ওপেনহাইমার: আধুনিক প্রমিথিউসের কাহিনি

রবার্ট ওপেনহাইমার। পারমাণবিক বোমার জনক। পরমাণুবিজ্ঞানে যাঁর কাজ কিংবদন্তীতুল্য। মার্কিন এই বিজ্ঞানীকে নিয়ে একটি চলচ্চিত্র বানিয়েছেন ক্রিস্টোফার নোলান। রবার্ট ওপেনহাইমারের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন কিলিয়ান মার্ফি। ৯৬তম অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডে সেরা চলচ্চিত্র, সেরা অভিনেতা, সেরা সহ-অভিনেতাসহ বেশ কিছু ক্ষেত্রে পুরস্কার পেয়েছে চলচ্চিত্রটি।

আজ ২২ এপ্রিল ওপেনহাইমারের জন্মদিন। এই দিনে জেনে নিন সেই চলচ্চিত্রটিতে উঠে আসা আধুনিক প্রমিথিউসের কাহিনি...

রবার্ট ওপেনহাইমার। পারমাণবিক বোমার জনক। এটুকু আমরা সবাই জানি। কিন্তু কীভাবে তিনি পারমাণবিক বোমা বানানোর মতো অসাধ্য সাধন করলেন? কেমন ছিল তাঁর জীবন? ক্রিস্টোফার নোলান পরিচালিত ওপেনহাইমার চলচ্চিত্রে উঠে এসেছে ওপেনহাইমারের বর্ণাঢ্য জীবন।

চলচ্চিত্রের শুরুর দৃশ্য। ওপেনহাইমার দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর চোখেমুখে দুঃস্বপ্নের ছাপ। এই দুঃস্বপ্ন তিনি শুধু ঘুমিয়েই দেখছেন না। জেগে থেকেও তাঁর মাথায় ঘুরে ফিরে বারবার আসছে সেই দুঃস্বপ্ন। সূর্যের শক্তি মানুষের হাতে। প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঝলকে উঠছে। নাড়িয়ে দিচ্ছে সব কিছু।

বাস্তবে যদি ফিরি, তবে ফিরতে হবে সেই দিনটিতে। ১৯৪৫ সালের ১৬ জুলাই। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ মেক্সিকো অঙ্গরাজ্যের ইয়োনার্দো দেল মুয়ের্তো মরুভূমি। এখানেই বিশ্বের প্রথম পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা হবে। এ পরীক্ষার নাম দেওয়া হয়েছে ট্রিনিটি টেস্ট। এ প্রকল্পের প্রধান জুলিয়াস রবার্ট ওপেনহাইমার। এ পরীক্ষা কি সফল হবে? বিন্দু বিন্দু করে প্রয়োজনীয় ইউরেনিয়াম পরিশোধন করা হয়েছে। যোগাড়যন্ত্র করা হয়েছে। মঞ্চ প্রস্তুত! ওপেনহাইমারের মাথায় দুশ্চিন্তা। হাতে একটি কাগজ। সমীকরণ বলছে, যে বিক্রিয়া শুরু হবে, তা বায়ুমণ্ডলের সঙ্গে মিলে চলতেই থাকতে পারে আজীবন—এমন আশঙ্কা আছে। আসলেই যদি তাই হয়, তাহলে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে পৃথিবী। এই কাগজ নিয়ে ওপেনহাইমার আলবার্ট আইনস্টাইনের কাছে ছুটে গেছেন। অথচ তিনি কাগজটির দিকে তাকিয়েও দেখেননি। বলেছেন, নিজেদেরই হিসেব করে নিতে।

ওপেনহাইমার সিনেমায় আলবার্ট আইনস্টাইন ও ওপেনহাইমারের সাক্ষাৎতের একটি দৃশ্য।

অথচ আইনস্টাইন নিজেই চিঠি লিখেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানকে। বলেছিলেন, নাৎসিরা বোমা বানাচ্ছে। প্লুটোনিয়াম বোমা। যুক্তরাষ্ট্রকে তাই দ্রুত প্রস্তুতি নিতে হবে। কিন্তু সত্যি সত্যি বোমা বানিয়ে, সেটা পরীক্ষা করার পক্ষে এই বিজ্ঞানী নন। কিন্তু ওপেনহাইমার জানেন, থামা চলবে না। তিনি কি নায়ক? নাকি খলনায়ক?

প্রমিথিউসের কথা মনে আছে আপনাদের? গ্রিক পুরাণ অনুসারে, স্বর্গ থেকে আগুন চুরি করে মানুষকে এনে দিয়েছিলেন তিনি। শাস্তিস্বরূপ তাঁকে বেঁধে রাখা হয়েছিল একটি পাথরের সঙ্গে, আজীবন। প্রমিথিউসের মতোই একই পথে ছুটছেন ওপেনহাইমার। চলচ্চিত্রের গল্প এবং ট্রিনিটি টেস্টের কথা জানার আগে চলুন, তাঁর কথা জেনে নিই সংক্ষেপে।

রবার্ট ওপেনহাইমের জন্ম ও বেড়ে ওঠা যুক্তরাষ্ট্রে। পড়াশোনা প্রথমে রসায়নে, পরে পদার্থবিজ্ঞানে। অণু, পরমাণু নিয়েই তাঁর কাজ। যুক্তরাষ্ট্রে যে কয়জন হাতেগোনা বিজ্ঞানী কোয়ান্টাম ফিজিকস নিয়ে কাজ করেছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ওপেনহাইমার। উঁহু, অন্যতম বলাটা কম হয়ে যায়। যুক্তরাজ্য থেকে ধারণা নিয়ে, জার্মানির গোটিঙ্গেনে পড়াশোনা করে যুক্তরাষ্ট্রে কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞান বিষয়টা তো তিনিই নিয়ে এসেছেন!

রবার্ট ওপেনহাইমারের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন কিলিয়ান মার্ফি

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র হঠাৎ জানতে পারল, জার্মানি পারমাণবিক বোমা বানানোর তোড়জোড় করছে। বিজ্ঞানীরা বললেন, যুদ্ধে টিকে থাকতে যুক্তরাষ্ট্রকেও বানাতে হবে পারমাণবিক বোমা। কিন্তু কে করবে এই অসাধ্য সাধন? নিশ্চয়ই দেশের সেরা বিজ্ঞানীদের এগিয়ে আসতে হবে। ডাক পড়ল ওপেনহাইমারের। তাঁর তত্ত্বাবধানে শুরু হলো ম্যানহাটন প্রকল্প। লস আলামোস গড়ে তোলা হলো ওপেনহাইমারের নেতৃত্বে। এই শহরের তিনিই শেরিফ, তিনিই আইনপ্রণেতা, তিনিই সর্বেসর্বা!

দেশের এবং বিদেশের সেরা পদার্থবিদদের তিনি ভেড়ালেন এই প্রকল্পে। অটো ফ্রিশ, নীলস বোর, ফেলিক্স ব্লক, রিচার্ড ফাইনম্যান, হ্যানস বেথে, জন ভন নিউম্যান—কে নেই! ইয়োনার্দো দেল মুয়ের্তো মরুভূমিতে গড়ে তোলা হলো এক অস্থায়ী শহর। বিজ্ঞানী ও তাঁদের পরিবার সেখানেই থাকবে তিন বছর। বাইরে বের হতে পারবে না কেউ। এই প্রজেক্টের কোনো তথ্য যেন ফাঁস না হয়, সে জন্যই এত আয়োজন।

চলচ্চিত্রটি সরলরৈখিক নয়। আরও দুটো টাইমলাইন চলছে এতে একইসঙ্গে। লুইস স্ট্রস, যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান। বর্তমানে তাঁর সিনেট কনফার্মেশন হিয়ারিং বা শুনানি চলছে। এই শুনানি শেষে জানা যাবে, তিনি প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ারের (প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানের পরের প্রেসিডেন্ট) সেক্রেটারি অব কমার্স হতে পারবেন কি না। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক বোমা তৈরির পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। অথচ ভয়ংকর এক অভিযোগ তুলেছেন তিনি। বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক বোমা তৈরির পেছনের কথা, বৈজ্ঞানিক নানা বিষয় রাশিয়ার কাছে ফাঁস করে দিয়েছেন ওপেনহাইমার।

আরেকটি টাইমলাইনে দেখা যাচ্ছে, তদন্ত চলছে ওপেনহাইমারকে নিয়ে। আসলেই কি তিনি ফাঁস করে দিয়েছেন এ তথ্য রাশিয়ার কাছে? যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন তাঁর অনুমতিপত্র স্থগিত করেছে। এতদিন যাঁরা তাঁর সঙ্গে কাঁধে কাধ মিলিয়ে কাজ করেছেন, তাঁরাই তাঁর বিপক্ষে কথা বলছেন। আসলেই কি এরকম ভয়ংকর অপরাধ করেছেন তিনি? জবাব পেতে অপেক্ষা করতে হবে ৩ ঘণ্টার এ চলচ্চিত্রের শেষ পর্যন্ত। 

এই চলচ্চিত্রে ওপেনহাইমারের শিক্ষাজীবন থেকে শুরু করে প্রেম, বিয়ে, সংসার, শিক্ষকতাসহ সবগুলো দিকই উঠে এসেছে। শিক্ষক হিসেবে দারুণ জনপ্রিয় ওপেনহাইমার। কিন্তু স্বামী হিসেবে তিনি কতটা ভালো?

সিনেমায় এই তিনটি টাইমলাইন চলে একসঙ্গে। কখনো ব্যাকগ্রাউন্ড সাদা কালো, তো কখনো রঙিন। ক্রিস্টোফার নোলানকে যাঁরা চেনেন, তাঁরা নিশ্চয়ই জানেন সময়, স্মৃতি আর ব্যক্তিসত্তার অদ্ভুত সমাবেশ ঘটান তিনি নিজের ছবিতে। এটিও তার ব্যতিক্রম নয়। নোলানের অন্যতম সেরা কাজ নিঃসন্দেহে। ব্যক্তিগতভাবে এটাকে আমি সেরা প্রথম বা দ্বিতীয় ছবির তালিকায় রাখব।

ওপেনহাইমার সিনেমার পরিচালক ক্রিস্টোফার নোলান

এই সিনেমাটি যে ওপেনহাইমারের বায়োপিক বা জীবনালেখ্য, তা সম্ভবত সবাই জানেন। তবে সাধারণ বায়োপিক যেরকম হয়, এটা সে ঘরানার নয়। ছবিটি পরিচালক বানিয়েছেন ওপেনহাইমারের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। সাধারণ মানুষ যেভাবে পারমাণবিক বোমার বিষয়টি দেখেন বা হিরোশিমা, নাগাসাকির ঘটনার কথা ভাবেন, এ সিনেমা মোটেও সেরকম নয়। পারমাণবিক বোমা তৈরি, এর পেছনের রাজনীতি, বিজ্ঞানী ওপেনহাইমারের মনস্তাত্বিক টানাপোড়েন, পারিবারিক ও ব্যক্তিগত জীবনে এর প্রভাব—এসব বিষয়ে জোর দিয়েছেন পরিচালক। তবে পুরো ছবিটিকে এককথায় বায়োপিকের পাশাপাশি বলা যায় দারুণ এক থ্রিলার। চমৎকার এক পাজল। পুরো চলচ্চিত্রে এক সেকেন্ডও যদি দম ফেলেন, মিস করে যান কোনো অংশ অগুরুত্বপূর্ণ ভেবে, শেষে গিয়ে চমকে যাবেন। শেষের কয়েক মিনিটে পুরো পাজলটি এমনভাবে জোড়া লেগে বসে যাবে খাপে খাপে, হাঁ হয়ে যেতে হয় আক্ষরিক অর্থেই! 

এবার অভিনয় নিয়ে সামান্য কথা বলা যাক। ওপেনহাইমারের চরিত্রে ছিলেন কিলিয়ান মার্ফি। এর আগেও তিনি নোলানের পাঁচটি ছবিতে অভিনয় করেছেন। তবে মূখ্য ভূমিকায় এবারই প্রথম। পিকি ব্লাইন্ডার্স খ্যাত এ অভিনেতা নিজের সবটা উজাড় করে দিয়েছেন এ সিনেমায়। তাঁর মুখের অভিব্যাক্তি, শরীরী ভাষা এত নিখুঁত হয়েছে যে এটা তাঁর অন্যতম সেরা কাজ বললেও ভুল হবে না। এ ছাড়া লুইস স্ট্রসের ভূমিকায় রবার্ট ডাউনি জুনিয়রের কথা আলাদাভাবে বলতে হয়। প্রথম নেতিবাচক চরিত্রে অভিনয় করে মুগ্ধ করেছেন সবাইকে। তারকাবহুল এ ছবিতে আরও অভিনয় করেছেন এমিলি ব্লান্ট, ম্যাট ডেমন, ফোরেন্স পিউ, কেসি অ্যাফ্লেক ও রামি মালিক। সবাই সবার জায়গায় দুর্দান্ত কাজ করেছেন। পরিচালক বের করে এনেছেন প্রত্যেকের সেরাটা।

লুইস স্ট্রসের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন রবার্ট ডাউনি জুনিয়র

বিজ্ঞানমনস্ক পাঠকের জন্য এ চলচ্চিত্র অন্যরকম আনন্দের কিছু মুহূর্ত তৈরি করবে। ওপেনহাইমারের সঙ্গে নীলস বোরের প্রথম সাক্ষাৎ, ফাইনম্যানের পাশাপাশি ওপেনহাইমারকে হাঁটতে দেখা কিংবা ট্রিনিটি টেস্টের বৈজ্ঞানিক বাস্তবতা—আছে এরকম আরও অনেক কিছু। আবার যাঁরা মার্কিন ও বিশ্ব রাজনীতির কথা জানেন, কিংবা দেখেছেন এ অভিনয়শিল্পীদের অন্যান্য কাজ—তাঁদের জন্য রয়েছে ছোট ছোট উপভোগ্য দারুণ সব মুহূর্ত। অসাধারণ সিনেমাটোগ্রাফি, নন-লিনিয়ার বা অ-সরলরৈখিক চিত্রনাট্য এবং টানটান এক থ্রিলার। সব মিলে এ চলচ্চিত্র বেশ উপভোগ্য। আধুনিক প্রমিথিউস রবার্ট ওপেনহাইমারের এ জীবনালেখ্য বিজ্ঞানে আগ্রহী ও রোমাঞ্চপ্রিয় দর্শকদের নিঃসন্দেহে ভালো লাগবে।

লেখক: কাজী আকাশ, সম্পাদনা দলের সদস্য, বিজ্ঞানচিন্তা

উচ্ছ্বাস তৌসিফ, সহসম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা