বাংলাদেশে আবহাওয়ার পূর্বাভাস প্রায়ই মেলে না কেন

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

প্রচণ্ড গরম পড়ছে ঢাকাসহ সারা দেশে। আবহাওয়া বার্তায় দেখাচ্ছে বৃষ্টি হবে। অথচ হলো না। এভাবেই দিন কেটে গেল। পরদিনের আবহাওয়া বার্তায় বৃষ্টির ছিঁটেফোঁটা সম্ভাবনা নেই। অথচ বাসা থেকে বেরোতেই নেমে গেল ঝুম বৃষ্টি। যাকে বলে, ভিজে একসা। এ রকম অভিজ্ঞতা আমাদের সবারই কমবেশি হয়েছে।

যাঁরা শহরে থাকেন, তাঁদের জন্য এ রকম পরিস্থিতি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তুলনামূলক বড় কোনো সমস্যা তৈরি করে না। গ্রামগঞ্জে, বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকাগুলোতে বৃষ্টি, বন্যা বা ঘূর্ণিঝড়, অর্থাৎ বৈরী আবহাওয়া বড় ধরনের সমস্যা তৈরি করে। জনজীবনে নেমে আসে বিপর্যয়। আবহাওয়ার সঠিক পূর্বাভাস তাই বেশ গুরুত্বপূর্ণ তাঁদের জন্য। গুরুত্বপূর্ণ আরও নানা ক্ষেত্রে।

অনেকের ধারণা, আবহাওয়া বার্তায় যখন বৃষ্টি হওয়ার কথা বলা হয়, তখন হয় না। আবার যখন বলে না, তখন ঝুম বৃষ্টি নামে। আসলেই কি তা–ই? যদি তা-ই হয়ে থাকে, প্রশ্ন আসে, কেন এমন হয়?

সমুদ্র থেকে তৈরি হচ্ছে লঘুচাপ, গড়ে উঠছে মেঘ কিন্তু এদের গন্তব্য আগে থেকে নিখুঁতভাবে হিসাব করাটা বেশ কঠিন। বিশেষ করে লঘুচাপ বেশি সমস্যা করে। দীর্ঘদিন পর্যবেক্ষণ করে, অভিজ্ঞতা থেকে কিছুটা আন্দাজ করা যায় বটে কিন্তু শতভাগ নিশ্চিতভাবে এই বিষয়গুলোর পূর্বাভাস করা খুব সহজ কাজ নয়
— আবদুল মান্নান, কর্মকর্তা, বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর

আসলে পৃথিবীর সবচেয়ে অস্থিতিশীল আবহাওয়ার দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ। আশপাশের ভারত ও মিয়ানমারের কিছু অঞ্চলের জন্যও এ কথা সত্যি। একই অবস্থা দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানেরও। মানচিত্রের সঙ্গে যদি পরিচয় থাকে, তাহলে সম্ভবত বিষয়টা বুঝে ফেলেছেন। যেসব জায়গায় সমুদ্র এসে মেলে স্থলের সঙ্গে, সেখানেই তৈরি হয় এই অস্থিতিশীলতা। কেন?

প্রশ্নটির একটি চমৎকার উত্তর দেন বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের কর্মকর্তা আবদুল মান্নান। তিনি বলেন, ‘ধরুন, রাজশাহী থেকে একটি ট্রেন আসবে ঢাকায়। বড় কোনো দুর্ঘটনা না ঘটলে ট্রেনটি যে মোটামুটি ছয় ঘণ্টা পরে কমলাপুরে পৌঁছে যাবে, তা বলে দেওয়া যায়। কারণ, রেললাইন একটা নির্দিষ্ট পথ। এই পথ ধরে ট্রেনটি আসবে। কিছুক্ষণ আগে হোক বা পরে, ট্রেনটি পৌঁছাবে নির্দিষ্ট গন্তব্যেই।

কিন্তু রাজধানীর ফার্মগেটের মোড়ে দাঁড়িয়ে আপনি যদি প্রতিটি গাড়ির গন্তব্য আন্দাজ করার চেষ্টা করেন, কতক্ষণ পরে সেই গাড়িগুলো নিজ নিজ গন্তব্যে পৌঁছাবে, তা বের করতে চান, পারবেন? যেসব বাসের গন্তব্য নির্দিষ্ট, সেগুলোর বিষয়ে তা–ও খানিকটা আন্দাজ করা সম্ভব। কিন্তু এত এত ব্যক্তিগত গাড়ি, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ইত্যাদি গাড়ি? এদের গন্তব্য আন্দাজ করা প্রায় অসম্ভব।

জল-স্থলের সংযোগস্থলে ঠিক একই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। সমুদ্র থেকে তৈরি হচ্ছে লঘুচাপ, গড়ে উঠছে মেঘ কিন্তু এদের গন্তব্য আগে থেকে নিখুঁতভাবে হিসাব করাটা বেশ কঠিন। বিশেষ করে লঘুচাপ বেশি সমস্যা করে। দীর্ঘদিন পর্যবেক্ষণ করে, অভিজ্ঞতা থেকে কিছুটা আন্দাজ করা যায় বটে কিন্তু শতভাগ নিশ্চিতভাবে এই বিষয়গুলোর পূর্বাভাস করা খুব সহজ কাজ নয়।’

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর যথাসম্ভব নিখুঁতভাবেই আবহাওয়া বার্তা দিতে চেষ্টা করে
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন
পূর্বাভাসের জন্য ব্যবহার করা হয় একধরনের পরিভাষা। যেমন আবহাওয়াবার্তায় বলা হয়, খুলনার ‘কিছু জায়গায়’ ‘মাঝারি ভারী’ বৃষ্টিপাত হবে। এখানে দুটি পরিভাষার মানে বুঝতে হবে। তাহলেই বোঝা যাবে কথাটির অর্থ

আরেকটি অভিযোগ করেন অনেকে। বৃষ্টি হলে, কোথায় কতটা বৃষ্টিপাত হবে, তা নির্দিষ্ট করে বলতে পারে না আবহাওয়া অধিদপ্তর। আসলে বাংলাদেশের অস্থিতিশীল আবহাওয়া পরিস্থিতির কারণে শতভাগ নিশ্চিত করে এটা বলা যায় না যে আজ ঢাকার মিরপুরে এতটা থেকে এতটা পর্যন্ত এই পরিমাণ বৃষ্টি হবে। তবে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর পুরো ঢাকার জন্য বা এ রকম একেকটি অঞ্চলের জন্য পূর্বাভাস দিতে পারে। এই পূর্বাভাসের জন্য ব্যবহার করা হয় একধরনের পরিভাষা। যেমন আবহাওয়াবার্তায় বলা হয়, খুলনার ‘কিছু জায়গায়’ ‘মাঝারি ভারী’ বৃষ্টিপাত হবে। এখানে দুটি পরিভাষার মানে বুঝতে হবে। তাহলেই বোঝা যাবে কথাটির অর্থ। একটি হলো, ‘মাঝারি ভারী’। বৃষ্টির ধরন বা মাত্রা কেমন হবে, তা বুঝতে প্রথমে বেশ কিছু বিষয় হিসাব করতে হয়। যেমন মেঘের অবস্থান, ঘনত্ব, আর্দ্রতা, বাতাসের দিক, লঘুচাপের অবস্থা ইত্যাদি। এগুলো থেকে হিসাব করা হয় কোথাও বৃষ্টি হবে কি না, হলে কী রকম বৃষ্টি হবে। এই যে বৃষ্টির পরিমাণ—এরই হিসাব করতে ব্যবহৃত হয় হালকা বর্ষণ, মাঝারি ভারী বৃষ্টিপাত ইত্যাদি। বিষয়টা বুঝতে নিচের তালিকাটি দেখুন।

আরেকটি বিষয় হলো, ‘কিছু জায়গা’—কিছু জায়গায় বৃষ্টিপাত হবে, এর মানে কী? এখানে তো নির্দিষ্ট কোনো সংখ্যা বলা নেই। আসলে আছে। আবহাওয়াবার্তা অনুযায়ী ‘এক-দুই জায়গা’ মানে সে অঞ্চলের ২৫ শতাংশ, ‘কিছু জায়গা’ মানে ২৬-৫০ শতাংশ, ‘অনেক জায়গা’ মানে ৫১-৭৫ শতাংশ আর ‘সব জায়গা’ মানে ১০০ শতাংশ। কিন্তু খুলনার ২৬-৫০ শতাংশ এলাকার মধ্যে ঠিক কোন এলাকাগুলো পড়বে, এটা এখনো নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব হয় না।

এ নিয়ে আসলে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরই শুধু নয়, পৃথিবীর কারওই এখন পর্যন্ত আর কিছু করার নেই। দক্ষিণ কোরিয়ার মতো উন্নত প্রযুক্তির দেশেও অস্থিতিশীল আবহাওয়া পরিস্থিতির জন্য পূর্বাভাসের অবস্থা একই রকম। আসলে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর আবহাওয়া যে পরিমাণ অস্থিতিশীল এবং এই অস্থিতিশীল আবহাওয়াকে মোটামুটি নিখুঁতভাবে নির্ণয় করার জন্য একটু পরপর যে পরিমাণ যন্ত্র বসানো প্রয়োজন, তার বাজেট এই দেশগুলোর কোনোটিরই নেই। বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের জন্য এইটুকু অনিশ্চয়তা তাই আপাতত মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। তবে এটি আরও নিখুঁত করতে কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর।

সূত্র: নাসা, ডব্লিউএমও, নোয়া, বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর;

নিউমেরিক্যাল ওয়েদার প্রেডিকশন বেসিকস: মডেলস, নিউমেরিক্যাল মেথডস অ্যান্ড ডেটা অ্যাসিমিলেশন/ঝাওশাই পু এবং ইউজেনিয়া ক্যালনিই;

ওয়েদার: আ ভেরি শর্ট ইন্ট্রোডাকশন/ স্টর্ম ডানলপ