে সমান: অমীমাংসিত খেলা বা ড্র

খেলা ড্র হতে পারে নানাভাবে। উভয় খেলোয়াড় সম্মত হলে ড্র করা যায়। আন্তর্জাতিক দাবায় নিয়মিত এটা দেখা যায়। এরপর প্রথমেই আসে স্টেলমেট। স্টেলমেট হলো এমন অবস্থা, যখন কোনো খেলোয়াড়ের রাজা কিস্তি বা চেকে নেই, তবে তার আর কোনো চাল দেওয়ার মতো অবস্থাও নেই। এ অবস্থায় খেলা ড্র। চিত্র ৬-এ এখন কালোর চাল। কিন্তু কালোর রাজার চাল দেওয়ার মতো কোনো ঘর নেই, তাই খেলা ড্র।

উভয় খেলোয়াড়ের চাল যদি পরপর তিনবার পুনরাবৃত্তি হয় তাতেও খেলা ড্র করা যায়। এমনকি চালগুলো পরপর না হয়ে মাঝে অন্য কোন চাল দিয়ে পুনরাবৃত্তি হলেও ড্র করা যাবে। তবে এ ক্ষেত্রে কোনো একজন খেলোয়াড়কে ড্র দাবি করতে হবে। একই চাল পাঁচবার পুনরাবৃত্তি হলে দাবি করতে হবে না, খেলা এমনিতেই ড্র হয়ে যাবে। যদি পরপর ৫০ চাল কোনো সৈন্যের চাল দেওয়া না হয় এবং উভয় পক্ষের কোনো ঘুঁটি কাটা না পড়ে তবেও কোনো খেলোয়াড় চাইলে ড্র দাবি করতে পারে। আর এমন ৭৫ চাল খেলা হলে ড্র হয়ে যাবে এমনিতেই, দাবি করতে হবে না।

 তিনটি কথা

অনেকেই মনে করে খেলার শুরুর চালে দুটি ভিন্ন সৈন্য এক ঘর করে চাল দেওয়া যায়। আসলে এমন কোনো নিয়ম নেই। কোনো পক্ষের সব ঘুঁটি খাওয়া গেলে বিপক্ষ যদি ১৬ চালের মধ্যে কিস্তিমাত করতে না পারে, অর্থাৎ হারাতে না পারে, তাহলে খেলা ড্র হয়, এমন কোনো নিয়মও নেই। তবু আমরা নিয়ম বলে মানি। এগুলো প্রচলিত ভুল। সৈন্যকে উত্তরণের সময় শুধু কাটা যাওয়া ঘুঁটিতে উত্তরণ করা যাবে এমন একটি ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। আসলে যেকোনো ঘুঁটিতেই উত্তরণ করা যায়। প্রচলিত ভুলগুলো এড়িয়ে বিশেষ এই নিয়মগুলোসহ খেলুন। আপনিও হতে পারবেন ভালো দাবাড়ু।

*লেখাটি বিজ্ঞানচিন্তার ২০১৭ সালের জানুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত